লক্ষ্মী বৌমা
অবশেষে এলো সেই দিন --
একার হাতে সবকিছু।সুতরাং আমাকে সেই কাক ডাকা ভোরেই প্রতিদিন উঠতে হয়।শ্বাশুড়ী মা বাতের রোগী।সারাটা রাত তিনি যন্ত্রণায় কষ্ট পান।ভোরের দিকে তাই ঘুমিয়ে পড়েন।সংসারের কোন কাজই তিনি করতে পারেন না। স্বামীর অফিসের তাড়া থাকে।তিনি আটটায় উঠে কোন রকমে স্নান,খাওয়া সেরে অফিসের উদ্দেশ্যে ছুটতে থাকেন।যেতে আসতেই তার চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা সময় চলে যায়। তারপর বাবাইয়ের টিফিন করা, সাড়ে ন'টায় তার বাস আসে তার আগেই তাকে রেডি করে ঠিক সময়ে তাকে নিয়ে ছুটতে হয় বড় রাস্তার মোড়ে। বাসে তুলে দিয়েই দৌড়াতে দৌড়াতে ঘরে ফিরেই সংসারের বাকি কাজে হাত লাগানো।ততক্ষণে শ্বাশুড়ী মা ঘুম থেকে উঠে পড়েন।তার চা,জল খাবার দিয়ে যদি সময় পাওয়া যায় তাহলে বসে টিফিনটা করি নতুবা মুখে খাবার পুড়ে চিবাতে চিবাতে এদিক ওদিক ছুটে কাজ করা।কোনদিন বসে চা টাও খেতে পারিনি।গরম চা প্লেটে ঢেলে তাড়াতাড়ি শেষ করেছি বিয়ের পর থেকে জীবনের এই বেলা পর্যন্ত। তিনটে বাজতেই ছেলেকে আনতে আবার সেই বড় রাস্তায় মোড়ে।
কাজের লোক কোনদিনও রাখতে পারিনি আর্থিক কারণে।খুব ভালো গান গাইতাম একসময়। পড়াশুনায় ছিলাম মধ্যম মানের।ভেবেছিলাম চাকরির বাজারের যা অবস্থা গান নিয়েই জীবনটাকে গড়ে নেবো।কিন্তু কপাল এমন মন্দ গ্র্যাজুয়েশনের আগেই স্ট্রোক করে বাবা চলে গেলেন চিরতরে।দাদা তখন চাকরি করছে ঠিকই কিন্তু মা আর দাদা দু'জনে মিলে আমার গ্র্যাজুয়েশনের রেজাল্ট বেরোনোর আগেই আমার বিয়ে ঠিক করে ফেললেন।আমার কোন আপত্তিতে কোনোই কান দিলেন না।
বিয়ের সাথে সাথেই আমার জীবনে দেখা স্বপ্নগুলো একটা একটা করে ফুলের পাপড়ি ঝরে যাওয়ার মত জীবন থেকে হারিয়ে যেতে থাকলো।
বাড়িতে নূতন বউ হয়ে ঢুকেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার শ্বাশুড়ী তার ছেলের বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ আনেননি এনেছেন একটি কাজের লোক।যে সারা দিনরাত কাজের বিনিময়ে খেতে পরতে পারবে আর রাত হলে তার ছেলের শারীরিক খুদা মেটাবে।আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভালোলাগা, মন্দলাগা কোনকিছুর দাম দেওয়ার মত এদের যেমন কোন মনোভাব নেই ঠিক তেমনই কোন সামর্থ্য কিংবা কোন সুযোগও নেই। তাই সবকিছুই ভাগ্যের দোহাই দিয়ে মুখ বুজে মেনে নিয়েছিলাম।
দু'বছরের মাথায় বাবাই আসে আমার কোল জুড়িয়ে।হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে রান্না করে রেখে তবে হাসপাতাল যেতে হয়েছিল।বিয়ের পরদিন থেকেই দেখেছি শ্বাশুড়ী মায়ের বাতের যন্ত্রণায় আহা,উহু করে হাঁটাচলা করতে।সেই অস্তমঙ্গলায় একবার বাপের বাড়িতে গেছিলাম সেই শেষ।আর গেছি মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে।চারদিনের মাথায় ঘরে বসে সামান্য কাজ করেছি কিন্তু মায়ের কাজে সেদিনও বাপেরবাড়ি আমার যাওয়া হয়নি কারণ শ্বাশুড়ী মা তখন এতটাই অসুস্থ্য আমার পক্ষে কয়েক ঘণ্টার জন্যও কোথাও বেরোনো সম্ভব নয়।
কাকে নালিশ জানাবো ? নালিশ জানানোর যেমন কেউ নেই ঠিক তেমনই জানিয়েও তো কোন লাভ নেই কারণ সবকিছুই তো আমি চোখের সামনে দেখতে পারছি।
ছেলে বড় হল।ব্যাংকে ভালো চাকরিও পেলো।তখন একটা কাজের লোক জোর করে সে রাখলো মায়ের কষ্ট দেখে।শ্বাশুড়ী মা তখন শুধু শুয়েই থাকেন আর যন্ত্রণায় পুরো বাড়ি মাথায় করেন চিৎকার করতে করতে।ওষুধ,মালিশ কিছুই বাদ নেই কিন্তু তবুও তিনি কোনদিনও বাতের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাননি।
ছেলের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে শুরু করা হল।মেয়ে পছন্দ করে আসার পর ছেলে বললো,
--- বিয়ের আগে একবার ওকে আমাদের বাড়িতে আনা যায় না মা?
--- এ আবার কেমন কথা? বিয়ের আগে কিভাবে বিয়ের কনেকে তার উঠবি স্বামীর বাড়িতে আসার কথা বলবো? তোর দরকার হলে তুই আলাদা করে কথা বল অন্য কোথাও।
ছেলের বিয়ে হল।কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার বৌমা অস্তমঙ্গলা সেরে এসে পুরো রান্নাঘরের দায়িত্ব নিলো।আমাকে কিছুই করতে দেয় না। আমি কিছু করতে গেলেই বলে,
-- মা রান্নাঘরের দায়িত্ব এতদিন আপনি সামলেছেন।এবার থেকে এ দায়িত্ব শুধু আমার।আপনি শুধু ঠাকুমাকে দেখুন।আমিও দেখবো তাকে যখন আপনি পারবেন না।কিন্তু রান্নাঘরে আপনাকে আর আমি কোনদিন ঢুকতে দেবো না।
স্বামী আমার সব দেখেশুনে বললেন,
--- আমার মনেহয় কি জানো তোমার বুবাই বিয়ের আগেই তার সাথে দেখা করে এ কথা আদায় করে নিয়েছে।যাক কপাল করে ছেলের বউ পেয়েছ বটে!
তারপর সত্যিই একদিন বুবাইয়ের কাছ থেকে জেনে নিলাম ওই কারণেই সে বিয়ের আগে রমাকে এ বাড়িতে একবার এনে নিজের চোখে সবকিছু দেখাতে চেয়েছিল। কিন্তু সে সুযোগ না হওয়ায় ফোনে কন্টাক্ট করে তার সাথে দেখা করে তার একটাই কথা ছিল ,
--- আমার মা সারাটা জীবন পরিশ্রম করেছেন ।অসুস্থ্য শরীরেও রান্না করেছেন।তুমি কি পারবে আমার মাকে রান্নাঘর থেকে মুক্তি দিতে? কয়েক মাসের মধ্যেই আমি রান্নার লোক রেখে দেবো।মাত্র ছ'টা মাস আমি সময় চাচ্ছি।
এখন রান্নার মাসি,কাজের মাসি সবই আছে আমার ছেলের দৌলতে।শ্বাশুড়ী মা বুবাইয়ের বিয়ের তিনমাসের মধ্যে মারা যান।আজ আমার কোন কাজ আর সংসারে নেই।এই বয়সে এসে আবার হারমোনিয়াম নিয়ে বসেছি বৌমার পীড়াপীড়িতে।বৌমা আমার সত্যিই লক্ষী।
No comments:
Post a Comment