দেবেশের মৃত্যুর পর ছোট ছোট দু'টি ছেলেমেয়ে নিয়ে রেখা খুবই অসহায় হয়ে পড়ে।একটা সাধারণ প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করা দেবেশ সঞ্চয় বলতে কিছুই রেখে যেতে পারেনি।কাজের দিনে এসে অফিসের কিছু লোক কয়েক হাজার টাকা দিয়ে গেলো।কাজটাই শুধু হল।কারণ তাদের অবস্থার কথা যেহেতু সকলেই জানত তাই ওইদিন আসার কথা বললে অধিকাংশ পরিবারই জানিয়েছে তারা শ্রাদ্ধ বাড়ি খায় না। এসেছেন তারা সকলেই কাগজের ছোট প্যাকেট মুড়ে যার যেমন ক্ষমতা সেইরূপ টাকা নিয়ে।একটা মিষ্টি আর একগ্লাস জল ছাড়া তারা কিছুই মুখে দেননি।
দিশেহারা রেখা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না কী করে ছেলেমেয়ে দু'টিকে মানুষ করবে। শেষে ঠিক করলো যদি দু'একটা বাড়িতে সে রান্নার কাজ নেয় তাহলে মাস গেলে অন্তত কিছু টাকা তো আসবে। মাধ্যমিক পাশ করা বিদ্যেই এর চেয়ে বেশি আর কিইবা সে করতে পারে। মাথা গোঁজার মত একটু নিজস্ব ঠাঁই ছিল তাই বাঁচোয়া। তানাহলে তো বাচ্চা দুটোকে নিয়ে মাথার উপর ছাদ হারা হতে হত।
একজন ক্লাস ফোর আর একজন ক্লাস সেভেন। কোন রকমে দিন চলে যেতে থাকে। সকাল সন্ধ্যা দুটি বাড়িতে রান্না করে যে টাকা আসে তাতে ডালভাত দু'বেলা জুঠে যায় তিনজনে। তাছাড়া বোসগিন্নি বেশ ভালো মানুষ।সময়ে অসময়ে কিছু খাবার আবার অনেক সময় কাচা শাকসবজি,মাছও দিয়ে দেন বাচ্চা দু'টির জন্য। আস্তে আস্তে ওরা বড় হতে থাকে আর ওদের পড়ার খরচ বাড়তে থাকে। গয়না দু'একটি যা ছিল সেগুলো একটু একটু করে বিক্রি করতে থাকে।কিন্তু সে টাকায় ক'দিন?
আস্তে আস্তে আরো দুটি বাড়ি রান্নার জন্য ধরে নেয়। ভোর পাঁচটা থেকে তার ছোটা শুরু হয়। একফাঁকে বাড়িতে এসে ঝটপট বাচ্চাদের স্কুলে বেরোনোর আগে কিছু রান্না করে রেখে যায়।সে কোনদিন ডালভাত কিংবা আলু সেদ্ধ ভাত। ছেলেমেয়ে দুটিই মায়ের এই পরিশ্রম দেখে যা মা জোগাড় করতে পারে তাই দিয়েই খেয়ে নেয়। কখনোই কোন অভিযোগ কোনদিন করেনি।ছেলেটি ছোট আর মেয়ে বড়।দেখতে দেখতে সময় চলে যায়।সামনেই মেয়ে মাধ্যমিক দেবে। রান্নাতেও মায়ের মত পটু। এখন সকালে রেখা বেরিয়ে একবারে সব বাড়ি কাজ সেরে তবে ঘরে ঢোকে।মেয়েই ভায়ের স্কুলের খাবার নিজেদের দুপুরের খাবার করে নেয়।
মায়ের এই পরিশ্রম তারা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে বলেই তারা দিনরাত চেষ্টা করে পড়াশুনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। আস্তে আস্তে তারা ক্লাসে ভালো ফল করতেও শুরু করে।বড় মেয়ে রুমনা মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে পাশ করে। যে সব বিষয় রুমনা বুঝতে পারতো না স্কুল শিক্ষকদের কাছে বিনা পয়সায় তারা তাকে পড়িয়েছেন।
অনেক কষ্ট,অনেক পরিশ্রমের পর রুমনা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে স্পকিং ইংলিশ কোর্স শিখে একটা নার্সিংহোমে রিসেপশনিষ্টে কাজ পেয়ে যায় আর প্রাইভেটে গ্র্যাজুয়েশনটা করার চেষ্টা করতে থাকে। মাকে দুটো বাড়ির রান্না ছাড়িয়ে দেয়। ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। ছেলের মাধ্যমিক রেজাল্টও খুব ভালো হয়। রুমনা এখন একটা সরকারি হাসপাতালের ক্লাক।আর ভাইকে এডুকেশন লোন নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াচ্ছে। রেখা এখন সব বাড়ির রান্নার কাজ ছেড়ে দিয়েছে। বাড়িতেই থাকে সব সময়।মেয়েকে বিয়ের কথা বললে বলে," ভাই পড়াশুনা শেষ করে চাকরি পাওয়ার পর ভেবে দেখবো।"
সময় তো বসে থাকে না। যতই বিপদ আসুক না কেন ভয় না পেয়ে এগিয়ে চলার একটা বিকল্প রাস্তা খুঁজে নিতে পারলে জীবনটা কারো থেমে থাকে না।
No comments:
Post a Comment