Thursday, July 7, 2022

মুখোশ

 মুখোশ 
 মাধবী বছর খানেক হল ঘোষবাবুদের বাড়িতে কাজ করছে।ঘোষগিন্নী যতক্ষণ মাধবী কাজ করে ঠিক ততক্ষনই তার পিছনে খিটির খিটির করতে থাকেন।সেই প্রথম দিন থেকে মাধবী ঘোষগিন্নীর মুখে কোনদিন ভালো কথা শোনেনি।মাঝে মাঝে মাধবী ভাবে ঘোষগিন্নীর মা বোধকরি জন্মের সময় তার মুখে মধু দিতে ভুলে গেছিলেন।যতই শরীর খারাপ হোক না কেন মাধবীর এ বাড়িতে কাজে আসা বন্ধ করতে পারবে না।তাহলে ঘোষগিন্নীর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।অবশ্য মাধবী চায়ও না ঘোষগিন্নীর বাড়ির কাজ কামাই করতে।স্বামী পরিত্যক্তা মাধবীর দুই সন্তান আর শ্বাশুড়ীকে নিয়ে সংসার।ঘোষবাবুদের বাড়িতে মাইনে ভালো।আর তাছাড়া দু'বেলা কাজে আসলেই টিফিনের জন্য সে যে খাবার ঘোষগিন্নীর কাজ থেকে পায় তা সে কোনদিনও একা খেয়ে পারে না।রোজই সে একটা প্লাস্টিকে করে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সবাই মিলে খায়।
   মাধবী কিছুতেই বুঝতে পারে না খিটখিটে ঘোষগিন্নী দু'বেলা তাকে এতটা করে খাবার দেন কেন?তিনি তো রোজই দেখছেন সে খাবার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে।দিনকে দিন যেন খাবারের পরিমাণ বেড়েই চলেছে।এই তো সেদিন স্বামী,স্ত্রী দু'জনে মিলে কোন আত্মীয়ের বাড়িতে গেছিলেন।বিকালে কাজে আসতে নিষেধ করেছিলেন।হঠাৎ রাত ন'টার দিকে ফোন।"বাড়িতে ফিরেছি কাজে আয়।" খুব রাগ হয়েছিল মাধবীর সেদিন।কিন্তু কিছুই করার নেই।যেতেই হবে।কাজটা যদি চলে যায় তাহলে খুব সমস্যায় পড়বে সে।
  মাধবীর আসতে প্রায় সাড়ে ন'টার মত বেজেছিল।এসে দেখে দু'জনে ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখতে দেখতে চা খাচ্ছেন।দরজা ভেজানোই ছিল।মুখ গোমড়া করে ঘরে ঢুকেই মাধবী চলে যায় রান্না ঘরে।গিয়ে দেখে সিংকে শুধু চায়ের বাসনটাই পড়ে আছে।মনেমনে ভাবে এই কটা বাসনের জন্য এত রাতে ডেকে পাঠানোর কি দরকার ছিলো?বাসন ক'টা মেজে রেখে যখন বেরিয়ে যাচ্ছে তখন ঘোষগিন্নী বললেন,
-- এই শোন,এদিকে আয়।ওই যে দেখ টেবিলের উপর দুপ্যাকেট বিরিয়ানী আছে।প্যাকেট দু'টো নিয়ে যা।বাচ্চা দু'টোকে দিস নিজেরাও একটু করে খেয়ে নিস।
  মাধবীর চোখ দু'টো জলে ভরে গেলো সঙ্গে সঙ্গে।সে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখটা যখন মুচছে ঘোষগিন্নী বলে উঠলেন সেই খ্যারখেরে গলায়,
-- সকাল সকাল আছিস কাজে।দেরি করে এসে আবার কোন অজুহাত দিস না।
  মাধবী মাথা হেলিয়ে বেরিয়ে গেলো।কিন্তু সত্যিই পরদিন বেলা দশটা বেজে গেলো মাধবীর পাত্তা নেই দেখে ঘোষগিন্নীর মাথায় আগুন চড়ে গেলো।বেশ কয়েকবার ফোন করলেন কিন্তু ফোন বেজে গেলো কেউ ধরলো না।আরো ক্ষেপে গিয়ে নিজেই একটা ছাতা মাথায় মাধবীর বস্তির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।এরূপ আগে কোনদিনও হয়নি যে ফোন করলে মাধবী ফোন ধরেনি।খুঁজে খুঁজে মাধবীর ঘরের কাছে গিয়ে বেশ রাগানিত্ব স্বরেই "মাধবী" বলে ডাক দিলেন।বছর সত্তরের এক বৃদ্ধা বেরিয়ে এসে যা বললেন তা হল - কাল বাবুদের বাড়ি থেকে দূপ্যাকেট বিরিয়ানী দিয়েছিল।সবাই মিলেই ভাগ করে খেয়েছিল তারা।কিন্তু ভোর রাত থেকে বড় ছেলেটির পায়খানা,বমি শুরু হয়।ভোরের দিকে কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ে সে।সবাই মিলে তাকে হাসপাতাল নিয়ে গেছে।
  এটুকু শুনে ঘোষগিন্নীর শরীরটা অস্থির অস্থির করতে লাগলো।বৃদ্ধা বলতে পারলেন না কোন হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।পাশের একটি ঘর থেকে জেনে তিনি দ্রুত পায়ে বাড়িতে এসে স্বামীকে সব জানালেন।
  ছুটে গেলেন দুজনেই হাসপাতালে।কথা বললেন ডাক্তারদের সাথে।ভয়ের কোন কারণ নেই জেনে তবে নিশ্চিন্ত হলেন।
 দুজনে সেদিন আত্মীয়ের বাড়ি থেকে খেয়েই ফিরছিলেন।বিকালের যেহেতু বাড়ি ছিলেন না তাই মাধবী এবং তার ছেলেমেয়ে দু'টির টিফিন যায়নি ঘরে ভেবেই দু'জনে ওই বিরিয়ানীর প্যাকেট দু'টি কিনে আনেন।কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল।খুব ভয় পেয়ে গেছিলেন নিঃসন্তান এই দম্পতি।
  চারদিন পর মাধবী কাজে ফিরেছে।সেই একই রূপ ঘোষগিন্নীর।এখন আর মাধবীর তার প্রতি কোন রাগ হয় না।রাগটা যে ঘোষগিন্নীর মুখোশ সেটা এখন মাধবী ভালোভাবেই বুঝে গেছে।

No comments:

Post a Comment