সময়ই উত্তর দেয়
আমি তখন স্কুলের গণ্ডি পেরোইনি। মাধ্যমিক দেবো সে বছর। দ্বাদশ শ্রেণীর দেবমাল্য আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের হাত দিয়ে একটি চিঠি পাঠালো আমায়।চিঠি পড়ে আমি তো থ! সে আমাকে প্রেম নিবেদন করেছে।জয়িতার মাধ্যমেই জানিয়ে দিলাম প্রেম এভাবে হয় না।ভালোবাসা হল দু'টি হৃদয়ের মিলন।তার আমাকে ভালো লাগলে আমার তাকে যে ভালোবাসতে হবে এমন কোন কথা তো নেই। আর এভাবে ভালোবাসা হয় না।তাছাড়া পড়াশুনা শেষ করার আগে এসব নিয়ে ভাবতে গেলে জীবনে পায়ের তলার মাটিটা শক্ত করতে পারবো না। আমি এসব নিয়ে এখন চিন্তা করতেই চাই না।
এরপর যতদিন দেবমাল্য স্কুলে ছিল বলতে গেলে আমার সামনে আর কোনদিন আসেনি।আমিও তাকে দেখতে পাইনি।
আমি যখন উচ্চমাধ্যমিক দেবো তখন হঠাৎ একদিন আবার তার সাথে আমার রাস্তায় দেখা।আমি কোচিং থেকে আসছিলাম।সেদিন রাস্তায় আলো ছিলো না। লোকজনও খুব একটা রাস্তায় ছিল না।তার সেই একই প্রস্তাব।তাকে সরাসরিই বললাম,"প্রেম এভাবে হয় না"
আমার কথাটা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই দেবমাল্য আমায় ওর বুকের সাথে চেপে ধরে জোর করে ওর মুখটা এগিয়ে এনে আমার ঠোঁটে আলতো এক কামড় দিয়ে বললো,"তাহলে কী প্রেম এভাবে হয়!" জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওর মুখে জোরে একটা থাপ্পড় মেরে বলি,"তোমার মত ছেলের এটাই প্রাপ্তি"।মুহূর্তে ও আমার গায়ের থেকে ওড়নাটা ছিনিয়ে নিয়ে কাছে আরো কাছে এগিয়ে আসতে গেলে আমি বলি,
"আমার দিকে আর এক পা এগোলে আমি কিন্তু চিৎকার করে লোক ডাকবো। তোমার কলেজকে সব জানিয়ে দেবো।" আমার কথা শুনে দেবমাল্য কিছুটা থমকে যায়।আমিও আর সেখানে এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে জোর পায়ে সেখান থেকে চলে আসি।মুখে তাকে যাই বলি না কেন কয়েকদিন বেশ ভয়ে ভয়েই কেটেছে আমার। বাড়িতে ইচ্ছা করেই কিছু বললাম না তাদের টেনশন আমায় নিয়ে বেড়ে যাবে মনে করে।
অনেক বছর কেটে গেছে এরপর।দেবমাল্যর সাথে আমার আর কোনদিন দেখা হয়নি।বাড়ির প্রচণ্ড চাপ স্বর্তেও বিয়ের পিঁড়িতে বসিনি। কারণ আমি যে প্রফেশনে আছি তার ডিউটির কোন ঠিক ঠিকানা নেই।রাত-বিরেতে যখন তখন ছুটতে হয়। প্রাণহানিরও ভয় রয়েছে। পরের বাড়িতে কিছুতেই এসব মেনে নেবে না।
থানায় বসে কাগজপত্র দেখছিলাম।হঠাৎ একটি কাগজে চোখ আটকে গেলো। প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে।মেয়েটির বাড়ির লোক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া দুটি ছাত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন।ফিরে গেলাম কয়েক যুগ আগে।মাথাটা এক নিমেষে গরম হয়ে গেলো। ইনভেস্টিগেশন শুরু হলেও ঢিমেতালে কেসটা এগোচ্ছে। যে ইন্সপেক্টর কেসটা দেখছেন তাকে ডেকে কতদূর কেসটা এগিয়েছে জানতে চাওয়ায় তিনি আমতা আমতা করে উত্তর দিলেন। নিজেই কেসটার দায়িত্ব নিয়ে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলাম। প্রমাণ যা কিছু পেলাম ছেলেদু'টিকে অ্যারেস্ট করে আগে থানায় এনে তুললাম। রাতেই হুমকি দিয়ে এক ফোন। প্রথমে টাকার লোভ পড়ে রীতিমত হুমকি গলাটা খুব চেনা চেনা মনেহল।
পরদিন আই পি এস অফিসার নন্দিতা রায় চৌধুরীর সাথে ধর্ষক পুত্রের পিতা কোর্ট খোলার আগেই দেখা করতে এলেন। এসেই তিনি টেবিলের উপর একটি ব্যাগ রাখলেন।তাকে দেখে চমকে উঠলাম।সে অবশ্য আমাকে প্রথম অবস্থায় চিনতেই পারেনি। জীবনে প্রতিটা ঘটনার পিছনে সুফল এবং কুফল দু'টোই থাকে। দেবমাল্যর ওই অপমানের জবাব শুধু থাপ্পড়ে দিয়ে আমার পোশায়নি সেদিন। তখনই ভেবে নিয়েছিলাম জীবনে যত প্রতিকূল পরিস্থিতিই আসুক না কেন আমি যেভাবেই হোক প্রশাসন বিভাগে চাকরি করবো। তার ফল হাতে হাতে পেয়েছি।প্রথমেই ধর্ষক পুত্রের পিতার কাছে জানতে চাইলাম ,
--- দেবমাল্য মজুমদার, আপনি কি আমায় চিনতে পারছেন?
লক্ষ্য করলাম যে তেজ নিয়ে তিনি আই পি এস অফিসারের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন তা এক নিমেষে উধাও! তাকে একথাও বললাম সেদিন তার ওই অপমান আজ আমাকে এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে।
দেবমাল্য হাত জোড় করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। মাঝপথে তাকে থামিয়ে দিয়ে টেবিলের উপর রাখা হয়ত টাকা ভর্তি ব্যাগটি নিয়ে সেই মুহূর্তে তাকে বেরিয়ে যেতে বললাম। দেবমাল্য চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমার পায়ে হাত দিতে গেলো।আমি হেসে পড়ে রুম ত্যাগ করলাম।
ছেলে দু'টির যাবতজীবন জেল হল।এতদিন পর মনেহল আমি আমার অপমানের জবাব নিতে পারলাম।
শেষ