Tuesday, February 28, 2017

অবুঝ মন  ( ২য়  অংশ )  নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
                       এই ঘটনার পর পাঁচ ,সাতদিন কেটে গেলো | তুষার কিন্তু বিপাশাদের বাড়িতে আর গেলোনা | পাগলের মত তুষারকে বিপাশা খুঁজে বেড়িয়েছে | কিন্তু কোথায় তুষার ? তুষারের ও নিজের বন্ধুদের কাছে ,তুষারের দূরসম্পর্কের ওই পিসিমার বাড়ি  ও গ্রামের বাড়ির ঠিকানা জানতে চেয়েছে | কিন্তু কেউই তার কোনো সন্ধান দিতে  | আর পারবেই বা কি করে ? বিপাশাকেও তো সে কোনোদিন তার পিসিমার বাড়ি বা গ্রামের বাড়ির ঠিকানা বলেনি | বহুবার বিপাশা তার কাছে জানতে চেয়েছে ,পিসিমার বাড়ির কথা | কিন্তু কোনোদিনও তুষার তাকে ঠিক কোন জায়গাটায় পিসিমার বাড়ি সেটা বলেনি |                          
বাড়িতে বিয়ের জন্য নিত্য অশান্তি | বিয়েতে মত না দিলে বিপাশার মা জলস্পর্শ করবেননা বলে দরজায় ছিটকেনি দিলেন | সকলের চাপের কাছে বিপাশা শেষ পর্যন্ত বিয়েতে রাজী হয় | বুকের যন্ত্রণার উপর একটা মস্তবড় পাথর চাপা দিয়ে সকলের সামনে সে হাসিমুখেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে | কিছুতেই সে বুঝতে পারেনা তুষার তার সাথে কেনো এমন করলো ! বিয়ের প্রায় মাসখানেক পর খবরের কাগজে বিপাশা দেখে তুষারের ভারসিটির লাইব্রেরীর কার্ডের ছবিটা | চমকে ওঠে | কাগজটা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে খবরটা পরে | হাওড়া রেললাইনের উপর অপরিচিত এক যুবকের ট্রেনে কাটা লাশ পাওয়া গেছে | মুখাকৃতি তার এতটাই বিকৃত হয়েছে যে তার পকেট থেকে পাওয়া ভার্সিটির কার্ডের সাথে মেলানো সম্ভব হচ্ছেনা | কার্ডে পাওয়া নাম অনুযায়ী মনে করা হচ্ছে - যুবকটির নাম তুষার মজুমদার |                                 
কাগজটি হাতে ধরে কতক্ষন এভাবে বিপাশা বসে ছিলো তা সে নিজেই জানেনা | চোখেরজল পড়তে পড়তে একসময় তাও বন্ধ হয়ে যায় | বিয়ের পর থেকেই সুখেন্দু অফিস চলে যাওয়ার পর স্নান সেরে সে খবরের কাগজটা নিয়ে শুয়ে পড়তো | প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তো | সংসারে তো মানুষ দুজন ; সে আর সুখেন্দু | বিয়ের মাসখানেক আগে সুখেন্দু চাকরী পায় | কিন্তু তার পোস্টিং হয় কলকাতার বাইরে - কুচবিহার | শ্বাশুড়িমা তার স্বামী ,শ্বশুরের ভিটা ছেড়ে আসবেন না | তাই চাকরী পাওয়ার পরই তিনি ছেলের বিয়ে দিয়ে দেন | অন্ধকার ঘরে পেপার হাতে বিপাশা যেন এ জগতেই নেই | বারবার কলিং বেলের আওয়াজ তার কানে যাচ্ছে কিন্তু পা দুটো তার যেন চলছে না | অনেকক্ষন পর সে উঠে দাঁড়ায় | ঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে দেখে সন্ধ্যা সাতটা | তারমানে সুখেন্দু এসে গেছে | কোনো রকমে হেঁটে যেয়ে দরজাটা খুলে দেয় | সুখেন্দু হেসে পরে জিজ্ঞাসা করে ," কিগো ঘুমিয়ে পড়েছিলে ?" অস্ফুট স্বরে বিপাশা উত্তর দেয় ," হ্যাঁ "|             
     
    জীবনে এরপরে কি করে যে সাতাশটা বছর কেটে গেছে তা বোধকরি বিপাশা নিজেও জানেনা | বিয়ের দুবছরের মাথায় তাদের একটি ফুটফুটে মেয়ে হয় | নিজেরা দেখেশুনে প্রবাসী ছেলের সাথে মেয়ের বিয়েও দিয়ে দেয় । মেয়ে ,জামাই অস্ট্রেলিয়াতেই থাকে । তাদেরও একটি সুন্দর ,ফর্সা একদম মোমের পুতুলের মত মেয়ে হয়েছে ।যার বয়স এখন ছমাস । নাতনীর জম্মের কয়েকদিনের মধ্যেই সুস্থ্য ,স্বাভাবিক সুখেন্দু স্ট্রোকে মারা যায় ।সম্পূর্ণ একা হয়ে যায় বিপাশা । মেয়ে বারবার করে তার কাছে চলে যাওয়ার জন্য বলেছে । কিন্তু বিপাশা রাজী হয়নি  । আবার তাই ডাইরী কলমকে সঙ্গী করেছে । দু'একটা ম্যাগাজিনে ছোট গল্প লিখতে লিখতে হঠাৎই সে তার নিজের জীবনী লিখে ফেলে । ছেলেবেলার বন্ধু রচনার সাথে তার নিত্য যোগাযোগ । ডাইরীটা সে রচনাকে পড়তে দেয় । কিন্তু রচনা তাকে অবাক করে দিয়ে ফোনে জানায় ,"তোর এই লেখাটার সাথে প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক আগন্তুকের 'শেষ দেখার' হুবহু মিল রয়েছে ।"  " তোর কাছে আছে আগন্তুকের উপন্যাসটা ?"  " হ্যাঁ আছে তো ,আমি কাল নিয়ে তোর কাছে যাবো ।"
       পরদিন ঠিক সকাল এগারোটা নাগাদ রচনা তার ছোট নাতনীটিকে সাথে নিয়ে বিপাশার বাড়িতে আসে । রচনা চিরকালই গল্প ,কবিতা পড়ার পোঁকা যাকে বলে । কারও কোনো নুতন লেখা বেরিয়েছে জানতে পারলেই তা সে কিনবেই । বলতে গেলে নিজের বাড়িটাকে ছোটোখাটো একটা লাইব্রেরী বানিয়ে ফেলেছে ।
     রচনারা চলে যাওয়ার পর বিপাশা বইটা নিয়ে বসে । গল্পের নাম "শেষ দেখা" লেখক আগন্তুক । বিপাশা শুয়ে শুয়ে বইটা পড়তে শুরু করে । তার লেখা "উত্তর পাইনি" আর আগন্তুকের লেখা "শেষ দেখা"-র ঘটনা এক শুধু লেখাটাই অন্যভাবে । বিকালের আগেই খাপছাড়া ,খাপছাড়া ভাবে বিপাশা পুরো উপন্যাসটাই শেষ করে । পার্থক্য শুধু একজায়গাতেই তার নিজের লেখা গল্পটি বিয়োগান্তক আর আগন্তুকের লেখা উপন্যাসটি মিলনাত্মক । ঘটনার বিস্তৃত বিবরণে বিপাশার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলিই কল্পনার সাহায্যে এক সুন্দর মাত্রা এনে দিয়েছেন আগন্তুক । বিপাশা ভাবতে থাকে - কে এই আগন্তুক ? কি করে এটা সম্ভব হলো ? জানতেই হবে আমাকে ! আমার জীবনের খুঁটিনাটি ঘটনাসমূহ তিনি কি করে জানলেন ?
নন্দা    (আবার কাল )

No comments:

Post a Comment