অব্যক্ত যন্ত্রণা
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
অফিস থেকে বেরিয়ে বাস থেকে নেমেই বৃষ্টির সম্মুখীন ! ছাতাটা আজ আনতে ভুলে গেছে রেখা ।গতকাল বৃষ্টিতে ভেজা ছাতাটা ব্যালকনিতে শুকাতে দিয়েছিলো আজ আর আসবার সময় ব্যাগে পুড়তে মনে নেই । এতো তাড়া থাকে অফিসে বেরোনোর সময় ! ছেলে স্কুলে বেরোবে তার খাবার ,টিফিন ,নীলয়ের টিফিন ,দুপুরের খাবার ,ওষুধ সব গুছিয়ে অচলাকে বুঝিয়ে দেওয়া । তারপর নাকে মুখে দু'টি গুঁজেই অফিস ছোটা ।
আজ প্রায় একবছর হোল নিলয়ের বাম অঙ্গটা পুরো অসার ।প্রথমে সামান্য জ্বর ,গায়ে ব্যথা । কিছুতেই জ্বর কমেনা ;আস্তে আস্তে শরীরের বাম অঙ্গে অসারতা ।আর কিছুই করার নেই ।ফিজিওথেরাপিষ্ট নিয়মিত এসে এক্সারসাইজ করিয়ে যাচেছন । কিনতু উন্নতির কিছুই দেখা যাচেছনা ।শ্বাশুড়ী মাস ছ'য়েক আগে মারা গেছেন । আর শ্বশুরমশাই তো বিয়ের আগেই চলে গেছেন । এখন বাড়িতে মানুষ বলতে সে নিজে ,পঙ্গু স্বামী ,দশ বছরের ছেলে নীলাদ্রী আর সর্বক্ষনের কাজের মেয়ে অচলা । অচলা ভীষণ ভালো মেয়ে ।রেখা যখন বাড়িতে থাকেনা তখন ছেলে স্কুল থেকে ফিরলে বড় রাস্তার মোড় থেকে তাকে বাড়িতে নিয়ে এসে যত্ন সহকারে খাওয়ানো ,তাকে দেখে রাখা ,বড়বাবুর সমস্ত দায়িত্ব পালন করা ,ঘড়ি ধরে তাকে সময়মত ওষুধ খাওয়ানো -সব সবকিছুই সে করে । রেখা বাড়িতে ফেরার সাথে সাথে তার চা ,জল খাবার এমনকি রাতের রান্না পর্যন্ত সব রেডি থাকে । শুধু সকালের দিকটাই রেখার একটু তাড়া থাকে । দুপুরের রান্নাটা সে নিজের হাতেই করে বাটিতে বাটিতে ঢেলে রেখে যায় ।
বাসটা এসে এমন জায়গায় দাঁড়ালো সামনে জল আর কাদায় পরিপূর্ণ । পড়ে যাচ্ছিলো । হঠাৎ এক ভদ্রলোক ধরে ফেলেন । মুখের দিকে না তাকিয়েই রেখা তাকে "থ্যাংক্স" বলে । বৃষ্টিটা বেশ জোরেই পড়ছে ।শেডের নীচে ছাতাবিহীন অবস্থায় যারা দাঁড়ানো তারা প্রত্যেকেই ভিজে যাচ্ছেন । আর যাদের কাছে ছাতা আছে তারা সকলেই ছাতা খুলে বৃষ্টির হাত থেকে নিজেদের পোশাক বাঁচাতে সামনের দিকে ছাতা খুলে ধরে আছেন ।রেখা আস্তে আস্তে পিছনদিকটাতে চলে যায় । অন্যমনস্ক ভাবেই চোখ পরে যে ভদ্রলোক তাকে পড়ে যাওয়ার থেকে বাঁচিয়েছিলেন তার দিকে ।
---সৌগত তুমি ?
সৌগতও এতোক্ষন পরে রেখাকে খেয়াল করে ।
----অনেকদিন পর তোমার সাথে দেখা হোল !
----বার বছর , একযুগ পর ।
----কেমন আছ ? সেই আগের মতই দেখতে আছ , কোন পরিবর্তন হয়নি । বয়স একটুও বাড়েনি ,,,,
----ওসব কথা ছাড়ো । আছি ,ভালোই আছি । তুমি কেমন আছ ? মাসিমা ,মেশোমশাই ,তোমার বৌ ,বাচ্চা আর দেবী ? দেবী কেমন আছে ? নিশ্চয় ওর বিয়ে হয়ে গেছে ? কেমন আছে ও এখন ? ওর শ্বশুরবাড়ি কোথায় ?
----আরে দাঁড়াও ,দাঁড়াও ;এতো প্রশ্নের একবারে উত্তর দেবো কি করে ? এক একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে পরের প্রশ্নটাতো ভুলে যাবো । মা ভালো আছেন ,বাবা আজ দু'বছর হোল আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ।" তারপর হাসতে হাসতে বললো ,"বিয়ে করলে তো বৌ,বাচ্চা ? বিয়ের ফুলই তো ফুটলো না । আর দেবী ?"
কথা বলতে বলতে বৃষ্টিটা কমে আসলো । এক এক করে সকলে শেডের নীচ থেকে বাস ধরার জন্য বাইরে এসে দাঁড়ালো । সৌগত রেখাকে বলে , "চল ,সামনেই একটা কফিবার আছে ,ওখানে কফি খেতে খেতে কথা হবে ।"
বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে রেখা সৌগতর মুখের দিকে তাকালো !
----সে সময় আজ আর আমার হাতে নেই ।বাড়িতে দু'টি প্রাণী হা করে ঘড়ির কাটার দিকে তাকিয়ে বসে আছে কখন আমি বাড়ি ফিরবো ।একদিন তোমাকে দেওয়ার জন্য আমার হাতে প্রচুর সময় ছিলো ।সেদিন তোমাকে কফিহাউসে আসতে বলে সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও তিনঘন্টা অপেক্ষা করেছিলাম তোমার জন্য ।আমার সাথে দেখা করবার তোমার সময় সেদিন হয়নি । ভীষণ ভেঙ্গে পড়েছিলাম । সেই সময় জীবনটাকে মূল্যহীন মনে হত ! ভেসেই যাচ্ছিলাম । বাবা ,মা জোর করে বিয়ে দিয়ে দিলেন । নিলয় জীবনে না আসলে বুঝতেই পারতামনা ভালবাসার প্রকৃত মর্ম ।কেনো ,কিসের জন্য তুমি আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছিলে জানিনা, আজ আর জানারও কোন ইচ্ছা নেই ।শুধু এটুকুই জানি নিলয় ছাড়া আর কাউকে একান্তে সময় দেওয়ার মত সময় আমার হাতে নেই । আমি আজ সুখী ,খুব সুখী । ওই যে আমার বাস এসে গেছে ।আমি আসি । ভালো থেকো তুমি ।"
রেখা দৌড়ে যেয়ে বাসে উঠলো ।সৌগত সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের মনেই বললো ,"সেদিন কেনো আসতে পারিনি তা যদি জানতে নিজেই কেঁদে আকুল হতে । তারথেকে এই ভালো হোল -আমার নামটা চিরদিনের মত তোমার মন থেকে মুছে ফেলতে পেরেছো ।আমায় ঠক ,জোচ্চর ,প্রতারক ভাবতে পেরেছো । তুমিও খুব খুব ভালো থেকো ।"
সৌগত একাই যেয়ে কফিবারে বসে কফি খেতে খেতে ফিরে যায় বার বছর আগের দিনগুলিতে --
সেদিন সৌগত কফিহাউজে যাবে বলে তৈরী হচ্ছে ;হঠাৎ লান্ডলাইনে একটা ফোনে জীবনের সব স্বপ্ন হঠাৎ আসা কালবৈশাখীর মত সবকিছু ভেঙ্গে চুরে তচনচ করে দিলো ।একমাত্র আদরের ছোট বোন দেবীকা কলেজ থেকে ফেরার পথে কিছু সমাজ বিরোধী তাকে তুলে নিয়ে যায় ।সমবয়সী অনেক বন্ধুদের সাথে সেও ফিরছিলো ।বন্ধুরা বাঁধা দিতে গেলে সমাজ বিরোধীরা ভোজালী বের করে তাদের দিকে তেড়ে আসে ।সকলেই ভয়ে জড়সড় হয়ে যায় । সমাজ বিরোধীরা দেবীকে নিয়ে চলে যাওয়ার পর ফোন করে তারা দেবীর বাড়িতে খবর দেয় ।সঙ্গে সঙ্গেই সৌগত দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় ।থানা ,পুলিশ সারারাত ছুটাছুটি দেবীর সন্ধান সেদিন আর পাওয়া যায়না ।রেখার কথা ভাববার সময় তখন সৌগতর নেই । কাক ডাকা ভোরে যখন সৌগত বাড়ির অভিমুখে রওনা দিয়েছে ঠিক তখনই পুলিশের একটা ভ্যান ঘ্যাচ করে সৌগতর সামনে এসে দাঁড়ায় ।পুলিশ অফিসার গাড়ি থেকে নেমে সৌগতকে বলেন ,"এখান থেকে কিছুটা দূরে রেললাইনের উপরে আঠার ,উনিশ বছরের একটি মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে ।মর্গে যেয়ে আপনাকে বডি শনাক্ত করতে হবে ।" সৌগত নিজের মাথাটা ধরে রাস্তাতেই বসে পড়ে হাউ ,হাউ করে কাঁদতে লাগে ।বয়স্ক এক পুলিশ অফিসার তার হাত ধরে উঠিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দেন ।
লাশ শনাক্তকরণ ,দাহ ,শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান সব মিটে যাওয়ার পর চিরশান্ত সৌগত অন্য মূর্তি ধারণ করে ।যে ভাবেই হোক বোনের প্রতি এই নারকীয় হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ নিতেই হবে ।থানা ,পুলিশের দরজায় ,দরজায় ঘুরে এক বছরের মধ্যেও কোন সুরাহা সে করতে পারেনা ।সব অপরাধী অধরাই থেকে যায় ।কিনতু এই একবছরে সে এটুকু বুঝতে পারে ধর্ষণকারী বা খুনীরা রাজনৈতিক নেতাদের আত্মীয় আবার কেউ তাদের ছত্রছায়ায় পালিত গুন্ডা । সোজা আঙ্গুলে ঘি কিছুতেই উঠবেনা । কিনতু আইনের ছাত্র সৌগত আইনের বিরুদ্ধচারণও করতে চায়না ।
সৌগতর সাথে রেখার যখন প্রেম চলছে সৌগতর তখন উকালতির ফাইনাল ইয়ার ।এই এক বছরে তার পড়াশুনার খুব ক্ষতি হয় । শুরু করে সে দিনরাত এককরে পড়াশুনা করতে । উকালতি পাশ করে সে নামজাদা উকিল অমরেশ রায় চৌধুরীর জুনিয়র হিসাবে কাজ শুরু করে । কথায় কথায় সে অমরেশবাবুকে তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য তার বোনের ধর্ষণকারী ও খুনিদের শাস্তি দেওয়ার কথা জানায় । অমরেশবাবু সৌগতকে খুব স্নেহ করতেন । তিনি তাকে কথা দেন এরজন্য সর্বরকম সাহায্য করতে তিনি প্রস্তুত ।
নূতন করে আবার কেস ফাইল করা হয় । ফোনে হুমকি দেওয়া ,ভয় দেখানো -অমরেশবাবু ও সৌগতর উপর চলতে থাকে ।কিনতু জাদরেল উকিল অমরেশবাবু কিছুতেই দমে যাওয়ার পাত্র নন ।তার সাথও প্রশাসনিক উপর মহলের উঠাবসা ।স্বাক্ষ্য,সাবুদ প্রমাণসহ তিনজন ধরা পরে । বাকী একজন ওই ঘটনার দু'বছরের মাথায় মদ্যপ অবস্থায় বাইক এ্যাকসিডেন্টে মারা যায় । এই তিনজনের যাব্বজীবন কারাদণ্ড হয় ।
সৌগত তার বোনের মৃত্যুর দশ বছরের মাথায় যেয়ে সুবিচার পায় ।এরমধ্যে তার যে রেখার কথা মনে পড়েনি তা নয় । কিনতু ইচ্ছা করেই কোন যোগাযোগ রাখেনি । প্রাণপ্রিয় ছোট্ট বোনটির মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়াটাই তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় ।তাই নিজের হাতেই সে তার ভালবাসাকে গলাটিপে হত্যা করে ।কারণ ভালবাসায় আবদ্ধ হতে গেলে পিছুটান থাকবে আর এই পিছুটানই তাকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করবে ।
এতগুলো বারবছর ধরে সে রেখার কোন খোঁজ করেনি । কারণ সে বুঝতে পেরেছিল বছর একটি মেয়ের পক্ষে কারও অপেক্ষায় বসে থাকা কিছুতেই সম্ভব নয় ।রেখা যে তাকে ভুল বুঝেছে এবং তাকে যে কোনদিন ক্ষমা করতে পারবেনা এই ব্যপারেও সে নিশ্চিত ছিলো ।
আজ যখন তার রেখার সাথে দেখা হোল ,সৌগত ভেবেছিলো সব শোনার পর রেখা তার অসহায়তা বুঝতে পারবে -পারবে তাকে ক্ষমা করে দিতে । কিনতু রেখা তো তাকে কোন সুযোগই দিলোনা !
@নন্দা 22-7-17