Wednesday, April 5, 2017

                           বন্ধুত্বের বন্ধন        
   নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী                    
    অভিন্ন হৃদয় দুই বন্ধু । আনন্দ ও জসীম । সাতচলিশ সালের দেশভাগের পর আনন্দ চলে আসে তার পরিবারের সাথে ভারতবর্ষে আর জসীম পূর্বপাকিস্তানেই থেকে যায় । ছেলেবেলার থেকে দুই বন্ধুরই স্বপ্ন ছিলো দেশের হয়ে কাজ করার জন্য সেনাবাহিনীতে তারা যোগদান করবে ।    .                  চৌদ্দ ,পনের বছরের দুই কিশোর যারা গঠনগতভাবে আলাদা হলেও মননে ছিলো এক ও অভিন্ন । সময় এগিয়ে চলেছে তার নিয়ম মেনেই ; কিন্তু তাদের হৃদয়ে জমে থাকা ভালোবাসা ,দুস্টুমির স্মৃতিগুলি বিন্দুমাত্র মলিনতার ছাপ ফেলতে পারেনি । ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয় জসীম তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশের মুক্তি আন্দোলনের জন্য জীবন পণ করে ঝাঁপিয়ে পরে । দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সে প্রতিরক্ষা বাহিনীর উচ্চপদে কর্মরত হয় ।                                                          এদিকে রতন তার বাবা, মায়ের সাথে পশ্চিমবঙ্গে এসে অজানা ,অচেনা দেশে চরম দুর্বিসহ জীবন-যাপন শুরু করে । মাথার উপর ছাদ নেই ,দু'বেলা দু'মুঠো খাবার কোনো সংস্থান নেই ! কখনো রেলষ্টেশনে কখনোবা খোলা আকাশের নীচে মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমানো । বাবার কাজে সহায়তা করার জন্য ষ্টেশনের ছোটছোট চায়ের দোকানে বাবার সাথে কাপ ,প্লেট ,কেটলি ধোয়ার কাজ করা ।    .                     সময়ের সাথে সাথে জীবনেরও কিছু পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী । রতনের বাবা ফ্যান কোম্পানীতে সামান্য মজুরীর বিনিময়ে একটি কাজ পান । রতনেরও পড়াশুনা তখন আবার শুরু হয় । অতি দারিদ্রের মধ্য দিয়ে হলেও শিক্ষিত বাবার সহায়তায় প্রাইভেট শিক্ষক ছাড়াই রতন বেশ ভালোভাবেই বি.এ . পাশ করে । শুরু হয় তার জীবনের স্বপ্ন পূরণের জন্য দেশের হয়ে কাজ করার জন্য লড়াই । নানান জায়গায় সেনাবাহিনীর চাকরীর জন্য ইন্টারভিউ দিতে আরম্ভ করে । ঈশ্বরের অপার কৃপায় তার স্বপ্ন পূরণও হয় । সে সেনাবাহিনীতে চাকরী পেয়ে যায় ।  ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলে গরু পাচারকে কেন্দ্র করে দুই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ চরম আকার নেয় । আটচলিশ ঘন্টা ধরে দুই পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হতে থাকে । পরিস্থিতি সামাল দিতে উচ্চপদস্থ দুইপক্ষের সেনাবাহিনীর অফিসারেরা দফায় দফায় মিটিং করতে থাকেন । শেষ পর্যন্ত ঠিক হয় দুই দেশের অফিসারেরা মুখোমুখি একবার মিটিং এ বসবেন ।   .                       রাত তিনটে । মিটিং শেষ হয় । তারা এবারের পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার একটা সিদ্ধান্তে আসেন । মিটিং কক্ষ থেকে যখন যে যার মত বেড়িয়ে যাচ্ছেন ,হঠাৎ ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক অফিসার বাংলাদেশের এক সেনা অফিসারকে বলেন ," মিস্টার জসীম উদ্দিন ,যদি কিছু মনে না করেন আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতাম ।" অফিসার দাঁড়িয়ে যান । ভারতীয় সেনা অফিসার জানতে চান ." আপনার ভ্রূতে যে কাটা দাগটা আছে ,ওটা কি পেয়ারা গাছ থেকে পড়ে যেয়ে হয়েছিল ? "  অফিসের হক্চকিয়ে যান ! তিনি একদৃষ্টে ভারতীয় সেনাঅফিসারের মুখের দিকে তাঁকিয়ে বলেন ,"আপনি কি করে জানলেন ?"  ভারতীয় অফিসার তখন মুচকি ,মুচকি হাসছেন ।  " পিঠের তিনটি সেলাইয়ের দাগ নিশ্চয় এখনো আছে ?"  "কে আপনি ?"  "একটু চিন্তা করে দেখুন তো কারপক্ষে এগুলি জানা সম্ভব ?"          

জসীম সাহেবের হঠাৎ মনে পড়লো মিটিং শুরু হওয়ার আগে যখন পরিচয় পর্ব চলছিল তখন এই সেনাঅফিসারের নাম শুনেছিলেন - রতন মজুমদার । হো ,হো করে জসীমসাহেব হেসে উঠে দু'হাত বাড়িয়ে ছেলেবেলার বন্ধু রতনকে জড়িয়ে ধরলেন ।   "কি অদ্ভুত দেখ ,কোনোদিনও স্বপ্নেও ভাবিনি তোর সাথে আমার আবার দেখা হবে ।"  জসীম কথাগুলি যখন বলছেন তখন তার চোখের কোলদু'টি জলে ভিজে গেছে ।

                 পনের থেকে কুড়ি মিনিটের মত দুই বন্ধু একসাথে ছিলেন । কিন্তু এই সামান্য সময়ের মধ্যেই উভয়েই তিনযুগ আগের দিনগুলি ওলোটপালট করে গল্পে মেতে ছিলেন । সময় ,দেশভাগ ,দীর্ঘদিন দেখা না হওয়া ,সীমান্তরক্ষার সামান্য খুঁটিনাটি ব্যাপারে গোলাগুলি - কোনো কিছুই দুই বন্ধুর বন্ধুত্বকে চিড় ধরাতে পারেনি ।

                  বৈশাখ ,জৈষ্ঠ্য মাসে দুপুরের ঝড়ে সেই আম কুড়ানো, ঈদ , দূর্গাপূজাতে দুজনের ঘুরে বেড়ানো ,  সরস্বতী পূজাতে দু'জনে একসাথে অঞ্জলি দেওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু ওই সামান্য সময়ে দুই বন্ধুর চোখের সামনে ভেসে ওঠে । সময় বড় অল্প ,কর্তব্যের নাগপাশে দুজনেই বাঁধা । তাই মুহূর্তেই দুজনেই সজাগ হয়ে ওঠে । পুনরায় দু'জন দুজনকে জড়িয়ে ধরেন । দু'জনেরই চোখ জলে ভিজে যায় । ফোন নম্বর ও বাড়ির ঠিকানা আদানপ্রদান করতে কেউই ভোলেননা । বিদায়কালে তারা দু'জনেই হয়তো ভাবছিলেন, সেই ঈশ্বর বা আল্লা যেই হোননা কেন তাদের বন্ধুত্বটাকে নিয়ে তিনি ছিনিমিনি খেলেছেন । তার যদি এটাই মনের ইচ্ছা ছিল তাহলে তাদের বন্ধুত্বটাকে হরিহর আত্মা তৈরী করেছিলেন কেন ? অপরাধ তো তাদের কিছু ছিলোনা !


                         একজনের গমন পথের দিকে আর একজন অপলক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে থাকেন । দেশের কর্তব্যের কাছে বন্ধুত্বের ভালোবাসার পরাজয় হয় । সেই ভালোবাসার স্থান হয় - কাঁটাতারের বেড়ার দু'পারের দু'দেশে বসবাসকারী দুই বন্ধুর অভিন্ন হৃদয়ে ।

নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

No comments:

Post a Comment