Saturday, December 17, 2022

সময়ই উত্তর দেয় (অর্বাচীন ওয়েব ম্যাগাজিন)

সময়ই উত্তর দেয়

    আমি তখন স্কুলের গণ্ডি পেরোইনি। মাধ্যমিক দেবো সে বছর। দ্বাদশ শ্রেণীর দেবমাল্য আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের হাত দিয়ে একটি চিঠি পাঠালো আমায়।চিঠি পড়ে আমি তো থ! সে আমাকে প্রেম নিবেদন করেছে।জয়িতার মাধ্যমেই জানিয়ে দিলাম প্রেম এভাবে হয় না।ভালোবাসা হল দু'টি হৃদয়ের মিলন।তার আমাকে ভালো লাগলে আমার তাকে যে ভালোবাসতে হবে এমন কোন কথা তো নেই। আর এভাবে ভালোবাসা হয় না।তাছাড়া পড়াশুনা শেষ করার আগে এসব নিয়ে ভাবতে গেলে জীবনে পায়ের তলার মাটিটা শক্ত করতে পারবো না। আমি এসব নিয়ে এখন চিন্তা করতেই চাই না।
 এরপর যতদিন দেবমাল্য স্কুলে ছিল বলতে গেলে আমার সামনে আর কোনদিন আসেনি।আমিও তাকে দেখতে পাইনি।
 আমি যখন উচ্চমাধ্যমিক দেবো তখন হঠাৎ একদিন আবার তার সাথে আমার রাস্তায় দেখা।আমি কোচিং থেকে আসছিলাম।সেদিন রাস্তায় আলো ছিলো না। লোকজনও খুব একটা রাস্তায় ছিল না।তার সেই একই প্রস্তাব।তাকে সরাসরিই বললাম,"প্রেম এভাবে হয় না"
আমার কথাটা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই দেবমাল্য আমায় ওর বুকের সাথে চেপে ধরে জোর করে ওর মুখটা এগিয়ে এনে আমার ঠোঁটে আলতো এক কামড় দিয়ে বললো,"তাহলে কী প্রেম এভাবে হয়!" জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওর মুখে জোরে একটা থাপ্পড় মেরে বলি,"তোমার মত ছেলের এটাই প্রাপ্তি"।মুহূর্তে ও আমার গায়ের থেকে ওড়নাটা ছিনিয়ে নিয়ে কাছে আরো কাছে এগিয়ে আসতে গেলে আমি বলি,
"আমার দিকে আর এক পা এগোলে আমি কিন্তু চিৎকার করে লোক ডাকবো। তোমার কলেজকে সব জানিয়ে দেবো।" আমার কথা শুনে দেবমাল্য কিছুটা থমকে যায়।আমিও আর সেখানে এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে জোর পায়ে সেখান থেকে চলে আসি।মুখে তাকে যাই বলি না কেন কয়েকদিন বেশ ভয়ে ভয়েই কেটেছে আমার। বাড়িতে ইচ্ছা করেই কিছু বললাম না তাদের টেনশন আমায় নিয়ে বেড়ে যাবে মনে করে।
  অনেক বছর কেটে গেছে এরপর।দেবমাল্যর সাথে আমার আর কোনদিন দেখা হয়নি।বাড়ির প্রচণ্ড চাপ স্বর্তেও বিয়ের পিঁড়িতে বসিনি। কারণ আমি যে প্রফেশনে আছি তার ডিউটির কোন ঠিক ঠিকানা নেই।রাত-বিরেতে যখন তখন ছুটতে হয়। প্রাণহানিরও ভয় রয়েছে। পরের বাড়িতে কিছুতেই এসব মেনে নেবে না।
   থানায় বসে কাগজপত্র দেখছিলাম।হঠাৎ একটি কাগজে চোখ আটকে গেলো। প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে।মেয়েটির বাড়ির লোক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া দুটি ছাত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন।ফিরে গেলাম কয়েক যুগ আগে।মাথাটা এক নিমেষে গরম হয়ে গেলো। ইনভেস্টিগেশন শুরু হলেও ঢিমেতালে কেসটা এগোচ্ছে। যে ইন্সপেক্টর কেসটা দেখছেন তাকে ডেকে কতদূর কেসটা এগিয়েছে জানতে চাওয়ায় তিনি আমতা আমতা করে উত্তর দিলেন। নিজেই কেসটার দায়িত্ব নিয়ে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলাম। প্রমাণ যা কিছু পেলাম ছেলেদু'টিকে  অ্যারেস্ট করে আগে থানায় এনে তুললাম। রাতেই হুমকি দিয়ে এক ফোন। প্রথমে টাকার লোভ পড়ে রীতিমত হুমকি গলাটা খুব চেনা চেনা মনেহল।
 পরদিন আই পি এস অফিসার নন্দিতা রায় চৌধুরীর সাথে ধর্ষক পুত্রের পিতা কোর্ট খোলার আগেই দেখা করতে এলেন। এসেই তিনি টেবিলের উপর একটি ব্যাগ রাখলেন।তাকে দেখে চমকে উঠলাম।সে অবশ্য আমাকে প্রথম অবস্থায় চিনতেই পারেনি। জীবনে প্রতিটা ঘটনার পিছনে সুফল এবং কুফল দু'টোই থাকে। দেবমাল্যর ওই অপমানের জবাব শুধু থাপ্পড়ে দিয়ে আমার পোশায়নি সেদিন। তখনই ভেবে নিয়েছিলাম জীবনে যত প্রতিকূল পরিস্থিতিই আসুক না কেন আমি যেভাবেই হোক প্রশাসন বিভাগে চাকরি করবো। তার ফল হাতে হাতে পেয়েছি।প্রথমেই ধর্ষক পুত্রের পিতার কাছে জানতে চাইলাম ,
--- দেবমাল্য মজুমদার, আপনি কি আমায় চিনতে পারছেন?
লক্ষ্য করলাম যে তেজ নিয়ে তিনি আই পি এস অফিসারের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন তা এক নিমেষে উধাও! তাকে একথাও বললাম সেদিন তার ওই অপমান আজ আমাকে এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে। 
 দেবমাল্য হাত জোড় করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। মাঝপথে তাকে থামিয়ে দিয়ে টেবিলের উপর রাখা হয়ত টাকা ভর্তি ব্যাগটি নিয়ে সেই মুহূর্তে তাকে বেরিয়ে যেতে বললাম। দেবমাল্য চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমার পায়ে হাত দিতে গেলো।আমি হেসে পড়ে রুম ত্যাগ করলাম।
 ছেলে দু'টির যাবতজীবন জেল হল।এতদিন পর মনেহল আমি আমার অপমানের জবাব নিতে পারলাম।

                শেষ
 
 

Friday, December 16, 2022

একদিন ভালোবাসবে (দ্বিতীয় পর্ব)


একদিন ভালোবাসবে (দ্বিতীয় পর্ব)
  
     
- আমার একটা কথা আছে তোর সাথে --- তুই বাসের ভিতর আমার পাশে বসিস তখন বলবো --
 নিলয়ের বুকের ভিতর তখন কে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে -- কী বলতে চাইছে শ্রাবণী তাকে। এতক্ষণ শ্রাবনীকে মন খারাপ করতে সে নিষেধ করেছে আর এখন সে নিজেই উদাস হয়ে যাচ্ছে।তাহলে কী শ্রাবণী তার মনের কথা টের পেয়েছে? কিন্তু সেতো কোন কথা তাকে কখনোই বলেনি। নাকি শ্রাবণীর তার প্রতি কোন দুর্বলতা গ্রো করেছে? কি বলতে চায় সে নিলয়কে?

     তিয়াসা তার শ্বশুরের জন্য বেশ গামাখা মাংসের মত করে বোয়াল মাছ রান্না করে দুপুরে বাটিতে করে এনে সামনে রাখলো।সঙ্গে সঙ্গে তিনি বাটিটা হাতে নিয়ে নাকের কাছে ঘ্রাণ শুকে বললেন,
--- গিন্নি, মায়ের আমার রান্নার হাতটি বেশ চমৎকার মনেহচ্ছে।বেশ সুন্দর একটা গন্ধ বেরোচ্ছে। তা তোমরাও বসে পরো একসাথেই চারজনে খেয়ে নিই।ক'দিন যা ধকল গেলো সকলের উপর থেকে আজ আত্মীয়রা সবাই চলেই যখন গেলেন সবাই দুপুরে একটু বিশ্রাম নিই।
 নিলয়ের দিকে মুখ করে বললেন,
--- কী রে নীলু? তুই তো খেয়েই চলেছিস গবগব করে। রান্নাটা কেমন হয়েছে বল?
নিলয় সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো
--- ভালো।
--- রান্নার প্রশংসা করতে শেখ বাবা। মেয়েরা অনেক কষ্ট করে যত্ন নিয়ে রান্না করে। প্রশংসা করলে কষ্টটা তাদের কাছে আর কষ্ট থাকে না।
--- তুমি তো প্রশংসা করছো আবার আমি কেন?
 তিয়াসা খেতে খেতে বারবার নিলয়কে লক্ষ্য করে। কিন্তু নিলয় নিজের মনে খেয়ে চলেছে। কারও আলোচনায় সে কোনোই উত্তর করে না।
  এইভাবেই সকলের আগে খাওয়া শেষ করে ড্রয়িংয়ে টিভি চালিয়ে সোফায় বসে দেখতে দেখতে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে।নিলয়ের এই সোফায় ঘুমিয়ে পড়া দেখে শ্বাশুড়ী বকবক করতে থাকেন। তিয়াসাকে বলেন,
-- যা মা তুই তোর ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নে।
 তিয়াসা বিনা বাক্যব্যয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।দুপুরে ঘুমানো তার কোন কালেই অভ্যাস নেই। কাল সারাটা রাত জেগে।তারউপর ফুলশয্যার রাতে স্বামীর ব্যবহারে সে সত্যিই অবাক! তারমানে এ বিয়েতে নিলয়ের মত ছিল না। যদি তাইই হয় সে কেন বিয়েটা করলো? তাহলে কী নিলয় অন্য কাউকে ভালোবাসে? মনেমনে ভাবে 'আমি তো মানুষটাকে চিনতামই না, আমার জীবনটা এভাবে নষ্ট করলো কেন?আমার তো কোন অপরাধ ছিল না --।'
 দুই বোনের মধ্যে তিয়াসাই বড়।ইংলিশে অনার্স করা তিয়াসা চেয়েছিল শিক্ষকতা করবে। কিন্তু হঠাৎ করেই বাবা বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। তিয়াসার সহপাঠী সৌম্য যে তাকে পছন্দ করতো তিয়াসা তা ভালোভাবেই জানতো।কিন্তু মুখ ফুটে কেউ কোনদিন কাউকে মনের কথা বলেনি। অত বড়লোকের সুদর্শন ছেলে তিয়াসার সাহসে কুলিয়ে ওঠেনি তাকে মনের কথাটা খুলে বলার।সৌম্য ছিল ধীর,শান্ত স্বভাবের ছেলে। সকলের সাথেই কথা বলতো, মিশতো কিন্তু চুপচাপ হয়েই থাকতো। সব সময়ই সে শুনতো বেশি কিন্তু বলতো কম।
  রেজাল্ট বেরোনোর সাথে সাথেই বাবার সিদ্ধান্ত মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। মা তন্দ্রার অবশ্য মত ছিল না এখনই বিয়ে দেওয়ার।কিন্তু বাবা অনিল দাস অনেক আগে থাকতেই ছেলে খুঁজতে শুরু করে দিয়েছিলেন। বাবা জানিয়েছিলেন,
-- চাকরি যদি করতেই হয় শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে কোরো আমি যে বাড়িতে তোমার বিয়ে দেবো সেখানে কথা বলেই নেবো।তারা রাজি হলেই আমি সেখানে বিয়ের ব্যবস্থা করবো। কিন্তু একটা কথা বোঝো আমার বয়স হয়েছে ,তোমার ছোটবোন পিয়াসার পড়াশুনা এখনো শেষ হয়নি। হঠাৎ করে আমার যদি কিছু একটা হয়ে যায় তোমার মা পড়বেন অথৈ সমুদ্রে।আর পুরো সংসারের জোয়াল এসে পড়বে তোমার ঘাড়ে। তোমার জীবনটা তখন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।এই সংসারের দায়িত্ব আমার। আমার অবর্তমানে এই সংসারের জন্য তোমার জীবনটা শেষ হয়ে যাক এটা আমি কিছুতেই হতে দিতে পারি না। চাকরির চেষ্টা তুমি করে যাও যদি বিয়ের আগে তুমি চাকরি পেয়ে যাও তো ভালোই আর বিয়ে দেবো বললেই তো আর বিয়ে হয়ে যায় না।তার জন্যও তো সময় লাগবে।
 বাবার এই কথার পরে তিয়াসা কিংবা তার মা কোন কথাই আর বলতে পারেননি। বিয়ে হয়ে যায় তিয়াসার। বিয়ের আগে সে নিলয়কে দেখেনি। বাবার পছন্দ করা ছেলেকে চোখ বন্ধ করে মেনে নিয়েছে।কিন্তু তিয়াসা স্বপ্নেও ভাবেনি ফুলশয্য্যার রাতে তার স্বামীর কাছ থেকে সে এরূপ ব্যবহার পাবে।এসব কথা ভাবতে ভাবতে সারারাতের না ঘুমানোর ফলে তিয়াসা একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। হঠাৎ ঘরের লাইট জ্বলে উঠায় তার ঘুম ভেঙে যায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে পাঁচটা বেজে গেছে।শীতের দিনে বিকেল পাঁচটা মানেই চারিদিকে অন্ধকার হয়ে যাওয়া।তাড়াতাড়ি উঠে পরে দেখে নিলয় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে।চুপচাপ উঠে যখন বেরিয়ে যাচ্ছে তখন নিলয় তাকে বলে,
-- আমি একটু বেরোচ্ছি।
 তিয়াসা অবাক হয়।যে মানুষটা তাকে স্ত্রীর মর্যাদায় দিলো না সে আবার বেরোনোর সময় বলে বেরোচ্ছে।নিলয় হয়ত তার মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যপারটা বুঝতে পেরেছে তাই আবারও বললো,
--- আসলে মা এখন ঠাকুরঘরে।এই সময় সেখানে ঢোকা নিষেধ কারো।বাবা ঘুমাচ্ছেন। মা তো তোমার কাছেই জানতে চাইবেন তাই আর কি!
তিয়াসা সে কথারও কোন উত্তর দেয় না।সে ধীরপায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে নিচুতে নেমে সোজা রান্নাঘরে গিয়ে ঢোকে। নিলয় বেরিয়ে যায়।
 নীলিমা তার পুজো সেরে এসে রান্নাঘরে ঢুকে দেখে তিয়াসা কাজের মহিলার সাথে গল্প করছে। তিনি ঢোকার সাথে সাথেই তিয়াসা বলে,
--- মা চা করি?
--- হ্যাঁ চা তো খাবো।কিন্তু তুই বোস আমি করছি।
--- তুমি বরং বসো।আমি করছি।এগুলো এখন আমার দায়িত্ব।
 নীলিমা ভীষণ খুশি হলেন তিয়াসার কথা শুনে।তিনি হাসতে হাসতে বললেন,
--- তুই তো দেখছি আমাকে একেবারে কুড়ে বানিয়ে দিবি।
--- নীলু কি ঘরে আছে নাকি ঘুম থেকে উঠেই বেরিয়ে গেছে?
--- বেড়িয়েছেন
--- ছেলেটা আমার এমনিতে খুবই ভালো রে কিন্তু কী জানিস অল্প বয়সে মানুষের অনেক ভুলভ্রান্তি থাকে। সেগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে ----
 কথাটা নীলিমা শেষ করার আগেই বসবার ঘর থেকে অজয়ের গলা শোনা গেলো 
--- কই গো তোমরা চা টা নিয়ে এখানে আসো গল্প করতে করতে সবাই মিলে চা খাই।
--- ওই এলেন উনি।তুই এক কাজ কর মা সকলের চা নিয়ে ড্রয়িংরুমে আয়।
নীলিমা সেই প্রসঙ্গে আর গেলেন না দেখে তিয়াসা তাকে মনে করিয়ে দিলো
--- কী যেন বলছিলেন মা?
--- হ্যাঁ তোর বাবা এসব জানেন না। পরে একসময় তোকে সব বলবো।তোকে তো সব জানতেই হবে রে -- কাল নীলু তোকে কিছু বলেনি?
বুকের ভিতরের কষ্টটাকে চেপে রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিয়াসা কথাটা এড়িয়ে গিয়ে বলে,
--- মা, চা হয়ে গেছে তুমি যাও ওঘরে আমি চা নিয়ে আসছি।
নীলিমা আর কিছু না বলে উঠে এলেন আর তিয়াসা চা নিয়ে বসবার ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখে বেশ হন্তদন্ত হয়ে নিলয় ঘরে ঢুকেই সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে।অজয় দেখতে পেয়েই চিৎকার করে বললেন,
--- কী হয়েছে নীলু এভাবে ছুটছিস কেন? আয় একসাথে বসে চা খাই।
 কথাটা যার উদ্দেশ্যে বলা তার কানে গেলো কিনা কেউই বুঝতে পারলো না কিন্তু সে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই নেমে এসে বললো,
--- মা আমি একটা বিশেষ কাজে বেরোচ্ছি কখন ফিরবো বলতে পারছি না।
--- কী হয়েছে টা কী সেটা তো বলবি?
 নীলিমা ছেলের উদ্দেশ্যে কথাটা বললেন।নিলয় দ্রুত বেরোতে বেরোতেই বললো,
--- কী হয়েছে আগে নিজে সব ভালোভাবে জানি তারপর নাহয় তোমাদের এসে সব বলবো।

ক্রমশ 




    

Wednesday, November 30, 2022

একদিন ভালোবাসবে (প্রথম পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে (প্রথম পর্ব)       

  আজ তিয়াসা আর নিলয়ের ফুল শয্যা। সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো খাটে তিয়াসাকে নিয়ে বাড়ির বউ, মেয়েরা ইয়ার্কি ঠাট্টায় মেতেছে।হঠাৎ একজনে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
-- এই রে দুটো বাজে,সবাই চল।নিলয়টা এই হিমের মধ্যে সেই থেকে বাইরে অপেক্ষা করছে।
 সকলে যে যার মত হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলো। তিতাসা আপাদমস্তক ফুল এবং সোনার গয়নায় সজ্জিত হয়ে গুটিসুটি মেরে খাটের মাঝখানে বসে তার জীবনের বহু আকাঙ্খিত রাতটির জন্য। কিন্তু সময় তো বয়েই চলেছে নিলয়ের কোন পাত্তা নেই।এক সময় তিয়াসার চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে।তার বারবার হাই উঠতে থাকে। সে একটা বালিশে মাথা দিয়ে সবে শুয়েছে এরমধ্যে দরজা দেওয়ার শব্দে পুনরায় উঠে বসতে গেলে নিলয় তাকে বলে,
--- উঠতে হবে না। তোমার ঘুম পেয়েছে বুঝতে পারছি।ঘুমিয়ে পরো। আজ আর কোন কথা নয়। কাল সব কথা হবে।
 তিয়াসা উঠে বসেছিল।নিলয় কথা শেষ করে বিছানার থেকে মাথার বালিশটা নিয়ে সোফার দিকে এগোতে লাগলে তিতাসা প্রচণ্ড অবাক হয়ে তাকে বলে,
--- তুমি খাটে শোবে না?
নিলয় কিছুটা থমকে যায়। পিছন ফিরেই উত্তর দেয়
--- কিছু কথা আমার বলার আছে । আজ খুব টায়ার্ড আছি। কিন্তু কথাগুলো তোমাকে বলার খুব দরকার। আজ রাতটা যাক কাল সব বলবো। তুমি খাটে শুয়ে পরো আমি সোফায় শুচ্ছি।
 বাবার পছন্দ করা ছেলেকে বিনা বাক্যব্যায়ে মেনে নিয়ে মনের মধ্যে সুখের সংসারের স্বপ্নকে লালিত করে বিয়ের পিঁড়িতে বসা তিয়াসা নতুন জীবনের শুরুতেই এ ধাক্কাটা খেয়ে কী বলবে কিংবা কী করবে বুঝতে না পেরে একটা আহত পাখির মত নাইট ল্যাম্পের আলোয় কিছুক্ষণ- শুয়ে থাকা নিলয়ের দিকে তাকিয়ে একবুক কষ্ট নিয়ে নিজেও শুয়ে পড়ে।বুক চিরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে আসে।বুঝতে পারে তার জীবনটা শুরু হতে চলেছে ফুলশয্যায় নয় কাঁটা মোড়া শয্যায়!কিন্তু একটু আগে যে রাজ্যের ঘুম তার দু'চোখ জুড়ে ছিল সেই ঘুম যেন এক অদৃশ্য মায়াবলে কোথায় উধাও হয়ে গেছে। সারাটা রাত আর তার ঘুম আসেনি।
  পরদিন সকালবেলা সবই স্বাভাবিক। তিয়াসা ঘুম থেকে উঠে দেখে নিলয় তখনো সোফায় শুয়ে। সে স্নান সেরে ঘরে ঢুকে দেখে নিলয় তার মাথার বালিশ আর গায়ের চাদরটা ভাঁজ করে খাটের উপর রেখে গেছে। কাল রাতের টাটকা ফুলগুলো আজ শুকিয়ে সব নেতিয়ে পড়েছে। ঠিক তার জীবনের স্বপ্ন দেখা রাতটির মত।একটা প্লাস্টিকের ক্যারি ব্যাগ এনে তিয়াসা সমস্ত ফুলগুলো ব্যাগের ভিতর পুরে খাটটাকে সুন্দর করে গুছিয়ে নিচুতে নামে। নিলয় আর তার বাবা ডাইনিংয়ে বসে চা খাচ্ছিলেন। তিয়াসাকে দেখতে পেয়ে তিনি বলে উঠলেন,
-- আয় মা এখানে এসে বোস। জানিস তো মা আমার একটা মেয়ের খুব শখ ছিল। আজ সে অভাবটা আমার পূরণ হয়েছে তুই এ বাড়িতে বউ নয় মেয়েই হয়ে থাকবি। আমার আর তোর মায়ের কাছে আবদার করবি। এই যে নীলুকে দেখছিস একে কিচ্ছু তোর বলতে হবে না। আমি তো বাড়িতে বউ আনিনি একটা মেয়ে এনেছি। মেয়ে মানেই ঘরের লক্ষী। তুই এ বাড়ির লক্ষী।
  তিয়াসা চুপ করে তার শ্বশুরের কথাগুলো শুনে যাচ্ছে।তিনি অনর্গল কথা বলেই চলেছেন এরই মাঝে শ্বাশুড়ী নীলিমা নিজের ও তার পুত্রবধূটির জন্য চা নিয়ে এসে বসলেন একটা চেয়ার টেনে।স্বামীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,
--- ওরে তুমি এবার একটু থামো। সেই থেকে কথা বলেই চলেছ। হ্যাঁরে মা তুই বোয়াল মাছ খাস তো? 
 তিয়াসা মাথা নেড়ে "না" বলতেই নীলিমা স্বামীর দিকে মুখ করে বলে উঠলেন,
--- নিজে যা যা ভালো খায় আজ তাই বাজার করে নিয়ে এসেছে। আমি বলেছিলাম বোয়াল মাছ সকলে পছন্দ করে না।ছেলেকে বললেন,
--- এই নীলু তুই একবার বাজার যা তো।অন্য কোন মাছ নিয়ে আয়।
 নিলয় চা খাওয়া শেষ করে পেপার নিয়ে পড়ছিল। মায়ের কথা শুনে একটু বিরক্তির সুরে বলে উঠলো,
--- কেন তোমার ফ্রিজে আর কোন মাছ নেই।আজকের দিনটা চালিয়ে দাও না - কাল ---
 কথা শেষ হওয়ার আগেই তিয়াসা খুব আস্তে বলল,
--- মা, যা আছে আজ তাই দিয়েই খাবো।নতুন করে আবার বাজারে যাওয়ার দরকার নেই।
 নীলিমার হঠাৎ মনে পড়ল ফ্রিজে তো গলদা চিংড়ি রয়েছে।তিনি বললেন,
--- ও হরি! আমি তো ভুলেই গেছিলাম ফ্রিজে তো গলদা চিংড়ি রয়েছে।নিলয়ের আইবুড়ো ভাত দিতে আনা হয়েছিল।কিছু রান্না হয়েছিল আর কিছু ফ্রীজে রেখেছিলাম।আজ তাহলে চিংড়ির মালাইকারি করি।বোয়াল কাল করবো।
--- তুমি চিংড়ির মালাইকারি করো আর আমি বাবার জন্য বোয়ালটা রান্না করি।
 তিয়াসার কথা শুনে শ্বশুর অজয় হাসতে হাসতে বলে উঠলেন,
--- দেখো গিন্নি দেখো কেমন মেয়ে পছন্দ করেছি।
 নিলয় তখন আড়চোখে তিয়াসাকে দেখে আবার পেপার পড়ায় মন দেয়। কিন্তু নিলয়ের এই আড়চোখে তাকানো তিয়াসার নজর এড়ায় না। কাল রাতের কথাগুলো তিয়াসার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে সেই থেকে। কালকে নিলয়ের বলা কথাগুলো এটাই প্রমাণ করে তারমানে এ বিয়েতে নিলয়ের কোন মত ছিলো না। সে হয়ত অন্য কাউকে ভালোবাসে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও তার শ্বশুর,শ্বাশুড়ির ব্যবহারে নিলয়ের কালকের বলা কথাগুলো একটু সময়ের জন্য হলেও ভুলে ছিল। কিন্তু নিলয়ের এই তাকানোতে আবার তারমধ্যে কিছুটা উদাস ভাব চলে আসে।নীলিমার কথায় তার সম্বিত ফেরে।
--- চল মা আমরা দু'জনে গিয়ে টিফিনটা করে ফেলি।

২. 
 কলেজ ফেস্টে গান শুনে নিলয়ের মত অনেক ছেলের বুকেই একটা সুর ধরিয়ে দিয়েছিল শ্রাবণী দত্ত।সুন্দরী শ্রাবণী অবশ্য কাউকেই পাত্তা দিত না। অনেক ছেলেই কারণে,অকারণে তার সাথে কথা বলতে এসেছে।ভদ্রতার খাতিরে তাদের সেসব কথার জবাব দিলেও কাউকেই সেভাবে কোনদিন অন্য কোন কথা বলার সুযোগ দেয়নি। নিজের ভিতর সব সময় একটা গাম্ভীর্য ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে। কারণ সে জানতো তার রক্ষণশীল পরিবারের পিতামাতা কোনদিনও তার পছন্দ করা ছেলের সাথে বিয়ে দেবেন না। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে যখন সে কলেজে ভর্তি হয় তখনই তার বাবা তাকে ডেকে স্মরণ করিয়ে দেন,
-- ছেলেদের সাথে একসাথে পড়তে যাচ্ছ খুব ভালো কথা। সবাই সেখানে ক্লাসমেট এবং সেই নজরেই তাদের দেখো। কোন ছেলের সাথে বেশি মেলামেশা করতে যেও না। পড়াশুনা শেষ করো ওসব নিয়ে আমরা ভাববো পরে।
  বাবার জীদ, বাবার রাগ সম্পর্কে ছোট থেকেই শ্রাবণী ওয়াকিবহাল। মা আজও বাবাকে জমের মত ভয় পান পান থেকে চুন খসলেই তিনি বাড়িতে দক্ষযজ্ঞ বাঁধিয়ে তোলেন। বাড়িতে মাত্র তিনটে প্রাণী। মা,মেয়ে কেউই প্রয়োজন না হলে জেদী, রাগী,একগুঁয়ে মানুষটার সাথে কথা বলেন না।আর তিনিও নিজের মনেই থাকেন।
  শ্রাবণীর বাবা সাত্যকী দত্ত বেসরকারি একটি কোম্পানির ম্যানেজার হিসাবে সৎ পথে চাকরি করার পর আজ বছর খানেক হল তিনি রিটায়ার করেছেন। অফিসে তিনি নরম স্বভাবের মানুষ হলেও বাড়িতে তার কথার উপর কেউ কথা বলতে পারে না।মা,মেয়ে সর্বদাই তার ভয়ে যুজুবুরি হয়ে থাকে।
 কলেজ পিকনিকে সকলে যাচ্ছে। শ্রাবণীরও ইচ্ছা সে যাবে। কিন্তু বাবার ভয়ে সে কথাটা তাকে বলতেই পারছে না।মাকে গিয়ে বলায় তার মা ভয়ে ভয়ে স্বামীকে কথাটা জানান কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল তিনি এক কথায় রাজি হয়ে যান।কিন্তু সন্ধ্যার আগেই বাড়িতে ফিরতে হবে সে কথা জানিয়ে দেন।
   ঠাকুরপুকুর কলেজের সামনের থেকেই বাস ছাড়ে। সকলে সময় মত সেখানে উপস্থিত হয়ে যায়।নির্দিষ্ট সময়ে বাস ডায়মন্ড হারবার গঙ্গার কাছে পিকনিক স্পটে চলে আসে। শ্রাবণী তার এক বন্ধুর সাথে হাঁটতে হাঁটতে পিকনিক স্পট থেকে অনেকটা দুর চলে আসে। দুপুরে খাওয়ার সময় তাদের দেখতে না পেয়ে নিলয় ও তার এক বন্ধু তাদের খুঁজতে যায়। হঠাৎ তারা লক্ষ্য করে কিছুটা দূরে আর একটি পিকনিক দলের বেশ কয়েকটি ছেলে শ্রাবণী এবং তার বন্ধুকে মধ্যপ অবস্থায় ঘিরে ধরে উত্যক্ত করে চলেছে। কিছুতেই ওরা দু'জনে ওদের কাছ থেকে সরে আসতে পারছে না। নিলয় ও তার বন্ধু দৌড়ে গিয়ে তাদের রক্ষা করে।কিন্তু শ্রাবণীর ওড়নাটি তাদের দখলেই চলে যায়। কাঁধের কাছে জামার কিছুটা অংশও ছেড়া দেখতে পেয়ে নিলয় তার গায়ের জ্যাকেটটা খুলে তার দিকে এগিয়ে দেয়।
  বিনা বাক্যব্যয়ে শ্রাবণী জ্যাকেটটা নিয়ে গায়ে পরে নেয়। সেই থেকেই শ্রাবণী একটু উদাস হয়ে যায় যা নিলয়ের চোখ এড়ায় না। নিলয় সুযোগ বুঝে শ্রাবনীকে বলে,
--- এতটা ভাবার কী আছে? যা হয়ে গেছে তা নিয়ে ভেবে লাভ কী? এনজয় কর।
--- আমার একটা কথা আছে তোর সাথে --- তুই বাসের ভিতর আমার পাশে বসিস তখন বলবো --
 নিলয়ের বুকের ভিতর তখন কে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে --

ক্রমশ 



  
    

Monday, November 28, 2022

মাথা তুলে বাঁচো

মাথা তুলে বাঁচো 
  দেবেশের মৃত্যুর পর ছোট ছোট দু'টি ছেলেমেয়ে নিয়ে রেখা খুবই অসহায় হয়ে পড়ে।একটা সাধারণ প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করা দেবেশ সঞ্চয় বলতে কিছুই রেখে যেতে পারেনি।কাজের দিনে এসে অফিসের কিছু লোক কয়েক হাজার টাকা দিয়ে গেলো।কাজটাই শুধু হল।কারণ তাদের অবস্থার কথা যেহেতু সকলেই জানত তাই ওইদিন আসার কথা বললে অধিকাংশ পরিবারই জানিয়েছে তারা শ্রাদ্ধ বাড়ি খায় না। এসেছেন তারা সকলেই কাগজের ছোট প্যাকেট মুড়ে যার যেমন ক্ষমতা সেইরূপ টাকা নিয়ে।একটা মিষ্টি আর একগ্লাস জল ছাড়া তারা কিছুই মুখে দেননি।
 দিশেহারা রেখা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না কী করে ছেলেমেয়ে দু'টিকে মানুষ করবে। শেষে ঠিক করলো যদি দু'একটা বাড়িতে সে রান্নার কাজ নেয় তাহলে মাস গেলে অন্তত কিছু টাকা তো আসবে। মাধ্যমিক পাশ করা বিদ্যেই এর চেয়ে বেশি আর কিইবা সে করতে পারে। মাথা গোঁজার মত একটু নিজস্ব ঠাঁই ছিল তাই বাঁচোয়া। তানাহলে তো বাচ্চা দুটোকে নিয়ে মাথার উপর ছাদ হারা হতে হত।
  একজন ক্লাস ফোর আর একজন ক্লাস সেভেন। কোন রকমে দিন চলে যেতে থাকে। সকাল সন্ধ্যা দুটি বাড়িতে রান্না করে যে টাকা আসে তাতে ডালভাত দু'বেলা জুঠে যায় তিনজনে। তাছাড়া বোসগিন্নি বেশ ভালো মানুষ।সময়ে অসময়ে কিছু খাবার আবার অনেক সময় কাচা শাকসবজি,মাছও দিয়ে দেন বাচ্চা দু'টির জন্য। আস্তে আস্তে ওরা বড় হতে থাকে আর ওদের পড়ার খরচ বাড়তে থাকে। গয়না দু'একটি যা ছিল সেগুলো একটু একটু করে বিক্রি করতে থাকে।কিন্তু সে টাকায় ক'দিন?
আস্তে আস্তে আরো দুটি বাড়ি রান্নার জন্য ধরে নেয়। ভোর পাঁচটা থেকে তার ছোটা শুরু হয়। একফাঁকে বাড়িতে এসে ঝটপট বাচ্চাদের স্কুলে বেরোনোর আগে কিছু রান্না করে রেখে যায়।সে কোনদিন ডালভাত কিংবা আলু সেদ্ধ ভাত। ছেলেমেয়ে দুটিই মায়ের এই পরিশ্রম দেখে যা মা জোগাড় করতে পারে তাই দিয়েই খেয়ে নেয়। কখনোই কোন অভিযোগ কোনদিন করেনি।ছেলেটি ছোট আর মেয়ে বড়।দেখতে দেখতে সময় চলে যায়।সামনেই মেয়ে মাধ্যমিক দেবে। রান্নাতেও মায়ের মত পটু। এখন সকালে রেখা বেরিয়ে একবারে সব বাড়ি কাজ সেরে তবে ঘরে ঢোকে।মেয়েই ভায়ের স্কুলের খাবার নিজেদের দুপুরের খাবার করে নেয়।
 মায়ের এই পরিশ্রম তারা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে বলেই তারা দিনরাত চেষ্টা করে পড়াশুনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। আস্তে আস্তে তারা ক্লাসে ভালো ফল করতেও শুরু করে।বড় মেয়ে রুমনা মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে পাশ করে। যে সব বিষয় রুমনা বুঝতে পারতো না স্কুল শিক্ষকদের কাছে বিনা পয়সায় তারা তাকে পড়িয়েছেন।
 অনেক কষ্ট,অনেক পরিশ্রমের পর রুমনা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে স্পকিং ইংলিশ কোর্স শিখে একটা নার্সিংহোমে রিসেপশনিষ্টে কাজ পেয়ে যায় আর প্রাইভেটে গ্র্যাজুয়েশনটা করার চেষ্টা করতে থাকে। মাকে দুটো বাড়ির রান্না ছাড়িয়ে দেয়। ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। ছেলের মাধ্যমিক রেজাল্টও খুব ভালো হয়। রুমনা এখন একটা সরকারি হাসপাতালের ক্লাক।আর ভাইকে এডুকেশন লোন নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াচ্ছে। রেখা এখন সব বাড়ির রান্নার কাজ ছেড়ে দিয়েছে। বাড়িতেই থাকে সব সময়।মেয়েকে বিয়ের কথা বললে বলে," ভাই পড়াশুনা শেষ করে চাকরি পাওয়ার পর ভেবে দেখবো।"
  সময় তো বসে থাকে না। যতই বিপদ আসুক না কেন ভয় না পেয়ে এগিয়ে চলার একটা বিকল্প রাস্তা খুঁজে নিতে পারলে জীবনটা কারো থেমে থাকে না।

 

Sunday, November 27, 2022

শান্তি খুঁজে নিতে হয়

শান্তি খুঁজে নিতে হয়

 সংসারের জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ করেও কারো মন রাখতে পারেনি কোনদিন সুষমা।অথচ মিষ্টি স্বভাবের এ মেয়েটির এরকম হওয়ার কথা ছিল না। মেধাবী সুষমা বিটেক করেই চাকরি জুটিয়ে নিয়েছিল। বিয়েতে তার মত ছিল না মোটেই।বাবা,মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ার ফলে ওর মনের মধ্যে একটা ধারণা বদ্ধমূল ছিল ও যদি শ্বশুরবাড়ি চলে যায় তাদের কে দেখবে? তাই বিয়ে করার মানসিকতা তার কোনদিন ছিল না। কিন্তু বাবা,মা কী আর সে কথা শোনেন? মেয়ে সন্তান তাকে তো বিয়ে দিতেই হবে। চাকরি পাওয়ার ছয়মাস থেকেই শুরু হয় মায়ের ঘ্যানঘ্যানানি। অফিস,বাড়ি আর মাকে বিশ্রাম দেওয়ার জন্য বাকি সময়টুকু সংসারের কাজ।
  ভীষণ মিশুকে, হাসিখুশি, সংসারী মেয়েটাকে আত্মীয়স্বজন পাড়াপ্রতিবেশী সকলেই খুব ভালোবাসে।পরিবারের চাপে শেষ পর্যন্ত তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতেই হল।সুফল একজন উচ্চপদস্ত ব্যাংক কর্মচারি। সংসারে পা দিয়েই সুষমা বুঝে গেলো স্বামী,শ্বশুর,শ্বাশুড়ী, দেওর আর ডিভোর্সী ননদ সকলের কথা শুনেই তাকে চলতে হবে তা না হলে অশান্তি অবশ্যম্ভাবী।স্বামী, দেওর, ননদ ,শ্বশুর সকলেই চাকরি করেন।সংসারে তারা কুটোটি নাড়েন না। শ্বাশুড়ী একার হাতেই সংসার সামলান। সকলেই অফিস থেকে ফিরে টায়ার্ড থাকেন। তাই কেউই তাকে সংসারের কাজে সহায়তা করে না।
  বিয়েতে মাসখানেক ছুটি নিয়েছিল সুষমা। তাই বৌভাতের পর সমস্ত আত্মীয়স্বজন চলে যাওয়ার পর শ্বাশুড়ির সাথে রান্নাঘরে থেকে বুদ্ধিমতী সুষমা বুঝে যায় পরিবারের কার কখন কোনটা দরকার। যার যা কিছুই সে তার হাতের কাছে পৌঁছে দিক না কেন কেউই কখনোই সাধারণ একটা ধন্যবাদও ছুঁড়ে দেয়নি কোনদিন। বরং একটা কাজ সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে অন্য আর একটা কাজের অর্ডার দিয়ে দেয়।সবকিছুই সে হাসিমুখে পালন করতে থাকে। জোর করে শ্বাশুড়ীকে রান্নাঘর থেকে ছুটি দেয়।মনেমনে ভাবে ছুটি ফুরালে তো তাকেই আবার রান্নাঘরে ঢুকতে হবে।তাই এ কটাদিন যাতে তিনি একটু বিশ্রাম পান সেই চেষ্টায় সে করে।
 কিন্তু কাল হল তার শ্বাশুড়ীকে বিশ্রাম দেওয়ার চেষ্টাটা করা। ছুটি ফুরিয়ে গেলে অফিসে যাওয়ার আগের দিন থেকেই শুরু হল চাপা গুঞ্জন।সংসারের এত কাজ কে করবে? ভাবখানা তাদের এমনই যেন এই সংসারে এ যাবৎকাল সুষমা ই সব কাজ করে এসেছে। ভোরবেলা উঠে যতদূর পারে রান্না করে সকলের অফিসের টিফিন গুছিয়ে নিজেরটা নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ননদ বলে উঠলো,
-- বৌদি, আজ কিন্তু আমি রাতে ভাত খাবো না ,আমার জন্য রুটি কোরো।
 সুষমা সে কথার কোন জবাব দিলো না দেখে শ্বশুর বললেন,
--- তুমি শুনতে পাওনি রমা কী বললো?
--- হ্যাঁ বাবা শুনেছি কিন্তু এখন তো অফিস যাচ্ছি আগে বাড়ি ফিরি তারপর এসব ভাববো।
 উত্তর শ্বশুরের পছন্দ হল না সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা গেলো।
 অফিস থেকে বাড়িতে ফিরেই সেদিন থেকে শুরু হল রান্নাঘরে ঢোকা। তারপর রাতের সমস্ত কাজ সেরে যখন সে ঘুমাতে যায় তখন স্বামীর আদর মনেহয় অত্যাচার।প্রথম প্রথম মুখ বুজে স্বামীর সোহাগ মেনে নিলেও পড়ে তাদের দূরত্ব বাড়তে লাগে।অবশেষে মায়ের চেষ্টায় সর্বক্ষণের একজন মহিলাকে বাড়িতে কাজের জন্য রাখে। প্রথম প্রথম সকলের আপত্তি থাকলেও পড়ে এটাতে তারা সুবিধায় পেয়ে যায়।আর মাইনেটা তো সুষমা দেয়। একমাত্র এই মহিলাই সুষমার কষ্টটা বোঝে।সুষমা কিছু করতে গেলেই হাত থেকে কাজ ছিনিয়ে নেয়। তবুও সুষমা সকালে অফিস যাওয়ার আগে আর অফিস থেকে ফিরেও ওই মহিলার হাতে হাতে কাজ করতে থাকে।রাতের খাবারটাও সেই দেয়।অথচ বাড়িতে যে চাকুরীরত ননদ রয়েছে সে এক গ্লাস জল ভরেও খায় না। সেটা কারোই চোখে লাগে না।কিন্তু অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীরে সে একটু শুয়ে থাকলেও সকলের মুখ ভার হয়ে যায়। তবে সুফল এখন অনেকটাই বোঝে সুষমাকে। কাজের মহিলাটি রাখার ফলে সুষমাও রাতে তার আদরে সাড়া দেয়।তাই তার মেজাজটাও থাকে ফুরফুরে। আর শ্বাশুড়ী মা ? তিনি তো একবার আরামের স্বাদ পেয়েছেন তাই ভুলেও রান্নাঘরে তিনি ঢোকেন না। তবে ভুল ধরতেও তিনি ছাড়েন না। কিন্তু সুষমা কখনোই কারো কথার উত্তর কোনদিন করে না। বুদ্ধিমতী সুষমা একটা কথা বেশ ভালোভাবেই জানে সকলকে নিয়ে চলতে গেলে সকলের সব কথার উত্তর দিলে নিজেরই মানসিক শান্তি নষ্ট হবে।কতটুকু সময়ই বা সে বাড়িতে থাকে? নিজেকে ভালো রাখতে গেলে ছোটখাটো ঝামেলা এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ।


Friday, November 11, 2022

ভালোবাসার রাজপ্রাসাদ

ভালোবাসার রাজপ্রাসাদ

   অভাবের সংসারেও ভাবভালোবাসা ছিলো -
  আসলে চাহিদা আর মনের উপরেই নির্ভর করে মানুষের সুখ। অভাব কিংবা একটু কম ভালোবাসা থাকলেও বিশ্বাসের ভীতটা যদি মজবুত থাকে সেখানে সুখের কোন কমতি থাকে না। ভাবভালবাসা আছে মানেই পরস্পরকে সব সময় গদগদ হয়ে থাকতে হবে তা মোটেই নয়।
 সোনালী ভালোবেসে বিয়ে করেছিল সোমেশকে। বড় লোকের মেয়ে না হলেও সোমেশদের থেকে তাদের অবস্থা ছিল ভালো। তাই স্বাভাবিক কারণেই সোনালীর মা,বাবার ছিল এ বিয়েতে আপত্তি। তিনবোনের মধ্যে সোনালী ছিল মেজ। বড়জনের অনেক আগেই বিয়ে হয়ে গেছিলো। সোনালী বাড়িতে নানান অশান্তি সহ্য করতে করতে গ্র্যাজুয়েশনটা কমপ্লিট করে। ইতিমধ্যে সাধারণভাবে সোমেশও গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসাবে একটা কোম্পানিতে জয়েন করে। সোনালী বাবা,মায়ের অমতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে সোমেশকে বিয়ে করে।
  সোমেশ আর তার মা। ছোট্ট দুটো ঘর। কোনরকমে একটা রান্নার জায়গা। দেড়কাঠা জমির উপর ছোট্ট একতলা একটা বাড়ি হলেও সুন্দর সাজানোগুছানো এবং বাড়ির পিছনে অল্প একটু ফাঁকা জমি যেখানে সোমেশের মা লাউ,বেগুন,লঙ্কা ,সিম ইত্যাদি সবজি চাষ করেন।খুব ভালোবাসেন তিনি বাগান করতে। সোনালী সেই পরিবারে এসে প্রথম প্রথম মানিয়ে নিতে তার বেশ কষ্ট হয়েছে। কিন্তু সোমেশের প্রতি অদম্য ভালোবাসা তার মনে কখনো কোন কষ্টকে কষ্ট মনে হয়নি। 
 সোনালী অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই তার শ্বাশুড়ির মন জয় করে নেয়। খুব ভালোবাসেন মৃন্ময়ীদেবী সোনালীকে। নিজের মেয়ের মতোই তিনি তার ছেলের বউয়ের সাথে তুই করে নাম ধরে ডেকেই কথা বলতেন। সোনালীও তার শ্বাশুড়িমাকে নিজের মায়ের মতই তুমি করে কথা বলে।
  সংসারে অভাব থাকলেও ভালোবাসার কমতি ছিল না মোটেই। কিন্তু বছর খানেক পরে হঠাৎ করেই সোমেশের চাকরিটা চলে গেলো। সংসারে তখন চরম অভাব। সকলে মিলে পরামর্শ করে সোনালী আর সোমেশ কিছু টিউশনি করতে শুরু করলো। কিন্তু এই সামান্য টাকায় তো আর সংসার চলে না। সোমেশ আর সোনালী দু'জনে মিলেই তখন যেমন-তেমন একটা কাজ খুঁজতে শুরু করলো। একটা কাপড়ের দোকানে সোনালী সেলসের একটা কাজও পেয়ে যায়। এইভাবে কিছুদিন চলার পর সোমেশ আবার অন্য একটি কোম্পানিতে সেই একই মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ কাজ পেয়ে যায়। সংসারটা তখন আবার অনুখাতে চলতে শুরু করে। এই যে সংসারের অর্থের উঠাপড়া তাদের ভালোবাসার ক্ষেত্রে কোন প্রভাব পড়তে কেউই দেয়নি।যেদিন যেমন জুটেছে সেদিন সেই সামান্য খাবারই তিনজনে ভাগ করেই খেয়েছে ; সেখানে কারো কোন অভিযোগ ছিলো না। সংসারে ভালোবাসার বন্ধনটা যদি বিশ্বাসের ভীত দ্বারা তৈরি হয় কোন অভাব সেখানে বাসা বাঁধতে পারে না।
  আস্তে আস্তে সোমেশের পদোন্নতি হয়েছে।সংসারের শ্রীবৃদ্ধির সাথে সাথে ছোট্ট এক লক্ষীর আগমন ঘটেছে।  তাকে নিয়েই পরিবারের বাকি তিনজন হাসি,আনন্দেই দিন কাটিয়ে দেয়। কোন কারণে কোন অশান্তি সোনালী সোমেশের সংসারে প্রবেশ করতে পারে না ।

Monday, November 7, 2022

আইবল

আইবল 

  লুকিয়ে দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলাম --- ব্যাস আর যায় কোথায়? বরবেশি কুন্তল তখন চোখ বড় বড় করে আমাদের একের অন্যের গায়ের উপর পড়া দেখতেই ব্যস্ত। আর সুমিত্রা ফুলশয্যার খাটে বসে আমাদের দেখে হেসেই অস্থির।
 ঘটনাটা খুলেই বলি। কলেজ লাইফ থেকেই আমাদের পাঁচজনের একটা দল ছিল। আমি মানে ছন্দা, কুন্তল, সুমিত্রা, শ্রাবন আর দেবেশ। আমার সাথে প্রেম পর্ব শেষ করে, না শেষ করে নয়; প্রেম চলতে চলতেই  বিয়ের কাজটি সম্পন্ন করে ফেলে শ্রাবন।দেবেশের বিয়ে হয় সম্মন্ধ করে। কুন্তল আর সুমিত্রার বিয়েটাই সকলের শেষে!আগে ছিলাম বন্ধু পাঁচজন এখন ছ'জন। দেবেশের বউ রিয়া একটু চুপচাপ হলেও দলের মধ্যে থাকলে তার নীরবতা ভাঙার জন্য সবাই প্রস্তুত।
  দেবেশের ফুলশয্যার রাতে আলমারির পিছন থেকে কুন্তলকে বের করা হয়েছিল। তারজন্য আলমারিটাকে একটু সামনে টেনে আনা হয়। লাইট অফ করে যখন দেবেশ খাটের উপর গিয়ে বসে ঠিক সেই মুহূর্তে দেবেশের ফোন বেজে ওঠে। খুব বিরক্ত হয়ে দেবেশ তার জামাইবাবুর ফোনটা রিসিভ করে জানতে পারে বন্ধুদের মধ্যে কুন্তলকে দেখা যাচ্ছে না। সে যেন ঘরের ভিতর ভালোভাবে দেখে তারপর লাইট অফ করে। ফোনে কথা শুনেই এক লাফে উঠে গিয়ে দেবেশ ঘরের লাইট জ্বালিয়ে চিরুনি তল্লাশী শুরু করে। জামার কলার ধরে কুন্তলকে আলমারির পিছন থেকে টেনে বের করে আনে।
 আজ প্রতিশোধ নেওয়ার পালা।সবাই যখন বৌভাতের অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত দেবেশ তখন আমাকে আর শ্রাবনকে নিয়ে এসে এক ফাঁকে কুন্তলের ঘরের দরজার আইবল খুলে রেখে যায়। দেবেশের মিসেস তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরে যায় কারণ সে প্রেগন্যান্ট। 
  সব কাজকর্ম শেষের পড়ে সবাই মিলে কুন্তলকে ঘরে ঢুকিয়ে টাটা, বাইবাই, কাল সকালে দেখা হবে , বেশি রাত জাগিস না - ইত্যাদি নানান কথা বলে যে যার মত পিছন ফিরে চলে যায়। 
 কুন্তল ,সুমিত্রা দুজনেই ভাবে এত তাড়াতাড়ি ওদের চলে যাওয়ার নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। ওরাও দু'জনে বসে বসে অনেকক্ষণ গল্প করতে থাকে। ঘরে যত রকম ফার্নিচার আছে সেগুলোর পিছন, তলা সব দেখেশুনেও কাউকেই তারা খুঁজে পায় না। শেষে কুন্তল আইবল দিয়ে বাইরে দেখতে গিয়ে দুটো বড় বড় চোখ দেখে ঝটপট দরজা খুলে ফেলায় দেবেশ, শ্রাবন আর আমি পরপর তিনজন পুরো কুন্তলের দরজার কাছে একের উপর আর একজন করে তিনজনেই ভূপতিত।
 হাহা ,হিহি কিন্তু কেউ সেখান থেকে ওঠে না। তখন সুমিত্রা খাট ছেড়ে নেমে এসে আমার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে বলে
-- আরে তোরা তো আমাদের বলতে পারতিস আমরা একটা বড় হলরুম বাইরে কোথাও ভাড়া নিয়ে একঘরেই থাকতাম সবাই। 
 কোমর কাত করতে করতে দেবেশ আর শ্রাবন উঠে দাঁড়িয়ে একসাথেই বলে উঠলো,
--- ঘাট হয়েছে।আমাদের।এই আমরা চললুম।
-- এই তার আগে আমার আইবলটা লাগিয়ে দিয়ে যা।
  দেবেশ আর শ্রাবন তখন আইবল লাগাতে লাগলো।


Tuesday, October 18, 2022

সহজে মানুষ চেনা যায় না



  সহজে মানুষ চেনা যায় না( আলো আঁধার)

  প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম সম্রাটকে। দাদার বিয়েতে প্রথম দেখা। লতায়পতায় সম্পর্কে বৌদির ভাই। দাদার বিয়ের পর নানান সূত্রে তার সাথে দেখা হত। আমি তখন সবে মাধ্যমিক দেবো।আর সম্রাট উচ্চমাধ্যমিক। আমার এই ভালো লাগাটা সম্রাট বুঝতে পেরেছিল কিনা আমি জানিনা। তবে সে একদিন ঠিক সুযোগ বুঝে তার মনের কথাটা আমায় জানিয়েছিল।
 সম্রাটের মুখে ' ভালোবাসি ' কথাটা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গেছিলাম।ও হঠাৎ করেই আমার হাত ধরে বলেছিল,
--- দিদির বিয়েতে প্রথম দেখে তোমায় খুব ভালো লেগেছিলো। সেই থেকে ভালোলাগাটা  একটু একটু করে কখন যে ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। অনেকদিন ধরেই কথাটা তোমায় বলবো ভাবছি কিন্তু সেই সুযোগ আর আসেনি। 
 আমি তো তখন লজ্জা আর ভালোলাগা মিশিয়ে ঠকঠক করে কাঁপছি। কোন রকমে চোখ তুলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি দিয়ে হাত ছাড়িয়ে পালালাম। সেই শুরু।
 সম্রাটকে যেমন দেখতে,পড়াশুনায়ও ঠিক তেমনই। সম্রাট যখন কথা বলে তখন ওর গলার আওয়াজ আমার কাছে এতটাই ভালোলাগে আমি মুগ্ধ হয়ে শুধু তাকিয়েই থাকি। সুন্দর গান করে, আবৃত্তি করে। যাকে বলে অলরাউন্ডার। 
  একটু একটু করে সম্রাট আর আমার ভালোবাসার পাঁপড়ি মেলতে শুরু করলো। আমিও নেহাৎ মন্দ ছিলাম না পড়াশুনায়। সম্রাট যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ভালো চাকরি পেয়ে গেলো আমিও কিছুদিনের মধ্যে একটা প্রাইভেট ফার্মে ঠিক চাকরি যুঠিয়ে নিলাম।
 দুই বাড়ির মতেই বেশ ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেলো। স্বপ্নের মত দিনগুলি চলে যেতে লাগলো। 
 নিজের ভাগ্যের প্রতি মাঝে মাঝে নিজেরই হিংসা হত। বিয়ের ঠিক দুবছরের মাথায় সুইজারল্যান্ডে সম্রাটের বিশাল চাকরির অফার। আমি রাজি থাকলেও আমার বাড়ি কিংবা সম্রাটদের বাড়ির কেউ রাজি ছিলো না সম্রাটের এই চাকরি অ্যাকসেপ্ট করার। কিন্তু আমার ও সম্রাটের যেহেতু দু'জনেরই মত আছে তাই কারো অমতই ঢপে টিকলো না। সম্রাট সুইজারল্যান্ড চলে গেলো। ছ'মাস পড়ে এসে আমায় সাথে নিয়ে যাবে। প্রতিটা মুহূর্তে চোখ বুঝে সুইজারল্যান্ডের মাটিতে দু'জনের সুখী জীবনের স্বপ্ন সফল করে চলেছি। রোজই সম্রাটের সাথে ফোনে কখনো ভিডিও কল কখনো বা এমনিই কথা হয়।
  ঠিক একবছরের মাথায় সম্রাট আমায় নিতে আসে।কিন্তু তার আগে অনেকবার ফোনে তার সাথে আমারo ঝামেলা হয়ে গেছে। এখন সে রোজ ফোন করে না, করলেও অল্প সময় কথা বলে। আগের সেই উৎফুল্লতা,আবেগ,অনুভূতি সব যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। 
  সুইজারল্যান্ডে পৌঁছে মন দিয়ে নিজের সংসার গুছিয়ে নেওয়ার জন্য আমি যখন ব্যস্ত তখন প্রতি মুহূর্তে সম্রাটের ভিতর আমূল পরিবর্তন দেখতে পাই। মাঝে মধ্যেই নেশায় বুদ হয়ে ঘরে ফেরে। কোথায় তার গান,কবিতা? সবকিছু তার জীবন থেকে তো বটেই আমার জীবন থেকেই একটু একটু করে সম্রাট হারিয়ে যেতে থাকলো। নিত্য নতুন নারী সঙ্গ যে তার জীবনে আসছে তা তার গতিবিধি দেখেই বুঝতে পারতাম। অনেক বুঝিয়েছি ; মানাভিমান, ঝগড়াঝাঁটি করেও কোন ফল হয়নি। জীবনে হঠাৎ করে অতিরিক্ত অর্থ সম্রাটের জীবনটাই শেষ করে দিলো। ভালোবাসায় যে আলোর দিশা সম্রাটের ভিতর দেখতে পেয়েছিলাম তা হঠাৎ করেই অন্ধকারে ঢেকে দিলো।সম্রাটের কাছে টেকাই আমার দায় হয়ে পড়ল।শেষে বাড়ির সাথে যোগাযোগ করে একদিন সম্রাটকে না জানিয়েই পুনরায় কলকাতা ফিরে আসা।

    

Saturday, October 15, 2022

ভাগ্যরেখা



 ভাগ্যরেখা      (সুখ - দুঃখ)

  জীবনটা শুরু হয়েছিল একভাবে। তখন ভেবেছিলাম নিজের জীবন নিজেই গড়ে নিতে পারবো। পড়াশুনায় ভালো ছিলাম, বাবার আর্থিক ক্ষমতা ছিল। লোকে আমাকে সুন্দরী, বুদ্ধিমতীই বলতো। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক।সবই ঠিকঠাক চলছিল। মাধ্যমিকে বেশ কয়েকটি লেটার নিয়ে পাশ করলাম। বাবার আমাকে নিয়ে খুব গর্ব ছিল।শুধু বাবা কেন পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও আমাকে নিয়ে গর্বের শেষ ছিল না। নিজের ইচ্ছা এবং বাবার দেখানো স্বপ্ন নিয়ে ভবিষ্যতে একজন ডাক্তার হিসেবে নিজেকে কল্পনা করতাম। জীবন ছিল সুখী,সচ্ছল,উচ্ছল।
  কিন্তু এ সুখ আমার কপালে বিধাতা লিখেছিলেন সাময়িক। ভাগ্য লেখার দোয়াত-কলম যে ছিল তার হাতে। শুরুতে তিনি আমাকে সবকিছু দিয়েও আচমকা সবকিছুই কেড়ে নিলেন। উচ্চমাধ্যমিক দেওয়ার আগেই হঠাৎ আসা ঝড়ে সব তছনছ করে দিলো। একদিন রাতে ঘুমের মধ্যেই চলে গেলেন বাবা। জীবনের মোড় ঘুরে গেলো অন্যখাতে। উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন গেলো ভেঙ্গে। একান্নবর্তী পরিবারের মধ্যে দেখা দিলো ফাটোল। বাবা পরিবারের মেজ ছেলে হলেও যেহেতু ভালো চাকরি করতেন কাকা,জ্যাঠার থেকে তিনি বেশি সংসার খরচটা দিতেন। অন্যান্যরা সংসারের পিছনে খুব একটা অর্থ খরচ করতেন না। ভাইদের মধ্যে মিল ছিল ভীষণ।
   কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেলো সবই ছিলো বালির বাঁধ।বলতে গেলে যেহেতু বাবার টাকায় সংসারটা চলতো তাই সকলেই বাবার কথা শুনে চলতেন। উপর উপর সকলেরই একটা মিষ্টির প্রলেপ দেওয়া ছিল।
  বাবার সমস্ত কাজকর্ম মিটে যাওয়ার পর হঠাৎ করেই একদিন সকলের হাঁড়ি আলাদা হয়ে গেলো। আমি, মা আর ভাই। কী করে কী হবে ভেবে ভেবে দিনরাত মা আর আমি প্রায় পাগল হওয়ার পথে। পেটে বিদ্যা কম তাই টিউশনি করেও বিশেষ কোন লাভ হয় না।তবুও নিজের পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট কয়েকটা বাচ্চা পড়াতে শুরু করলাম। একটা একটা করে মায়ের গয়না বিক্রি হতে লাগলো। 
  চরম দরিদ্রতার ভিতর উচ্চমাধ্যমিকে খুব ভালো ফল করলাম। কিন্তু জয়েন্টে বসার মত আর্থিক সামর্থ না থাকায় অঙ্কে অনার্স নিয়ে ভর্তি হতে ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। তখন মায়ের গয়নাও শেষ।ভাই তখনো মাধ্যমিক দেয়নি। পড়াশুনা আমার বন্ধ হওয়ার পথে তখন। সবকিছু শুনে পাড়ার ক্লাব আর স্কুলের কয়েকজন শিক্ষকের সহয়তায় আমি কলেজে ভর্তি হলাম অঙ্কে অনার্স নিয়ে।
  আমি যখন দ্বিতীয় বর্ষ তখন মা চলে গেলেন আমাকে আর ভাইকে ছেড়ে। ভাই তখন সবে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে। পাড়ার কিছু সহৃদয় ব্যক্তি,কয়েকটি ক্লাব আর স্কুল কলেজের শিক্ষকদের সহয়তায় আমি বেশ ভালোভাবেই পাশ করে গেলাম। জীবনের প্রতি পদেপদে ঠোক্কর খেতে খেতে যখন এই জায়গায় এসে দাঁড়ালাম তার ঠিক তিন মাসের মাথায় ওই কলেজেই আমি পার্টটাইম জব পেয়ে গেলাম স্যার আর ম্যামদের সহায়তায়। 
  বছর দুয়েক বাদে আমার চাকরিটা পার্মানেন্ট হয়।ভাই এখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। জীবনে সব আশা পূরণ না হলেও একটা জায়গায় এসে আজ দাঁড়াতে পেরেছি। কিন্তু যে দুটো মানুষ বেঁচে থাকলে সব থেকে খুশি হতেন তারাই আজ আমার জীবনে নেই। মাঝে মাঝে ভীষণ মন খারাপ হলেও ভাইকে নিয়ে সব কষ্ট ভুলে ভালো থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে আমাকে যেতেই হবে।
 

Friday, October 14, 2022

শুধু ভালোবাসি

শুধু ভালোবাসি

ভালোবাসা যায় এভাবেও --- 
 যা পাইনি রিয়া তা নিয়ে প্রথম প্রথম ভীষণ দুঃখ ছিল,কষ্ট ছিল। কিন্তু জানো এক সময় নিজেই উপলব্ধি করলাম আমি তো তোমায় ভালবাসতাম, তাহলে তোমায় নিজের করে পাইনি বলে আমার এত কষ্ট কেন হচ্ছে? প্রতিদিন তোমার খবর পাচ্ছি, ফেসবুকে তোমার ছবি দেখছি। যেহেতু তোমায় ভালোবাসি আমি তো তোমায় সুখী দেখতেই চেয়েছিলাম। সেটাই যদি হয় আমার এই কষ্ট পাওয়ার তো কোন মানেই হয় না। আর ঠিক তখনই তোমাকে নিজের করে না পাওয়ার কষ্টটা আস্তে আস্তে কমতে থাকলো আর তোমার প্রতি ভালোবাসাটা দিনকে দিন বাড়তে থাকলো।
 হ্যাঁ তুমি জানতে চাইতেই পারো আমি কেন বিয়ে করিনি। আসলে আমার জীবনের প্রথম প্রেম ছিলে তুমি। তোমাকে নিয়ে যে স্বপ্নগুলো আমি দেখেছিলাম সেই স্বপ্ন আমি অন্য কাউকে নিয়ে পূরণ করতে গেলে প্রতি পদেপদে ঠোকর খেতাম; তোমাকে নিয়ে দেখা স্বপ্ন অন্যকে দিয়ে কি পূরণ হত বলো? তাই ওই রাস্তায় আমি আর হাঁটিনি। আর ঠিক এইভাবেই তোমাকে ভালোবেসে আমি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবো। প্রকৃত ভালোবাসায় শরীর থাকে না থাকে ভালোবাসার জন্যই ভালোবাসা।
 রিয়া আর সৌম্য একই পাড়ার দুটি কিশোর কিশোরী। ছেলেবেলা থেকেই দু'জন দু'জনের বন্ধু। রিয়া চ্যাটার্জী আর সৌম্য দাস। দু'জনের মিলনের পথে এটাই ছিল প্রতিবন্ধকতা। সৌম্যর বাড়িতে রাজি থাকলেও রিয়ার বাড়িতে এই অসবর্ণ বিয়েতে কিছুতেই রাজি হয়নি। রিয়া সৌম্যকে বলেছিল পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করতে। কিন্তু সেক্টর ফাইভে কর্মরত মোটা মাইনের চাকরি করা সৌম্য চায়নি রিয়াকে তার প্রিয়জনদের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে। 
 রিয়ার বিয়ে হয়ে যায় বয়সে দশ বছরের বড় স্কুল শিক্ষক সুনীলের সাথে। একটি সন্তান হওয়ার পর সুনীলের হঠাৎ স্ট্রোক হয়।বাম অঙ্গ পুরো অসার হয়ে যায়। তখন রিয়া প্রাইভেট পড়িয়ে ছেলেকে মানুষ করতে থাকে সাথে সুনীলের ব্যয়বহুল চিকিৎসা যা প্রায় অসম্ভব ছিল। পরিণতি বত্রিশ বছর বয়সেই রিয়া সুনীলকে হারায়।
 ছেলে এখন বি.কম করছে। এখন মায়ের মত সেও প্রচুর টিউশনি করে। সৌম্য একের পর এক চাকরি ছেড়েছে ভালো অফার পেয়ে। এখন সৌম্য সুইজারল্যান্ড। বাবা গত হলেও মা এখনো জীবিত। এখনো রোজই ছেলের মাথার পোকা তুলে খান বিয়ে করার জন্য। সৌম্য যখন দেশে ফেরে তখন সে মাকে নিয়েই মাসখানেক কলকাতা তাদের পুরনো বাড়িতে কাটিয়ে যায়।
  ফেসবুকে সৌম্য ,রিয়া বন্ধু থাকলেও কেউ কোনদিন কারো ব্যক্তিগত কথা কারো সাথেই শেয়ার করেনি। কিন্তু দু'জনেই দু'জনের খবর সব জানতো কমন বন্ধুদের মাধ্যমে।এবার দেশে ফেরার আগে সৌম্য জানিয়েই এসেছিলো রিয়ার সাথে দেখা করতে চায়। তাই বহু বছর বাদে পুরনো কফিশপে দু'জনের দেখা।
 কথা হয় কম, নীরবতায় বেশি। নীরবতায় যেন তাদের মনের সব কথা বলে যাচ্ছে। রিয়ার দু'একটি প্রশ্নের উত্তরে সৌম্য যেটুকু বললো রিয়া তাই শুধু শুনে গেলো।
  কথা শেষে বেরিয়ে যাওয়ার আগে দু'জনের বুক চিরে দুটি দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে এলো যা দু'জন এত কাছে থেকেও টের পেলো না নিজেরা ছাড়া!



 
 

লক্ষী বৌমা

  লক্ষ্মী বৌমা 

অবশেষে এলো সেই দিন --
  একার হাতে সবকিছু।সুতরাং আমাকে সেই কাক ডাকা ভোরেই প্রতিদিন উঠতে হয়।শ্বাশুড়ী মা বাতের রোগী।সারাটা রাত তিনি যন্ত্রণায় কষ্ট পান।ভোরের দিকে তাই ঘুমিয়ে পড়েন।সংসারের কোন কাজই তিনি করতে পারেন না। স্বামীর অফিসের তাড়া থাকে।তিনি আটটায় উঠে কোন রকমে স্নান,খাওয়া সেরে অফিসের উদ্দেশ্যে ছুটতে থাকেন।যেতে আসতেই তার চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা সময় চলে যায়। তারপর বাবাইয়ের টিফিন করা, সাড়ে ন'টায় তার বাস আসে তার আগেই তাকে রেডি করে ঠিক সময়ে তাকে নিয়ে ছুটতে হয় বড় রাস্তার মোড়ে। বাসে তুলে দিয়েই দৌড়াতে দৌড়াতে ঘরে ফিরেই সংসারের বাকি কাজে হাত লাগানো।ততক্ষণে শ্বাশুড়ী মা ঘুম থেকে উঠে পড়েন।তার চা,জল খাবার দিয়ে যদি সময় পাওয়া যায় তাহলে বসে টিফিনটা করি নতুবা মুখে খাবার পুড়ে চিবাতে চিবাতে এদিক ওদিক ছুটে কাজ করা।কোনদিন বসে চা টাও খেতে পারিনি।গরম চা প্লেটে ঢেলে তাড়াতাড়ি শেষ করেছি বিয়ের পর থেকে জীবনের এই বেলা পর্যন্ত। তিনটে বাজতেই ছেলেকে আনতে আবার সেই বড় রাস্তায় মোড়ে।
 কাজের লোক কোনদিনও রাখতে পারিনি আর্থিক কারণে।খুব ভালো গান গাইতাম একসময়। পড়াশুনায় ছিলাম মধ্যম মানের।ভেবেছিলাম চাকরির বাজারের যা অবস্থা গান নিয়েই জীবনটাকে গড়ে নেবো।কিন্তু কপাল এমন মন্দ গ্র্যাজুয়েশনের আগেই স্ট্রোক করে বাবা চলে গেলেন চিরতরে।দাদা তখন চাকরি করছে ঠিকই কিন্তু মা আর দাদা দু'জনে মিলে আমার গ্র্যাজুয়েশনের রেজাল্ট বেরোনোর আগেই আমার বিয়ে ঠিক করে ফেললেন।আমার কোন আপত্তিতে কোনোই কান দিলেন না।
  বিয়ের সাথে সাথেই আমার জীবনে দেখা স্বপ্নগুলো একটা একটা করে ফুলের পাপড়ি ঝরে যাওয়ার মত জীবন থেকে হারিয়ে যেতে থাকলো।
  বাড়িতে নূতন বউ হয়ে ঢুকেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার শ্বাশুড়ী তার ছেলের বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ আনেননি এনেছেন একটি কাজের লোক।যে সারা দিনরাত কাজের বিনিময়ে খেতে পরতে পারবে আর রাত হলে তার ছেলের শারীরিক খুদা মেটাবে।আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভালোলাগা, মন্দলাগা কোনকিছুর দাম দেওয়ার মত এদের যেমন কোন মনোভাব নেই ঠিক তেমনই কোন সামর্থ্য কিংবা কোন সুযোগও নেই। তাই সবকিছুই ভাগ্যের দোহাই দিয়ে মুখ বুজে মেনে নিয়েছিলাম।
 দু'বছরের মাথায় বাবাই আসে আমার কোল জুড়িয়ে।হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে রান্না করে রেখে তবে হাসপাতাল যেতে হয়েছিল।বিয়ের পরদিন থেকেই দেখেছি শ্বাশুড়ী মায়ের বাতের যন্ত্রণায় আহা,উহু করে হাঁটাচলা করতে।সেই অস্তমঙ্গলায় একবার বাপের বাড়িতে গেছিলাম সেই শেষ।আর গেছি মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে।চারদিনের মাথায় ঘরে বসে সামান্য কাজ করেছি কিন্তু মায়ের কাজে সেদিনও বাপেরবাড়ি আমার যাওয়া হয়নি কারণ শ্বাশুড়ী মা তখন এতটাই অসুস্থ্য আমার পক্ষে কয়েক ঘণ্টার জন্যও কোথাও বেরোনো সম্ভব নয়।
  কাকে নালিশ জানাবো ? নালিশ জানানোর যেমন কেউ নেই ঠিক তেমনই জানিয়েও তো কোন লাভ নেই কারণ সবকিছুই তো আমি চোখের সামনে দেখতে পারছি।
  ছেলে বড় হল।ব্যাংকে ভালো চাকরিও পেলো।তখন একটা কাজের লোক জোর করে সে রাখলো মায়ের কষ্ট দেখে।শ্বাশুড়ী মা তখন শুধু শুয়েই থাকেন আর যন্ত্রণায় পুরো বাড়ি মাথায় করেন চিৎকার করতে করতে।ওষুধ,মালিশ কিছুই বাদ নেই কিন্তু তবুও তিনি কোনদিনও বাতের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাননি।
  ছেলের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে শুরু করা হল।মেয়ে পছন্দ করে আসার পর ছেলে বললো,
--- বিয়ের আগে একবার ওকে আমাদের বাড়িতে আনা যায় না মা?
--- এ আবার কেমন কথা? বিয়ের আগে কিভাবে বিয়ের কনেকে তার উঠবি স্বামীর বাড়িতে আসার কথা বলবো? তোর দরকার হলে তুই আলাদা করে কথা বল অন্য কোথাও।
 ছেলের বিয়ে হল।কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার বৌমা অস্তমঙ্গলা সেরে এসে পুরো রান্নাঘরের দায়িত্ব নিলো।আমাকে কিছুই করতে দেয় না। আমি কিছু করতে গেলেই বলে,
-- মা রান্নাঘরের দায়িত্ব এতদিন আপনি সামলেছেন।এবার থেকে এ দায়িত্ব শুধু আমার।আপনি শুধু ঠাকুমাকে দেখুন।আমিও দেখবো তাকে যখন আপনি পারবেন না।কিন্তু রান্নাঘরে আপনাকে আর আমি কোনদিন ঢুকতে দেবো না।
  স্বামী আমার সব দেখেশুনে বললেন,
--- আমার মনেহয় কি জানো তোমার বুবাই বিয়ের আগেই তার সাথে দেখা করে এ কথা আদায় করে নিয়েছে।যাক কপাল করে ছেলের বউ পেয়েছ বটে!
 তারপর সত্যিই একদিন বুবাইয়ের কাছ থেকে জেনে নিলাম ওই কারণেই সে বিয়ের আগে রমাকে এ বাড়িতে একবার এনে নিজের চোখে সবকিছু দেখাতে চেয়েছিল। কিন্তু সে সুযোগ না হওয়ায় ফোনে কন্টাক্ট করে তার সাথে দেখা করে তার একটাই কথা ছিল ,
--- আমার মা সারাটা জীবন পরিশ্রম করেছেন ।অসুস্থ্য শরীরেও রান্না করেছেন।তুমি কি পারবে আমার মাকে রান্নাঘর থেকে মুক্তি দিতে? কয়েক মাসের মধ্যেই আমি রান্নার লোক রেখে দেবো।মাত্র ছ'টা মাস আমি সময় চাচ্ছি।
  এখন রান্নার মাসি,কাজের মাসি সবই আছে আমার ছেলের দৌলতে।শ্বাশুড়ী মা বুবাইয়ের বিয়ের তিনমাসের মধ্যে মারা যান।আজ আমার কোন কাজ আর সংসারে নেই।এই বয়সে এসে আবার হারমোনিয়াম নিয়ে বসেছি বৌমার পীড়াপীড়িতে।বৌমা আমার সত্যিই লক্ষী।



 

Friday, September 2, 2022

কেউ কারো নয়

কেউ কারো নয় 

কতদিন আর মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে যাবো --

  ব্যালকনি থেকে নন্দিতা উঁকি দিয়ে দেখে গেটের কাছে একটি হলুদ ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে।ফ্ল্যাটটিতে আটটা পরিবার বাস করে।একমাত্র বীরেনবাবুর ছাড়া আর সকলেরই গাড়ি রয়েছে। বীরেনবাবু আর তার স্ত্রী থাকেন দোতলার পশ্চিম দিকের ফ্ল্যাটটিতে।
  বীরেনবাবু আর তার স্ত্রীর দু'জনেরই বয়স হয়েছে।ছেলে থাকে আমেরিকায়।বছর দু'য়েক আগে এসে বাপের বিশাল তিনতলা বাড়ি বিক্রি করে বাবা,মায়ের জন্য ছোট্ট দু'কামরার এই ফ্ল্যাটটি কিনে দিয়ে বাকি টাকা পয়সা নিয়ে পুনরায় আমেরিকা চলে গেছেন।যদিও স্বামী,স্ত্রী দেখা হলে প্রায়ই বলে থাকেন ছেলে মাসে মাসে টাকা পাঠায় কিন্তু সেটা যে সত্যি নয় এটা ফ্ল্যাটের অনেকেই বুঝতে পারেন।
  মাঝে মাঝে নন্দিতা এটা সেটা রান্না করে যখন তাঁদেরকে দিতে গেছে অধিকাংশ দিনই সে দেখেছে এক তরকারী ভাত করা।প্রথম থেকেই নন্দিতার বয়স্ক এই মানুষ দু'টির প্রতি অদ্ভুত এক মায়া।কেন তা সে নিজেই জানে না।নন্দিতা তার শ্বাশুড়ী ,চার বছরের ছেলে আর স্বামী থাকে তিন তলায়।
  বীরেনবাবুর স্ত্রীর হঠাৎ এই বয়সে এসে ধরা পড়ে ব্লাড ক্যান্সার।যেহেতু নন্দিনী বীরেনবাবুর স্ত্রী ললিতাদেবীকে নিয়ে নিজে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল তাই ললিতাদেবী নন্দিনীকে বলেছিলেন,
--- এই বয়সে এসে মানুষটা একথা জানলে বড্ড কষ্ট পাবেন। তাই মা তুমি এই রোগের কথা ওনাকে কিছু জানিও না।কটাদিনই বা আর বাঁচবেন আর আমারও তো সময় শেষ।
 নন্দিনী ললিতাদেবীর কথা রেখেছে। সে শুধু বীরেনবাবু কেন ফ্ল্যাটের অন্যান্য বাসিন্দাদেরও অনেকদিন পর্যন্ত কিছু বলেনি।নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া, ওষুধপত্র কেনা সবই নন্দিনী করে। নন্দিনী বয়স্ক ভদ্রলোকটিকে নিজের বিবেকের বিরুদ্ধে গিয়ে বানিয়ে বানিয়ে ডাক্তার এই বলেছেন,ডাক্তার ওই বলেছেন - বলতে বলতে নিজেও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন দু থেকে তিনবার বীরেনবাবুর ফ্ল্যাটে নন্দিনীকে যেতেই হয়। 
  যেহেতু শ্বাশুড়ী আছেন এবং তিনি বীরেনবাবুদের অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তাই সব সময়ই তিনি তার বৌমার এই কাজকে সমর্থন করে গেছেন।
  আগেরদিন অনেক রাত পর্যন্ত বীরেনবাবুর শরীর খারাপ হওয়াতে নন্দিনী ওদের ফ্ল্যাটেই ছিল।তার আগেই সন্ধ্যার দিকে ললিতাদেবীকে নিয়ে নার্সিংহোম ভর্তি করতে হয়েছে প্রচণ্ড শরীর খারাপ হওয়াতে।বীরেনবাবু চোখে খুবই কম দেখেন। মোটা পাওয়ারের চশমা পরেও সবকিছু আবছা দেখেন।চোখে ভালো দেখতে পেলে তিনি দেখতে পেতেন কিংবা জানতে পারতেন এক একটা গয়না বিক্রির টাকায় এক একটা কেমো নেওয়ার ফলে তার লালির মাথায় এখন একটাও চুল নেই।
  সেদিন যখন নন্দিনী বীরেনবাবু অসুস্থ্য হলে বাড়িতে ডাক্তার দেখে এনেছিল তখন ডাক্তারবাবুর সাথে কথা প্রসঙ্গে বলছিলো, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ভদ্রলোককে এতদিন ঠিক রেখেছিলাম।কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হলেও কানটা তো ঠিক আছে।মাসিমাকে নিয়ে যাওয়ার সময় পাশের ফ্ল্যাটের দু'জন ভদ্রলোকের কানাঘুষো শুনে উনি জেনে যান মাসিমার রোগের কথা।তারপর থেকেই এই অবস্থা।
  বীরেনবাবু রাতে দরজা বন্ধ না করে শোয়ার ফলে সকালে দুধ দিতে এসে ছেলেটি ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে বীরেনবাবু মেঝেতে পড়ে আছেন।চিৎকার করে লোক জড়ো করে।সেই সময় নিচুতে একটি ট্যাক্সি তার চালক পরিষ্কার করছিলো।সেও ছুটে আসে।
 রাত করে ফেরার ফলে ঘুম থেকে উঠতে নন্দিতার একটু দেরি হয়।কিন্তু ওই ট্যাক্সি আর সিঁড়িতে অসংখ্য পায়ের শব্দ শুনে তৎক্ষণাৎ দৌড়ে চলে যায় সেখানে।গিয়ে দেখে সব শেষ।বীরেনবাবু আর নেই।ততক্ষনে ফ্ল্যাটের অপর এক বাসিন্দা যিনি পেশায় ডাক্তার তিনি জানিয়ে দেন বেশ কয়েক ঘণ্টা আগেই তিনি এ নশ্বর দেহ ত্যাগ করেছেন।
  বীরেনবাবুর ফ্ল্যাটে যাওয়ার আগে নন্দিনী ফোনটা নিয়েই গেছিলো কিছুটা বিপদের আঁচ পেয়ে।ঠিক তখনই নার্সিংহোম থেকে ফোন করে নন্দিনীকে জানিয়ে দেওয়া হয় ভোর চারটে নাগাদ ললিতাদেবী পরপারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন।
  ফ্ল্যাটের লোকেরা তার ছেলেকে জানানোর ফলে সে জানিয়ে দেয় তার পক্ষে আসা কিছুতেই সম্ভব নয় এখন। দুটি দেহ চাঁদা তুলে সৎকার করা হয়।


  
    

অতীত শুধু ভাবনায় মানায়

জীবনে দেখা স্বপ্নগুলো কোনটাই পূরণ হল না নন্দিনীর। নিজেকে নিয়ে যখন ভাবতে বসে তখন বুকটা কেমন ফাঁকা হয়ে যায়। অথচ পড়াশুনায় বেশ ভালই ছিল সে,চেহারাও খারাপ ছিল না।কিন্তু ভাগ্য! সবকিছু থাকা স্বর্তেও ভাগ্যের বিরম্বরায় জীবন যুদ্ধে পর্যুদস্ত সে। কিশোরী বয়সে ভালোলাগার কথা সেই মানুষটাকেই কোনদিন মুখ ফুটে বলতে পারেনি। বাবার পছন্দ করা ছেলেকে পড়াশুনার মাঝপথে বিয়ে দেওয়ার ফলে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্নটুকুও ধুলিৎসাত হয়ে যায়।
 দুই সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচে থাকার তীব্র লড়াইয়ে যখন নিজের মনকে শক্ত করে নিয়েছে ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ করেই বিমলের চলে যাওয়া। লড়াইয়ের রাস্তাটা তখন আরো বন্ধুর হয়ে পড়ে। লড়াইটা তখন নন্দিনীর একার কাছে আরো কঠোর হয়ে ওঠে।মেয়ের শিক্ষা সম্পন্ন করার পর তার বিয়ে দিয়ে ছেলের উচ্চশিক্ষার আর্থিক দিক থেকে যখন জর্জরিত ঠিক তখনই ফেসবুকের সূত্র ধরে তার জীবনে নূতন করে ঝড় তোলে কিশোরীবেলার সেই ভালোলাগা। 
 পুরনো অনেক কথার ভিড়ে ফোনালাপেই মনের অনেক কাছে চলে আসে তারা। কোন চাহিদা ছাড়াই নন্দিনী বাঁচার একটা রাস্তা খুঁজে পায়। কিন্তু সে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি যে কিশোরকে তার ভালো লেগেছিলো জীবনের শুরুতে, তার এখন আমূল পরিবর্তন! 
  নন্দিনী যে তার জীবনে শুধুমাত্র একটা সময় কাটানোর যন্ত্র সৌমেনের কথাবার্তায় সে কোনদিনও বুঝতে পারেনি।বেশ কয়েকমাস কেমন একটা নেশার মত পেয়ে বসেছিলো নন্দিনীর। সৌমেন যেহেতু নির্দিষ্ট সময় ধরে ফোন করতো তাই ওই সময়টা নন্দিনী সব কাজ শেষ করে ফোনের অপেক্ষাতেই থাকতো। সৌমেনের সাথে কথা বলতেই ভালো লাগতো নন্দিনীর। নন্দিনী জানতো সৌমেন বিবাহিত,স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে সে খুব সুখী। সুতরাং নন্দিনীর অন্য কোন চাহিদা সৌমেনের কাজ থেকে ছিল না; শুধু মাঝে মধ্যে হাজার হাজার মাইল দূর থেকে একটু কথা বলা। এই কথা বলার মধ্যেই নন্দিনী ফিরে পেয়েছিল তার হারানো শৈশব।
 কিন্তু হঠাৎ করেই সৌমেন নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করে।সৌমেনের কথাবার্তায় নন্দিনী বহুবার বুঝতে পেরেছে সে যতটা সুখী হওয়ার ভান করে ততটা সুখী সে নয়, সেও বোধহয় এইভাবে হঠাৎ পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করে ভালো থাকে।কিন্তু বউকে যে মারাত্মক ভয় পায় আর হয়ত এই ভয় পাওয়ার কারণ থেকেই কোনকিছু ঘটায় সে নন্দিনীকে ফোন করা মোটামুটি বন্ধই করে দেয়। 
 হঠাৎ করে এই বয়সে এসে বিনা কারণে এত বড় একটা আঘাত নন্দিনী কিছুতেই নন্দিনী মেনে নিতে পারে না।তার আত্মসম্মানে প্রচণ্ড আঘাত লাগে। কারণ সৌমেনের কাছ থেকে তার কিছুই চাওয়ার ছিল না। সৌমেন সরাসরি যদি তাকে কারণটা জানিয়ে সরে যেত তাহলে নন্দিনীর এতটা খারাপ লাগতো না।কারণ সেও চায় না তার কারণে সৌমেনের সংসারে কোন ক্ষতি হয়। এক্ষেত্রে নন্দিনীর মনে হতে লাগলো "অপরাধী জানিল না কি তার অপরাধ বিচার হইয়া গেলো" -। 
 নিঃসঙ্গ জীবনে সৌমেন দমকা হাওয়ার মত বেশ কিছুদিন নন্দিনীর জীবনে ফ্রেস অক্সিজেন হয়ে এসেছিলো। নন্দিনী সৌমেনের না বলা সত্ত্বেও তার অসুবিধাগুলো বুঝতে পেরেই তাকে ব্লক করে দেয়। জীবন যুদ্ধে আরো একবার পরাজয় নন্দিনীর!
 তবে এই ঘটনা থেকে নন্দিনী একটা কথা বুঝতে পারে আর তা হল অতীত অতীতেই থাকা ভালো ,সুযোগ পেলেও তাকে কখনোই সামনে আনা উচিত নয়। তাতে কষ্ট বাড়ে বৈ কমে না।অতীত থাক মননে আর ভাবনায়। শুধুমাত্র অবসরে একান্তে তাকে ভাবলে অন্তত মানসিক কিছুটা তো তৃপ্তি আসবে। সুযোগ পেলেও অতীতকে গ্রহণ না করায় ভালো।

Wednesday, August 31, 2022

কারো গলগ্রহ হবো না

 কারো গলগ্রহ হবো না 
খিদের মুখে ভাত, ডালই অমৃত।
  সারাটাদিন পথে পথে ঘুরে কোন কাজের সন্ধান না পেয়ে চলতি পথে একটা ছোট পার্কে ঢুকে চুপচাপ বসে নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভাবছিলাম।সারাটা দিন পেটে জল ছাড়া কিছুই পড়েনি।
খিদে আর ক্লান্তিতে চোখটাও লেগে এসেছিলো।হঠাৎ একটা চিৎকারে কিছুটা সজাগ হয়ে তাকিয়ে দেখি চার,পাঁচটা ছেলে একটা তরুণীর উপর যেন হামলে পড়েছে।রাত তখন খুব একটা বেশি নয়।তবে জায়গাটা একটু নির্জন।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত তখন দশটা।কলকাতা শহরে রাত দশটা মানে কিছুই নয়।বুঝতে পারলাম মেয়েটির সম্মান এবং জীবন দুইই বিপন্ন।বাড়িতে হয়ত তার বাবা,মা এবং অন্যান্যরা তারজন্য ভাবছে।তার ফেরার অপেক্ষা করছে।স্বল্প সময়ের মধ্যে এও ভাবলাম আমার জন্য ভাবার তো কেউ নেই।আমি মেয়েটিকে বাঁচাতে গেলে হয়ত ওরা আমায় মেরেই ফেলবে।অভুক্ত অবস্থায় শরীরে নেই বিন্দুমাত্র জোর।তাছাড়া সংখ্যায় ওরা অনেকজন।কিন্তু হঠাৎ করেই শারীরিক বলের কাছে যেন আমার মানসিক বলটা কয়েকশ গুন বেড়ে গেলো।ছুটে এগিয়ে গেলাম ওদের কাছে 
  জন্মের পর থেকেই অভাব,দুঃখ আর কষ্টের মধ্য দিয়ে আমার জীবন শুরু।মা আমার নাম রেখেছিলেন সৌমেন।আদর করে আমায় সমু বলে ডাকতেন।জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখেছি আমায় নিয়ে মা মামাবাড়িতে শুধুমাত্র মাথার উপর একটু ছাদের আশায় ঘরের কাজ আর রান্নাবান্নার বিনিময়ে থাকেন সারাদিনে বিন্দুমাত্র সময় পান না।সন্ধ্যায় সব কাজকর্ম আর রান্না সেরে সাতটার মধ্যে বেরিয়ে গিয়ে দুটো বাড়িতে রান্না করে রাত দশটার মধ্যে ফিরে আবার সকলকে খেতে দেওয়া, বাসন মেজে রাখা।এই দুটো বাড়িতে রান্না করেই মা আমায় মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়িয়েছেন।তারপর আর পড়ার সুযোগ আমার হয়ে ওঠেনি।
  বহুবার মাকে জিজ্ঞাসা করেও বাবার কথা জানতে পারিনি।তবে একটু বড় হতেই মামীর মাকে বিঁধিয়ে কথা বলার ধরণ দেখে বুঝতে পারতাম মা ও, আজ আমার সামনে যে মেয়েটি বিপদের মধ্যে পড়ে নরপশুদের হাত থেকে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আমার জন্মটাও ঠিক একইভাবে।আমাকে মা মেরে ফেলতে পারেননি বা হয়ত নিজেও মরার সাহস দেখাতে পারেননি আমাকে পৃথিবীর আলো দেখানোর জন্য যেদিন থেকে একথা বুঝতে পেরেছি সেদিন থেকেই মাকে আমার জন্মদাতার কথা বলে আর লজ্জায় ফেলতে চাইনি।হতে পারি আমি জারজ কিন্তু জন্ম তো আমায় মা একা দেয়নি। যে বা যারা একটা নারীর সম্মান নষ্ট করে শুধু আমার জন্মদাত্রীর গায়ে নয় আমার গায়েও কালি লেপ্টে দিয়েছে তার খবরে আমার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই।
  সামান্য ক'টা টাকা রোজগার করার জন্য ফুটপাথের হোটেলগুলোতে বাসন মাজা থেকে শুরু করে কি না করেছি।কিন্তু মা কখনোই চাইতেন না আমি এইসব কাজ করি।কিন্তু সেই মুহূর্তে কোন উপায়ও ছিল না।মায়ের নিউমোনিয়া হল।ডাক্তার জলের কাজ একদম করতে নিষেধ করলেন।রান্নার বাড়ি দু'টো ছেড়ে দিতে হল।ওই শরীরে মা আমার গুছিয়ে দেওয়া সবকিছু নিয়ে দাঁড়িয়ে রান্না করতে গিয়ে একদিন মাথা ঘুরে পড়ে যান।তারপর হাসপাতাল থেকে আর বাড়ি আসেননি।মুখ বন্ধ করে মায়ের কাজের পূর্ব পর্যন্ত মামীর সকল গঞ্জনা সহ্য করে কালীঘাটে নমনম করে মায়ের কাজ করে আর ওবাড়ির মুখো হইনি।
  লোকগুলো মেয়েটির জামা ছিঁড়ে ফেলেছে ততক্ষনে; মুখটা তারই ওড়না দিয়ে বাঁধা। ওদের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আগে এদিক-ওদিক তাকিয়ে একটা মোটা লাঠি পেয়ে গেছিলাম ভাগ্যক্রমে।লাঠিটা নিয়ে এলোপাথাড়ি মারতে লাগলাম ওদের।ওরা তখন মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।অসুরের মত তখন যেন আমার গায়ে শক্তি।মেয়েটি ওই অবস্থায় পার্কের থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে চিৎকার চেঁচামেচি করে লোক জড়ো করলো।
 নিজের গায়ের জীর্ণ জামাটা খুলে ওর হাতে দিয়ে বললাম,
-- পরে নাও। চলো তোমায় বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।
 শরীরের নানান জায়গায় আমার কেটে গেছে তখন, ব্যথায় টনটন করছে।হঠাৎ করেই খিদেটা তখন আবার চাগার দিয়ে উঠলো।ওই অবস্থায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মেয়েটির সাথে ওর বাড়িতে গেলাম।
 বাড়ির সকলে ঘটনার আদ্যপান্ত বিবরণ শুনে এবং সকাল থেকে আমি না খাওয়া জেনে আমাকে ভাত ও ডাল দিয়ে খেতে দিলেন।কারণ মেয়েটির বাড়ির অবস্থাও খুব একটা ভালো নয় তা তাদের বাড়ি,ঘর দেখেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম।খিদের মুখে ওই ডাল, ভাতই ছিল আমার কাছে অমৃত।সেদিন রাতটা ওখানেই কাটিয়ে পরদিন কেউ ওঠার আগেই সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ি এই আশায় -একটা তো মাত্র পেট ও ঠিক চলে যাবে কিন্তু কারো বাড়িতে অন্য কারো গলগ্রহ হয়ে কিছুতেই থাকবো না।


Monday, August 29, 2022

সেই বকুলফুল গাছটা

 কয়েকদিন আগেই সজলের সাথে মনিকার বিশাল ঝামেলা হয়ে গেছে। সজলের বক্তব্য মনিকা যে প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে সেখানে ছুটির কোন সময় জ্ঞান নেই।তাই বারবার সজল চাপ দিতে থাকে ওই চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোন চাকরি নেওয়ার জন্য।কিন্তু তিন বছর হয়ে গেছে এই চাকরি তাই মনিকাও এই চাকরি ছাড়তে নারাজ।
  বেশ কয়েক বছর আগে হঠাৎ বৃষ্টির সম্মুখীন হয়ে মাথা বাঁচাতে অপরিচিত দু'টি কিশোর কিশোরী বৃষ্টির থেকে মাথা বাঁচাতে রাস্তার উপরে একটি বকুল ফুল গাছের তলায় আশ্রয় নিয়েছিল।বৃষ্টির সাথে বাতাস ছিল প্রচুর।গাছ থেকে বকুলফুল পড়ে ঢিপ হচ্ছিল গাছের তলায়।মনিকা ওড়নার এক কোণে ভিজতে ভিজতেই বকুলফুল কুড়িয়ে জমা করছে দেখে সজলও অপরিচিত মেয়েটিকে ওই কাজে সাহায্য করে।ফুল কুড়াতে কুড়াতেই দু'জনের কথা
-- আপনি বকুলফুল খুব ভালোবাসেন?
-- খুব।জানেন একমাত্র এই ফুল যত শুকিয়ে যাক না কেন এর গন্ধ কিন্তু থেকেই যাবে।
--- তাই নাকি? আমি কিন্তু জানতাম না এটা।
  তারপর বেশ কয়েকমাস পড়ে দু'জনের পরিচয় যখন বেশ গাঢ় হয় তখন একদিন সজল তার মনিকে বলে,
-- বকুল ফুলের গন্ধটা জানো ঠিক ভালোবাসার মত। দিন যত গড়াবে ভালোবাসাও ঠিক ততই গাঢ় হবে।
  ওদের দেখা হওয়ার কথা থাকলেও দু'জনের মিট করার জায়গাটা হচ্ছে বুকুল গাছতলা।তারপর সেখান থেকে যেখানে যাওয়ার যাবে। দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকে দু'জন দু'জনকে চেনে।তারপর কলেজ,হায়ার এডুকেশন চাকরি।সজল বেসরকারি হলেও সুচাকুরে।আর মনিকা একটা সাধারণ প্রাইভেট কোম্পানিতে।কিন্তু মনিকা চাকরি পাওয়ার দু'বছর বাদে সজলের চাকরি।
 দুই বাড়ির সকলেই জানে ওদের সম্পর্কটা। বিয়ের সব ঠিকও ছিল।কিন্তু হঠাৎ করে সজলের মায়ের মৃত্যুর কারণে বিয়ের তারিখ কিছুটা পাল্টে দিতে হল। মায়ের মৃত্যুর একবছর পার না হলে বিয়ে সম্ভব নয়। সজল রোজই অফিস থেকে ফিরে বাস স্ট্যান্ডে মনিকার জন্য অপেক্ষা করে কারণ বাস থেকে নেমে যে রাস্তাটা ধরে মনিকা বাড়িতে যায় সেটা খুব নির্জন।আর এখানেই সজলের ভয়।একটা নির্দিষ্ট সময় হলে তাও হয়।কোন কোন দিন সজল ছ'টা থেকে রাত ন'টা দশটা অবধি দাঁড়িয়ে থাকে। মাঝে মধ্যে সজল খুব জোর দিতে থাকে মনিকাকে এই চাকরিটা ছেড়ে দিতে।চাকরি করা নিয়ে তার কোন আপত্তি নেই কিন্তু মনিকার অফিসের ছুটির কোন নির্দিষ্ট সময় নেই , যদি কখনো অঘটন ঘটে যায় সেই ভয়ে।
 একদিন রাত দশটা বেজে যায় মনিকার দেখা নেই।ফোনেও পাচ্ছে না।বারবার ফোন করে যাচ্ছে। 'নট রিচেবল' - ছাড়া আর কিছুই শব্দ শুনতে সে পাচ্ছে না। প্রথমে রাগ,অভিমান পরে টেনশনে পাগলের মত প্রতিটা বাস আসলেই উঁকি ঝুঁকি। মনিকার বাড়িতে একমাত্র বয়স্ক মা। তিনি মেয়ের টেনশনে বেশ কয়েকবার ফোন করেছেন সজলকে। কারণ তিনিও মনিকাকে ফোনে পাচ্ছেন না।
 রাত তখন দশটা।মনিকা একটা উবের করে নামছে দেখে সজল ছুটে যায়। এতক্ষণ যার জন্য এত টেনশন হচ্ছিল তাকে সুস্থ্য,স্বাভাবিক দেখতে পেয়েই সব টেনশন গিয়ে মাথায় রাগ হয়ে জমা হল।মনিকা নেমেই সজলকে বলতে গেলো তার দেরি হওয়ার কারণ কিন্তু কে শুনবে কার কথা --
-- জানো সজল আজ না
-- আমি কোন কথা জানতে  চাইছি না। বহুদিন ধরে বলছি তুমি অন্য কোথাও চাকরির চেষ্টা করো কিছুতেই তুমি আমার কথা গ্রাহ্য করছো না।
  সজল মনিকার কোন কথা শুনার প্রয়োজনই বোধ করলো না উপরন্তু মনিকার বাড়িতে যেতে যেতেই রাস্তার উপরেই চিৎকার করে রাগ দেখাতে শুরু করলো। মনিকা তাকে বারবার অনুরোধ করলো রাস্তার উপরে চিৎকার না করতে।কিন্তু কে শোনে কার কথা!
সজল এতটাই রেগে ছিল তার মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেলো,
-- আমার সাথে সারাজীবন থাকতে হলে এই চাকরি তোমায় ছাড়তে হবে।আমার তো চাকরিতে কোন আপত্তি নেই।তুমি অন্য কোথাও চাকরি খোঁজো।
 সজলের এই চিৎকার চেঁচামেচিতে মনিকার মাথা এমনিতেই গরম ছিল তারপর এই শর্ত দেওয়ায় মনিকাও রেগে বলে বসলো,
--- আমাকেও ভেবে দেখতে হবে ভবিষ্যতে তোমার সাথে আমি থাকবো কিনা।চাকরির বয়স বেড়েছে।সামনে আমার প্রমোশন হবে।এখানে আমার একটা উন্নত ভবিষ্যত আছে। আমি কিছুতেই এই চাকরি ছাড়বো না।
-- তাহলে আমার সাথে সম্পর্ক ছাড়তে হবে।
--- আমি তো তোমায় ধরে রাখিনি। আমার ভালোবাসার প্রতি যদি তোমার বিশ্বাস না থাকে তাহলে সেই সম্পর্ক আজ না হলেও কাল ভেঙ্গে যাবেই। তাই আরও জড়িয়ে যাওয়ার আগেই উভয়কেই বিষয়টা নিয়ে ভাবতে হবে।আর জেনে রাখো তোমার কথাই আমি চাকরি কিছুতেই ছাড়বো না।
  কেটে গেছে চার বছর।দু'জনের ইগো ঝেড়ে কেউই আর কোনদিন কারো সামনে গিয়ে দাঁড়ায়নি। প্রথম দেখার স্মৃতিটা মনে রেখে দু'জনেই সেই বকুল গাছটার কাছ থেকে যাওয়ার সময় কিছুক্ষণ থমকে যায়।সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মত তাদের সামনে ভেসে ওঠে দু'টি কিশোর কিশোরীর গাছতলায় ফুল কুড়ানোর দৃশ্য।বুকের ভিতর হঠাৎ ওঠা ঝড় সামলে নিয়ে আবার রোজ নামচায় লেগে পড়ে। একই শহর অনেক সময় একই রাস্তা কেউ আগে কেউ পড়ে হাঁটছে কিন্তু ইগো ঝেড়ে কেউ কারো সামনে আর যায়নি।

২৯-৮-২২ 

Wednesday, August 10, 2022

হরিহর আত্মা

  হরিহর আত্মা (m)

  ছেলেবেলা থেকেই দীপিকা আর অঞ্জনা খুব ভালো বন্ধু।সেই প্রথম স্কুলে ভর্তি হওয়া থেকে গ্র্যাজুয়েশন একই স্কুল এবং একই কলেজ। যার ফলে রক্তের সম্পর্ক ছাড়াই এই দুটি পরিবারের লোকজনও আত্মিক বন্ধনে খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছে।কোন পরিবারের লোকজনকে বাদ দিয়ে অন্য পরিবারে ছোট থেকে বড় কোন অনুষ্ঠানই হয় না।পড়াশুনায় দু'জনেই মাঝারি মানের।দু'বাড়ির লোকেরাই মজার ছলে বলে,"যে বাড়িতে দু'টি ছেলে আছে আমরা সেই বাড়িতেই আমাদের মেয়েদের বিয়ে দেবো।"
  দীপিকার মাসতুত বোনের বিয়েতে দু'পরিবারেরই সকলের নিমন্ত্রণ।সেখানেই দীপিকাকে দেখে একটি পরিবার তাদের ছেলের জন্য পছন্দ করে।কথাবার্তা এগোতে লাগে।এখন বলতে গেলে প্রায় চব্বিশ ঘন্টায় দু'বন্ধু একসাথে সময় কাটায়।আনন্দের মাঝে মাঝে দু'জন দু'জনকে ছেড়ে থাকতে হবে মনে হলেই উভয়ের মনের ভিতরে বিষাদের কালো মেঘে চোখের কোল বেয়ে জল ঝরতে শুরু করে
  দেখতে দেখতে বিয়ের দিন চলে এলো।বিদায়ের মুহূর্তে দীপিকা আর অঞ্জনার একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্না দেখে পাড়া-প্রতিবেশীরাও চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি।সে এক হৃদয় বিদারক পরিস্থিতি।
  বৌভাতের দিন অবশ্য দু'জনে অনেকটাই সামলে গেছে।তবুও ফেরবার সময় দু'জনের চোখেই জল।
  দীপিকার বিয়ের ঠিক বছর দু'য়েকের মাথায় অঞ্জনার বিয়ে ঠিক হয়। সম্মন্ধটা অবশ্য দীপিকাই করে।দীপিকার স্বামীর অফিস কলিগ দেবাংশুকে দেখেই দীপিকার মাথায় এটা ঘুরপাক খেতে থাকে।অনেক বলেকয়ে স্বামী সুমিতকে দিয়ে দেবাংশুকে কথাটা বলায়।দেবাংশু বন্ধু সুমিতকে বলে,
-- দেখ যদি প্রেম করতাম তাহলে বাবা,মাকে আমিই জানাতাম।কিন্তু যেহেতু এটা প্রেম নয় তাই এ সম্মন্ধটা তোকে বা তোর বউকেই বাবা,মাকে জানাতে হবে। হ্যাঁ একটা কথা আমি বলতে পারি অঞ্জনাকে আমি বহুবার দেখেছি নানান অনুষ্ঠানে তোদের বাড়িতে।মন্দ নয় দেখতে।আর সেক্ষেত্রে আমার মত জানতে চাইলে আমি হ্যাঁ ই বলবো।
 সুমিত অফিস থেকে ফিরে সব কথা দীপিকাকে জানায়।দীপিকা ফোনে অঞ্জনার বাবা,মায়ের সাথে কথা বলে ছেলের সব বিবরণ দেয়।তারা এই ব্যাপারে সব দায়িত্ব দীপিকাকেই সমর্পণ করেন।
  সুমিত ও দীপিকা দেবাংশুদের বাড়িতে গিয়ে তার বাবা,মাকে অঞ্জনার ছবি দেখিয়ে পছন্দ করিয়ে মেয়ে দেখার জন্য কথা আদায় করে বাড়িতে ফেরে।
  মেয়ে দেখে পছন্দ হওয়ার পর একসময় বিয়ের তারিখও ফাইনাল হয়ে বিয়ে হয়ে যায়।
 এদিকে দীপিকার বিয়ে হয়েছে চার বছর কিন্তু মাতৃত্বের স্বাদ সে আজও পায়নি।নানান পরীক্ষা নিরীক্ষায় ধরা পড়ে সে কোনদিনও মা হতে পারবে না।খুব ভেঙ্গে পরে।সুমিত তাকে অনেক বোঝায় আজকের দিনে মা হওয়া কোন ব্যাপারই না।প্রয়োজনে তারা একটি সন্তান দত্তক নিয়ে নেবে।কিন্তু দিনরাত কেঁদে কেঁদে প্রায় পাগলের মত অবস্থা হয়ে দাঁড়ায়।আর ঠিক এই মুহুর্তেই বিয়ের দু'বছরের মাথায় অঞ্জনা প্রেগন্যান্ট হয়।এত বড় একটা খুশির খবর সে আর দেবাংশু ছাড়া কাউকেই দিতে পারে না দীপিকার কথা ভেবে।এমনকি তার শ্বশুর শ্বাশুড়িকেউ জানাতে পারে না যদি দীপিকার কানে চলে যায়।
  আল্ট্রাসোনোগ্রাফিতে ধরা পড়ে অঞ্জনা যমজ বাচ্চা জন্ম দিতে চলেছে।সঙ্গে সঙ্গে তার মাথায় খেলে একটা সন্তান তো সে দীপিকাকে দত্তক দিতে পারে।কিন্তু কিছুতেই দেবাংশুকে রাজি করাতে পারে না।শ্বশুর শ্বাশুড়ি তখনও কিছুই জানেন না।দিনরাত স্বামীর সাথে মত বিরোধ মনোমালিন্য চলতে থাকে।ঠিকভাবে অঞ্জনা খাওয়া দাওয়া করে না,ওষুধ দিতে গেলে খাবে না বলে জানিয়ে দেয়।শেষ পর্যন্ত দেবাংশু মেনে নিতে বাধ্য হয়।আর তখনই বাড়িতে সকলকে জানানো হয়।
  দীপিকাকে এই সুখবরটা তার বাড়ি গিয়েই দেবে ঠিক করে।স্বামীকে নিয়ে দীপিকার বাড়ি যায় সে।সবকিছু খুলে বলে তাকে।দীপিকা দুই হাতে অঞ্জনাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে," আমাদের মত আমাদের সন্তানেরাও একই স্কুল,একই কলেজে পড়বে। আমরা দু'জনেই একসাথে মা হবো।"
  কিন্তু তারা ঠিক করে তারা চারজন ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ কোনদিন এ কথা জানবে না।তাই তখন থেকেই দীপিকা প্রেগন্যান্ট বলে চাউর করা হয়। একেই বলে মনেহয় হরিহর আত্মা।


 
  

Saturday, July 30, 2022

মানুষ চেনা বড় দায় (দশম ও শেষ পর্ব)

 অতনু তার মাকে আলমারির ভিতর হতে সেই ছবি বের করা থেকে শুরু করে নিকিতার সাথে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা মায়ের কাছে ব্যক্ত করে।তার মা অবাক হয়ে শুধু শুনে যান। অতনুর কথা শেষ হলে জানতে চান,
--- নিকিতার সাথে তোর রক্তের সম্পর্ক আছে ঠিকই কিন্তু কি প্রয়োজন ছিল তোর এইভাবে কিছুদিন নিজের পদমর্যাদা ভুলে তার আন্ডারে কাজ করার?
--- জানিনা মা, হঠাৎ করেই কেন জানিনা ওর পরিচয় জানার পর ভীষণভাবে ইচ্ছা করছিলো ওর সাথে কিছুটা সময় কাটাতে। একেই মনেহয় রক্তের টান বলে।
 কথাটা শুনে অতনুর মা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন।
  মাকে নিয়ে অতনু গ্রামের বাড়িতে ফিরে এলো।সে বহুবার মাকে বলেছিল তার সাথে ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার কথ।কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হননি।অগত্যা তাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসলে তার শ্বশুরমশাই আর কয়েকটা দিন ছুটি বারিয়ে পুজোটা কাটিয়ে যেতে বলেন।অতনু তাইই করে।বউ,ছেলে নিয়ে বেশ হৈ হৈ করে তার সময় কেটে যায় বেশ কিছুদিন।
  আর এদিকে নিকিতা অতনু সাহার সব পরিচয় জোগাড় করে।প্রতি বছর সে পুজোর সময় ছুটি নিয়ে কলকাতা বাবা,মায়ের কাছে আসে।এবারও তার ব্যতিক্রম হয় না। ষষ্ঠীর দিনে আসা আর লক্ষী পুজোর পর যাওয়া।বছরে একবারই বাড়িতে আসে।যা ছুটি নেওয়ার ওই একবারেই নেয়। এবার লক্ষী পুজোর পরও মেয়ে যাওয়ার তোড়জোড় করছে না দেখে ডিনার টেবিলে নিকিতার কাছে জানতে চাইলেন তার বাবা ,
--- হ্যারে তুই এবার কি একটু বেশিদিন ছুটি নিয়ে এসেছিস?
 নিকিতা সে কথার উত্তর না দিয়ে বললো,
-- আচ্ছা বাবা, তুমি তো কোনদিনও তোমার গ্রামের গল্প, আমার ঠাকুমা,ঠাকুরদার গল্প করোনি? তারা কি কেউ বেঁচে নেই এখন ?
সুভাষবাবু খেতে খেতে খাওয়া বন্ধ করে হঠাৎ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
--- কি হল বাবা উত্তর দিলে না? তোমার মুখে তো কোনদিন পিলজঙ্গ নামটাও শুনিনি।
---তুই কি করে জানলি আমার গ্রামের বাড়ি পিলজঙ্গ?
--- আরো অনেককিছুই এখন জানি বাবা।
 সুভাষবাবু কোন কথার উত্তর না দিয়ে খাওয়া শেষ না করেই উঠে গেলেন। নিকিতার মা জানতে চাইলেন,
-- কি ব্যাপার বলতো? হঠাৎ তোর বাবার গ্রামের বাড়ি নিয়ে পড়লি কেন?
--- তোমার এসব না জানাই ভালো মা।এই বয়সে এসে তুমি কোন আঘাত পাও তা আমি চাই না।
--- মানেটা কি?
 নিকিতা কোন উত্তর না দিয়ে বেসিনে মুখ ধুতে ধুতে বললো,
-- মা, আমি কাল খুব ভোরে বেরিয়ে যাবো। ফোন করে জানিয়ে দেবো রাতে ফিরতে পারবো কিনা।অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।
 নিকিতার মা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন ততক্ষণ নিকিতা ডাইনিং ছেড়ে বাবার ঘরে ঢুকে বাবাকে বললো,
--- বাবা, কাল আমি তোমার গাড়িটা নিয়ে একটু বেরবো। কখন ফিরবো বলতে পাচ্ছি না। একটু পিলজঙ্গ গ্রামে যাবো। ভয় পেও না, আমি মাকে কোন কথা জানাবো না। পুরোপুরি সব কিছু বুঝতে না পারলেও এইটুকু অন্তত বুঝেছি আমার একটা দাদা আছে। তোমার কাছ থেকে আমি কিছুই জানতে চাইছি না, ওখানে গিয়েই আমি সব জানবো অন্য কারো কাছে।গ্রামের নাম আর তোমার বাড়ির ঠিকানা একসময় জেনেছিলাম তোমার কাগজপত্র ঘাটতে ঘাটতে। এই ঠিকানা আর তার পিতৃপরিচয় থেকে তার পরিচয় জানতে পেরেছি।
 সুভাষবাবু যেন কথা বলতেই ভুলে গেছেন।আজ এত বছর পর তার অতীত তার মেয়ে সামনে আনবে তিনি ভাবতেই পারেননি।
 ভোরবেলা নিকিতা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলো পিলজঙ্গ গ্রামের উদ্দেশ্যে।

 অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নিকিতা যখন তার শিকড় খুঁজে পেলো সেই বাড়িতে তালা বন্ধ।আশেপাশে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলো বাড়ির ছেলে কয়েকটা দিন আগেই তার কর্মস্থলে ফিরে গেছে আর তার মা গ্রামের রায় চৌধুরীদের বাড়িতে।নিকিতা সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়ে অতনুর মায়ের সাথে দেখা করে সব পরিচয় দেয়।অতনুর মা তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরেন।নিকিতা তাকে সাথে করে নিয়ে যেতে চায়।তিনি জানান,
-- যেহেতু তুমি বললে তোমার মা জানেন না তাই আমিও এই বয়সে এসে কারো সুখের সংসারে কাঁটা হতে চাই না।আমার ভালোবাসা তার সাথে ছিলো আজীবন থাকবে। আমি আজও তাকে ঠিক সেই আগের মতই ভালোবাসি।আমি তোমার ডাকে সারা দেওয়া মানেই একটা সংসারে আগুন জ্বালানো। তা আমি কোনদিনও পারবো না।তুমি ফিরে যাও মা।আমার বিটু তোমার দাদা।ওর সাথে সম্পর্কটা রাখলে আমার জীবনের না পাওয়াগুলো পূর্ণতা পাবে।আমি মরে শান্তি পাবো এই ভেবে অন্তত আমার বিটুর রক্তের সম্পর্কের কেউ আছে।
  ভদ্রমহিলা যখন কথাগুলি নিকিতাকে বলছেন সে শুধু অবাক হয়ে শুনছে।একজন নারীই পারে এতটা কষ্টসহিষ্ণু হতে।সে মনেমনে প্রতিজ্ঞা করে মাকে না জানিয়েই আজীবন সে তার দাদার সাথে সম্পর্ক রেখে চলবে।
সারা দুপুর সে তার বড়মার কাছ থেকে তার বাবার সমস্ত কথা শুনে সন্ধ্যায় এই মহীয়সী নারীর আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে আগামীবার আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

     শেষ



  





  

মানুষ চেনা বড় দায় ( নবম পর্ব)

 মায়ের অসুস্থ্যতার খবর পেয়ে হঠাৎ করেই অতনু গ্রামের বাড়িতে চলে যায়।বিয়ের পর বেশ কিছুদিন তার স্ত্রী তার সাথে থাকলেও পরে সেই যে বাচ্চা হতে সে বাপের বাড়িতে গেছে তারপর সে আর অতনুর কাছে ফিরে আসেনি।অতনু মাঝে মধ্যে তার শ্বশুরবাড়িতে যায়।আদরের দুলালী একাএকা তার সময় কাটে না তাই সে বাপের বাড়িতেই ছেলে নিয়ে থাকা সমীচীন মনে করেছে। অতনু বা তার মায়ের এতে কোনো আপত্তিও নেই; আর থাকলেই বা শুনছে কে? বুদ্ধিমত্তা আর কৃতজ্ঞতা বশত তারা এটাকে সানন্দেই মেনে নিয়েছেন।
  মায়ের শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ দেখে সে মাকে কলকাতা নিয়ে আসতে চায়।রায় চৌধুরীবাবু তাকে সমর্থন করেন।একটা গাড়ি ভাড়া করে মাকে নিয়ে কলকাতার এক নামী নার্সিংহোমে ভর্তি করিয়ে নিজে হোটেলে থাকতে শুরু করে। আস্তে আস্তে মায়ের অবস্থার উন্নতি হতে থাকে।একদিন ভিজিটিং আওয়ারে অতনুর মা অতনুকে বলেন,
--- ছেলেবেলায় বহুবার তুই তোর বাবার কথা জানতে চেয়েছিস তবে বড় হওয়ার পর কোনদিন আর বাবার কথা আমার কাছে বলিসনি। কিন্তু আমি কোনদিন তোকে তার সম্পর্কে কিছুই বলিনি। আজ আমি তোকে তার সম্মন্ধে কিছু জানাতে চাই।
--- আমি সব জানি মা।ঠাম্মা আমায় সব বলেছেন।কিন্তু তুমি কষ্ট পাবে বলে কোনদিন কিছু তোমায় বলিনি।তাকে আমি চিনি।তিনি কলকাতা শহরে কোথায় থাকেন? কি করতেন সব জানি।
  কথা বলতে বলতে মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে মায়ের দু'চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।হাত দিয়ে মায়ের চোখের জল মুছে দিয়ে বলে,
-- আমি জানি তুমি আজও বাবাকে ভালোবাসো।জীবনের সব থেকে মূল্যবান সময় তো কাটিয়েই ফেলেছো তবে কেন আজ এই চোখের জল ফেলছো?
-- একবার যদি তার সাথে দেখা হত শুধু একটা কথাই জানতে চাইতাম কি ছিলো আমার অপরাধ? তবে একটা কথা ভেবে অবাক হচ্ছি তুই তাকে কিভাবে চিনলি? তার বাড়ি, ঘরের ঠিকানা কিভাবে জানলি?

ক্রমশ 

প্রকৃত বন্ধু

   প্রকৃত বন্ধু   
 
  সদ্য বাবাকে হারানো আর হঠাৎ করেই স্বপ্ন ভঙ্গের হতাশায় প্রথম অবস্থায় দোলন ভীষণভাবে মুষরে পড়ে। এত বড় সংসারের দায়িত্ব বিশেষত ভাইবোনগুলোকে কিভাবে একা তাদের জীবনে দাঁড় করাবে এই ভেবেই সে কোন কুল কিনারা পাচ্ছিল না। যদিও মা বেঁচে আছেন কিন্তু তিনি সংসারটা সামলানো ছাড়া আর কিইবা করতে পারবেন? 
  বাবার মৃত্যুর পর সংসারের সব দায়িত্ব এসে পড়ে দোলনের উপর।দোলন এখন একটা কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক।দীপকের সাথে বছর খানেক ধরে পরিচয়।দু'জন দু'জনকে ভালোবাসলেও কেউই মুখ ফুটে কাউকে বলেনি।
  ভালোবাসা যেখানে শুরুর থেকেই গভীর হয় হয়ত সেখানে সত্যিই মুখ ফুটে পরস্পরকে বলার প্রয়োজন হয় না।দোলনের মা, একবোন আর ছোট দুই ভাই। 
  দোলন ও দীপক যখন মনেমনে ভাবছে তারা এবার একই ছাদের তলায় সংসার গুছিয়ে নেবে ঠিক সেই মুহূর্তেই দোলনের পিতৃ বিয়োগ। পুরো সংসারের দায়িত্ব এসে পড়লো দোলনের উপর।বাবা প্রাইভেট ফার্মে চাকরী করলেও মাইনে ছিল ভালো। সুতরাং বেশ ভালোভাবেই তাদের সংসার চলে যেত। সঞ্চয় খুব বেশি না হলেও মোটামুটি। কিন্তু সঞ্চয় দিয়ে এতগুলো মানুষের শুধু তো খাওয়াপরাই নয় অসুখবিসুখ সর্বোপরি তিন তিনটে ছোট ছোট ভাইবোনদের পড়াশুনার খরচ।
  মায়ের সাথে পরামর্শ করে সঞ্চয়ে হাত না দিয়ে দোলন তার মাস মাইনের টাকাটা মায়ের হাতে দিয়ে কোনরকমে সংসার চালিয়ে নিয়ে যেতে বলে।দোলনের পাশে প্রকৃত বন্ধু হয়ে দাঁড়ায় দীপক।দীপকের সাথে এতদিন মিশেও দোলন জানতে পারেনি দীপকের মধ্যে বন্ধুত্বের এক সুন্দর রূপ লুকিয়ে আছে।এতদিন দীপককে কাছে পেয়েছে শুধু একজন প্রেমিক হিসেবে আর আজ দীপক তার কাছে সব চেয়ে কাছের এক বন্ধু।
  দীপকের সাথে একান্তে আলাপচারিতায় দীপক দোলনকে জানিয়েছে,
--- ভালোবেসে বিয়ে করে একই ছাদের তলায় থেকে সংসার করার নামই শুধু ভালোবাসা নয়।সুখে-দুখে, বিপদে-আপদে একে অপরের পাশে থেকে সুখী হওয়া কিংবা সেই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার পথ দু'জনে মিলে খুঁজে বের করার নামই ভালবাসা, আজীবন দু'টি মন এক হয়ে থাকার নাম ভালোবাসা।তার জন্য একই ছাদের তলায় থাকার কোন দরকারই পড়ে না। মেশমশাইয়ের অবর্তমানে তুমিই এই সংসারের সমস্ত দায়িত্ব তার মত করেই সামলাবে। আজীবন আমি তোমার পাশে থাকবো। সব দায়িত্ব, কর্তব্য শেষ হওয়ার পর সকলে যখন যে যার জীবনে দাঁড়িয়ে যাবে তখন নাহয় ভেবে দেখা যাবে আমাদের মাথার উপরের ছাদটা এক হবে কিনা। 
  দীপক যখন এই কথাগুলি বলছে সে দু'হাত দিয়ে দোলনের হাত দু'টিকে শক্ত করে ধরে রেখেছে।দোলনের দু'চোখ বেয়ে নীরবেই অশ্রু পড়ে চলেছে।আজ যেন সে নূতন করে আবার দীপককে আবিষ্কার করলো।
  স্বামী, প্রেমিক, বন্ধু সকলেই পায়।কিন্তু সেই স্বামী কিংবা প্রেমিক অধিকাংশ নারীর কাছে বন্ধু হয়ে উঠতে পারে না।একজন মানুষ আর একজন মানুষের কাছে যখন প্রকৃত বন্ধু হয়ে উঠতে পারে তাহলেই মনেহয় জীবনে সবকিছু পাওয়া হয়ে যায়।
 
  

Wednesday, July 20, 2022

মানুষ চেনা বড় দায় (অষ্টম পর্ব)

 বেশ কিছুদিন ধরে নিকিতা অতনুকে আর অফিসে দেখতে পায় না।ভাবে হয়ত ছুটি নিয়েছে।কোন কারণ ছাড়াই লোকটির কথা বারবার কেন তার মনে পড়ছে নিজেও বুঝতে পারছে না।একটু ভালো পোষ্টে থাকার ফলে এদিকওদিক খবর নেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু সবাই যেন অতনু সাহা সম্পর্কে মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে।
  অতনু ওরফে বিটু বেশ কয়েক বছরের মধ্যেই অফিসের বেশ উচ্চ পদে চলে যায়।নূতন নূতন ছেলেমেয়ে অফিসের নানান ব্রাঞ্চে নিয়োগ হতে থাকে, তাদের কোন ব্রাঞ্চে কখন ট্রান্সফার করতে হবে তা দেখা অতনুর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। 
  একদিন কাজ করতে করতে নিকিতা সাহার পরিচয় সে জানতে পারে যে কিনা তাদেরই অফিসের অন্য ব্রাঞ্চে আছে এবং বেশ ভালো পোষ্টেই আছে।বাবার নাম আর পুরনো ঠিকানা দেখেই সে বুঝতে পারে এ হচ্ছে তার কলেজ অধ্যাপক এস.এস. অর্থাৎ তার বাবা সুভাষ সাহার একমাত্র মেয়ে।
  কি জানি কেন তার মাথায় এ খেয়াল চাপলো।সে কিছু নতুন ছেলেমেয়ের সাথে মাত্র কয়েকটা দিন নিকিতার অফিসে এসে তার আন্ডারে চাকরি করতে চাইলো।
  নিকিতা রোজই খবর নেয় অতনু সাহা অফিসে এসেছে কিনা।কিন্তু হঠাৎ করেই যেন লোকটা অফিস থেকে সকলের অলক্ষ্যে উবে গেছে।এবার সে ঠিক করে ল্যাপটপ ঘেঁটে নতুন যোগদান করা ছেলেমেয়েদের নামের লিস্টটা তাকে বের করতেই হবে।
 লোকটা বয়সে বড়,দেখতেও খুব একটা ভালো নয় কিন্তু তবুও প্রথম দিন থেকেই লোকটার প্রতি অদ্ভুত একটা মায়া কাজ করছে কেন এটাই নিকিতা বুঝতে পারছে না।

 ক্রমশ -

Thursday, July 14, 2022

ভাগ্যই জীবনের শেষ কথা বলে

ভাগ্যই জীবনে শেষ কথা বলে  

  নিজের জন্য কিছু একটা করা ভীষণ দরকার হয়ে পড়েছিল।
  একাই বাবুঘাট গঙ্গার পাড়ে বসে এলোমেলো ভাবনার সাথে এই ভাবনাটাই নন্দিনীকে ভাবিয়ে যাচ্ছিল।তখনো সন্ধ্যা হয়নি।অস্তগামী সূর্যের লাল আভা গঙ্গার জলে পড়ে এক মনোরম শোভায় আকৃষ্ট হয়ে বেশ অনেকক্ষণ বসে ছিল নন্দিনী।আজকে আর ঘরে ফেরার কোন তাড়া নেই তার।অনেক কষ্টে গড়ে তোলা সংসারে তার দায়িত্ব আজ ফুরিয়েছে।এলোমেলো ভাবনারা আজ সত্যিই মনটাকে বারবার অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
  বাবা,মায়ের পছন্দ করা সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি মানুষকে মেনে নিয়ে শ্বশুরবাড়ির দরজায় পা রেখেই বুঝে গেছিলো এ বাড়িতে শ্বাশুড়ী মায়ের কথাই শেষ কথা।বাংলায় এম. এ. করা নন্দিনীর ভীষণ ইচ্ছা ছিল শিক্ষকতা করার।কিন্তু বাবার জেদের কাছে বর্ষতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল মায়ের এক কথাই,
--- তুই কি চাস নন্দা? এমনিতেই মানুষটার হাই ব্লাডপ্রেসার,সুগার।আর এই বিয়ে নিয়ে তুই যে তাল শুরু করেছিস তাতে মানুষটাকে তুই আরও অসুস্থ্য করে ছাড়বি। আরে চাকরি করতে হলে বিয়ের পড়ে করিস।এই মানুষটাকে শেষ বয়সে এসে একটু শান্তি দে।
 মায়ের এই স্বার্থপরের মত কথা শুনে দরজা বন্ধ করে আকুল হয়ে সারারাত কেঁদে সকালেই মাকে জানিয়ে দিয়েছে,
-- তোমরা যেখানে আমার বিয়ে দেবে আমি রাজি।
 স্বামী ভালো মনের মানুষ।নন্দিনীকে খুবই ভালোবাসে।কিন্তু মায়ের মুখের উপর একটা কথা বলার সাহস তার নেই।সেই ফুল শয্য্যার রাত থেকে একটি কথাই শুনে যাচ্ছে নন্দিনী, "একটু কষ্ট করে মানিয়ে নাও। মা আমায় অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছেন।মায়ের কথার অবাধ্য হয়ো না কখনো।"
 বিয়ের মাসখানেক পড়ে স্বামী বিমলেন্দুকে জানিয়েছিল নিজের মনের কথা। বিমলেন্দু তাকে বলেছিল,
-- চাকরি করবে এত খুব ভালো কথা, তবে মায়ের মতটা নিয়ে তবে এগিও।
 না,তিনি রাজি হননি। কিন্তু নন্দিনী তার এই ইচ্ছার মৃত্যুও ঘটাতে পারেনি। মনের মধ্যে সুপ্ত ইচ্ছাকে লালন করে চলেছে আজ অবধি। বাবা,মা জীবিত থাকাকালীন সময়ে দশ বছরের বিবাহিত জীবনে দশবারও বাপেরবাড়িতে যেতে পারেনি অর্থাৎ শ্বাশুড়ী যেতে দেননি।এই দশ বছরের মধ্যেই সে বাবা,মা উভয়কেই হারিয়েছে। তাই এখন সেখানে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়েছে।
 ঘুমের মধ্যে হঠাৎ স্ট্রোকে স্বামীর যখন মৃত্যু হয় ছেলে তখন ডাক্তারি পড়ছে।শ্বাশুড়ির সামান্য পেনশনে সংসার চালাতে হয়েছে।তবুও তিনি নন্দিনীকে কিছু রোজগারের জন্য বাইরে বেরোতে দেননি।জমানো পুঁজি শেষ হয়েছে ছেলে রাহুলকে পড়াশুনা শেষ করাতে।
  শ্বাশুড়ী গত হয়েছেন বছর খানেক।ছেলে তার আগেই উচ্চ শিক্ষার জন্য লন্ডন পাড়ি দেয়।তারপর সেখানেই সেটেল্ড।এখন নন্দিনী সম্পূর্ণ একা।রাহুল প্রবাসী এক বাঙ্গালী মেয়েকে বিয়ে করে মাকে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেয় নূতন বাড়ি কিনে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে জানিয়ে।বয়স এখন নন্দিনীর পঞ্চান্ন।এই বয়সে চাকরি পাওয়া অসম্ভব।কিন্তু নিজেকে খেয়েপরে তো বাঁচতে হবে।
 পেপারে অ্যাড দেখে একটা কোচিং সেন্টারে গেছিলো বাংলার শিক্ষক হিসাবে পড়ানোর দায়িত্বটা পাওয়ার আশায়।না,তারা তাকে নিরাশ করেননি।সেদিনই সে দশম শ্রেণীর একটি ক্লাস নেয় পরীক্ষা মূলক হিসাবে।তারা তাকে জানিয়েছেন দুদিনের মধ্যে ফোন করে জানাবেন।সেখান থেকেই হাঁটতে হাঁটতে এসে গঙ্গার পাড়ে বসে।
  নন্দিনী গঙ্গার পবিত্র জলের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে সেই সময় যদি বাপেরবাড়ি কিংবা শ্বাশুড়ীর কাছে চাকরির জন্য বাঁধাপ্রাপ্ত না হতে হত তাহলে আজ এই পরিস্থিতির মধ্যে তাকে পড়তে হত না।আসলে মানুষের মেধা আর ইচ্ছা থাকলেই হয় না তার সাথে সাথে ভাগ্যেরও দরকার আছে।ভাগ্যে না থাকলে মানুষের পাওয়া জিনিসও অনেক সময় হাত ফস্কে বেরিয়ে যায়।
 

Saturday, July 9, 2022

সময় মানুষকে বুঝতে শেখায়

সময় মানুষকে বুঝতে শেখায় 

  তিন বছর হল তিয়াসার বিয়ে হয়েছে।বাবা,মায়ের পছন্দ করা ছেলেকে খুশি মনেই মেনে নিয়েছে।কলেজ লাইফে জয়কে পছন্দ করলেও কোনদিন মুখ ফুটে বলতে পারেনি তিয়াসা।জয়ের নায়কোচিত চেহারা কলেজের সব মেয়েদের পছন্দের প্রথম কারণ ছিলো।সকলেই জয়কে দেখলে কেমন যেন হ্যাংলার মত ঘিরে ধরতো যা তিয়াসা কোনদিন পারেনি।জয়ের ভূত মাথার থেকে সেদিনই নেমেছে তিয়াসার যেদিন সে নিজ চোখে দেখেছে কলেজ ক্যাম্পাসের ভিতর নিরিবিলি জায়গায় তিয়াসার ক্লাসমেট সুপর্ণাকে জয় জড়িয়ে ধরে কিস করেছে।
  কলেজ লাইফে এরপর শুধু জয় কেন অন্য কোন ছেলের দিকে তিয়াসা আর কোনদিন ফিরেও তাকায়নি।সাধারণ ভাবেই গ্র্যাজুয়েশনের পর বাড়িতে শুয়ে,বসে আর মাঝে মাঝে মাকে রান্না আর ঘরের কাজে সাহায্য করেই সময় কেটে যাচ্ছিল।বাবার রিটায়ারমেন্ট এর দিনে বাবার নির্দেশমত মাকে নিয়েই অফিসে উপস্থিত হয়েছিল।সেখানেই বাবার এক সহকর্মী তিয়াসাকে দেখে পছন্দ করেন তার একমাত্র ছেলের জন্য।
  কথাবার্তা এগোতে লাগে। তিয়াসা ও পলাশ পরস্পরকে চেনে,জানে। দু'জনেরই দু'জনকে ভালো লাগে।
  কিন্তু বিয়ের পর তিয়াসা দেখে, যে পলাশকে সে ছ'মাস ধরে চিনেছে,জেনেছে আর যে পলাশকে সে বিয়ে করেছে সে সম্পূর্ণ আলাদা।বিয়ের আগে ঘুরতে গিয়ে পলাশের যে কেয়ারিং মনোভাব সে দেখেছে বৌভাতের দু'দিন যেতে না যেতেই পলাশের সেই মনোভাব আর সে খুঁজে পায়নি।কিছুটা গায়ে পড়া হয়ে ছ'মাস আগে চেনা পলাশকে খুঁজতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে।
 প্রথম প্রথম বেশ কটাদিন তিয়াসার মন খারাপ করলেও পড়ে ভাগ্যের দোহাই দিয়ে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে।সংসারে মানুষ তো তিনজন।সকালে পলাশ অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর তার শ্বশুরমশাইও বেরিয়ে যান।সারাটাদিন তিয়াসা একাই।ঘর গুছিয়ে,শুয়ে-বসে তার সময় কাটে।শ্বশুর আগেই ফেরেন অফিস থেকে।তিনি প্রতিদিনই ফেরার পথে কিছু না কিছু খাবার কিনে আনেন।এসেই বাচ্চাদের মত তার আদরের বৌমাকে প্যাকেটটা দিয়ে বলেন,
-- বৌমা,দু'কাপ চা করে আনো তাড়াতাড়ি। পুলু ফেরার আগেই এককাপ খেয়ে নিই ও আসলে আর এক কাপের সাথে তখন তিনজনে মিলে জমিয়ে টিফিন করবো।আমি বেশি চা খেলে ব্যাটা আজকাল বেশ চিল্লায়। 
 কথাটা বলেই হাসতে থাকেন।পলাশ বাড়িতে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে বাবার আনা টিফিন খেতে খেতে বলে,
-- বাড়িতে এসে ক'কাপ চা খেলে? রোজ রোজ এত তেলে ভাজা এখন তোমার খাওয়া ঠিক নয় বাবা।
 একথা শুনে অনেক সময় তিয়াসা বলে উঠেছে,
-- সেকথা আমিও বাবাকে বারবার বলেছি।কিন্তু বাবা কথাই শোনেন না।টিফিনটা তো আমিই বানাতে পারি রোজ।
-- বানাতে পারি নয় এখন থেকে তুমিই বানিয়ে রাখবে।
    এইভাবেই চলতে থাকে দিন।বিয়ের পর থেকে পলাশ তিয়াসার ব্যাপারে যেমন উদাসীন ছিলো তার কোন পরিবর্তন হয় না।এরই মাঝে একদিন তিয়াসার শ্বশুর অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখেন তিয়াসার ভীষণ জ্বর।বাড়িতে ফিরেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে ছেলেকে ফোন করেন।পলাশ বাড়িতে ফিরে দেখে জ্বরে বেহুস তার স্ত্রী আর বাবা তার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছেন।সে কোনরকমে হাত,মুখ ধুয়ে বাবাকে কিছুটা মুড়ি আর চা করে দিয়ে তিয়াসার কাছে গিয়ে বসে।আগেই তাকে জ্বরের ওষুধ দেওয়া হয়েছিল।তখন ঘাম দিয়ে জ্বর কমছে। তিয়াসা উঠে বসার চেষ্টা করে।পলাশ তাকে বলে,
-- একদম না।যেমন শুয়ে আছ তেমন ভাবেই শুয়ে থেকো।আমি দু'টি ভাত ফুটিয়ে নিতে পারবো।
-- কিন্তু বাবা তো রাতে রুটি খান।
-- আজ ভাত খেয়ে নেবেন।তুমি আগে সুস্থ্য হও পরে এসব দেখবে।
 সেদিন রাতে যতবার তিয়াসার ঘুম ভেঙেছে সে অনুভব করেছে পলাশের একটা হাত ঘুমের মধ্যেও তার চুলে বিলি কেটে চলেছে। তিয়াসা একটু নড়লেই পলাশ উঠে বসে জানতে চেয়েছে,
-- শরীর খারাপ লাগছে?
 পরদিন শ্বশুর,স্বামী কেউ আর অফিস যায় না।সারাটা দিন বাপ,ছেলে কেউই তাকে বিছানা ছেড়ে নামতে দেয় না।মাথাটাও পলাশ ধরে নিয়ে গিয়ে বাথরুমে ধুইয়ে নিয়ে আসে।খাবার টেবিলে ভাত গুছিয়ে ঘরে এসে তিয়াসাকে ধরে নিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসায়।
 তিয়াসা বুঝতে পারে পলাশকে সে যেমন দেখেছিল ঠিক তেমনই সে আছে।সেই তাকে বুঝতে ভুল করেছিল।আসলে মানুষ বিপদে না পড়লে কাছের মানুষগুলিকে ঠিক চিনতে পারে না।মানুষ বিপদে পড়লে কাছের মানুষগুলির ভালো - মন্দ উভয় দিকই জলের মত পরিস্কার হয়ে যায়। তবে এ কথাও মানতেই হবে একটি ছেলে যখন একটি মেয়ের সাথে প্রেম করে তখন পরস্পরকে কাছে পাওয়ার যে অদম্য ইচ্ছা কাজ করে, চার দেওয়ালের মধ্যে তাকে সম্পূর্ণভাবে নিজের করে পেয়ে যাওয়ার পর সেই ইচ্ছেটা যখন পূরণ হয়ে যায় তখন কিছুটা হলেও তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন হয়ে থাকে।আর এটাই বাস্তবতা। কারণ ভালোবাসাটা তখন সহবাসে পরিণত হয় আর দায়িত্ববোধটা ভীষণভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

#মানবী

 
    

Thursday, July 7, 2022

মুখোশ

 মুখোশ 
 মাধবী বছর খানেক হল ঘোষবাবুদের বাড়িতে কাজ করছে।ঘোষগিন্নী যতক্ষণ মাধবী কাজ করে ঠিক ততক্ষনই তার পিছনে খিটির খিটির করতে থাকেন।সেই প্রথম দিন থেকে মাধবী ঘোষগিন্নীর মুখে কোনদিন ভালো কথা শোনেনি।মাঝে মাঝে মাধবী ভাবে ঘোষগিন্নীর মা বোধকরি জন্মের সময় তার মুখে মধু দিতে ভুলে গেছিলেন।যতই শরীর খারাপ হোক না কেন মাধবীর এ বাড়িতে কাজে আসা বন্ধ করতে পারবে না।তাহলে ঘোষগিন্নীর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।অবশ্য মাধবী চায়ও না ঘোষগিন্নীর বাড়ির কাজ কামাই করতে।স্বামী পরিত্যক্তা মাধবীর দুই সন্তান আর শ্বাশুড়ীকে নিয়ে সংসার।ঘোষবাবুদের বাড়িতে মাইনে ভালো।আর তাছাড়া দু'বেলা কাজে আসলেই টিফিনের জন্য সে যে খাবার ঘোষগিন্নীর কাজ থেকে পায় তা সে কোনদিনও একা খেয়ে পারে না।রোজই সে একটা প্লাস্টিকে করে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সবাই মিলে খায়।
   মাধবী কিছুতেই বুঝতে পারে না খিটখিটে ঘোষগিন্নী দু'বেলা তাকে এতটা করে খাবার দেন কেন?তিনি তো রোজই দেখছেন সে খাবার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে।দিনকে দিন যেন খাবারের পরিমাণ বেড়েই চলেছে।এই তো সেদিন স্বামী,স্ত্রী দু'জনে মিলে কোন আত্মীয়ের বাড়িতে গেছিলেন।বিকালে কাজে আসতে নিষেধ করেছিলেন।হঠাৎ রাত ন'টার দিকে ফোন।"বাড়িতে ফিরেছি কাজে আয়।" খুব রাগ হয়েছিল মাধবীর সেদিন।কিন্তু কিছুই করার নেই।যেতেই হবে।কাজটা যদি চলে যায় তাহলে খুব সমস্যায় পড়বে সে।
  মাধবীর আসতে প্রায় সাড়ে ন'টার মত বেজেছিল।এসে দেখে দু'জনে ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখতে দেখতে চা খাচ্ছেন।দরজা ভেজানোই ছিল।মুখ গোমড়া করে ঘরে ঢুকেই মাধবী চলে যায় রান্না ঘরে।গিয়ে দেখে সিংকে শুধু চায়ের বাসনটাই পড়ে আছে।মনেমনে ভাবে এই কটা বাসনের জন্য এত রাতে ডেকে পাঠানোর কি দরকার ছিলো?বাসন ক'টা মেজে রেখে যখন বেরিয়ে যাচ্ছে তখন ঘোষগিন্নী বললেন,
-- এই শোন,এদিকে আয়।ওই যে দেখ টেবিলের উপর দুপ্যাকেট বিরিয়ানী আছে।প্যাকেট দু'টো নিয়ে যা।বাচ্চা দু'টোকে দিস নিজেরাও একটু করে খেয়ে নিস।
  মাধবীর চোখ দু'টো জলে ভরে গেলো সঙ্গে সঙ্গে।সে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখটা যখন মুচছে ঘোষগিন্নী বলে উঠলেন সেই খ্যারখেরে গলায়,
-- সকাল সকাল আছিস কাজে।দেরি করে এসে আবার কোন অজুহাত দিস না।
  মাধবী মাথা হেলিয়ে বেরিয়ে গেলো।কিন্তু সত্যিই পরদিন বেলা দশটা বেজে গেলো মাধবীর পাত্তা নেই দেখে ঘোষগিন্নীর মাথায় আগুন চড়ে গেলো।বেশ কয়েকবার ফোন করলেন কিন্তু ফোন বেজে গেলো কেউ ধরলো না।আরো ক্ষেপে গিয়ে নিজেই একটা ছাতা মাথায় মাধবীর বস্তির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।এরূপ আগে কোনদিনও হয়নি যে ফোন করলে মাধবী ফোন ধরেনি।খুঁজে খুঁজে মাধবীর ঘরের কাছে গিয়ে বেশ রাগানিত্ব স্বরেই "মাধবী" বলে ডাক দিলেন।বছর সত্তরের এক বৃদ্ধা বেরিয়ে এসে যা বললেন তা হল - কাল বাবুদের বাড়ি থেকে দূপ্যাকেট বিরিয়ানী দিয়েছিল।সবাই মিলেই ভাগ করে খেয়েছিল তারা।কিন্তু ভোর রাত থেকে বড় ছেলেটির পায়খানা,বমি শুরু হয়।ভোরের দিকে কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ে সে।সবাই মিলে তাকে হাসপাতাল নিয়ে গেছে।
  এটুকু শুনে ঘোষগিন্নীর শরীরটা অস্থির অস্থির করতে লাগলো।বৃদ্ধা বলতে পারলেন না কোন হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।পাশের একটি ঘর থেকে জেনে তিনি দ্রুত পায়ে বাড়িতে এসে স্বামীকে সব জানালেন।
  ছুটে গেলেন দুজনেই হাসপাতালে।কথা বললেন ডাক্তারদের সাথে।ভয়ের কোন কারণ নেই জেনে তবে নিশ্চিন্ত হলেন।
 দুজনে সেদিন আত্মীয়ের বাড়ি থেকে খেয়েই ফিরছিলেন।বিকালের যেহেতু বাড়ি ছিলেন না তাই মাধবী এবং তার ছেলেমেয়ে দু'টির টিফিন যায়নি ঘরে ভেবেই দু'জনে ওই বিরিয়ানীর প্যাকেট দু'টি কিনে আনেন।কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল।খুব ভয় পেয়ে গেছিলেন নিঃসন্তান এই দম্পতি।
  চারদিন পর মাধবী কাজে ফিরেছে।সেই একই রূপ ঘোষগিন্নীর।এখন আর মাধবীর তার প্রতি কোন রাগ হয় না।রাগটা যে ঘোষগিন্নীর মুখোশ সেটা এখন মাধবী ভালোভাবেই বুঝে গেছে।

মানুষ চেনা বড় দায় (সপ্তম পর্ব)

  বিটু খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারে তাদের এই এস.এস. ই তার বাবা সুভাষ সাহা।এস.এস. ক্লাসে আসলেই বিটু কেমন যেন হয়ে যেত।এত মেধাবী ছেলে হওয়া স্বর্তেও এতটাই অন্য মনস্ক হয়ে পড়ত সে কোন পড়াই তার কর্ণগোচর হত না।দু'একদিন অন্যমস্কতার কারণে ভৎসনার স্বীকারও হয়েছে।কিন্তু বেশিদিন তাকে এই অস্বস্তিতে পড়তে হয়নি।কলেজে ভর্তি হওয়ার মাস তিনেকের মধ্যেই এস.এস. রিটায়ার করে যান।
  খোঁজ নিয়ে আগেই জানতে পেরেছিল তার একটি সৎবোন আছে।সে পড়াশুনায় খুবই ভালো।ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার মধ্যে বিটু একবারই শুধু বাড়ি গেছিলো তার ঠাকুমা  অত্যন্ত অসুস্থ্য হয়ে তাকে দেখতে চাওয়ার কারণে।মৃত্যুর আগে ঠাকুমা তাকে জানিয়ে গেছিলেন রায় চৌধুরীবাবু তাদের জন্য যথেষ্ঠ করেছেন।ভবিষ্যতে তিনি কিছু বললে তার কথার যেন সে মান্যতা দেয়।বিটু তখন তার ঠাকুমাকে জানিয়ে দেয় যে সে তার বাবার দেখা পেয়েছে।সেকথা জেনে ঠাকুমা তাকে জানান,
-- তার ছেলের কথা জানার কোন ইচ্ছা তার নেই।সে যেন তার মাকে কোনদিন কষ্ট না দেয়।
  মৃত্যুর আগে ঠাকুমার দু'চোখ বেয়ে যে জলের ধারা নামে তাতেই বিটু বুঝে যায় ঠাকুমার চোখের এ জল তার একমাত্র সন্তানের জন্যই!
  কাজ মিটে যাওয়ার পর বিটু ফিরে আসে।দিনরাত এক করে পড়ার ফল সে হাতে হাতেই পায়, ব্যাঙ্গালোরে ভালো চাকরির অফার।মাকে সাথে নিয়ে যেতে চাইলে মা রাজি হন না।রায় চৌধুরীবাবু এবার তাদের মনের কথা জানান। বিটু দু'বছর সময় চেয়ে নেয়। 
  মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার বিটু অনেক সময় তার পদমর্যাদার কথা ভুলে শ্রমিকদের সাথে সাধারণ একজন শ্রমিক হিসাবেই কাজে হাত লাগিয়েছে।উপর মহলের চোখ রাঙানি তাকে এ কাজ থেকে বিরত করতে পারেনি।নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে তাদের ভালো টিফিনের ব্যবস্থাও করেছে।চাকরি পাওয়ার প্রথম মাস থেকেই মাকে মাইনের চার ভাগের তিনভাগ টাকা পাঠাতে তার কখনোই ভুল হয়নি।
  দু'বছর বাদে সে তার কথা রাখে রায় চৌধুরীবাবুর খোঁড়া মেয়েটিকে বিয়ে করে সসম্মানে সে তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেয়।

 ক্রমশ 

অক্ষমতা

 সংসারে পড়ে রইলো তিনটে প্রাণী।একটি শিশু,একজন বয়স্কা আর পূর্ণ যৌবনা এক নারী।অথচ সংসারে উপার্জনক্ষম কোন মানুষ নেই।কামিনী পড়লো মহা ফ্যাসাদে।
 কামিনী গ্রামের অবস্থাপন্ন রায় চৌধুরীদের বাড়িতে গিয়ে তার দুঃখের কথা জানিয়ে ভীষণভাবে কান্নাকাটি করতে লাগলে রায় চৌধুরী গিন্নী তাকে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি কাজে বহাল করেন।নামেই কাজ।গিন্নী মায়ের সাথে সাথে থাকা,ঘণ্টায় ঘণ্টায় পান সেজে দেওয়া আর টুকটাক এদিক-ওদিক কিছু সামান্য কাজ।বিনিময়ে যে টাকা এবং খাবার দিতেন তাকে তাতে তিনটে পেট ভালোভাবে না ভরলেও চলে যেত।প্রথম মাসটা একটু কষ্ট হলেও পরের মাস থেকে ঠিক চলে যাচ্ছিল।কামিনীর ছেলের পড়াশুনার ভালো মাথা দেখে রায় চৌধুরীবাবু নিজের থেকেই তার পড়াশুনার দায়িত্ব নেন।ছেলেবেলার থেকেই কামিনীর আদরের বিটু ভীষণ বুদ্ধিমান আর বোঝদার ছেলে।যে সুযোগ সে পেয়েছে জীবনে তার নির্যাস লাভ তাকে করতেই হবে এই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনোভাবে সে দিনরাত এক করে পড়াশুনা শুরু করে। 
 গ্রামের স্কুল থেকে বেশ কয়েকটি বিষয়ে লেটার মার্কস নিয়ে সে মাধ্যমিক পাশ করার পর রায় চৌধুরীবাবুর চেষ্টায় কলকাতায় উচ্চমাধ্যমিকও বেশ ভালো রেজাল্ট করে।
 তখন বিটুর ক্লাস নাইন।ছেলেবেলা থেকেই মা ও ঠাকুমার আলোচনা থেকে বাবার সম্পর্কে সব জেনেই সে বড় হয়েছে।একদিন মায়ের অনুপস্থিতিতে মায়ের আলমারির ভিতর থেকে মায়ের অজান্তে টেনে বের করে আনে বাবা,মায়ের একটি ছবি।
  রায় চৌধুরীবাবুর একটি মাত্র কন্যা সন্তান।জন্ম থেকেই তার পায়ে সামান্য অসুবিধা থাকায় সে একটু খুঁড়িয়েই হাঁটে।গ্রামের স্কুল থেকেই সে মাধ্যমিক পাশ করার পর পড়াশুনা আর তার এগোয়নি।রায় চৌধুরী গিন্নী তাকে সংসারের কাজকর্মে পারদর্শী করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিটুর প্রতি চৌধুরী পরিবারের দুর্বলতার আরও একটি কারণ দূরদৃষ্টি সম্পন্ন রায় চৌধুরীবাবু বিটুর মধ্যে এক উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখেছেন।যদি তিনি বিটুকে একটু সাহায্য করেন তাহলে ভবিষ্যতে বিটু যে জায়গায় দাঁড়াবে তাতে তার মেয়ে সুখীই থাকবে।
  বিটু তার মেধা শক্তির পরিচয় দিয়ে সরকারিভাবে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সুযোগ পায়।
  প্রথম দিন ক্লাসে বিটু যাকে ক্লাস নিতে দেখে তাতে সে ভীষণভাবে ঘাবড়ে যায়।

  ক্রমশ -

মুখোশ

 মুখোশ (m)
 মাধবী বছর খানেক হল ঘোষবাবুদের বাড়িতে কাজ করছে।ঘোষগিন্নী যতক্ষণ মাধবী কাজ করে ঠিক ততক্ষনই তার পিছনে খিটির খিটির করতে থাকেন।সেই প্রথম দিন থেকে মাধবী ঘোষগিন্নীর মুখে কোনদিন ভালো কথা শোনেনি।মাঝে মাঝে মাধবী ভাবে ঘোষগিন্নীর মা বোধকরি জন্মের সময় তার মুখে মধু দিতে ভুলে গেছিলেন।যতই শরীর খারাপ হোক না কেন মাধবীর এ বাড়িতে কাজে আসা বন্ধ করতে পারবে না।তাহলে ঘোষগিন্নীর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।অবশ্য মাধবী চায়ও না ঘোষগিন্নীর বাড়ির কাজ কামাই করতে।স্বামী পরিত্যক্তা মাধবীর দুই সন্তান আর শ্বাশুড়ীকে নিয়ে সংসার।ঘোষবাবুদের বাড়িতে মাইনে ভালো।আর তাছাড়া দু'বেলা কাজে আসলেই টিফিনের জন্য সে যে খাবার ঘোষগিন্নীর কাজ থেকে পায় তা সে কোনদিনও একা খেয়ে পারে না।রোজই সে একটা প্লাস্টিকে করে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সবাই মিলে খায়।
   মাধবী কিছুতেই বুঝতে পারে না খিটখিটে ঘোষগিন্নী দু'বেলা তাকে এতটা করে খাবার দেন কেন?তিনি তো রোজই দেখছেন সে খাবার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে।দিনকে দিন যেন খাবারের পরিমাণ বেড়েই চলেছে।এই তো সেদিন স্বামী,স্ত্রী দু'জনে মিলে কোন আত্মীয়ের বাড়িতে গেছিলেন।বিকালে কাজে আসতে নিষেধ করেছিলেন।হঠাৎ রাত ন'টার দিকে ফোন।"বাড়িতে ফিরেছি কাজে আয়।" খুব রাগ হয়েছিল মাধবীর সেদিন।কিন্তু কিছুই করার নেই।যেতেই হবে।কাজটা যদি চলে যায় তাহলে খুব সমস্যায় পড়বে সে।
  মাধবীর আসতে প্রায় সাড়ে ন'টার মত বেজেছিল।এসে দেখে দু'জনে ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখতে দেখতে চা খাচ্ছেন।দরজা ভেজানোই ছিল।মুখ গোমড়া করে ঘরে ঢুকেই মাধবী চলে যায় রান্না ঘরে।গিয়ে দেখে সিংকে শুধু চায়ের বাসনটাই পড়ে আছে।মনেমনে ভাবে এই কটা বাসনের জন্য এত রাতে ডেকে পাঠানোর কি দরকার ছিলো?বাসন ক'টা মেজে রেখে যখন বেরিয়ে যাচ্ছে তখন ঘোষগিন্নী বললেন,
-- এই শোন,এদিকে আয়।ওই যে দেখ টেবিলের উপর দুপ্যাকেট বিরিয়ানী আছে।প্যাকেট দু'টো নিয়ে যা।বাচ্চা দু'টোকে দিস নিজেরাও একটু করে খেয়ে নিস।
  মাধবীর চোখ দু'টো জলে ভরে গেলো সঙ্গে সঙ্গে।সে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখটা যখন মুচছে ঘোষগিন্নী বলে উঠলেন সেই খ্যারখেরে গলায়,
-- সকাল সকাল আছিস কাজে।দেরি করে এসে আবার কোন অজুহাত দিস না।
  মাধবী মাথা হেলিয়ে বেরিয়ে গেলো।কিন্তু সত্যিই পরদিন বেলা দশটা বেজে গেলো মাধবীর পাত্তা নেই দেখে ঘোষগিন্নীর মাথায় আগুন চড়ে গেলো।বেশ কয়েকবার ফোন করলেন কিন্তু ফোন বেজে গেলো কেউ ধরলো না।আরো ক্ষেপে গিয়ে নিজেই একটা ছাতা মাথায় মাধবীর বস্তির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।এরূপ আগে কোনদিনও হয়নি যে ফোন করলে মাধবী ফোন ধরেনি।খুঁজে খুঁজে মাধবীর ঘরের কাছে গিয়ে বেশ রাগানিত্ব স্বরেই "মাধবী" বলে ডাক দিলেন।বছর সত্তরের এক বৃদ্ধা বেরিয়ে এসে যা বললেন তা হল - কাল বাবুদের বাড়ি থেকে দূপ্যাকেট বিরিয়ানী দিয়েছিল।সবাই মিলেই ভাগ করে খেয়েছিল তারা।কিন্তু ভোর রাত থেকে বড় ছেলেটির পায়খানা,বমি শুরু হয়।ভোরের দিকে কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ে সে।সবাই মিলে তাকে হাসপাতাল নিয়ে গেছে।
  এটুকু শুনে ঘোষগিন্নীর শরীরটা অস্থির অস্থির করতে লাগলো।বৃদ্ধা বলতে পারলেন না কোন হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।পাশের একটি ঘর থেকে জেনে তিনি দ্রুত পায়ে বাড়িতে এসে স্বামীকে সব জানালেন।
  ছুটে গেলেন দুজনেই হাসপাতালে।কথা বললেন ডাক্তারদের সাথে।ভয়ের কোন কারণ নেই জেনে তবে নিশ্চিন্ত হলেন।
 দুজনে সেদিন আত্মীয়ের বাড়ি থেকে খেয়েই ফিরছিলেন।বিকালের যেহেতু বাড়ি ছিলেন না তাই মাধবী এবং তার ছেলেমেয়ে দু'টির টিফিন যায়নি ঘরে ভেবেই দু'জনে ওই বিরিয়ানীর প্যাকেট দু'টি কিনে আনেন।কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল।খুব ভয় পেয়ে গেছিলেন নিঃসন্তান এই দম্পতি।
  চারদিন পর মাধবী কাজে ফিরেছে।সেই একই রূপ ঘোষগিন্নীর।এখন আর মাধবীর তার প্রতি কোন রাগ হয় না।রাগটা যে ঘোষগিন্নীর মুখোশ সেটা এখন মাধবী ভালোভাবেই বুঝে গেছে।


Thursday, June 30, 2022

মানুষ চেনা দায় (পঞ্চম পর্ব)

 নিকিতা কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে অতনুর এই অদ্ভুত কাজকর্ম দেখে অকারনেই কেন যেন ক্ষেপে যায়!কিছুতেই সে মাথায় আনতে পারে না কেন এই মানুষটার এইসব কাজকর্ম বা তাকে সাহায্য করার পরেও সে মেনে নিতে পারছে না।বিনা কারণেই লোকটার প্রতি দিনকে দিন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সে। অকূল সমুদ্রে সাঁতার কেটেও এই প্রশ্নের কোন মীমাংসা সে করতে পারে না।প্রথম থেকেই নিকিতার এই অতনুকে দেখলেই শরীরে অদ্ভুত এক ইরিটেশন হয়।
  পুরনো কিছু ঘটনা -
   সুভাষ রায় বাবা,মায়ের কথামত ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পড়তেই কামিনীকে নিজের অমতে বিয়ে করতে বাধ্য হয়।গ্রামের ছেলে কলকাতা শহরে থেকে পড়াশুনা করছিলো।হঠাৎ বাবার ফোন পেয়ে গ্রামে গিয়ে শোনে বাবা তার বিয়ে ঠিক করেছেন।একমাত্র সন্তান।একটু বেশি বয়সে সুভাষ রায় তার মায়ের কোলে আসেন।কলকাতা সম্পর্কে নানান কথা শুনতে শুনতে স্বল্প শিক্ষিত সুভাষের বাবা ভয় পান তার ছেলে কোন মেয়ের পাল্লায় পড়লে তার লেখাপড়ায় ব্যাঘাত হবে।তাই স্বামী,স্ত্রী দু'জনে পরামর্শ করে গ্রামের মাধ্যমিক পাশ করা দেখতে শুনতে মন্দ নয় এমন একটি মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করে ছেলেকে ডেকে এনে বিয়ে দেন।
  ঘটনার আকস্মিকতায় সুভাষ প্রথমে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও বাবার সাথে তর্কে পেরে না উঠে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করতে কামিনীকে বাধ্য হয় কারণ বাবার কথা অগ্রাহ্য করলে উচ্চাকাঙ্খী সুভাষের পড়াশুনাটাই হয়ত বন্ধ হয়ে যাবে।কারণ সে ভালো করেই জানে তার বাবা প্রচণ্ড জেদী।
তখন সুভাষের ইঞ্জিনিয়ািংয়ে তৃতীয় বর্ষ।
 প্রথম থেকেই সুভাষ কামিনীকে মন থেকে মেনে নিতে না পারলেও যুবক ছেলের শারীরিক সম্পর্কে কোন অনীহা দেখা যায় না।বিয়ের পর সুভাষ যে কটাদিন বাড়িতে ছিলেন প্রতিদিনই প্রায় দু থেকে তিনবার সে কামিনীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক লিপ্ত হয়।অথচ সে কামিনীকে একটুও ভালো বাসতে পারেনি এই কটাদিনে।বিয়ের সাতদিন পর সুভাষ যথারীতি কলকাতা চলে আসেন। 

ক্রমশ -

মানুষ চেনা দায় (চতুর্থ পর্ব)

মানুষ চেনা দায় (চতুর্থ পর্ব)
 নিকিতা কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে অতনুর এই অদ্ভুত কাজকর্ম দেখে অকারনেই কেন যেন ক্ষেপে যায়!কিছুতেই সে মাথায় আনতে পারে না কেন এই মানুষটার এইসব কাজকর্ম বা তাকে সাহায্য করার পরেও সে মেনে নিতে পারছে না।বিনা কারণেই লোকটার প্রতি দিনকে দিন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সে। অকূল সমুদ্রে সাঁতার কেটেও এই প্রশ্নের কোন মীমাংসা সে করতে পারে না।প্রথম থেকেই নিকিতার এই অতনুকে দেখলেই শরীরে অদ্ভুত এক ইরিটেশন হয়।
  পুরনো কিছু ঘটনা -
   সুভাষ রায় বাবা,মায়ের কথামত ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পড়তেই কামিনীকে নিজের অমতে বিয়ে করতে বাধ্য হয়।গ্রামের ছেলে কলকাতা শহরে থেকে পড়াশুনা করছিলো।হঠাৎ বাবার ফোন পেয়ে গ্রামে গিয়ে শোনে বাবা তার বিয়ে ঠিক করেছেন।একমাত্র সন্তান।একটু বেশি বয়সে সুভাষ রায় তার মায়ের কোলে আসেন।কলকাতা সম্পর্কে নানান কথা শুনতে শুনতে স্বল্প শিক্ষিত সুভাষের বাবা ভয় পান তার ছেলে কোন মেয়ের পাল্লায় পড়লে তার লেখাপড়ায় ব্যাঘাত হবে।তাই স্বামী,স্ত্রী দু'জনে পরামর্শ করে গ্রামের মাধ্যমিক পাশ করা দেখতে শুনতে মন্দ নয় এমন একটি মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করে ছেলেকে ডেকে এনে বিয়ে দেন।
  ঘটনার আকস্মিকতায় সুভাষ প্রথমে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও বাবার সাথে তর্কে পেরে না উঠে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করতে কামিনীকে বাধ্য হয় কারণ বাবার কথা অগ্রাহ্য করলে উচ্চাকাঙ্খী সুভাষের পড়াশুনাটাই হয়ত বন্ধ হয়ে যাবে।কারণ সে ভালো করেই জানে তার বাবা প্রচণ্ড জেদী।
তখন সুভাষের ইঞ্জিনিয়ািংয়ে তৃতীয় বর্ষ।
 প্রথম থেকেই সুভাষ কামিনীকে মন থেকে মেনে নিতে না পারলেও যুবক ছেলের শারীরিক সম্পর্কে কোন অনীহা দেখা যায় না।বিয়ের পর সুভাষ যে কটাদিন বাড়িতে ছিলেন প্রতিদিনই প্রায় দু থেকে তিনবার সে কামিনীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক লিপ্ত হয়।অথচ সে কামিনীকে একটুও ভালো বাসতে পারেনি এই কটাদিনে।বিয়ের সাতদিন পর সুভাষ যথারীতি কলকাতা চলে আসেন। 

ক্রমশ -

Thursday, June 23, 2022

সমাজ কি ভাববে (m)

সমাজ কি ভাববে (m)

  ভুল একবারই হয়,বারবার করলে তা হয় অন্যায়।
   আজ সিঙ্গেল মাদার শ্রেয়সীর একমাত্র মেয়ে শ্রীপর্ণা মাধ্যমিকে প্রথম হওয়ায় তার ছোট্ট ফ্ল্যাটটিতে সাংবাদিকদের হুড়োহুড়ি লেগে গেছে।
  তিনদিনের শিশুটিকে গ্রহণ করার জন্য শ্রেয়সী অনেক কাকুটিমিনতি করেছিলো সেদিন উজানের কাছে।কিন্তু উজান শ্রেয়সীর কোন কথাই শোনেনি।তার একটাই কথা ছিল "আমাকে বিয়ে করতে হলে ওই বাচ্চাকে তুমি দত্তক নিতে পারবে না।অন্যের পাপের বোঝা আজীবন আমি টানতে পারবো না।"
  দশ বছর হল উজানের বিয়ে হয়েছে।এক অফিসে এখন না থাকলেও উজানের খবর সবই জানে শ্রেয়সী।কোন সন্তান তাদের নেই।অফিসের আর একজন সহকর্মীর সাথে উজানের বিয়ে হয়।অন্যদের মুখেই শুনেছে শ্রেয়সী,সন্তান না হওয়ার দোষটা উজানেরই।
 বিয়ের দশ বছর পর একটি কন্যা সন্তান দত্তক নেয় উজান ও তার স্ত্রী মানসী।
  মাধ্যমিক পরীক্ষার পর শ্রেয়সী মেয়েকে নিয়ে যখন শপিংমলে শপিং করছে তখন হঠাৎ করেই উজানের সাথে তার দেখা।সেও এসেছে তার মেয়ের জন্য কিছু কেনাকাটা করতে।আর তখনই শ্রেয়সীর মেয়ের আড়ালে উজান হাত জোড় করে শ্রেয়সীর কাছে ক্ষমা চায়।
    মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য ফর্ম ফিলাপ করতে গিয়ে শ্রেয়সী একটা জায়গা ফাঁকা রেখেছিল;আর সেটা হচ্ছে ফাদার্স নেম।
  হেড মিস্ট্রেস ফর্মটা আবার শ্রেয়সীর হাতে দিয়ে বললেন,
-- এখানে আপনার স্বামীর নামটা লিখুন।
-- নেই তো
-- নেই তো আপনাকে দেখেই বুঝতে পারছি।কিন্তু ফর্মে তো নামটা লাগবে।
--- যে নেই তার নাম কোথায় পাবো?
--- আপনার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।আপনি আপনার সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করতে এসেছেন।সন্তানের বাবার নামটা লিখতে বা বলতে আপনার এত অসুবিধা হচ্ছে কেন?
--- হয় আপনি বুঝতে পারছেন না নয় আমি আপনাকে বুঝাতে পারছি না।আমি বিয়ে করিনি।কিন্তু আমিই ওর মা।
 হেডমিস্ট্রেস চুপচাপ শ্রেয়সীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।পাহাড় সমান প্রশ্ন তার মাথায় কিলবিল করছে।কিন্তু কোনো প্রশ্নই না করে শ্রেয়সীর মুখের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলেন।
  কর্পোরেট দুনিয়ায় চাকুরীরত শ্রেয়সী ভালোবাসে তারই সহকর্মী উজানকে।দুই বাড়িতেই দু'জনকে মেনে নিয়েছে।বিয়ে ঠিকঠাক।পুরোদমে শপিং চলছে। হাতে গোনা মাত্র পনেরদিন বাকি।অফিস সেরে মাসতুত বোনের বাড়ি আইবুড়ো ভাত খেয়ে রাতে বেরোতে একটু দেরিই হয়ে গেছিলো।নিজেই ড্রাইভ করে ফিরছিলো।বাড়িতে মা একাই।বেশ কয়েকবার ফোনে মেয়েকে বলা হয়ে গেছে "সাবধানে আসিস"।ফিরছিলো বাইপাস ধরেই।
 বহুদূর থেকেই তার চোখ পড়ে রাস্তার একপাশে বেশ একটা জটলা।এত রাতে গাড়িটা থামাবে কিনা,কোন রকম বিপদ আসতে পারে কিনা বেশ কয়েকবার ভেবেও গাড়িটা একপাশে দাঁড় করিয়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায়।একজন দরিদ্র জীর্ণ বস্ত্র পরিহিতা ভদ্রমহিলা প্রসব যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছেন আর কিছু মানুষ তার এই যন্ত্রণায় দগ্ধ হওয়ার চিৎকার দাঁড়িয়ে দেখে চলেছে। অদূরে তার নজরে আসে প্লাস্টিকের ছাউনী দেওয়া একটা আস্তানা।সেখানে যারা দাঁড়িয়ে ছিলেন সকলেই পুরুষ সুতরাং তাদেরও ঠিক দোষও দেওয়া যায় না।এখন তো নানান সমস্যা।মানুষের উপকার করতে গেলেও প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে অনেক সময় দোষীও হয়ে যেতে হয়।
 দু'একজনের সহায়তায় ওই ভদ্রমহিলাকে নিয়ে শ্রেয়সী তখনই একটি সরকারি হাসপাতালে আসে।এর মধ্যে বারকয়েক মায়ের ফোন আসাতে কোনরকমে লাউস্পিকারে দিয়ে মাকে জানিয়ে দেয় ফিরতে রাত হবে।
 ভদ্রমহিলাকে হাসপাতালে ভর্তি করে বাড়ি ফিরতে রাত প্রায় দুটো।পরদিন অফিস যায় না।সকালে ফোন করে উজানকে সব জানায়।উজান চুপচাপ সব শোনে কিন্তু কোন কথার কোন উত্তর দেয় না।দুপুর বারোটা নাগাদ হাসপাতাল থেকে ফোন করে জানায় ভর্তিরত ওই ভদ্রমহিলা একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছেন।যেহেতু শ্রেয়সী তাকে ভর্তি করে নাম,ঠিকানা আর ফোন নম্বর দিয়ে এসেছিল তাই আজই তাকে দেখা করতে হবে।
 উজানকে ফোন করে সব জানায় সে।উজান আসে তো না ই উপরন্তু এই উটকো ঝামেলায় তাকে জড়াতে নিষেধ করে।মাকে রাতে ফিরেই সব জানিয়েছিল।মা তাকে খুব সমর্থন জানিয়েছিলেন এতবড় মানসিকতার পরিচয় দেওয়ার জন্য।উজানকে ফোন করার পর মাকে এখনকার বিষয়টি জানিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
 প্রথমেই সে আসে গতকাল যেখান থেকে তাকে তুলে নিয়ে হাসপাতাল ভর্তি করেছিলো সেখানে।কিন্তু প্লাস্টিক দিয়ে মোড়া ছাউনীর ভিতর ঢুকে কাউকেই সে দেখতে পেলো না।আশেপাশে কোন বাড়িঘরও তার চোখে পড়লো না।বড় বড় প্রায় আকাশ ছোঁয়া সব বিল্ডিং।এমন একজন নারীর খোঁজ তারা কেউ রাখবে না এটা নিশ্চিত।প্রচণ্ড চিন্তিত হয়ে পড়লো শ্রেয়সী।গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ভাবছে এখন সে কি করবে?হঠাৎ সেখান থেকে এক ভদ্রলোককে সাইকেল করে যেতে দেখে তাকে দাঁড় করিয়ে তার কাছ থেকেই জানতে পারে ভদ্রমহিলা মানসিক ভারসাম্যহীন।নিজেই কোথা থেকে ওই প্লাস্টিক জোগাড় করে রোদ বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচাতে ওই ব্যবস্থা করেছে।তাহলে প্রেগন্যান্ট?
 হায় ঈশ্বর!মানুষের কি রুচি!একজন মানসিক ভারসাম্যহীন নারীকেউ হায়েনারা ছাড়েনি।
   কিন্তু সুস্থ্য,সুন্দর সমাজ একজন শিক্ষিত,সুন্দরী,মাস গেলে হাজার হাজার টাকা রোজগার করা মহিলাকে অনায়াসে একজন শিক্ষিত পুরুষের জীবন থেকে ছেটে ফেলতে পারে কারণ একটা জারজ সন্তানকে সে দত্তক নিলে "সমাজ কি ভাববে এই ভাবনায়।"


    

মানুষ চেনা বড় দায় (তৃতীয় পর্ব)

মানুষ চেনা বড় দায় (তৃতীয় পর্ব)

   নিকিতা বাস থেকে নেমে অদ্ভুতুড়ে লোকটা সম্পর্কে সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে অফিসে পৌঁছে দেখে অতনু তার টেবিলে কম্পিউটারের সামনে বসে কাজ করে চলেছে।"এ কিরে বাবা!লোকটা ম্যাজিক জানে নাকি?এত তাড়াতাড়ি কোথা থেকে অফিসে এসে ঢুকলো?
  সুন্দরী,স্মার্ট নিকিতা মনেমনে ভাবে এই মানুষটা সম্পর্কে সে যেন একটু বেশিই ভাবছে।যাক গে যাক -- আর পাঁচজন সাধারণ কর্মচারীর মত অতনু গায়েনও।তাকে নিয়ে এত ভাবার কোন মানে নেই।
  সেদিনের ঘটনার পড়ে ওই হলরুমে মিস্ত্রীদের কাজ চলছে।সব সময় ঠুকঠাক আওয়াজ লেগেই আছে।যে রুমে বসে অফিসের টেম্পোরারি কাজ চলছে সেই রুমে ছোট একটা বেসিন।আর সেই বেসিনে টিফিন খাওয়ার পর হাত,মুখ ধুতে রীতিমত একটা লাইন পড়ে যাচ্ছে।তাই টিফিন আওয়ারে নিকিতা খাবারটা খেয়ে ব্যাগের থেকে নিজের জলের বোতলটা বের করে নিয়ে বাইরেই হাত,মুখ ধুতে এসে অতনুর কান্ড দেখে তো সে থ। এ মানুষটা কি ধরনের ভেবেই সে পাচ্ছে না।বাইরে বেরিয়ে নিকিতা দেখে নিজের টিফিন বক্সটা তার বোগোলে ধরা আর হাতে একটা বড় প্লাস্টিকের ব্যাগ। যার ভিতর থেকে সে কেক বের করে অফিসে কাজ করতে আসা প্রত্যেক লেবারকে একটা করে কেক দিচ্ছে আর পাশে বড় একটা কেটলি থেকে কাগজের কাপে চা ঢেলে দিচ্ছে অফিসের বাইরে রাস্তার উপরে চায়ের স্টলের ছেলেটা।অথচ নিকিতা জানে লেবারদের এই টিফিনের টাকা তাদের যে কন্ট্রাক্টরের আন্ডারে তারা কাজ করছে তার।খামোখা লোকটা এই টাকা কেন এদের পিছনে খরচ করছে তা তার বোধগম্য হল না।

ক্রমশ --

Wednesday, June 22, 2022

সমাজ কি ভাববে

সমাজ কি ভাববে 

  ভুল একবারই হয়,বারবার করলে তা হয় অন্যায়।
   আজ সিঙ্গেল মাদার শ্রেয়সীর একমাত্র মেয়ে শ্রীপর্ণা মাধ্যমিকে প্রথম হওয়ায় তার ছোট্ট ফ্ল্যাটটিতে সাংবাদিকদের হুড়োহুড়ি লেগে গেছে।
  তিনদিনের শিশুটিকে গ্রহণ করার জন্য শ্রেয়সী অনেক কাকুটিমিনতি করেছিলো সেদিন উজানের কাছে।কিন্তু উজান শ্রেয়সীর কোন কথাই শোনেনি।তার একটাই কথা ছিল "আমাকে বিয়ে করতে হলে ওই বাচ্চাকে তুমি দত্তক নিতে পারবে না।অন্যের পাপের বোঝা আজীবন আমি টানতে পারবো না।"
  দশ বছর হল উজানের বিয়ে হয়েছে।এক অফিসে এখন না থাকলেও উজানের খবর সবই জানে শ্রেয়সী।কোন সন্তান তাদের নেই।অফিসের আর একজন সহকর্মীর সাথে উজানের বিয়ে হয়।অন্যদের মুখেই শুনেছে শ্রেয়সী,সন্তান না হওয়ার দোষটা উজানেরই।
 বিয়ের দশ বছর পর একটি কন্যা সন্তান দত্তক নেয় উজান ও তার স্ত্রী মানসী।
  মাধ্যমিক পরীক্ষার পর শ্রেয়সী মেয়েকে নিয়ে যখন শপিংমলে শপিং করছে তখন হঠাৎ করেই উজানের সাথে তার দেখা।সেও এসেছে তার মেয়ের জন্য কিছু কেনাকাটা করতে।আর তখনই শ্রেয়সীর মেয়ের আড়ালে উজান হাত জোড় করে শ্রেয়সীর কাছে ক্ষমা চায়।
    মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য ফর্ম ফিলাপ করতে গিয়ে শ্রেয়সী একটা জায়গা ফাঁকা রেখেছিল;আর সেটা হচ্ছে ফাদার্স নেম।
  হেড মিস্ট্রেস ফর্মটা আবার শ্রেয়সীর হাতে দিয়ে বললেন,
-- এখানে আপনার স্বামীর নামটা লিখুন।
-- নেই তো
-- নেই তো আপনাকে দেখেই বুঝতে পারছি।কিন্তু ফর্মে তো নামটা লাগবে।
--- যে নেই তার নাম কোথায় পাবো?
--- আপনার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।আপনি আপনার সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করতে এসেছেন।সন্তানের বাবার নামটা লিখতে বা বলতে আপনার এত অসুবিধা হচ্ছে কেন?
--- হয় আপনি বুঝতে পারছেন না নয় আমি আপনাকে বুঝাতে পারছি না।আমি বিয়ে করিনি।কিন্তু আমিই ওর মা।
 হেডমিস্ট্রেস চুপচাপ শ্রেয়সীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।পাহাড় সমান প্রশ্ন তার মাথায় কিলবিল করছে।কিন্তু কোনো প্রশ্নই না করে শ্রেয়সীর মুখের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলেন।
  কর্পোরেট দুনিয়ায় চাকুরীরত শ্রেয়সী ভালোবাসে তারই সহকর্মী উজানকে।দুই বাড়িতেই দু'জনকে মেনে নিয়েছে।বিয়ে ঠিকঠাক।পুরোদমে শপিং চলছে। হাতে গোনা মাত্র পনেরদিন বাকি।অফিস সেরে মাসতুত বোনের বাড়ি আইবুড়ো ভাত খেয়ে রাতে বেরোতে একটু দেরিই হয়ে গেছিলো।নিজেই ড্রাইভ করে ফিরছিলো।বাড়িতে মা একাই।বেশ কয়েকবার ফোনে মেয়েকে বলা হয়ে গেছে "সাবধানে আসিস"।ফিরছিলো বাইপাস ধরেই।
 বহুদূর থেকেই তার চোখ পড়ে রাস্তার একপাশে বেশ একটা জটলা।এত রাতে গাড়িটা থামাবে কিনা,কোন রকম বিপদ আসতে পারে কিনা বেশ কয়েকবার ভেবেও গাড়িটা একপাশে দাঁড় করিয়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায়।একজন দরিদ্র জীর্ণ বস্ত্র পরিহিতা ভদ্রমহিলা প্রসব যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছেন আর কিছু মানুষ তার এই যন্ত্রণায় দগ্ধ হওয়ার চিৎকার দাঁড়িয়ে দেখে চলেছে। অদূরে তার নজরে আসে প্লাস্টিকের ছাউনী দেওয়া একটা আস্তানা।সেখানে যারা দাঁড়িয়ে ছিলেন সকলেই পুরুষ সুতরাং তাদেরও ঠিক দোষও দেওয়া যায় না।এখন তো নানান সমস্যা।মানুষের উপকার করতে গেলেও প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে অনেক সময় দোষীও হয়ে যেতে হয়।
 দু'একজনের সহায়তায় ওই ভদ্রমহিলাকে নিয়ে শ্রেয়সী তখনই একটি সরকারি হাসপাতালে আসে।এর মধ্যে বারকয়েক মায়ের ফোন আসাতে কোনরকমে লাউস্পিকারে দিয়ে মাকে জানিয়ে দেয় ফিরতে রাত হবে।
 ভদ্রমহিলাকে হাসপাতালে ভর্তি করে বাড়ি ফিরতে রাত প্রায় দুটো।পরদিন অফিস যায় না।সকালে ফোন করে উজানকে সব জানায়।উজান চুপচাপ সব শোনে কিন্তু কোন কথার কোন উত্তর দেয় না।দুপুর বারোটা নাগাদ হাসপাতাল থেকে ফোন করে জানায় ভর্তিরত ওই ভদ্রমহিলা একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছেন।যেহেতু শ্রেয়সী তাকে ভর্তি করে নাম,ঠিকানা আর ফোন নম্বর দিয়ে এসেছিল তাই আজই তাকে দেখা করতে হবে।
 উজানকে ফোন করে সব জানায় সে।উজান আসে তো না ই উপরন্তু এই উটকো ঝামেলায় তাকে জড়াতে নিষেধ করে।মাকে রাতে ফিরেই সব জানিয়েছিল।মা তাকে খুব সমর্থন জানিয়েছিলেন এতবড় মানসিকতার পরিচয় দেওয়ার জন্য।উজানকে ফোন করার পর মাকে এখনকার বিষয়টি জানিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
 প্রথমেই সে আসে গতকাল যেখান থেকে তাকে তুলে নিয়ে হাসপাতাল ভর্তি করেছিলো সেখানে।কিন্তু প্লাস্টিক দিয়ে মোড়া ছাউনীর ভিতর ঢুকে কাউকেই সে দেখতে পেলো না।আশেপাশে কোন বাড়িঘরও তার চোখে পড়লো না।বড় বড় প্রায় আকাশ ছোঁয়া সব বিল্ডিং।এমন একজন নারীর খোঁজ তারা কেউ রাখবে না এটা নিশ্চিত।প্রচণ্ড চিন্তিত হয়ে পড়লো শ্রেয়সী।গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ভাবছে এখন সে কি করবে?হঠাৎ সেখান থেকে এক ভদ্রলোককে সাইকেল করে যেতে দেখে তাকে দাঁড় করিয়ে তার কাছ থেকেই জানতে পারে ভদ্রমহিলা মানসিক ভারসাম্যহীন।নিজেই কোথা থেকে ওই প্লাস্টিক জোগাড় করে রোদ বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচাতে ওই ব্যবস্থা করেছে।তাহলে প্রেগন্যান্ট?
 হায় ঈশ্বর!মানুষের কি রুচি!একজন মানসিক ভারসাম্যহীন নারীকেউ হায়েনারা ছাড়েনি।
   কিন্তু সুস্থ্য,সুন্দর সমাজ একজন শিক্ষিত,সুন্দরী,মাস গেলে হাজার হাজার টাকা রোজগার করা মহিলাকে অনায়াসে একজন শিক্ষিত পুরুষের জীবন থেকে ছেটে ফেলতে পারে কারণ একটা জারজ সন্তানকে সে দত্তক নিলে "সমাজ কি ভাববে এই ভাবনায়।"