ভবিতব্য
নন্দা মুখার্জী রায়চৌধুরী
সাগর কিছুতেই বুঝতে পারছে না ; বাবা কোনো মেজকাকুকে দিয়ে তাকে ফোন করলেন বাড়ি যাওয়ার জন্য । এইতো মাত্র কদিন আগেই বাড়ি থেকে সে আসলো । তবে কি বাবার শরীর খারাপ করেছে ?তাই বা কেন হবে ? বাবার শরীর খারাপ করলে তো নিশ্চয় মেজকাকু তাকে বলতেন । সেদিন আসবার সময় বাবা বলেও দিলেন ," ছুটি হলেই বাড়ি চলে এসোনা ,তাতে পড়াশুনার ক্ষতি হয় । তুমি আমার একমাত্র সন্তান । তোমার মায়ের মৃত্যুর সময় তিনি আমাকে বারবার করে শুধু একটি কথায় বলেছিলেন ; যে ভাবেই হোক আমি যেন তোমায় ডাক্তারী পড়াই । এখানে মিত্র প্রায়ই আসে ,তোমার কাকু, কাকিমাও রয়েছেন ; তারাই আমার দেখাশুনা করবেন । তুমি আমায় নিয়ে কখনো চিন্তা করোনা । মনদিয়ে শুধু পড়াশুনাটা কোরো । মিত্রা হলো সাগরদের পাশের গাঁয়ের মেয়ে । সাগরের বাবার ছাত্রী । সাগরের বাবা একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন ।মিত্ৰা ছিল মেধাবী ছাত্রী । তাই স্বভাবতই সাগরের বাবা অনাদী মুখার্জী তাকে খুব স্নেহ করতেন । যদিও অনাদিবাবু এখন চাকরী থেকে অবসর নিয়েছেন মিত্রারও পড়াশুনা শেষ হয়েছে ; তবুও এখনো প্রায় রোজই মিত্ৰা একবার আসবেই তার মাস্টার মহাশয়ের কাছে । মাঝে মাঝে নিজে রান্না করে বা মায়ের হাতের রান্নাও সে তার শিক্ষাগুরুর জন্য নিয়ে আসে । খুব সুন্দরী মেয়ে মিত্ৰা । স্বভাবতই তার আরও সুন্দর । একই গ্রামে থাকার সুবাদে সাগর ও মিত্রা পরস্পরের পরিচিত এবং উভয়ের মধ্যে মামুলি কথাবার্তাও হয় ।
সাগরের মা অনুভাদেবী সাগর যে বছর মাধ্যমিক দেয় ; সে বছরই মারা যান । ছেলের পরীক্ষার ফলটাও জেনে যেতে পারেন না । সুস্থ্য স্বাভাবিক মানুষ । হঠাৎ করেই প্রচন্ড ঠান্ডা লেগে বুকে কফ বসে যায় । গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বেশ কিছুদিন ভর্তিও ছিলেন । কিন্তু বাড়ি আর ফিরতে পারেননি । স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি থাকার সময়ই একদিন তিনি তার স্বামীর হাত দু'টি ধরে তাদের একমার ছেলেকে ডাক্তারী পড়ানোর কথা বলেন । শুধু বলেন ই না ,একপ্রকার কথা আদায় করেই নেন । মায়ের মৃত্যুর সময় সাগর মায়ের কাছেই ছিলো । যেন কথা বলতে বলতেই তিনি পরপাড়ের উর্দ্যেশ্যে যাত্রা করেন । তখন সাগরের মাত্র ষোলো বৎসর বয়স । মায়ের মৃত্যুর পর সাগর খুবই ভেঙ্গে পড়েছিলো । কিন্তু তার বাবা ,দুই কাকু ,কাকিমাদের সহায়তায় বেশ তাড়াতাড়িই সামলে উঠেছিলো মায়ের মৃত্যুশোক । প্রায় দিন পনের বাদে সাগরের পরীক্ষার ফল বেড়োয় । নব্বই শতাংশ নম্বর পেয়ে সাগর গ্রামের সোনার ছেলে হয়ে ওঠে । উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলও তার গর্ব করার মত । অনাদিবাবু ছেলেকে জয়েন্টে বসান । ডাক্তারীতে সাগরের রাঙ্ক একশত দশ । চলে আসে সাগর কলকাতায় । সরকারিভাবে ডাক্তারীতে সুযোগ পাওয়ায় অনাদিবাবুরও আর্থিক দিক থেকে অনেক সুবিধা হয় । প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করে অবসর গ্রহণ করার পর কটা টাকায় বা তিনি হাতে পেয়েছেন ? তবুও ছেলের যাতে ডাক্তারী পড়তে কোনো অসুবিধা না হয় সে চেষ্টা তিনি সর্বদা করে যাচ্ছেন । সাগর মেজকাকুকে পুনরায় ফোন করে । কাকু তাকে জানান, "যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গ্রামে চলে আয় । সব কথা বাড়িতে আসার পর হবে ।" বলেই তিনি ফোনটা কেটে দেন । অগত্যা সেদিনই সাগর রাতের শেষ ট্রেন ধরে গ্রামের উর্দ্যেশ্যে রওনা দেয় । ভোর চারটের সময় স্টেশনে নেমে গ্রামের মেঠো পথ ধরে হাঁটতে শুরু করে । কাকডাকা ভোরে এসে সে বাড়ির উঠানের সামনে দাঁড়ায় । সে দেখে - ওই ভোরেই বাবা উঠানে পায়চারী করছেন । সাগরকে দেখে তিনি বলে ওঠেন ," তুই এসেছিস বাবা ! আমায় বাঁচালি !" "তুমি ভালো আছো তো বাবা ?" "ওরে হ্যাঁ ,আমি ভালো আছি ।" "তবে আমায় আসতে বললে কেন ?" " বলবো বাবা ,সবই বলবো । তুই ভিতরে যা ,ফ্রেস হয়ে নে - তারপর সব বলছি ।"
বাবার কথাগুলি সাগরের কাছে হেঁয়ালি বলে মনে হয় । কিন্তু চিরবাধ্য সাগর বাবাকে আর কোনো প্রশ্ন করেনা । ঘরে ঢুকে হাত ,পা ধুঁয়ে খাঁটের উপর বসতে যাবে ঠিক তখনই মেজকাকিমা চা ,বিস্কুট নিয়ে ঘরে ঢোকেন । সাগর তার মেজমার মুখের কাছে মুখটি নিয়ে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করে ," কি হয়েছে গো মেজমা ?" তার মেজমা তারই মত আস্তে আস্তে উত্তর দেন ,"সব কথা দাদাই তোকে বলবেন ।" সাগর বুঝতে পারে তার বাবার দেওয়া কঠিন নির্দেশের ফলেই তার অতি কাছের মেজমার কাছ থেকেও কিছুই জানতে পারলোনা । কাকিমা চলে গেলেন অন্য ঘরে । বার দুই সাগর লক্ষ্য করলো তার ছোট ভাইবোনেরা দরজার ফাকঁ দিয়ে তাকে দেখছে । ইশারায় তাদের কাছে ডাকলো । কিন্তু দুস্টুগুলি একটাও কাছে এলোনা । চা খাওয়া শেষ করে সাগর বাড়ির ভিতরে ঢুকবে বলে উঠে দাঁড়াতেই দেখে ,বাবা এসে বৈঠকখানাতে ঢুকলেন । সাগরের দিকে তাঁকিয়ে বললেন ," এবার তোমার সব প্রশ্নের উত্তর আমি দেবো । কিন্তু তার আগে একটা কথা আমায় বলতো বাবা ! আজ পর্যন্ত আমি কোনো অন্যায় করেছি কি ?" সাগর হতভম্বের মত বাবার মুখের দিকে তাঁকিয়ে অতন্ত্য নীচু গলায় বললো ,"একথা কেন বলছো ? আমায় সব খুলে বলো । এভাবে বললে তো আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা ।" "না - তুমি আমাকে শুধু বলো কখনো দেখেছো কি আমি কোনো অন্যায় করেছি ? আমার সম্মান ক্ষুন্ন হয় ,আমি কাউকে কথা দিয়ে কথা না রাখতে পারি ,এমনটাতো তুমি নিশ্চয়ই চাও না ।" " না - কিন্তু বাবা কি হয়েছে আমায় পরিষ্কার করে বোলো । কি কথা কাকে দিয়েছো ? কেন কথা রাখতে পারছো না ? সবকিছু আমাকে খুলে বলো ।" " বলছি ,সব বলছি তোমায় । বলবো বলেই তো তোমায় ডেকে এনেছি । তুমিই একমাত্র পারো আমার সম্মান রাখতে । বলো বাবা ,রাখবে তো ?" "হ্যাঁ নিশ্চয় রাখবো । তোমার সম্মান ক্ষুন্ন হয় এমন কোনো কাজ যেমন আগেও করিনি ; এখনো করবোনা । আমাকে কি করতে হবে বলো ।" "কিন্তু বাবা ,এই মুহূর্তে কাজটা একটু কঠিন তোমার পক্ষে ।" " সে হোক তুমি আমায় বলো কি করতে হবে ।যত কঠিনই হোক আমি কথা দিচ্ছি তোমায় ,আমি তা পারবো ।" কিন্তু সাগর স্বপ্নেও ভাবেনি বাবা তাকে এই ধরণের কথা বলতে পারেন । বাবার কথা শুনে সাগরের মাথায় যেন বাজ ভেঙ্গে পড়লো । পায়ের নীচু থেকে মনে হচ্ছে মাটি সরে যাচ্ছে । বাবা কি করে এ রকম কথা দিয়ে ফেললেন ? এই তো মাত্র কদিন আগেই সে স্বরুপাকে তার ভালোলাগার কথাটা জানিয়েছে । যদিও সে মুখে কিছুই বলেনি ; তবুও তার মুখের দিকে তাকিয়ে সাগর বুঝতে পেরেছে - স্বরূপারও তাকে ভালো লাগে । দুজনেরই এবার ফাইনাল ইয়ার । দেখা ,সাক্ষাৎ তাদের প্রায়ই হয় ,কিন্তু কথা হয় খুবই কম । কারণ দুজনেই পড়াশুনার ফাঁকি দেওয়ার পক্ষপাতি নয় । সুতরাং পড়াশুনা নিয়েই তাদের মধ্যে কথা হত বেশি । দিন পনের আগে একদিন সুযোগ পেয়ে সাগর স্বরুপাকে বলে ," তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে ।" স্বরূপা কোনো উত্তর দেয়না । শুধু সাগরের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে দেয় । স্বরূপারও যে এতে সায় আছে ; ওই লজ্জা মিশ্রিত মুচকি হাসিতেই সাগর তা বুঝতে পারে । তার ঠিক দুদিন পরেই বাড়ি থেকে ফোন । অনাদিবাবু সাগরকে বলেন ," মিত্রার বাবা মৃত্যুশয্যায় আমার হাতদুটি ধরে বলে গেছেন ,যাতে তার মেয়ের সর্বরকম দাযিত্ব আমি নিই । তার মায়ের শরীরও খুব একটা ভালোনা । একজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ হাত ধরে এমন ভাবে বললেন যে আমি না বলতে পারলামনা । মিত্রা খুব ভালো মেয়ে । তুই ওকে বিয়ে কর বাবা ; তোরা সুখী হবি ।" সাগর বাবার এ কথার উত্তরে খুব শান্তভাবে বলে ,"কিন্তু বাবা ,আমার এখনো পড়াশুনা শেষ হয়নি । আমি এখন কি করে বিয়ে কোরবো ? তুমি বরং একটা ভালো ছেলে দেখে ওর বিয়ের ব্যবস্থা করো ।" "কিন্তু আমি যে মিত্রার বাবাকে কথা দিয়েছি আমি ওকে আমার ঘরের বৌ করে অন্য । কোনোদিন কথা দিয়ে আমি কথার খেলাপ করিনি । আজ যদি তোমার জন্য আমার কথার খেলাপ হয় সেটা আমার কাছে মৃত্যুর সামিল হবে ।"
সাগরের অনেক কিছু বলার ইচ্ছা থাকলেও সে বাবার এই কথার পরে আর কিছুই বলতে পারেনা । চুপ করে বসে থাকে । আর ভাবতে লাগে - বাবা তার কথার খেলাপ করবেননা ; কিন্তু তার যে সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুড়মার হয়ে যাচ্ছে । নিজেকে খুব অসহায় মনে হতে লাগলো ।কি কোরবে এখন সে ?নিজের জীবনের স্বপ্ন নাকি বাবার দেওয়া কথা ?কোনটা সে রক্ষা কোরবে ? বাবার মুখের উপর না বলা মানে বাবাকে অসম্মান করা ; যা সে কোনোদিনও করেনি । অনাদিবাবু আবারও বলতে শুরু করেন ," তোমাকে এই মুহূর্তে মিত্রাকে সাথে করে নিয়ে যেতে হবেনা ,আর সেটা সম্ভবও নয় ।ও আমার কাছেই থাকবে । তুমি যতদিন না তোমার পড়াশুনা শেষ করছো ,যতদিন না তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছ - ততদিন পর্যন্ত ওকে নিয়ে তোমার বিন্দুমাত্র ভাবতে হবে না । তুমি শুধু রেজিস্ট্রিটা করে সিঁদুর পড়িয়ে দাও । গ্রামের মানুষজন তো আর সব ভালো নয় । ও আমার কাছেই থাকবে । বরং আমারও সময় ভালো কেটে যাবে , আমিও কথা বলার একজন সাথী পাবো । সত্যিই যদি তুমি আমায় সম্মান করো ,ভালোবাসো - তাহলে তুমি আমার কথাটা শুনবে বলে আমার বিশ্বাস ।
সাগর মিত্রাকে বিয়ে করতে বাধ্য হোল। বাবার আবেগকে মেনে নিয়ে,নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে,প্রথম ভালোবাসাকে গলা টিপে মেরে সে মিত্রাকে জীবনসঙ্গী করে নিলো।অনাড়ম্বর পরিবেশ,মুষ্ঠিমেয় কিছু আত্মীয়স্বজন, আশেপাশের কয়েকজন পাড়া প্রতিবেশীর সামনে সে মিত্রাকে রেজিষ্ট্রির পরে সিঁধুর পড়িয়ে দিলো।বৌভাতও হোল জ্ঞাতি বন্ধুদের উপস্থিতিতে।ফুলশয্যার রাতে সাগর মিত্রাকে জানালো যতদিন না সে নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে ততদিন স্বামীস্ত্রীর সম্পর্ক বলতে যা বোঝায় তা তাদের মধ্যে গড়ে উঠবেনা।মাঝে মাঝে সে যেমন গ্রামে আসে ঠিক সেইরূপই আসবে।তবে মিত্রার যদি ইচ্ছা করে সে চাকরীর চেষ্টা করতে পারে।গ্রামের দিকে না হোক কলকাতার দিকে হলেও কোন অসুবিধা হবেনা।লেখাপড়া শিখে শুধু হাতাখুন্তি নাড়ানোর মানসিকতা নিয়ে বসে থাকলে জীবনে অনেককিছুই থেকে বঞ্ছিত হতে হবে।ভালো ছাত্রী ছিলে, তোমার প্রতিটা নম্বরও উচ্চমানের।আমার মনেহয় তুমি একটু চেষ্টা করলেই কিছু একটা চাকরী পেয়ে যাবে।মিত্রা হা করে সাগরের কথাগুলি শোনে।ঠিকই তো বলছে সে।তবে মনেমনে এটাও ঠিক করে নেয় -তার শ্বশুরমশাই যতদিন জীবিত আছেন ততদিন সে তার কাছেই থাকবে।তার ইচ্ছা কলকাতায় নয় গ্রামের কোন স্কুলেই সে শিক্ষকতার চেষ্টা সে করে যাবে।
পরদিন সাগর কলকাতায় ফিরে যায়। মিত্রার সাথে আলাদা করে কোন কথা আর হয়না।যাবার সময় অনাদিবাবু ছেলেকে একা পেয়ে বলেন,"আমি জানি বাবা আমার কথা রাখতে তুমি ঐ বিয়ে করতে রাজি হয়েছো তুমি ভেবোনা,ও এখন থেকে আমার কাছেই থাকবে। আগে তোমার পড়াশুনা শেষ হোক ;নিজে প্রতিষ্ঠা লাভ করো, তখন না হয় মিত্রাকে তুমি তোমার কাছে নিয়ে যাবে। ও খুব ভালো মেয়ে বাবা! আমি ওকে ওর ছেলেবেলা থেকেই চিনি ।তুমি দেখো তোমরা খুব সুখি হবে।" সাগর কোন কথার উত্তর দেয়না।নীচু হয়ে ভক্তিভরে বাবাকে প্রনাম করে 'আসি' বলে বেরিয়ে যায়। মিত্রা ছাদের উপর দাঁড়িয়ে দেখে যতক্ষন সাগরকে দেখা যায়।মনে একটা কষ্ট সে ভীষনভাবে উপলব্দি করে যে সাগর বাধ্য হয়ে বাবার কথা রাখতে তাকে মেনে নিয়েছে।হয়তো মন থেকে কোনদিনও তাকে মেনে নিতে পারবেনা।কিন্তু ঈশ্বর যদি তাকে কোনদিনও একটু সুযোগ দেন তাহলে ভালোবাসা দিয়ে,যত্ন দিয়ে সাগরের জীবনের সমস্ত কষ্ট সে ভুলিয়ে দেবে এমন একটি প্রতিজ্ঞা সে মনেমনে করে।তবে এখন থেকে চাকরীর একটা চেষ্টা তাকে করে যেতেই হবে কারন ভাগ্যে কি লেখা আছে তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। নিজের পায়ে যেভাবেই হোক তাকে দাঁড়াতে হবে।
এদিকে সাগর কলকাতায় ফিরে আসার পর সম্পূর্ণ যেন অন্যমানুষ। সেই উচ্ছলতা,হাসি, গল্প কোনটাই তার সহপাঠীরা তার ভিতর খুঁজে পায়না।সকলে জানতে চায় -শরীর খারাপ নাকি?বাড়ির সকলে ভালো তো?হ্যাঁরে-তুই কি প্রেমে পড়েছিস?কুশল জিঙ্গাসা করলে ঘাড় নারে বাকি সব এড়িয়েই যায়।স্বরূপার সাথেও দেখা হচ্ছে , পড়াশুনা নিয়ে কথাও হচ্ছে।কিন্তু আলাদাভাবে কোন কথা বলার সুযোগ স্বরূপা পাচ্ছেনা।
কয়েকদিন এভাবে কাটার পর স্বরূপা সুযোগ পেয়ে সাগরের কাছে জানতে চায় তার কি হয়েছে? সাগর তাকে জানায় অনেক কিছু তার বলার আছে সে যেন ছুটির পর আজ চলে না যায়।স্বরূপা শুধু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়।
কলেজ ছুটির পর দুজনে যেয়ে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে বসে। সাগরকে চুপ করে থাকতে দেখে স্বরূপা বলে,"তুমি কি বলবে বলছিলে?"সাগর মুখ নীচু করেই সমস্ত ঘটনা তাকে জানায়।কিন্তু একবারও মুখ তুলে সে স্বরূপার দিকে তাকায়না।যদি সে স্বরূপার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখতো তাহলে সে দেখতে পেতো স্বরূপা তার চোখের জল বারবার তার ওড়না দিয়ে মুছছে।সাগর কথা বলতেই থাকে।কোন রকমে স্বরূপা নিজেকে একটু সামলে নিয়ে সাগরের কথার মাঝখানেই হেসে পড়ে বলে,"বিয়ে করেছো তা এত অপরাধ বোধে ভুগছো কেন?"
সাগর অবাক হয়ে এবার স্বরূপার মুখের দিকে তাকায়। স্বরূপার মুখে হাসি।কিন্তু সাগর তো আর তার অন্তর দহনটা দেখতে পাচ্ছেনা!"মেশোমশাইয়ের কথা রেখে তুমি ঠিক কাজই করেছ।তানাহলে তিনি খুব কষ্ট পেতেন।ভেবে দেখো তো তার অবর্তমানে তুমি যখন তার কথা ভাবতে তখন তুমি নিজে কতটা কষ্ট পেতে।ভাবতে তোমার জন্যই তিনি হয়তো তাড়াতাড়ি চলে গেলেন।পারতে কোনদিন নিজেকে ক্ষমা করতে?পারতেনা, কিছুতেই পারতে না!সুতরাং তুমি যা করেছ তোমার জায়গায় আমি থাকলেও তাই করতাম।আমরা যেমন বন্ধু ছিলাম ঠিক তেমনই থাকবো।একটা বছর পর কে কোথায় চলে যাবো আর হয়তো জীবনে দেখাও হবেনা।তোমার নেওয়া সিদ্ধান্তে কোথাও কোন ভুল নেই।কিন্তু তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ তুমি আর মুখ গোমড়া করে থেকোনা।তোমার বৌ কলকাতায় আসলে আমায় জানিও আমি নিজে গিয়ে তার সাথে দেখা করে আসবো।তবে তাকে কিন্তু কখনোই ভালোবাসায় ফাঁকি দিওনা।তার কিন্তু কোন অপরাধ নেই।তুমি আমায় ভালোবেসেছিলে আমিও তাই।হয়তো আমাদের ভালোবাসাটা চরম পুর্নতা পায়নি বা বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়নি;তাইবলে ভালোবাসাটা কিন্তু মরে যায়নি।তোমার বা আমার জীবনে যেই আসুক না কেন আমরা কিন্তু তাকে ঠকাতে পারিনা।তুমি কখনোই মিত্রাকে অবহেলা করবেনা।আমায় কথা দাও। "সাগর স্তব্ধ স্বরূপার মুখে কথাগুলি শুনে।সে স্বরূপার দিকে তাকিয়ে বলে, "তুমি আমায় ক্ষমা করে দিও"।"কি অন্যায় তুমি করেছ যে তোমায় ক্ষমা চাইতে হচ্ছে?আচ্ছা সাগর কি ভাবো তোমরা মেয়েদের ? আমরা মেয়েরা সব সময় পরিস্থিতির সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে জানি।ভগবান আমাদের এইভাবেই তৈরি করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে স্বরূপা চুপ করে যায়।সাগরও চুপ করেই থাকে।তারপর একসময় স্বরূপাই বলে,"চলো,সন্ধ্যা হতে আসলো।"সাগর কোন কথা না বলেই যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায়।
স্বরূপা সেদিন আর বাসের জন্য অপেক্ষা না করে একটা ট্যাক্সি ধরেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। চোখের জল যেন কিছুতেই বাঁধ মানছে না।নিজেকে যে কিভাবে সাগরের সামনে সামলে রেখেছিল তা সে নিজেই এখন বুঝতে পারছেনা;কোথা থেকে তার এত শক্তি ও সাহস এসে হাজির হয়েছিল ভাবলে সে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে।
পরদিন থেকে স্বরূপা কলেজে ঠিক সেই আগের মতই স্বাভাবিক।ঠিক যেমন পড়াশুনা নিয়ে আগে সাগরের সাথে কথা হত এখনো তেমনই হয়।কিন্তু সাগর কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছেনা। প্রতিটা মুহূর্তেই সে নিজেকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রেখেছে।পারতপক্ষে সে স্বরূপাকে এড়িয়েই চলে।
সময়ের সাথে সাথে সবকিছুই বদলে যেতে থাকে।সাগরও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে।আর স্বরূপা ?কলেজে সে উচ্ছল , প্রানবন্ত আর বাড়িতে সে চুপচাপ।বাবা -মা বারবার জানতে চান তার কি হয়েছে?তার একটাই উত্তর , "কিছুনা।ফাইনাল পরীক্ষা সামনে তাই একটু টেনশানে আছি।"
কালের নিয়মে সময় তার গতিপথ বদল না করেই এগিয়ে যেতে থাকে।কেটে যায় তিনমাস।এরই মাঝে সাগরের বাবা তাকে ফোন করে জানান মিত্রার মা মারা গেছেন।কিন্তু যেহেতু তার ফাইনাল পরীক্ষা সামনে তাই এই মুহূর্তে সাগরকে বাড়িতে আসতে হবেনা;তিনি নিজেই মিত্রাকে সামলে নেবেন।
তিন বছর পরের ঘটনা :-
সাগরের বাবা মারা যাওয়ার পর সাগর যখন শেষবারের মত গ্রামের বাড়িতে যায়;তখন সে মিত্রাকে সঙ্গে করেই কলকাতায় ফেরে।বিয়ের পর যতবারই সে গ্রামে গেছে ততবারই সে মিত্রাকে চাকরীর চেষ্টা করতে বলেছে।তারা দুজনেই সকলের সামনে অতি সাধারন আচরন করে, এমন কি অতি কাছের মেঝমাও বুঝতে পারেননি যে তাদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর কোনই সম্পর্ক নেই।
এরই মাঝে সাগরের বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়।সাগর জানতে পেরেই বাড়িতে চলে আসে।কিন্তু সে আসার আগেই সব শেষ হয়ে যায়।তখনই সে ঠিক করে মিত্রাকে নিয়েই সে কলকাতা ফিরবে।শ্রাদ্ধ,নিয়মভঙ্গ সবকিছু মিটে যাওয়ার পর সেদিন রাতেই সাগর মীত্রাকে বলে,"কাল খুব ভোরে বেরবো,জিনিসপত্র সব গুছিয়ে রেখো।তোমার যেগুলি না নিলেই নয় শুধুমাএ সেগুলিই নেবে।প্রথম প্রথম তোমার ওখানে একটু কষ্ট হবে;তারপর আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।একটা কিছু চাকরী-বাকরী থাকলে বাইরে লোকজনের সাথে মিশে সময়টাও কেটে যেত।তা যখন আর হোলনা তখন ওই হাতা-খুন্তীই নাড়তে হবে তোমার।"কথাটা বলেই সাগর হেসে দেয়।মিত্রা অবাক হয়ে সাগরের দিকে তাকিয়ে বলে,"আমিও যাবো সাথে?"
---হ্যাঁ,এখন আর তো এখানে থাকা সম্ভব নয়।আর বাবাই যখন আর নেই তখন বারবার প্রাক্টিসের ক্ষতি করে এখানে আসাও সম্ভব নয়।আর তাছাড়া তুমি এখানে থাকলে আমার লাগাতার একটা টেনশান থাকবে।এতদিন বাবা বেঁচে ছিলেন আমার কোন চিন্তা ছিলোনা।কাকু-কাকীমাদের অনুমতি নেওয়া হয়ে গেছে।এখন আমি একটা ছোট বাড়িতে ভাড়া আছি।পরে দেখে শুনে একটা ভালো বাড়ি ভাড়া করে নেবো।কষ্ট করে একটু মানিয়ে গুছিয়ে নিও।তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।"
মিত্রা সাগরের একটু কাছে এগিয়ে এসে অস্ফুট স্বরে মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো,"আমি এখানে থাকলে আমার জন্য তোমার চিন্তা হবে? "সাগর কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে মিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো।অবাক বিস্ময়ে মিত্রা সাগরের গমন পথের দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের মানেই বলতে লাগলো,'এত ভালো মানুষ হয়?বাবার কথা রাখতে যেয়ে যে মানুষটা নিজের ইচ্ছার কোন দাম দেয়নি,ঈশ্বর কোনদিন একটু সুযোগ দিলে মনপ্রান উজাড় করে ভালোবাসা দিয়ে তার না পাওয়াগুলিকে ভুলিয়ে দেওয়ার আপ্রান চেষ্টা করবো।'
ভবিতব্য (৪র্থ অংশ)
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই সাগর ও মিত্রা বেরিয়ে পড়ে।শিয়ালদহ স্টেশনে নেমে তারা একটি ট্যাক্সি নিয়ে সাগরের এক কামরা বিশিষ্ট ছোট্ট ভাড়া বাড়িটাই এসে পৌঁছায়।সেখানে ঢুকে মিত্রা দেখে রান্নার ঘর একটা আছে বটে, কিন্তু চায়ের সরঞ্জাম ছাড়া আর কিছুই সেখানে নেই।ঘরে একটা খাট, একটা আলমারি, আর একটা টেবিল চেয়ার।ব্যস-এই হচ্ছে সাগরের সংসারের জিনিসপত্র।সবকিছু দেখেশুনে সে বাথরুমে ঢোকে ফ্রেস হওয়ার জন্য।বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে সে দেখে সাগর চা তৈরি করছে।মিত্রা যেয়ে তাকে বলে, "ওটা আজ থেকে আমার কাজ।তুমি গিয়ে বসো আমি চা নিয়ে আসছি।"সাগর নিঃশব্দে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যায়।মিত্রা দু'কাপ চা করে এনে খাটের উপর বসে।সাগর চা খেতে খেতে তাকে বলে,"আমার এখানে রান্নার সরঞ্জাম কিছুই নেই;এখন হোটেল থেকেই খাবারটা নিয়ে আসি।সন্ধায় বেরিয়ে সব কিনে আনবো।"মিত্রা কোন উত্তর দেয়না।সাগর চা খেয়ে হোটেল থেকে কিছু খাবার-দাবার নিয়ে ফেরে।সন্ধায় তারা বেরিয়ে সংসারের যাবতীয় জিনিসপত্র কিনে ঘরে ফেরে।শুরু হয় সাগর ও মিত্রার নূতন জীবন।
সময় তার নিজের মতিতেই টিকটিক করে এগিয়ে চলে।যারা তার সাথে তাল মেলাতে পারেনা তারা পিছিয়ে পরে।আর যারা ওই সময়ের চলার সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে তারাই জীবনের সুখপাখিটাকে ধরতে পারে।মিত্রা ও সাগর ঠিক ঘড়ির কাটার মতই নিয়ম করে জীবনের চলার পথটি অতিক্রম করতে থাকে।তাই সুখি হওয়ার চাবিটা তাদের হাতের মুঠোই এসে ধরা দেয়।সুখের পথে তারা হাঁটতে শুরু করে। কিন্তু তাইবলে সাগর যে স্বরূপাকে ভুলে গেছে তা নয়।এমন কোন দিন নেই যেদিন তার স্বরূপার কথা মনে পড়েনি।স্বরূপার কথাটাই মনে করে সাগর সামনের দিনগুলিতে এগিয়ে চলেছে।"মিত্রা তো কোন দোষ করেনি,ওকে কিন্তু তুমি ঠকিও না।"ঐ কথাটাই হয়তো সাগরের জীবনে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার উপায়।না-ভালোবাসার দিক থেকে সাগর মিত্রাকে কখনোই ঠকায়নি, ঠকাতে পারবেও না;কারন মিত্রা যে তাকে নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসে।
দিন,মাস,বছর গড়িয়ে চলে।তাদের সুন্দর ফুটফুটে একটি ছেলেও হয়;যার বয়স এখন একবছর হতে চললো।উভয়েরই ইচ্ছা খুব ঘটা করে জম্মদিন পালন করবে।ঘরে কাজ করার জন্য সব সময়ের একজন কাজের মাসি আছে।কিন্তু মিত্রা তাকে দিয়ে রান্না কখনোই করায় না।সে নিজের হাতে রান্না করেই সাগরকে খাওয়াতে ভালোবাসে।খাবার ভালো লাগলে আড়চোখে মিত্রার দিকে তাকানো আর একটা একটা করে আঙ্গুল চেটে চেটে খাওয়া মিত্রা ভীষন উপভোগ করে।এটা থেকে সে বঞ্চিত হতে চায়না বলেই রান্নাটাও নিজের হাতছাড়া করতে চায়না।
কিন্তু বিধাতা তাদের কপালে সুখ বেশিদিন লেখেননি!ছেলের আসন্ন জম্মদিন উপলক্ষে ছেলেকে মাসির কাছে রেখে স্বামী-স্ত্রী মার্কেটিং করতে বেরিয়ে পরে।দু'জনে মিলে প্রচুর কেনাকাটি করে রেস্টুরেন্টে খেয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।আর তখনই ঘটে যায় মারত্মক এক এ্যাকসিডেন্ট!রাস্তা পারাপারের সময় চলন্ত এক বাসের ধাক্কা।দু'জনে দু'দিকে ছিটকে যায়।পথচারীরা ছুটে আসে।কোন রকমে দু'জনকে সকলে মিলে ধরাধরি করে সামনেই একটা নার্সিংহোমে ভর্তি করে।তাদের মধ্য থেকেই একজন সাগরের প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে কার্ডে তার নার্সিংহোমের ঠিকানাটা পায়।সে নিজেই উদ্দোগী হয়ে সাগরের নার্সিংহোমে ফোন করে।ছুটে আসে সাগরের ডক্টর বন্ধু-বান্ধবেরা।মিত্রার তখনও জ্ঞান ছিলো। অস্ফুট স্বরে সে শুধুই 'রূপ রূপ' করছিল।মিত্রা ও সাগরের ছেলের নাম 'স্বরূপ';সাগরই তাকে এই নাম দেয়। মিত্রা তাকে রূপ নামেই ধরেই ডাকতো।কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস মিত্রা ডাক্তারদের কোন সুযোগই দেয়না!সাগরের প্রথম থেকেই জ্ঞান ছিলোনা ;তাকে আই সি সি ইউ তে নিয়ে যাওয়া হয়। সে ভেন্টিলেশনে চলে যায়।নার্সিংহোমের আইনকানুনের পাঠ চুকিয়ে মিত্রার সৎকার সাগরের বন্ধুরা মিলেই শেষ করে। সাগরের চিকিৎসার যেন কোন গাফলতি না হয় এবং টাকা পয়সার ব্যাপারে কোন চিন্তার কারন নেই যাওয়ার সময় তারা বারবার করে কথাটা জানিয়ে যায়।
আজ নার্সিংহোমের আই.সি.সি.ইউ তে রাতে যে ডক্টরের ডিউটি তার নাম ডাক্তার স্বরূপা দাশগুপ্তা । তিনি এক এক করে রোগীদের বেডের কাছে যাচ্ছেন আর তার ফাইলটা নিয়ে কেস হিস্টিরিতে চোখ বুলাচ্ছেন । হঠাৎ সাগরের দিকে দৃষ্টি যাওয়াতে তিনি একটু এগিয়ে যেয়েই ফাইলটা হাতে তুলে নেন । না - সে ভুল করেনি ! সাগরই তো । সঙ্গে সঙ্গেই ফাইলটা পড়তে শুরু করেন । একজন নার্সকে ইশারায় কাছে ডাকেন । জানতে চান কখন এবং কিভাবে ডক্টর চক্রবর্তী এখানে ভর্তি হলেন ? স্বরূপা হতভম্বের মতো সামনের চেয়ারটায় বসে পরে । নার্স বলতে থাকেন ,"আজ সন্ধ্যায় একসিডেন্ট করে ডক্টর চক্রবর্তী আর উনার সাথে থাকা এক ভদ্রমহিলা সম্ভবত উনার মিসেস হবেন এখানে ভর্তি হন । উনি যে নার্সিংহোমে আছেন সম্ভবত সেখানে কেউ খবর দেয় । সেখান থেকে উনার সহকর্মীরা এসে স্যারের ( ইনচার্জ অফ আই.সি.সি.ইউ.) সাথে কথা বলে গেছেন । যে ভদ্রমহিলা উনার সাথে ছিলেন তাকে বাঁচানো যায়নি । ডক্টর চক্রবর্তীর বাড়িতে আমরা খবর দিতে পারিনি । উনার বাড়ি কোথায় ,কে কে আছেন আমরা কিছুই জানতে পারিনি । স্বরূপা আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায় । সাগরের সামনে যেয়ে ভালোভাবে দেখে ; সত্যিই সে যা ভাবছে ভুল হচ্ছে না তো ! না - কোনো ভুল হচ্ছেনা ,এ তারই সাগর । কিন্তু কোনোদিন স্বপ্নেও সে ভাবেনি সাগরের সাথে আবার দেখাটা তার এইভাবে হবে ! ফাইনাল পরীক্ষার পর অনেকটা ইচ্ছা করেই সে আর সাগরের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখেনি । সত্যি বলতে সে চায়নি তারজন্য সাগরের জীবনে কোনো কালো ছায়া পড়ুক ।
রাত কেটে ভোর হল।সাগরের বেডটা আই সি সি ইউ তে এমন একটি জায়গায় যে ডাক্তারদের টেবিলের সামনেই।কেউ যাতে কিছু বুঝতে না পারে এমনভাবেই স্বরূপা সারারাত সাগরের খেয়াল রাখে।সকালে ডিউটি শেষ হলেই মাকে ফোন করে জানায় তার বাড়ি ফিরতে দেরি হবে।
চলে যায় সে সাগরের নার্সিংহোমে।সেখানে যেয়ে ডক্টর সাগর চক্রবর্ত্তীর আত্মীয় বলে নিজের পরিচয় দেয় ও তাদের কাছ থেকে সাগরের বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে।গেট খুলে সোজা বাড়ির ভিতর ঢুকে বেল বাজায়।মাঝবয়সী এক ভদ্রমহিলা এসে দরজা খোলেন।মহিলার কাছে জানতে পারে স্বামী-স্ত্রী দুজনে কাল সন্ধ্যায় বেরিয়েছিল ছেলের জম্মদিনের বাজার করতে।আজ ছেলের জম্মদিন।কিন্তু দু'জনের কেউই আর বাড়ি ফিরে আসেননি।সে কোন খবরও জানতে পারেনি তাদের।কোলের শিশু, সারাটা রাত বুকের দুধের জন্য কেঁদেছে।এই এখন অনেক কষ্ট করে কৌটোর দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছি।স্বরূপা সব শুনে ঘুমন্ত শিশুটিকে কোলে তুলতে তুলতে জানতে চায়,"ওর নাম কি?" মাসি বলে, "ওর নাম স্বরূপ।" স্বরূপা নামটি শুনে চমকে ওঠে।বুঝতে পারে সাগর আজও তাকে মনে রেখেছে।সে মাসিকে গতকালের ওদের এ্যাকসিডেন্টের কথা, মিত্রার মৃত্যুর কথা সব জানায়।মাসি খুব কাঁদতে থাকে।মাসি কাঁদতে কাঁদতেই বলতে থাকে, "বৌদিমনি, দাদাবাবু দু'জনেই খুব ভালো মানুষ।আজ প্রায় দু'বছর হোল এখানে আছি একবারের জন্যও মনে হয়নি তারা আমার নিজের কেউ নয়,এটা আমার নিজের বাড়ি নয়।এখন এই দুধের শিশুটিকে নিয়ে আমি একা কি করবো বলতে পারো দিদিমনি?" মুহূর্তে স্বরূপা ঠিক করে নেয় তার করনীয় কাজ।সে মাসিকে জানায় তার ও বাচ্চাটির কিছু জিনিসপত্র খুব তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নিতে।স্বরূপা ওদের নিয়েই তার বাড়িতে যাবে।মাসি স্বরূপার কাছে জানতে চায়,"দিদিমনি, তুমি দাদাবাবুর কি হও?" স্বরূপা কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দেয়, "বন্ধু।"
স্বরূপা ওদের সাথে করেই নিজের বাড়িতে ফেরে।বাড়িতে ফেরার পথে সে বাচ্চাটির জন্য দুধের কৌটো, কিছু খেলনা আর নূতন জামা কিনে নিয়ে আসে।বাড়িতে ফিরে সে তার মা-বাবাকে সাগর ও মিত্রার এ্যাকসিডেন্টের কথা বলে এও বলে যে সাগর তার পূর্বপরিচিত।বাচ্চাটির কথা ভেবেই সে তাকে ও মাসিকে এখানে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে।তার বাবা-মা বরং খুশিই হন;তারা মেয়ের এই কাজকে সমর্থন করেন।বাচ্চাটিকে তার মা নিজ হেফাজতে নিয়ে নেন।পরিচিত মুখ দেখতে না পেয়ে একটু কান্নাকাটি সে করছে ঠিকই কিন্তু সকলের কোলে কোলে দিব্যি তার সময় কেটে যাচ্ছে।স্বরূপা মাকে জানায় আজ ওর জম্মদিন।সে নিজের হাতে পায়েস করে বাচ্চাটিকে খাওয়াবে।একটা ব্যাগ দেখিয়ে বলে,"ওর মধ্যে ওর জন্য কিছু জিনিস আছে, নূতন জামা-প্যান্টও আছে।"মা শুনে শুধু একটু হেসে দেন।
ডিউটির একটু আগেই সে নার্সিংহোম পৌঁছায়।এরই মধ্যে দু'দু্ইবার ফোন করে সে সাগরের খবর নেয়।যেয়ে দেখে সাগরের জ্ঞান ফিরেছে।ভেন্টিলেশন খুলে দেওয়া হয়েছে।স্বরূপাকে দেখে নিমেষেই সে চিনতে পারে।প্রথমেই সে জানতে চায়,"মিত্রা ভালো আছে তো?"স্বরূপা কি বলবে ভেবে পায়না।উত্তরের অপেক্ষা না করেই সে আবার বলে,"আমার একটি ছেলে আছে বাড়িতে।মাসির কাছে রেখে কাল সন্ধ্যায় বেরিয়েছিলাম।নিশ্চয় খুব কান্নাকাটি করছে!তোমার একটু সময় হবে ওকে দেখতে যাওয়ার?" "তোমার ছেলে এখন আমার বাড়িতে।আমার মা-বাবার কোলে কোলে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর আদর খাচ্ছে মোটেই কান্নাকাটি করছেনা।" সাগর এবার সরাসরি স্বরূপার মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো,"আর মিত্রা?ও ভালো আছে তো?"স্বরূপা চুপ করে মাথা নীচু করে থাকে।সাগরের বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়না মিত্রা আর নেই!সাগরের চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে। "ভগবান আমার কপালে সুখ লেখেননি।যখনই মনে মনে ভেবেছি আমি খুব সুখী তখনই ভগবান আমার সবকিছু কেড়ে নেন।সেই ছেলেবেলা মাকে হারানোর থেকে শুরু হয়েছে।জানো,আমি কোনদিন মিত্রাকে ভালোবাসায় ফাঁকি দিইনি বা বলতে পার দিতে পারিনি।কারন তুমিই আমায় বলেছিলে যে ওর তো কোন দোষ নেই।আমিও ঠিক সেটাই ভেবে দেখেছি।"সাগরের চোখ থেকে পুনরায় জল পড়তে থাকে।"এখন আমার ছেলেকে কে দেখবে?কি করে আমি ওকে মানুষ করবো?"স্বরূপা আনমনা ভাবেই উত্তর দেয়,"কেন আমি আছি তো!" "কি বললে?" "না বলছি আমরা আছি তো কিছু একটা ব্যবস্থা হবেই।"
দিন সাতেক পরে সাগর নার্সিংহোম থেকে ছুটি পায়।সে বাড়িতে চলে যেতে চায়।স্বরূপা তাকে বোঝায় এই অবস্থায় বাড়িতে গেলে তাকে ও ছেলেকে সামলাতে মাসির খুব অসুবিধা হবে।একজন বয়স্ক মানুষ একদিকে একটি শিশু অপরদিকে একজন রোগীকে কিছুতেই সামলাতে পারবেন না।কিছুদিনের জন্য সে যাতে তাদের বাড়িতে যায়।সাগরও আপত্তি করে না।সেও ভেবে দেখে কথাটা ঠিক।কিন্তু তবুও বলে,"মাসিমা-মেসোমশাই কিছু মনে করবেন না তো?" "তোমাকে বাড়িতে নিয়ে যাবো তাদের অনুমতি নিয়েই আমি এসছি।"
স্বরূপাদের বাড়িতে সাগর আসে।সাগরের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর স্বরূপা যখন খুব ভেঙ্গে পড়েছিল;তখন নিজেকে সব সময় ঘরবন্ধী করেই রাখতো,যেটুকুন সময় সে বাড়িতে থাকতো।একদিন স্বরূপার অনুপস্থিতিতে তার মা ঘরে ঢুকে তার পড়ার টেবিলের উপর খোলা অবস্থায় একটি ডাইরী দেখতে পান।স্বরূপার মা-বাবা দুজনেই জানতেন ছেলেবেলা থেকেই স্বরূপা নিত্য ডাইরী লেখায় অভ্যস্ত।একমাত্র মেয়ের ব্যবহারের এই পরিবর্তনের কোন সদুত্তর না পেয়ে স্বরূপা কলেজে বেরিয়ে গেলে তিনি চুপি চুপি মেয়ের ঘরে ঢুকে ডাইরিটা হাতের কাছে পেয়ে সাগর সম্পর্কে সবকিছু জানতে পারেন এবং স্বামীকেও জানান।কিন্তু তারা যে ঘটনাটা জেনে গেছেন সেটা মেয়েকে কোনদিনও বুঝতে দেননি।মেয়ে তাদের খুব জেদী।বিয়ের ব্যপারে যেহেতু সে না বলেছে তারা ভালোভাবেই জানতেন এই না কোনদিনও হ্যাঁ হয়ে আসবেনা।তারা উভয়েই মেয়েকে নিয়ে চিন্তা করলেও কোনদিন স্বরূপাকে উত্তক্ত করেননি।তাই সাগরের ছেলেকে নিয়ে বাড়ি আসা, সাগরকে নার্সিংহোম থেকে বাড়িতে নিয়ে আসা-তারা কোন ব্যপারেই আপত্তি করেননি।
সাগর স্বরূপাদের বাড়িতে ঢোকা মাত্রই তাকে দেখতে পেয়ে ছেলে হাত উঠিয়ে বাবার কোলে যেতে চায়।স্বরূপা এটা দেখেই সাগরকে বলে,"তুমি হাসপাতালের জামা-কাপড় ছেড়ে ফ্রেস হয়ে তারপর রূপকে কোলে নাও।"
দিনপনের এভাবে কাটার পর সাগর যখন পুরোপুরি সুস্থ্য তখন স্বরূপার অনুপস্থিতিতে তার মা-বাবাকে নিজের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার কথা বলে।স্বরূপার মা-বাবা যেন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন।কোন রাখঢাক না করেই সরাসরিই সাগরকে বলেন,"যাবে তো নিজের বাড়িতে নিশ্চয় বাবা,তবে আমার ফুটফুটে ওই নাতিটার মাকে সঙ্গে নিয়ে যাও।"সাগর এ কথার অর্থ বুঝতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে স্বরূপার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।স্বরূপার মা আবারও বলতে থাকেন,"জানো বাবা এই নাতিটার দিদিমা-দাদু হওয়ার খুব ইচ্ছা আমাদের।আর তোমার মত জামাই সেতো ভাগ্য করে মেলে।আমরা সব জানি বাবা।মেয়েটা আজও তোমাকে খুব ভালোবাসে।তাই তো সে বিয়ে বসতেই চায়না। আমরাও তাকে কোনোদিন বিয়ে করা নিয়ে বিরক্ত করিনি।কারণ আমরা বুঝতে পেরেছিলাম ,বললেও সে রাজী হবেনা । হয়তো তার ভাগ্যের লিখন ছিলো এই ভাবেই তোমায় পাওয়া । সে তো হাসতেই ভুলে গেছিলো । এখন বাড়িতে থাকলেই স্বরূপকে নিয়ে সে তোমার ঘরেই কাটায় । তার মুখে হাসি দেখে আমরাও যে আবার হাসতে শিখেছি । তুমি আর দ্বিমত কোরোনা ,রাজী হয়ে যাও।" "কিন্তু ওর মতটাও তো জানা দরকার । ওর কাছে জিজ্ঞেস না করে আপনারা কি করে ভাবছেন ,এতগুলো বছর ,এত ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও ও আমায় মেনে নেবে ?" স্বরূপার বাবা তখন বললেন ,"ঠিক আছে বাবা ,ও আজ ফিরলে তুমি নিজেই নাহয় ওর কাছে জানতে চেও ।"
স্বরূপা নার্সিংহোম থেকে ফিরে ফ্রেস হয়ে যখন রূপকে কোলে নিয়ে সাগরের ঘরে ঢোকে -সাগর তখন একটা বই পড়ছিলো । সাগরকে কিছু একটা বলার জন্য এগোতেই - সাগর নিজেই বলে ওঠে ,"রুপা ,আমার এই মা হারা ছেলেটির একটা মায়ের খুব দরকার । তুমি পারোনা সেই জায়গাটা পূরণ করতে ?" স্বরূপা সাগরের মুখে হাত চাপা দিয়ে বলে ওঠে ,"ওকে মা হারা বলছো কেন ? হ্যাঁ, আমি ওকে জম্ম দিইনি ঠিক কথা কিন্তু যেদিন থেকে ওকে আমি কোলে তুলে নিয়েছি ; সেদিন থেকেই আমি ওর মায়ের জায়গাটাই নিয়েছি । ওকে আমি আমার সন্তানই মনে করি। এখন যদি ওর বাবা তার বুকে আমায় একটুখানি জায়গা দেয়" - বলেই হেসে দেয় । সাগর হাত বাড়িয়ে ছেলে সমেত স্বরুপাকে বুকে টেনে নেয় ।
~~~~~~~~শেষ~~~~~~~
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী