Thursday, July 14, 2022

ভাগ্যই জীবনের শেষ কথা বলে

ভাগ্যই জীবনে শেষ কথা বলে  

  নিজের জন্য কিছু একটা করা ভীষণ দরকার হয়ে পড়েছিল।
  একাই বাবুঘাট গঙ্গার পাড়ে বসে এলোমেলো ভাবনার সাথে এই ভাবনাটাই নন্দিনীকে ভাবিয়ে যাচ্ছিল।তখনো সন্ধ্যা হয়নি।অস্তগামী সূর্যের লাল আভা গঙ্গার জলে পড়ে এক মনোরম শোভায় আকৃষ্ট হয়ে বেশ অনেকক্ষণ বসে ছিল নন্দিনী।আজকে আর ঘরে ফেরার কোন তাড়া নেই তার।অনেক কষ্টে গড়ে তোলা সংসারে তার দায়িত্ব আজ ফুরিয়েছে।এলোমেলো ভাবনারা আজ সত্যিই মনটাকে বারবার অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
  বাবা,মায়ের পছন্দ করা সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি মানুষকে মেনে নিয়ে শ্বশুরবাড়ির দরজায় পা রেখেই বুঝে গেছিলো এ বাড়িতে শ্বাশুড়ী মায়ের কথাই শেষ কথা।বাংলায় এম. এ. করা নন্দিনীর ভীষণ ইচ্ছা ছিল শিক্ষকতা করার।কিন্তু বাবার জেদের কাছে বর্ষতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল মায়ের এক কথাই,
--- তুই কি চাস নন্দা? এমনিতেই মানুষটার হাই ব্লাডপ্রেসার,সুগার।আর এই বিয়ে নিয়ে তুই যে তাল শুরু করেছিস তাতে মানুষটাকে তুই আরও অসুস্থ্য করে ছাড়বি। আরে চাকরি করতে হলে বিয়ের পড়ে করিস।এই মানুষটাকে শেষ বয়সে এসে একটু শান্তি দে।
 মায়ের এই স্বার্থপরের মত কথা শুনে দরজা বন্ধ করে আকুল হয়ে সারারাত কেঁদে সকালেই মাকে জানিয়ে দিয়েছে,
-- তোমরা যেখানে আমার বিয়ে দেবে আমি রাজি।
 স্বামী ভালো মনের মানুষ।নন্দিনীকে খুবই ভালোবাসে।কিন্তু মায়ের মুখের উপর একটা কথা বলার সাহস তার নেই।সেই ফুল শয্য্যার রাত থেকে একটি কথাই শুনে যাচ্ছে নন্দিনী, "একটু কষ্ট করে মানিয়ে নাও। মা আমায় অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছেন।মায়ের কথার অবাধ্য হয়ো না কখনো।"
 বিয়ের মাসখানেক পড়ে স্বামী বিমলেন্দুকে জানিয়েছিল নিজের মনের কথা। বিমলেন্দু তাকে বলেছিল,
-- চাকরি করবে এত খুব ভালো কথা, তবে মায়ের মতটা নিয়ে তবে এগিও।
 না,তিনি রাজি হননি। কিন্তু নন্দিনী তার এই ইচ্ছার মৃত্যুও ঘটাতে পারেনি। মনের মধ্যে সুপ্ত ইচ্ছাকে লালন করে চলেছে আজ অবধি। বাবা,মা জীবিত থাকাকালীন সময়ে দশ বছরের বিবাহিত জীবনে দশবারও বাপেরবাড়িতে যেতে পারেনি অর্থাৎ শ্বাশুড়ী যেতে দেননি।এই দশ বছরের মধ্যেই সে বাবা,মা উভয়কেই হারিয়েছে। তাই এখন সেখানে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়েছে।
 ঘুমের মধ্যে হঠাৎ স্ট্রোকে স্বামীর যখন মৃত্যু হয় ছেলে তখন ডাক্তারি পড়ছে।শ্বাশুড়ির সামান্য পেনশনে সংসার চালাতে হয়েছে।তবুও তিনি নন্দিনীকে কিছু রোজগারের জন্য বাইরে বেরোতে দেননি।জমানো পুঁজি শেষ হয়েছে ছেলে রাহুলকে পড়াশুনা শেষ করাতে।
  শ্বাশুড়ী গত হয়েছেন বছর খানেক।ছেলে তার আগেই উচ্চ শিক্ষার জন্য লন্ডন পাড়ি দেয়।তারপর সেখানেই সেটেল্ড।এখন নন্দিনী সম্পূর্ণ একা।রাহুল প্রবাসী এক বাঙ্গালী মেয়েকে বিয়ে করে মাকে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেয় নূতন বাড়ি কিনে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে জানিয়ে।বয়স এখন নন্দিনীর পঞ্চান্ন।এই বয়সে চাকরি পাওয়া অসম্ভব।কিন্তু নিজেকে খেয়েপরে তো বাঁচতে হবে।
 পেপারে অ্যাড দেখে একটা কোচিং সেন্টারে গেছিলো বাংলার শিক্ষক হিসাবে পড়ানোর দায়িত্বটা পাওয়ার আশায়।না,তারা তাকে নিরাশ করেননি।সেদিনই সে দশম শ্রেণীর একটি ক্লাস নেয় পরীক্ষা মূলক হিসাবে।তারা তাকে জানিয়েছেন দুদিনের মধ্যে ফোন করে জানাবেন।সেখান থেকেই হাঁটতে হাঁটতে এসে গঙ্গার পাড়ে বসে।
  নন্দিনী গঙ্গার পবিত্র জলের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে সেই সময় যদি বাপেরবাড়ি কিংবা শ্বাশুড়ীর কাছে চাকরির জন্য বাঁধাপ্রাপ্ত না হতে হত তাহলে আজ এই পরিস্থিতির মধ্যে তাকে পড়তে হত না।আসলে মানুষের মেধা আর ইচ্ছা থাকলেই হয় না তার সাথে সাথে ভাগ্যেরও দরকার আছে।ভাগ্যে না থাকলে মানুষের পাওয়া জিনিসও অনেক সময় হাত ফস্কে বেরিয়ে যায়।
 

No comments:

Post a Comment