কয়েকদিন আগেই সজলের সাথে মনিকার বিশাল ঝামেলা হয়ে গেছে। সজলের বক্তব্য মনিকা যে প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে সেখানে ছুটির কোন সময় জ্ঞান নেই।তাই বারবার সজল চাপ দিতে থাকে ওই চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোন চাকরি নেওয়ার জন্য।কিন্তু তিন বছর হয়ে গেছে এই চাকরি তাই মনিকাও এই চাকরি ছাড়তে নারাজ।
বেশ কয়েক বছর আগে হঠাৎ বৃষ্টির সম্মুখীন হয়ে মাথা বাঁচাতে অপরিচিত দু'টি কিশোর কিশোরী বৃষ্টির থেকে মাথা বাঁচাতে রাস্তার উপরে একটি বকুল ফুল গাছের তলায় আশ্রয় নিয়েছিল।বৃষ্টির সাথে বাতাস ছিল প্রচুর।গাছ থেকে বকুলফুল পড়ে ঢিপ হচ্ছিল গাছের তলায়।মনিকা ওড়নার এক কোণে ভিজতে ভিজতেই বকুলফুল কুড়িয়ে জমা করছে দেখে সজলও অপরিচিত মেয়েটিকে ওই কাজে সাহায্য করে।ফুল কুড়াতে কুড়াতেই দু'জনের কথা
-- আপনি বকুলফুল খুব ভালোবাসেন?
-- খুব।জানেন একমাত্র এই ফুল যত শুকিয়ে যাক না কেন এর গন্ধ কিন্তু থেকেই যাবে।
--- তাই নাকি? আমি কিন্তু জানতাম না এটা।
তারপর বেশ কয়েকমাস পড়ে দু'জনের পরিচয় যখন বেশ গাঢ় হয় তখন একদিন সজল তার মনিকে বলে,
-- বকুল ফুলের গন্ধটা জানো ঠিক ভালোবাসার মত। দিন যত গড়াবে ভালোবাসাও ঠিক ততই গাঢ় হবে।
ওদের দেখা হওয়ার কথা থাকলেও দু'জনের মিট করার জায়গাটা হচ্ছে বুকুল গাছতলা।তারপর সেখান থেকে যেখানে যাওয়ার যাবে। দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকে দু'জন দু'জনকে চেনে।তারপর কলেজ,হায়ার এডুকেশন চাকরি।সজল বেসরকারি হলেও সুচাকুরে।আর মনিকা একটা সাধারণ প্রাইভেট কোম্পানিতে।কিন্তু মনিকা চাকরি পাওয়ার দু'বছর বাদে সজলের চাকরি।
দুই বাড়ির সকলেই জানে ওদের সম্পর্কটা। বিয়ের সব ঠিকও ছিল।কিন্তু হঠাৎ করে সজলের মায়ের মৃত্যুর কারণে বিয়ের তারিখ কিছুটা পাল্টে দিতে হল। মায়ের মৃত্যুর একবছর পার না হলে বিয়ে সম্ভব নয়। সজল রোজই অফিস থেকে ফিরে বাস স্ট্যান্ডে মনিকার জন্য অপেক্ষা করে কারণ বাস থেকে নেমে যে রাস্তাটা ধরে মনিকা বাড়িতে যায় সেটা খুব নির্জন।আর এখানেই সজলের ভয়।একটা নির্দিষ্ট সময় হলে তাও হয়।কোন কোন দিন সজল ছ'টা থেকে রাত ন'টা দশটা অবধি দাঁড়িয়ে থাকে। মাঝে মধ্যে সজল খুব জোর দিতে থাকে মনিকাকে এই চাকরিটা ছেড়ে দিতে।চাকরি করা নিয়ে তার কোন আপত্তি নেই কিন্তু মনিকার অফিসের ছুটির কোন নির্দিষ্ট সময় নেই , যদি কখনো অঘটন ঘটে যায় সেই ভয়ে।
একদিন রাত দশটা বেজে যায় মনিকার দেখা নেই।ফোনেও পাচ্ছে না।বারবার ফোন করে যাচ্ছে। 'নট রিচেবল' - ছাড়া আর কিছুই শব্দ শুনতে সে পাচ্ছে না। প্রথমে রাগ,অভিমান পরে টেনশনে পাগলের মত প্রতিটা বাস আসলেই উঁকি ঝুঁকি। মনিকার বাড়িতে একমাত্র বয়স্ক মা। তিনি মেয়ের টেনশনে বেশ কয়েকবার ফোন করেছেন সজলকে। কারণ তিনিও মনিকাকে ফোনে পাচ্ছেন না।
রাত তখন দশটা।মনিকা একটা উবের করে নামছে দেখে সজল ছুটে যায়। এতক্ষণ যার জন্য এত টেনশন হচ্ছিল তাকে সুস্থ্য,স্বাভাবিক দেখতে পেয়েই সব টেনশন গিয়ে মাথায় রাগ হয়ে জমা হল।মনিকা নেমেই সজলকে বলতে গেলো তার দেরি হওয়ার কারণ কিন্তু কে শুনবে কার কথা --
-- জানো সজল আজ না
-- আমি কোন কথা জানতে চাইছি না। বহুদিন ধরে বলছি তুমি অন্য কোথাও চাকরির চেষ্টা করো কিছুতেই তুমি আমার কথা গ্রাহ্য করছো না।
সজল মনিকার কোন কথা শুনার প্রয়োজনই বোধ করলো না উপরন্তু মনিকার বাড়িতে যেতে যেতেই রাস্তার উপরেই চিৎকার করে রাগ দেখাতে শুরু করলো। মনিকা তাকে বারবার অনুরোধ করলো রাস্তার উপরে চিৎকার না করতে।কিন্তু কে শোনে কার কথা!
সজল এতটাই রেগে ছিল তার মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেলো,
-- আমার সাথে সারাজীবন থাকতে হলে এই চাকরি তোমায় ছাড়তে হবে।আমার তো চাকরিতে কোন আপত্তি নেই।তুমি অন্য কোথাও চাকরি খোঁজো।
সজলের এই চিৎকার চেঁচামেচিতে মনিকার মাথা এমনিতেই গরম ছিল তারপর এই শর্ত দেওয়ায় মনিকাও রেগে বলে বসলো,
--- আমাকেও ভেবে দেখতে হবে ভবিষ্যতে তোমার সাথে আমি থাকবো কিনা।চাকরির বয়স বেড়েছে।সামনে আমার প্রমোশন হবে।এখানে আমার একটা উন্নত ভবিষ্যত আছে। আমি কিছুতেই এই চাকরি ছাড়বো না।
-- তাহলে আমার সাথে সম্পর্ক ছাড়তে হবে।
--- আমি তো তোমায় ধরে রাখিনি। আমার ভালোবাসার প্রতি যদি তোমার বিশ্বাস না থাকে তাহলে সেই সম্পর্ক আজ না হলেও কাল ভেঙ্গে যাবেই। তাই আরও জড়িয়ে যাওয়ার আগেই উভয়কেই বিষয়টা নিয়ে ভাবতে হবে।আর জেনে রাখো তোমার কথাই আমি চাকরি কিছুতেই ছাড়বো না।
কেটে গেছে চার বছর।দু'জনের ইগো ঝেড়ে কেউই আর কোনদিন কারো সামনে গিয়ে দাঁড়ায়নি। প্রথম দেখার স্মৃতিটা মনে রেখে দু'জনেই সেই বকুল গাছটার কাছ থেকে যাওয়ার সময় কিছুক্ষণ থমকে যায়।সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মত তাদের সামনে ভেসে ওঠে দু'টি কিশোর কিশোরীর গাছতলায় ফুল কুড়ানোর দৃশ্য।বুকের ভিতর হঠাৎ ওঠা ঝড় সামলে নিয়ে আবার রোজ নামচায় লেগে পড়ে। একই শহর অনেক সময় একই রাস্তা কেউ আগে কেউ পড়ে হাঁটছে কিন্তু ইগো ঝেড়ে কেউ কারো সামনে আর যায়নি।
২৯-৮-২২
No comments:
Post a Comment