ভাগ্যরেখা (সুখ - দুঃখ)
জীবনটা শুরু হয়েছিল একভাবে। তখন ভেবেছিলাম নিজের জীবন নিজেই গড়ে নিতে পারবো। পড়াশুনায় ভালো ছিলাম, বাবার আর্থিক ক্ষমতা ছিল। লোকে আমাকে সুন্দরী, বুদ্ধিমতীই বলতো। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক।সবই ঠিকঠাক চলছিল। মাধ্যমিকে বেশ কয়েকটি লেটার নিয়ে পাশ করলাম। বাবার আমাকে নিয়ে খুব গর্ব ছিল।শুধু বাবা কেন পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও আমাকে নিয়ে গর্বের শেষ ছিল না। নিজের ইচ্ছা এবং বাবার দেখানো স্বপ্ন নিয়ে ভবিষ্যতে একজন ডাক্তার হিসেবে নিজেকে কল্পনা করতাম। জীবন ছিল সুখী,সচ্ছল,উচ্ছল।
কিন্তু এ সুখ আমার কপালে বিধাতা লিখেছিলেন সাময়িক। ভাগ্য লেখার দোয়াত-কলম যে ছিল তার হাতে। শুরুতে তিনি আমাকে সবকিছু দিয়েও আচমকা সবকিছুই কেড়ে নিলেন। উচ্চমাধ্যমিক দেওয়ার আগেই হঠাৎ আসা ঝড়ে সব তছনছ করে দিলো। একদিন রাতে ঘুমের মধ্যেই চলে গেলেন বাবা। জীবনের মোড় ঘুরে গেলো অন্যখাতে। উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন গেলো ভেঙ্গে। একান্নবর্তী পরিবারের মধ্যে দেখা দিলো ফাটোল। বাবা পরিবারের মেজ ছেলে হলেও যেহেতু ভালো চাকরি করতেন কাকা,জ্যাঠার থেকে তিনি বেশি সংসার খরচটা দিতেন। অন্যান্যরা সংসারের পিছনে খুব একটা অর্থ খরচ করতেন না। ভাইদের মধ্যে মিল ছিল ভীষণ।
কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেলো সবই ছিলো বালির বাঁধ।বলতে গেলে যেহেতু বাবার টাকায় সংসারটা চলতো তাই সকলেই বাবার কথা শুনে চলতেন। উপর উপর সকলেরই একটা মিষ্টির প্রলেপ দেওয়া ছিল।
বাবার সমস্ত কাজকর্ম মিটে যাওয়ার পর হঠাৎ করেই একদিন সকলের হাঁড়ি আলাদা হয়ে গেলো। আমি, মা আর ভাই। কী করে কী হবে ভেবে ভেবে দিনরাত মা আর আমি প্রায় পাগল হওয়ার পথে। পেটে বিদ্যা কম তাই টিউশনি করেও বিশেষ কোন লাভ হয় না।তবুও নিজের পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট কয়েকটা বাচ্চা পড়াতে শুরু করলাম। একটা একটা করে মায়ের গয়না বিক্রি হতে লাগলো।
চরম দরিদ্রতার ভিতর উচ্চমাধ্যমিকে খুব ভালো ফল করলাম। কিন্তু জয়েন্টে বসার মত আর্থিক সামর্থ না থাকায় অঙ্কে অনার্স নিয়ে ভর্তি হতে ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। তখন মায়ের গয়নাও শেষ।ভাই তখনো মাধ্যমিক দেয়নি। পড়াশুনা আমার বন্ধ হওয়ার পথে তখন। সবকিছু শুনে পাড়ার ক্লাব আর স্কুলের কয়েকজন শিক্ষকের সহয়তায় আমি কলেজে ভর্তি হলাম অঙ্কে অনার্স নিয়ে।
আমি যখন দ্বিতীয় বর্ষ তখন মা চলে গেলেন আমাকে আর ভাইকে ছেড়ে। ভাই তখন সবে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে। পাড়ার কিছু সহৃদয় ব্যক্তি,কয়েকটি ক্লাব আর স্কুল কলেজের শিক্ষকদের সহয়তায় আমি বেশ ভালোভাবেই পাশ করে গেলাম। জীবনের প্রতি পদেপদে ঠোক্কর খেতে খেতে যখন এই জায়গায় এসে দাঁড়ালাম তার ঠিক তিন মাসের মাথায় ওই কলেজেই আমি পার্টটাইম জব পেয়ে গেলাম স্যার আর ম্যামদের সহায়তায়।
বছর দুয়েক বাদে আমার চাকরিটা পার্মানেন্ট হয়।ভাই এখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। জীবনে সব আশা পূরণ না হলেও একটা জায়গায় এসে আজ দাঁড়াতে পেরেছি। কিন্তু যে দুটো মানুষ বেঁচে থাকলে সব থেকে খুশি হতেন তারাই আজ আমার জীবনে নেই। মাঝে মাঝে ভীষণ মন খারাপ হলেও ভাইকে নিয়ে সব কষ্ট ভুলে ভালো থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে আমাকে যেতেই হবে।
No comments:
Post a Comment