ছেলেবেলা থেকেই দীপিকা আর অঞ্জনা খুব ভালো বন্ধু।সেই প্রথম স্কুলে ভর্তি হওয়া থেকে গ্র্যাজুয়েশন একই স্কুল এবং একই কলেজ। যার ফলে রক্তের সম্পর্ক ছাড়াই এই দুটি পরিবারের লোকজনও আত্মিক বন্ধনে খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছে।কোন পরিবারের লোকজনকে বাদ দিয়ে অন্য পরিবারে ছোট থেকে বড় কোন অনুষ্ঠানই হয় না।পড়াশুনায় দু'জনেই মাঝারি মানের।দু'বাড়ির লোকেরাই মজার ছলে বলে,"যে বাড়িতে দু'টি ছেলে আছে আমরা সেই বাড়িতেই আমাদের মেয়েদের বিয়ে দেবো।"
দীপিকার মাসতুত বোনের বিয়েতে দু'পরিবারেরই সকলের নিমন্ত্রণ।সেখানেই দীপিকাকে দেখে একটি পরিবার তাদের ছেলের জন্য পছন্দ করে।কথাবার্তা এগোতে লাগে।এখন বলতে গেলে প্রায় চব্বিশ ঘন্টায় দু'বন্ধু একসাথে সময় কাটায়।আনন্দের মাঝে মাঝে দু'জন দু'জনকে ছেড়ে থাকতে হবে মনে হলেই উভয়ের মনের ভিতরে বিষাদের কালো মেঘে চোখের কোল বেয়ে জল ঝরতে শুরু করে
দেখতে দেখতে বিয়ের দিন চলে এলো।বিদায়ের মুহূর্তে দীপিকা আর অঞ্জনার একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্না দেখে পাড়া-প্রতিবেশীরাও চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি।সে এক হৃদয় বিদারক পরিস্থিতি।
বৌভাতের দিন অবশ্য দু'জনে অনেকটাই সামলে গেছে।তবুও ফেরবার সময় দু'জনের চোখেই জল।
দীপিকার বিয়ের ঠিক বছর দু'য়েকের মাথায় অঞ্জনার বিয়ে ঠিক হয়। সম্মন্ধটা অবশ্য দীপিকাই করে।দীপিকার স্বামীর অফিস কলিগ দেবাংশুকে দেখেই দীপিকার মাথায় এটা ঘুরপাক খেতে থাকে।অনেক বলেকয়ে স্বামী সুমিতকে দিয়ে দেবাংশুকে কথাটা বলায়।দেবাংশু বন্ধু সুমিতকে বলে,
-- দেখ যদি প্রেম করতাম তাহলে বাবা,মাকে আমিই জানাতাম।কিন্তু যেহেতু এটা প্রেম নয় তাই এ সম্মন্ধটা তোকে বা তোর বউকেই বাবা,মাকে জানাতে হবে। হ্যাঁ একটা কথা আমি বলতে পারি অঞ্জনাকে আমি বহুবার দেখেছি নানান অনুষ্ঠানে তোদের বাড়িতে।মন্দ নয় দেখতে।আর সেক্ষেত্রে আমার মত জানতে চাইলে আমি হ্যাঁ ই বলবো।
সুমিত অফিস থেকে ফিরে সব কথা দীপিকাকে জানায়।দীপিকা ফোনে অঞ্জনার বাবা,মায়ের সাথে কথা বলে ছেলের সব বিবরণ দেয়।তারা এই ব্যাপারে সব দায়িত্ব দীপিকাকেই সমর্পণ করেন।
সুমিত ও দীপিকা দেবাংশুদের বাড়িতে গিয়ে তার বাবা,মাকে অঞ্জনার ছবি দেখিয়ে পছন্দ করিয়ে মেয়ে দেখার জন্য কথা আদায় করে বাড়িতে ফেরে।
মেয়ে দেখে পছন্দ হওয়ার পর একসময় বিয়ের তারিখও ফাইনাল হয়ে বিয়ে হয়ে যায়।
এদিকে দীপিকার বিয়ে হয়েছে চার বছর কিন্তু মাতৃত্বের স্বাদ সে আজও পায়নি।নানান পরীক্ষা নিরীক্ষায় ধরা পড়ে সে কোনদিনও মা হতে পারবে না।খুব ভেঙ্গে পরে।সুমিত তাকে অনেক বোঝায় আজকের দিনে মা হওয়া কোন ব্যাপারই না।প্রয়োজনে তারা একটি সন্তান দত্তক নিয়ে নেবে।কিন্তু দিনরাত কেঁদে কেঁদে প্রায় পাগলের মত অবস্থা হয়ে দাঁড়ায়।আর ঠিক এই মুহুর্তেই বিয়ের দু'বছরের মাথায় অঞ্জনা প্রেগন্যান্ট হয়।এত বড় একটা খুশির খবর সে আর দেবাংশু ছাড়া কাউকেই দিতে পারে না দীপিকার কথা ভেবে।এমনকি তার শ্বশুর শ্বাশুড়িকেউ জানাতে পারে না যদি দীপিকার কানে চলে যায়।
আল্ট্রাসোনোগ্রাফিতে ধরা পড়ে অঞ্জনা যমজ বাচ্চা জন্ম দিতে চলেছে।সঙ্গে সঙ্গে তার মাথায় খেলে একটা সন্তান তো সে দীপিকাকে দত্তক দিতে পারে।কিন্তু কিছুতেই দেবাংশুকে রাজি করাতে পারে না।শ্বশুর শ্বাশুড়ি তখনও কিছুই জানেন না।দিনরাত স্বামীর সাথে মত বিরোধ মনোমালিন্য চলতে থাকে।ঠিকভাবে অঞ্জনা খাওয়া দাওয়া করে না,ওষুধ দিতে গেলে খাবে না বলে জানিয়ে দেয়।শেষ পর্যন্ত দেবাংশু মেনে নিতে বাধ্য হয়।আর তখনই বাড়িতে সকলকে জানানো হয়।
দীপিকাকে এই সুখবরটা তার বাড়ি গিয়েই দেবে ঠিক করে।স্বামীকে নিয়ে দীপিকার বাড়ি যায় সে।সবকিছু খুলে বলে তাকে।দীপিকা দুই হাতে অঞ্জনাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে," আমাদের মত আমাদের সন্তানেরাও একই স্কুল,একই কলেজে পড়বে। আমরা দু'জনেই একসাথে মা হবো।"
কিন্তু তারা ঠিক করে তারা চারজন ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ কোনদিন এ কথা জানবে না।তাই তখন থেকেই দীপিকা প্রেগন্যান্ট বলে চাউর করা হয়। একেই বলে মনেহয় হরিহর আত্মা।
No comments:
Post a Comment