বন্ধু প্রীতি
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
আজ কিছুদিন ধরেই সায়নী লক্ষ্য করছে দেবেশ একটু অন্যমনস্ক।অফিস থেকে ফিরেও রাত করে।আগে অফিস থেকে ফিরে টিফিন করে সায়নী ও তাদের তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে সময় কাটাতো।আর এখন এতটাই রাত করে ফেরে টিফিন করার আর প্রয়োজন হয়না,এসে ফ্রেস হয়েই ডিনার সেরে ঘুমিয়ে পড়ে।তাদের মেয়ে শ্রেয়া এখন আর বাবাকে কাছে পায়না বললেই হয়।যেহেতু নিজের থেকে দেবেশ তাকে কিছু বলেনা, শান্ত স্বভাবের সায়নীও কখনোই দেবেশকে কিছু জিজ্ঞাসা করেনা।
অত্যন্ত গরীব ঘরের মেয়ে সায়নী। অনেক কষ্টে বাবা তাকে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করিয়েছেন।রূপে-গুনে সে অতুলনীয়া।দেবেশের বাবার এক বন্ধু ও সায়নীর বাবার এক বন্ধুর যৌথ উদ্দোগে এই বিয়ের সম্মন্ধ।দেবেশের মা ছাড়া সংসারে আর কেউই নেই।তিনিও খুব একটা সুস্থ্য নন।বাবা সরকারী চাকরী থেকে রিটায়ার করার পর বছর দুয়েক বেঁচে ছিলেন।শ্বাসকষ্ট জনিত কারনে দুটি লাঞ্চই তার ব্লক হয়ে গেছিল।এমতাবস্থায় বহুদিন নার্সিংহোমে ভেন্টিলেশনে ছিলেন।উনি রিটায়ার করার অনেক আগেই দেবেশ ব্যাংকে চাকরী পেয়ে গেছিলো।রিটায়ার করে যা পেয়েছিলেন তার পুরোটাই খরচ হয়ে যায় নার্সিংহোমের খরচ দিতে।স্বামীর বন্ধু মাঝে মাঝে আসতেন দেবেশ ও তার মায়ের খবর নিতে।তাকেই একদিন আশাপূর্ণাদেবী বলেছিলেন দেবেশের জন্য একটি ভালো পাত্রীর ব্যবস্থা করতে।কারন তার শরীর মোটেই ভালোনা;তিনি চলে যাওয়ার আগে দেবেশকে সংসারী দেখে যেতে চান
মেয়ে দেখতে যেয়ে মা,ছেলের দু'জনেরই সায়নীকে খুব পছন্দ হয়।সায়নী তো পছন্দ হবার মতই মেয়ে।সেদিনই তিনি বিয়ের যাবতীয় কথাবার্তা পাকা করে যান।সায়নীদের আর্থিক অবস্থা যেহেতু মোটেই ভালো নয় সেইহেতু তিনি এক বস্ত্রে ছেলের বৌকে বরণ করবেন কথা দিয়ে যান।কিন্তু একমাত্র মেয়ে তার উপর মা হারা,হরিহরবাবু সাধ্যের অতীত করেন তার সানুর বিয়েতে।
বুদ্ধিমতী,ধীর, শান্ত স্বভাবের সায়নী শ্বশুর বাড়িতে এসেই সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেয়।শ্বাশুড়ীমায়ের সেবা-যত্নেরও কোন ত্রুটি সে রাখেনা।শুধু একটি কাজ আশাপুর্ণা দেবীর জন্য সংসারে বরাদ্ধছিলো;দু'বেলা খাওয়ার সময় তাকে এসে ছেলের সামনে বসতে হত।আর ছুটির দিনে তো তিনবেলায়।এ নিয়ে তিনি দেবেশকে অনেক বুঝিয়েছেন।কিন্তু ছেলের ওই এক গো!ছেলেবেলা থেকে তুমি খাবার সময় সামনে না বসে থাকলে আমি কোন খাবারে স্বাদ পাইনা।আজীবন এটা তোমাকে করতেই হবে।সায়নীর অবশ্য এ নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই।সেও তার কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসে মা,ছেলের গল্পের মধ্যে যোগ দেয়।আর দেবেশ অফিস থেকে ফিরলে এক সাথে চা খাওয়া,হালকা টিফিন করা আবার রাতে একসাথেই খেতে বসা।আনন্দ, হাসির মধ্য দিয়ে দিনগুলি কোথা দিয়ে যেন কেটে যাচ্ছিল হু-হু করে।এক বছর যেতে না যেতেই কোল আলো করে সায়নীর জীবনে আসে শ্রেয়া।শ্রেয়ার সবকিছু তার ঠাকুমার হাতে।শুধু তাকে খাওয়ানোটা ছাড়া।আশাপুর্ণাদেবী বলেন,"শোন বৌমা,তুমি তোমার সংসার সামলাও আর আমি আমার নাতনীকে সামলাই।কিছুই তো আমায় করতে দাওনা।বসে বসে আমার হাতপায়ে কড়া ধরে গেলো"।
সময় যেন ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলছে।সুখের দিনগুলি হয়তো এভাবেই ধাবমান।মেয়ের যখন আড়াই বছর বয়স তখন একদিন রাতে ঘুমের মধ্যেই স্ট্রোক করে আশপুর্ণাদেবী মারা যান।দেবেশ ভীষনভাবে ভেঙ্গে পড়ে।সময়ের সাথে সাথে আর সায়নীর সর্বদা সঙ্গ দেওয়া, হাসি খুশির মধ্যে রাখার চেষ্টা করার ফলে দেবেশ আস্তে আস্তে তার মাকে হারানোর শোক কিছুটা সামলে ওঠে।এরপর মাসতিনেক সব ঠিকঠাক থাকে।
তারপরেই দেবেশের ভিতর এই পরিবর্তন।প্রতিদিন সায়নী ভাবে আজ নিশ্চয়ই দেবেশ তাকে কিছু বলবে।কিন্তু দেবেশ, সায়নীকে কিছুই বলেনা।আস্তে আস্তে দেবেশ ও সায়নীর ভিতর বিরাট এক ফারাক তৈরি হয়।পৃথিবীতে সায়নীর নিজের বলতে আর কেউই নেই।বাবা দু'বছর হোল গত হয়েছেন।ছোট্ট বাড়িটা তালাবন্ধ অবস্থায় পড়ে রয়েছে।এ জীবন তার কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে।নিজেকে মাঝে মাঝে শেষ করে দিতে ইচ্ছা করে।কিন্তু শ্রেয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে তাও পারেনা।
ছেলেবেলায় দেবেশের প্রাণপ্রিয় বন্ধু ছিলো অশোক।খুবই গরীব ঘরের সন্তান অশোক।কিন্তু পড়াশুনায় ছিলো তুখোড়।উচ্চমাধ্যমিকে ৮৫%নম্বর নিয়ে পাশ করে যখন অর্থের অভাবে পড়া বন্ধ করে দেবে ভেবেছিল তখন দেবেশের বাবার হস্তক্ষেপে যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার নিয়ে পড়াশুনা শুরু করে কোর্স শেষ হওয়ার আগেই চাকরী পাকা হয়ে থাকে।পরবর্তীতে আমেরিকায় চাকরির সুবাদে সেটেল্ড হয়।একমাত্র বৃদ্ধা মাকে সে সাথে করেই নিয়ে যায়।সেখানে এক বাঙ্গালী পরিবারের সাথে দেবেশদের খুব ঘনিষ্টতা হয়।এবং সেই পরিবারের সুন্দরী,শিক্ষিতা ও চাকুরীরতা মেয়েকে সে বিয়ে করে।অশোকের স্ত্রীর সাথে তার মায়ের বনিবনা ছিলোনা।সর্বদায় একটা ঝামেলা লেগেই থাকতো।একদিন অফিসে থাকাকালীন সময়ে তার স্ত্রী মধুরিমা তাকে জানায় যে তার শ্বাশুড়ীমা সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পরে গেছেন।উদভ্রান্তের মত মা অন্তপ্রান ছেলে বাড়িতে এসে দেখে সব শেষ।প্রথম অবস্থাতে সে এই ঘটনাকে এ্যাকসিডেন্ট হিসাবেই মেনে নেয়।কিন্তু দিন যতই এগিয়ে যেতে থাকে তার মনে বদ্ধমূল এক ধারনা জম্মায় যে মধুরিমা ইচ্ছাকৃত তার মাকে সিঁড়ি দিয়ে ধাক্কা মেরে নীচুতে ফেলে দিয়েছে আর তার ফলেই তার মায়ের মৃত্যু হয়েছে।মায়ের প্রতি অন্ধ ভালোবাসার বসে সে হয়ে ওঠে প্রতিহিংসাপরায়ন।আস্তে আস্তে সে সম্পূর্ণভাবে পাল্টে যেতে শুরু করে।
রোজ রাতে ঘুমানোর সময় মধুরিমা স্লিপিং ট্যাবলেট খেতো।অশোক বেশি ডোজের ওষুধ কিনে এনে ওই পাত্রে রেখে দেয়।তারপর একরাতে মধুরিমার ঘুমের মধ্যে তাকে গলা টিপে মেরে ফেলে সেই রাতেই সে ফ্লাইট ধরে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়;যার ব্যবস্থা সে অনেক আগে থাকতেই করে রেখেছিলো।কলকাতা পৌঁছে সে পাগলের মত রাস্তা-ঘাটে এদিকে ওদিকে ঘুরে বেরিয়েছে।থাকার কোন সংস্থান নেই, পকেটেও বিশেষ টাকা নেই।তখন অশোক অনেকটাই ভারসাম্যহীন।হঠাৎই দেবেশ একদিন তাকে আবিষ্কার করে ফুটপাতে একটি চায়ের দোকানে বেঞ্চের উপর।অসংলগ্ন কথাবার্তা শুধু নয় দেবেশকে সে চিনতেও পারেনা।দেবেশ জোড় করে অশোককে নিয়ে সোজা পরিচিত এক সাইকিয়াট্রিষ্টের কাছে ।দেবেশ ওই ডাক্তারের আন্ডারে একটি এ্যাসাইলামে সেদিনই অশোককে ভর্তি করে। সেখানেই চিকিৎসা হতে হতে একসময় অশোক সমস্ত ঘটনা ডাক্তারবাবুকে খুলে বলে।
এদিকে দেবেশ সমস্ত ঘটনা স্ত্রী সায়নীর কাছে চেপে যায়।অশোক এতটাই উন্মাদ প্রকৃতির হয়ে গেছিলো যে তাকে পাগলাগারদের আলাদা একটি ঘরে দরজা বন্ধ করে রাখতে হয়েছিলো।কাউকে দেখলেই বিশেষত সে কোন মহিলাকে সহ্য করতে পারতোনা।দেখার সাথে সাথেই সে তার গলা টিপে ধরতে যেত।অথচ কোন বৃদ্ধাকে দেখলে তার পা দু'টি ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতো।দেবেশের মনে হয়েছিলো সায়নীকে জানালে সে ভয় পেয়ে দেবেশকে আর অশোকের কাছে আসতে দেবেনা।ডাক্তার বলেছিলেন অশোক কিছুদিনের মধ্যেই সুস্থ্য হয়ে যাবে।দেবেশও ভেবেছিলো একটু সুস্থ্য হলেই সে তার স্ত্রীকে সব জানাবে। তাই এই ব্যপারটা সে পুরোপুরি সায়নীর কাছে লুকিয়ে যায়।
রোজ অফিস ছুটির পর দেবেশ নিয়ম করে অশোককে দেখতে যেত।বেশ কয়েক মাস এভাবে চলার পর অশোক তখন অনেকটাই সুস্থ্য বন্ধুকে চিনতেও পেরেছে।কিন্তু দেবেশ লক্ষ্য করে অশোকের ভিতর সবসময় একটা ভয় কাজ করে।অনুশোচনায় দগ্ধও হয় একজন মানুষের হত্যাকারী হিসাবে।
অশোক আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে থাকে।দেবেশ ঠিক করে যে সে এবার সবকিছু সায়নীকে জানাবে।সেদিন অফিস থেকে দেবেশ একটু তাড়াতাড়িই বেরোয়।না, আজ অশোকের কাছে নয়;বাড়িতে ফিরে সে সমস্ত ঘটনা সায়নীকে খুলে বলবে। হঠাৎ একটি ফোন এ্যাসাইলাম থেকে।
বিনাকারনে দেবেশের এই অবহেলা সহ্যসীমা অতিক্রম করে সায়নীর।সে মনস্থির করে মেয়েকে নিয়ে সে বাবার বাড়িতেই ফিরে যাবে।যেভাবেই হোক কটা টিউশনি সে জোগাড় করে নেবে।সায়নীর সবসময়ই মনে হচ্ছে দেবেশ কিছু একটা লুকাচ্ছে তার কাছ থেকে।যদি সে অন্য কোন মেয়েকে নিয়ে সুখি হতে চায়,তার জীবনে যদি সত্যিই অন্য কেউ এসে থাকে তাহলে ওদের দু'জনের মাঝখানে প্রাচীর হয়ে সে দাঁড়াবেনা।সে তার ও মেয়ের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাগে গুছিয়ে ফেলে।সন্ধ্যার পর থেকে অনেক খোঁজাখুঁজির পর বাপের বাড়ির চাবিটা পেয়ে তার পার্সে রাখে।বাবার দেওয়া গয়নাগুলিও ব্যাগে রাখে।এই গয়না বিক্রি করেই তো তাকে কিছুদিন চালাতে হবে টিউশনি বা অন্য কোন উপায়ে কিছু রোজগার না করা পর্যন্ত।কিন্তু আজ যেন দেবেশ আরও বেশি দেরি করছে।রাত একটা বাজতে চললো এখনও দেবেশের দেখা নেই।সকাল হলেই সে তার মেয়ে শ্রেয়াকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বে।দেবেশের এই বদল আসার পরে বহুদিন হোল সে অভিমান করে তাকে ফোন করাও বন্ধ করে দিয়েছে।
এত রাতে সায়নীর ফোনটা বেজে ওঠায় সে একটু অবাকই হয়।ফোনটা তুলে দেখে তার ছেলেবেলার বন্ধু অপর্ণার ফোন।
---এত রাতে কি ব্যপার?কেমন আছিস?
---আমি জানতাম তুই জেগে আছিস।
---কি করে জানলি?
---আরে দেবেশদাই তো এই মাত্র শ্মশান থেকে বেরোল।
---শ্মশানে দেবেশ কি করতে গেছে?কে মারা গেছে?
---দেবেশদা বাড়িতে পৌঁছালে তুই সব জানতে পারবি।
---দেবেশদার এক বন্ধু সুইসাইড করেছে।মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন।সে অনেক কথা।বাড়িতে যেয়ে সব সেই তোকে বলবে,কিন্তু তুই দেবেশদাকে ভুল বুঝিসনা।ছেলেবেলার বন্ধুর প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য অস্বীকার করতে পারেনি।তোকে যে কোন কারনেই হোক ভয়ে কিছু বলতেও পারেনি।আর এর ফলে তোদের মধ্যে একটা ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছেও বললো।
---আমি তোর কথা কিছু বুঝতে পারছিনা।তুই কি করে এসব জানলি?
---তুই তো জানিস আমি কে.এম.সি.তে চাকরী পেয়েছি।আজ বার্নিংঘাটে আমার ডিউটি ছিলো।সেখানেই দেবেশদার মুখে সব শুনি।মানুষটা খুব ভেঙ্গে পড়েছে বন্ধুকে হারিয়ে।এখন তোর সঙ্গ মানুষটার খুব দরকার রে!এখন রাখি, আবার একটা বডি এসছে।একদিন যাবো তোর ওখানে।
সায়নী ফোন রেখে সাতপাঁচ ভাবতে লাগে।হঠাৎ কলিং বেলটা বেজে ওঠে।ভোরের আলো তখন একটু একটু করে উঁকি দিচ্ছে।সায়নী তার গুছানো ব্যাগটা খাটের নিচে লুকিয়ে রেখে দরজা খুলতে এগিয়ে যায়।
(শেষ)
No comments:
Post a Comment