Thursday, June 14, 2018

মুক্তি 
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী 

       সে দিনটি ছিলো অমাবস্যা।সরকারী চাকরির পদোন্নতি ও বদলির সুবাদে অচেনা,অজানা এক গ্রামের উদ্দেশে রওনা দিলাম ।গ্রামে নূতন পোষ্ট অফিস হওয়াতে আমাকে পোষ্টমাষ্টার পদে উত্তীর্ন করে বলতে গেলে এক জনমানব শূন্য দ্বীপে সরকার পাঠিয়ে দিলেন।কলকাতা শহরের জনবহুল এলাকা বালিগঞ্জ আমার বাড়ি।এক মেয়ে, অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আর মাকে নিয়ে সাজানো গুছানো সংসার আমার। পেটের দায়ে সরকারী আজ্ঞা অমান্য করতে পারিনা। সরকার বাহাদুর এক ধাক্কায় আমাকে পোষ্টমাষ্টার বানিয়ে গলাধাক্কা দিয়ে এক গন্ডগ্রামে পাঠিয়ে দেওয়ার সু-বন্দোবস্ত করে ফেললেন।আমিও মোটা মাইনে আর বেঁচে থাকা এবং পরিবারের বাকি সদস্যদের আরও ভালো রাখার তাগিদে বাধ্য শিশুর মত ব্যাগ-প্যাটরা গুছিয়ে পলাশপুর গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

     দুপুরে খেয়েদেয়ে লোটা-কম্বল গুছিয়ে নিয়ে হাওড়া স্টেশনে এসে হাজার হাজার লোকের ভিতর দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিলো কলকাতা শহরের এবং তার আশেপাশের সমস্ত জায়গার লোক যেন আজ হাওড়া স্টেশনে এসে জমা হয়েছে।তখন মেয়ের ছেলেবেলার একটা কথা খুব মনে হচ্ছিল, মেয়েকে নিয়ে বাসে উঠলেই বাসটা যদি ভিড় হয়ে যেত আমার ছোট্ট মেয়ে তখন বলতো,"বাবা, আমি যে বাসটায় উঠি সেটাতেই সবাই উঠে কেন?" আজ আমারও মনের অবস্থা ঠিক একই।গরু হারালেও তার ভিতর খুঁজে পাওয়া যাবেনা।বসা তো দূরহস্ত!দাঁড়িয়ে থাকার জায়গারও অভাব।দাঁড়িয়ে থাকাও সম্ভব হচ্ছেনা;লোকের ধাক্কাধাক্কিতে কখনো দুপা সামনে আবার কখনোবা দুপা পিছনে পিছিয়ে যেতে হচ্ছে।আজ এত ভিড়ের কারন লোক মুখে শুনলাম একটি ট্রেন বেলাইন হওয়াতে পর পর দুটি ট্রেন এখনও এসে পৌঁছাতে পারেনি।সারাইয়ের কাজ চলছে।মাথায় হাত!তারমানে পরপর দুটি ট্রেনের যাত্রী পরবর্তীতে আসা তৃতীয় ট্রেনটিতে উঠবে। নিজের উপর নিজের রাগ হতে লাগলো।এর থেকে বালিগঞ্জ স্টেশনে যেয়ে গাড়ি পাল্টে আর একটি ট্রেনে গেলে অন্তত এই ভিড়ের হাত থেকে বাঁচতাম।একটা গাড়িতে যাবো মনস্থির করে বোকার মত দুশো টাকা ট্যাক্সি ভাড়া দিয়ে ঘাড় ধাক্কা, গলা ধাক্কা,পিঠ ধাক্কা অন্যদের অজান্তেই লাথি, ঘুসি সব খাচ্ছি!গাড়ি আসার পর কি হবে সেটা মনে করতেই ঘামতে শুরু করলাম।সাথে আবার আমার বিশাল আয়তনের তিনখানা ব্যাগ।একটিকে গলায় স্থান দিয়ে বাকি দুটিকে হাতে নিয়ে প্লাটফর্ম থেকে একটু দূরত্বে যেখানে অপেক্ষাকৃত একটু কম লোক সমাগম সেখানে হাজির হয়ে আমার তিন সঙ্গীকে নীচুতে রেখে একসঙ্গীর মাথার উপর বসে পড়লাম।ঘন্টা দুয়েক অপেক্ষার পর সন্ধ্যা ছটা নাগাদ বহু আঙ্খাংকিত ট্রেনটি দূর থেকে শিস (হুইসেল)দিয়ে তার আগমনবার্তা জানিয়ে দিলো।ব্যস শুরু হোল রেডী, গো, স্টার্ট ।দৌড় প্রতিযোগীতা !সাথে একটা কিনলে অন্যটা ফ্রীর মত ধাক্কাধাক্কিটা উপরি পাওনা!আমিও আমার তিন সঙ্গীকে আমার শরীরের পূর্ব জায়গায় স্থাপন করে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করলাম।
আমার ছুটাই সার হোল।আমি কোন পজিশনে আসতে পারলামনা!কারন যতই আমি সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করিনা কেন;জনসমুদ্র আমার সঙ্গীদের ধাক্কা মেরে আমাকে পিছনে সরিয়ে দেয়।সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও আমি ট্রেনের কোন কামড়ার সম্মুখে যেতে সমর্থ হলামনা।
          গাড়ি পূনরায় আমার কানের কাছে শিষ দিয়ে মনেহল একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে টা টা করে প্লাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।আমারই মত আরও বেশ কয়েকজন অপলক দৃষ্টিতে আমাদের আরাধ্য ট্রেনটি যতক্ষণ দেখা যায় বোকার মত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। 
            খবর নিয়ে জানতে পারলাম পরবর্তী ট্রেন আরও এক ঘন্টা পর।অগত্যা এই বহু আঙ্খাংকিত যানটির জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করলাম বুকের ভিতর ধূপপুকানী নিয়ে।যেন সদ্য প্রেমে পড়া প্রেমিক তার প্রেমিকার আসার অপেক্ষায় বসে।মিনিটে মিনিটেই ঘড়ির দিকে আর তার আসার পথের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ। 
         অবশেষে তিনি এলেন।ঘড়িতে তখন রাত পৌনে আটটা।মনেহল তাকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খাই।কিন্তু আমার প্রেমিকা আড়ে এবং লম্বায় এতই বিশাল আকৃতির সে আশা ত্যাগ করেই মনের আনন্দে তার ভিতর ঢুকে গেলাম আমার শরীরে অবস্থানরত সঙ্গীদের নিয়ে।আমি উঠে বসতেও পারলাম।দু'ঘন্টার রাস্তা।তারমানে পলাশপুর স্টেশনে নামতে রাত দশটা তো বাজবেই।সারাদিনের এই ধকলের পরে বসে বসে ঝিমাচ্ছিলাম।হঠাৎ চাইইআইইই-- চাআআআআ--।নিলাম এক কাপ চা।চা খেতে খেতে সারাদিনের যুদ্ধের কথা মনে পড়তেই নিজের মনেই হাসতে লাগলাম।হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠে।দেখি আমার 'সুইট হার্ট'ফোন করেছেন পৌঁছেছি কিনা জানার জন্য।সংক্ষেপে দুপুরের যুদ্ধের বর্ণনা দিলাম চাপাস্বরে।
               নিদৃষ্ট স্টেশন পলাশপুর এসে নামলাম।চারিদিকে শুনশান।এখান থেকে যেতে হবে আরও চার মাইল।সেটা রিক্সা বা ভ্যানে।রিক্সা একটিও নেই।অগত্যা একটি ভ্যানে চেপে বসলাম।পাঁচজন একটি ভ্যানে আর আমার ওই বিশাল আয়তন ও ওজনের তিন সঙ্গী।মনেহচ্ছিল সঙ্গীদের ভ্যানে চাপিয়ে নিজে দৌড়ে ভ্যানের পিছন পিছন যাই। অবস্থা তখন আমার শোচনীয়।ভ্যানের উপর আমি,আমার উপর আমার ভারী ও বড় সঙ্গী,তার উপর মেজটি সর্বশেষে আমার কাঁধের উপর বাইরের দিকে ঝুলন্ত ছোটটি।ভ্যানে বসার পর আমার যে উচ্চতা ছিলো আমার কালের উপর সঙ্গীদের স্থাপন করে দু'হাতে তাদের জড়িয়ে রাখতেও হিমসিম খেতে হচ্ছিলো কারন তখন তাদের উচ্চতা আমার উচ্চতার থেকে ফুট খানেক বেড়ে গেছে।
                    ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভিতর দিয়ে ভ্যান এগিয়ে চলেছে।সহযাত্রীদের সাথে আলাপচারিতায় জেনে গেলাম পোষ্ট অফিসটি মাস ছ'য়েক আগেই খুলেছে পূরন একটি দোতলার বাড়ির নিচের সম্পূর্ণ অংশটি নিয়ে।উপরে বেশ কয়েকটি বড় কামড়া রয়েছে।সেখানেই পোষ্টমাষ্টারের থাকার ব্যবস্থা।প্রথম অবস্থায় যিনি পোষ্ট মাষ্টার হয়ে এসেছিলেন তিনি দু'মাস এখানে ছিলেন।বদলীর জন্য বারবার সুপারিশ করেও কোন ফল না পেয়ে শেষে চাকরীতে ইস্তফা দিয়ে চলে যান।আর দ্বিতীয়জন পনের দিনের মাথায় হার্ট অ্যাটাকে।তারপর থেকে বলতে গেলে পোষ্ট মাষ্টার ছাড়ায় ঢিমেতালে পোষ্ট অফিসটি চলছে। আমি 'কেন এখানে কোন পোষ্ট মাষ্টার থাকতে চাননা'-জানতে চাওয়ায় কেউ আর কোন কথা না বলে চুপ করে যায়।আমিও আর কোন কথা বাড়ায়না।আমার কি লাভ এসব জেনে?আমি আদার ব্যাপারী জাহাজের খবর নিতে যাবো কেন?
        ভ্যান এসে আমাকে নিদৃষ্ট জায়গায় নামিয়ে দিলো।রাস্তায় কোথাও কোন আলো না থাকলেও কিছু কিছু বাড়িতে ইলেকট্রিক এসে গেছে।কিছুটা হাঁটতে হবে।তবে অতি সামান্যই!আমি সঙ্গী তিনজনকে নিচু হয়ে তুলতে যাবো হঠাৎ দেবদূতের মত এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক এসে বললেন,"আমি ব্যাগগুলো নিয়ে যাচ্ছি আপনি আমার সাথে সাথে চলুন"।পরিচয় জানতে চাইলে বলেন এই গায়েই বাস তার।এও বললেন, আমার জন্যই তিনি অপেক্ষা করছিলেন।বড় একটি লোহার গেটের সামনে ভদ্রলোক দাঁড়ালেন।দেখলাম আমার অফিস কাম বাসস্থানটিতে একটি টিমটিমে বাল্ব জ্বলছে।ভিতর থেকে গেটটি বন্ধ।বুঝলাম ভিতরে কেউ আছে।গেটে শব্দ করলাম।সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো, "আসছি স্যার।"পিছন ফিরে দেখি ওই ভদ্রলোক আমার ব্যাগদু'টিকে নীচুতে রেখে চলে গেছেন।দু'টি বললাম এই কারনে একটি আমার গলাতেই ঝুলন্ত অবস্থায় বিরাজিত ছিলেন।একটু অবাক হলাম।কিন্তু ভাবার সময় পেলামনা কারন ততক্ষনে চল্লিশউর্দ্ধ এক দীর্ঘায়ি পুরুষ এসে গেট খুলে সহাস্য বদনে আমার সঙ্গীদের নিজ হাতে নিয়ে নিয়েছেন।কথা বলে জানতে পারি উনি পোষ্ট অফিসের দারোয়ান এখানেই থাকেন, সাথে উনার স্ত্রীও থাকেন কোন সন্তানাদি নেই।আমার থাকার ব্যবস্থা উপরের ঘরেই।রমাপদ দোতলার সিঁড়ির ঘর খুলে আমাকে উপরে নিয়ে গিয়ে একটি ঘরের দরজা খুলে দিলো।ভিতরে ঢুকে আমার তো চক্ষু চড়কগাছ!দামী সোফা,দামী খাট। সবই পূরন আমলের সেগুন কাঠের তৈরি।খুব সুন্দর করে ঘরটি সাজানো।মনের মধ্যে যে একটি বেড়ার ঘর উঁকি দিচ্ছিল এই গন্ডগ্রামের মধ্যে বুঝলাম সেটা আমার দুঃস্বপ্ন ছিলো।এত সুন্দর একটা থাকার ব্যবস্থা দেখে মনটা ভারী প্রসন্ন হয়ে গেলো।রমাপদ আমায় জানালো আজ রাতের খাবারটা সে নিজেই দিয়ে যাবে।আর আগামীকাল সকালে যেয়ে নিজেই বাজারঘাট করে এনে দেবে তখন আমাকে নিজেই রান্না করে খেতে হবে যতদিন না রান্নার লোক সে খুঁজে আনতে পারছে।কথাগুলো বলে রমাপদ বেরিয়ে গেলো। 
          সারাদিনের এই ধকলের পর ক্লান্তিতে শরীরে মোটেই জোর ছিলোনা।ঝকঝকে বাথরুমে গিয়ে স্নান সেরে ফ্রেস হয়ে নিলাম।রমাপদ বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই আমার সবেধন নীলমনি একটিমাত্র বৌকে ফোন করে বীরদর্পে জানিয়ে দিলাম আমার রাজকীয় বাসস্থানের কথা।
         এরপর বাথরুম থেকে বেরিয়ে নিজেকে খাটের উপর এলিয়ে দিতে যাবো হঠাৎ শুনি বাথরুমের ভিতর থেকে জলের আওয়াজ হচ্ছে।কিন্তু আমার পরিস্কার মনে আছে আমি কল বন্ধ করেছি।মনের ভুল ভেবে শুয়েই পড়ি।কিন্তু না এবার যেন বালতি সরানোর শব্দ কানে আসলো।উঠে গেলাম বাথরুমে।হ্যাঁ ঠিকই শুনেছি।একটা কল থেকে জল পড়ছে।কি করে এটা সম্ভব ভাবতে ভাবতেই কলটা বন্ধ করে এসে সোফায় বসলাম।ইতিমধ্যে রমাপদ রাতের খাবারের জন্য চারখানা রুটি ও what not (সর্বরকম সব্জি) তরকারি নিয়ে এসে দিয়ে গেলো।যাওয়ার সময় সকালের বাজার করার টাকাটা চেয়ে নিয়ে গেলো আর বলে গেলো,"স্যার এটা তো গ্রাম, কোনরকম চিৎকার-চেঁচামেচি কান্নার শব্দ শুনলে কোন কিছুতেই দরজা খুলবেন না"।একটা কাগজের চিরকুট টেবিলের উপর রেখে আরও বললো,"এটা আমার ফোন নম্বর।রাতে দরকার  হলে আমায় ফোন করবেন কিন্তু আপনি নীচুতে নামবেন না।"
               রমাপদর কথাবার্তায় মানুষটিকে খুব কর্তব্যপরায়ন ও ভালো মানুষ বলে মনে হোল।যাহোক সে বেরিয়ে গেলে পেটের ছুঁচোগুলিকে নির্মমভাবে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তার দেওয়া রুটি আর সব্জি নিয়ে গোগ্রাসে খেতে শুরু করলাম।শরীর তখন আর চলছেনা।বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দিলাম।শুয়ে পরে মনেহোল ঘরের লাইটটাই তো ওফ করিনি।অলসতায় উঠে আর ওফ ও করলাম না।গাঢ় ঘুমের মধ্যে হঠাৎ পুরুষ কন্ঠে "বাঁচাও বাঁচাও"- বলে চিৎকার।ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম।সাথে আর এক নারী কন্ঠ।সেও চিৎকার করে কি সব বলছে কিন্তু আমার এই ঘুমের ঢুলুনির মধ্যে পরিস্কার বুঝতে পারছিনা।ভাগ্য ভালো লাইটটা জ্বালানো ছিলো।মনে পড়লো রমপদর সতর্কবানী। আবার শুয়ে পড়লাম।         
      দ্বিতীয় ঘুমে রাত শেষ।চিরদিনের অভ্যাস ছ'টাই ওঠা।ঠিক ছ'টাতেই ধুম ভাঙ্গলো।ব্রাশ করে নীচুতে নেমে চায়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম।মিনিট পাঁচেক হেঁটে পেয়ে গেলাম একটি চায়ের দোকান।জায়গা পেয়ে বসে পড়ে বড় এক কাঁচের গ্লাস চায়ের অর্ডার দিলাম।গ্রামের ভিতর নূতন এই মানুষটিকে দেখে সকলেই আড়চোখে আমায় একটু পর্যবেক্ষন করতে চেষ্টা করছে এটা আমি বিলক্ষণ বুঝতে পারি।তাদের কৌতুহল দমন করার জন্য নিজেই আলাপ জমালাম। 
----আমি এখানকার পোষ্ট অফিসে নূতন পোষ্টমাষ্টার হয়ে এসেছি। 
    আমি লক্ষ্য করলাম প্রত্যেকেই প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ চাওয়াচাওনি করছে।
----গতকাল এসেছেন?উঠেছেন ওই পোষ্ট অফিসের দোতলার ঘরে?
    আমি 'হ্যাঁ'বলাতে দেখলাম সকলের মধ্যেই একটা অস্বাভাবিকতা!প্রশ্নাত্তর পর্ব বেশি দূর আর এগোলো না কারন আমার তাড়া ছিলো তাই আমি ওখান থেকে বেরিয়ে আমার বর্তমান বাসস্থানের দিকে এগোতে থাকি, প্রথমদিন একটু তাড়াতাড়ি অফিসে ঢোকার মনোবাসনা নিয়ে।
        রমাপদ ততক্ষণে বাজার দিয়ে গেছে।শুধু বাজার করে দেওয়ায় নয় মাছ, তরকারি কুটে মাছে নুন-হলুদ মাখিয়েও রেখে গেছে।শুধু তাই নয় হাঁড়িতে জল দিয়ে আর একটা বড় পাত্রে চাল রেখে হাঁড়ির কাছেই রেখে দিয়েছে যাতে সহজেই আমার চোখে পড়ে।হয়তো চালটা হাঁড়ির মধ্যে দেয়নি আমার ভাতের পরিমান কতটা হবে বুঝে উঠতে পারেনি বলে।বেশ বুদ্ধিমান মানুষ মনেহোল রমাপদকে।কিন্তু কতগুলো চাল দিলে কি পরিমান ভাত হবে আমিই কি ছাই জানি?তবুও বেশ বিজ্ঞেরমত একটা কাপের দেড়কাপ চাল নিয়ে হাঁড়ির মধ্যে দিয়ে হাঁড়িটা গ্যাসে বসিয়ে দিলাম। ঘরে ঢুকে দেখি রমাপদ একটা নিউজ পেপারও আমার জন্য কিনে এনেছে।পেপারটা নিয়ে সেদিনের হেডলাইনসগুলো চোখ বুলিয়ে সেটিকে ভাঁজ করে খাটের একপাশে রেখে দিলাম সন্ধ্যার দিকে আমার একাকীত্বকে কাটানোর আশায়।বাড়িটার ভিতর দেখলে কে বলবে এটা একটা গন্ডগ্রাম।আধুনিকতার ছাপ চারিপাশে স্পষ্ট।কিন্তু কেন?আস্তে আস্তে সব কিছুই জেনে যাবো ভেবে নিজের কৌতুহলকে শান্তনা দিলাম বা বলতে গেলে দমন করলাম।
          সমস্ত তরকারীগুলি দিয়ে মাছের ঝোল আর ভাত করে খেয়ে নিয়ে আমি আমার নিজের অফিসে যেয়ে ঢুকলাম।সকলের সাথেই পরিচিত হলাম।কিন্তু আমি লক্ষ্য করছি গতকাল রাস্তা থেকে শুরু করে অফিসের কর্মচারীদের মধ্যেও আমি ওই বাড়ির দোতলার ঘরে আছি শুনে আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে কি যেন জানতে চায়।কিন্তু আমি কোন প্রশ্ন করলে নানান অছিলায় এড়িয়ে যায়।কেমন যেন একটা রহস্যের সন্ধান পেতে লাগলাম।
             সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে রান্না ঘরে ঢুকে এককাপ চা করে পেপারটা নিয়ে বসি।এরই মধ্যে দু'দুবার আমার সুইট হার্ট ফোন করে আমার খবরাখবর নিয়েছেন এবং আমি রান্না করেছি শুনে হেসে কুটিকুটি হয়েছেন।যাহোক-পেপারটা পড়তে পড়তে বাইরে দেখি এক ছায়ামূর্তি।রমাপদ ভেবে পেপার পড়তে পড়তেই ওকে ভিতরে ডাকি।কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে পেপার থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি 'কই কেউ তো না।'একটু অবাক হলেও ভাবি হয়তো আমার দেখার ভুল।
         রুটি আমি করতে পারিনা। তাই সকালেই দুটি চাল বেশি নিয়েছিলাম যাতে করে রাতের খাবারটাও হয়ে যায়।রাত প্রায় দশটা।নিউজ পেপার পড়া শেষ করে স্মার্টফোনটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতে করতেই এত রাত হয়ে গেলো।রান্নাঘরে খাবার আনতে যাওয়ার আগে একবার বাথরুমে ঢুকলাম প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে।সারাজীবনই আমার ওই জায়গাটাতেই একটু দেরি হয়।বেশ কিছুক্ষণ বাদে সেখান থেকে বেরিয়ে একটু অবাকই হলাম।আমার জন্য চারটি হাতে গড়া আটার রুটি আর একবাটি আলুর দম আমার ঘরের বড় টেবিলটাতে রাখা।দরজা খোলায় ছিলো সুতরাং এটা আমি নিশ্চিত যে রমাপদই খাবারটা দিয়ে
 গেছে।বাইরের সিঁড়ির ঘরের চাবি একটা তার কাছে আর একটা আমার কাছেই থাকে।সকালের রান্না করা খাবারগুলো যা রাতে খাবো ভেবেছিলাম সেগুলো ফ্রিজে তুলে দিলাম।আর রুটি চারটি খেয়ে নিলাম।সকালে আর রান্না করার হ্যাপা রইলোনা।ভাবতে লাগলাম রোজ রাতের রুটি,তরকারীটা যদি রমাপদ দিয়ে যায় তাহলে আমাকে মাসের শেষে ওকে কিছু টাকা দিতেই হবে। 
         লাইট ওফ করে শুয়ে পড়লাম।ঘাড়ঘুমে যখন আচ্ছন্ন তখন গতকালের সেই পুরুষ কন্ঠের 'বাঁচাও বাঁচাও' বলে চিৎকার।উঠে বসলাম।মনেহচ্ছে চিৎকারটা যেন পাশের ঘর থেকেই আসছে।লাইট জ্বালিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম।গতকাল রাতের মত এক নারী কন্ঠের চিৎকারও কানে ভেসে আসছে।আজ তার একটি কথা বুঝতে পারলাম,এটা তুমি কি করলে?"আমি ওই ঘরটার দিকে যতই এগোতে থাকি চিৎকার-চেঁচামেচি ততই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকে।যখন তালা দেওয়া ঘরটার সামনে এসে দাঁড়াই তখন সব শান্ত।অদ্ভুত ব্যপার তো!ভূতের ভয় কোনদিন আমার ছিলোনা আজও নেই।ভূত বলে কিছু আছে বলে আমি বিশ্বাসও করিনা।কিন্তু কেন জানিনা আজ জীবনে প্রথমবার মনে হোল কোন ভূত-প্রেত নয় তো ?কিন্তু ভয় আমায় স্পর্শ করতে পারেনি সেদিনও।
         
         পরদিন যথাসময়ে পোষ্ট অফিসে যেয়ে পাহাড় প্রমান কাজ নিয়ে বসলাম।মনেহচ্ছে এখানে পোষ্ট অফিস হওয়ার পর কোন পোষ্টমাষ্টার এ সব ফাইল খুলেও দেখেনি।সহকর্মী প্রবীর সেন অবশ্য পোষ্ট মাষ্টারের কাজগুলো যেহেতু দেখতেন তিনিই এই ব্যাপারে আমায় সাহায্য করতে লাগলেন।কথা প্রসঙ্গে তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, 
--রাতে কেমন ঘুম হচ্ছে? 
---ভালোই ঘুমাচ্ছি তো। 
---কিছু টের পেলেন? 
---কি ব্যপারে বলুন তো? 
---না, আসলে বাইরে থেকে যারাই পোষ্টমাষ্টার হয়ে এসেছেন কেউই এক রাতের বেশি ওখানে থাকেন না। কি সব ভূতের উপদ্রব আছে নাকি।একজন তো ভয়েই হার্ট ফেল করলেন, আর একজন চাকরি ছেড়েই চলে গেলেন। 
   অবাক হয়ে প্রবীর সেনের মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,"ভূত-প্রেত আমি বিশ্বাস করিনা।
        বাকি ঘটনা চেপে গেলাম কারন ওই চিৎকারের মূল রহস্য আমায় উদ্ভাবন করতেই হবে। আর এটা গতকাল রাতেই আমি ঠিক করে ফেলেছি।
        অফিস থেকে ঘরে ফিরে কিছু টিফিন করে আমি রমাপদকে ডেকে নিলাম।উদ্দেশ্য তার কাছ থেকে ঘটনার যদি কোন সূত্র পাই।সরাসরি রমাপদর কাছে জানতে চাইলাম, 
---রোজ রাতে পাশের ঘর থেকে একটা আত্মনাদ আসে।অনেকের মুখেই শুনেছি এখানে নাকি খুব ভূতের উপদ্রব।তুমি আমায় বলতো আসল ঘটনাটা কি?হ্যাঁ-তুমি যা জানো সেটাই বোল আমি ভয় পাবোনা কারন ভূত-প্রেত আমি বিশ্বাস করিনা।
---হ্যাঁ বাবু রোজ রাতে ওই আওয়াজটা আমিও শুনি।প্রথম প্রথম আমিও খুব ভয় পেতাম।কিন্তু এখন আর পাইনা।ভূত-প্রেত যাই হোকনা কেন ওরা কখনোই কারও ক্ষতি করেছে বলে শুনিনি।তবে ভয় পেয়ে এক পোষ্টমাষ্টারের হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়েছিলো।অনেক বছর হোল এখানে পরিবার নিয়ে আছি।এ নিয়ে এক একজন এক এক রকম গল্প-কাহিনী শোনায়।অনেক হাত বদল হয়েছে এই বাড়ির।তবে এখন বাড়িটা সরকারের।এই বাড়িতে রাতে যে ঘরটা থেকে চিৎকার আসে শুনেছি সেই ঘরে কেউ শুলেই সকালে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে।অদ্ভুত অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে এই দোতলার উপর।সবই লোক মুখে শোনা কথা।ওই চিৎকার ছাড়া আপনি কি কিছু টের পেয়েছেন?
          আমিও যে টের পাচ্ছি সে কথা রমাপদর কাছে গোপন রাখলাম।
---না, না,আমি সে রকম কিছু টের পাইনি। আচ্ছা কালকে তুমি কখন এসে রাতের খাবারটা আমায় দিয়ে গেলে? 
---আমি তো কাল রাতে আপনাকে কোন খাবার দিইনি। 
           আমি আকাশ থেকে পড়লাম।তবে কি ভূতের হাতে তৈরি করা খাবার খেলাম।বাহ!বেশ আধুনিক ভূত তো!হাতের রান্নাটাও চমৎকার!রমাপদর ডাকে আমার ভাবনায় ছেদ পড়ে, "বাবু,খাবারের কথা কি বলছিলেন?"
আমি প্রসঙ্গ পাল্টে তার কাছে জানতে চাইলাম, 
---আচ্ছা রমাপদ ওই ঘরের চাবিটা কোথায়? 
---জানিনা বাবু,আমি আসা থেকেই দেখছি ওই ঘর তালা বন্ধ অবস্থায় পড়ে আছে।
      রমাপদ তার শোনা কাহিনী একের পর এক বলতে শুরু করলো।যখন সে উঠলো রাত প্রায় ন'টা।গ্রামের ভিতর রাত ন'টা মানে অনেক রাত।সে নেমে গেলে আমি রান্নাঘরে ঢুকি খাবারগুলো গরম করার জন্য।মনের ভিতর একটা খচখচানি থেকেই গেলো ওই ঘরের ভিতর কি আছে তা আমাকে জানতেই হবে।কিন্তু অবাক হলাম খাবার গরম করে যখন আমি ঘরে নিয়ে আসি তখন দেখি গতকালের মত রুটি আর আলুরদম টেবিলের উপর ঢাকা দেওয়া।তারমানে আজ আবারও আমাকে ভূতের খাবার খেতে হবে।নিজের হাতের রান্না করা খাবার আর ভূতের খাবার নিয়ে বসে যখন আমি ভাবছি কোনটা খাবো তখন এক অদৃশ্য শক্তি যেন আমার হাতটি নিয়ে রুটির পাত্রে রেখে দিলো।জীবনে প্রথম ভয়ে গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো।
           বিছানায় শুয়ে কিছুতেই ঘুম আসেনা।সারাক্ষণ মাথার মধ্যে ভূত ঘুরে বেড়াচ্ছে।যা কোনদিন বিশ্বাস করিনি আজ তাই বিশ্বাস করতে বাধ্য হতে হচ্ছে। কারন নানান ঘটনা প্রমান করছে ভূত বা আত্মা বলে কিছু তো নিশ্চয়ই আছে।কিন্তু যাই হোকনা কেন আমাকে এর একটা হিল্লে করতেই হবে।এইসব আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতে যখন ঠিক ঘুমে চোখটা একটু লেগে এসছে তখন অন্যের মুখে নিজের নামটা শুনে তড়িঘড়ি উঠে বসলাম।আর ঠিক তখনই পোষ্ট অফিসের বিশাল দেওয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে তিনটে বাজার সঙ্কেত জানালো। সামনে তাকিয়ে দেখি সেই ভদ্রলোক যিনি ভ্যান থেকে নামার পর আমার ব্যাগ দুটিকে টেনে এনে পোষ্ট অফিসের সামনে রেখে অদৃশ্য হয়ে গেছিলেন।আমি জানতে চাইলাম, 
---এত রাতে আপনি কি করে আমার ঘরে এলেন?কেন এলেন?আমি কি নিচের দরজা খুলে রেখেছিলাম?আর যদিবা আমি দরজা খুলেই রাখি তাহলেও তো রমাপদ ঠিক তালা দিয়ে দেয়।আপনি কেমন করে এলেন উপরে? 
---বিজনবাবু, আপনার সাথে আমার একটু কথা ছিলো। 
---হ্যাঁ সেতো বুঝতে পারছি কিন্তু আপনি কি করে উপরে আসলেন দয়া করে যদি আমায় বলেন----বলতে বলতে আমি খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়াই ঘরের লাইটটা জ্বালাবো বলে।কিন্তু ভদ্রলোকের কথা শুনে আবারও ধপ করে খাটের উপর বসে পড়ি।
---আমি তো উপরেই থাকি। 
---উপরে?মানে?উপরে কোন ঘরে?দেখিনি তো কখনো আপনাকে! 
---ওইযে যে ঘরে চিৎকার শুনে আপনি দৌড়ে গেলেন সেই ঘরে। 
---কিন্তু ওটা তো বাইরে থেকেই সব সময় তালাবন্ধ থাকে।আপনি কি আমার সাথে ইয়ার্কি মারছেন? 
---সেই ঘটনাটাই তো আপনাকে জানাতে আসলাম। 
---কেন আমাকে কেন? 
---এই কেনোর উত্তরটাই তো দেবো।বহু বছর ধরে যে আমি ওই ঘরে বন্ধি আর আপনার জন্যই অপেক্ষারত। 
---কে আপনি? আমার জন্যই বা কেন অপেক্ষা করেছেন?আমি আপনার কথার মাথামুন্ড কিছুই বুঝতে পারছিনা। 
---আমাকে বলতে দিন;আপনি তাহলে সব বুঝতে পারবেন।কারন আপনাকেই তো বুঝতে হবে।আপনি না বুঝলে আমার মুক্তি যে কোনদিন হবেনা। 
---মুক্তি?তারমানে আপনি------? 
---হ্যাঁ মুক্তি!আমি বেঁচে নেই।প্রায় দুযুগেরও বেশি বছর আগে আমার মৃত্যু হয়েছে বা বলতে পারেন মরতে বাধ্য হয়েছি। 
 ---কিন্তু কেন? 
---তাহলে শুনুন আমার জীবনের ঘটনা। 

           দুই ছেলে নিয়ে বিধান মজুমদারের সংসার।স্ত্রী ইশানী রূপসী।সেই তুলনায় বিধানবাবু দেখতে খুব একটা ভালো ছিলেননা।নিয়মমাফিক তিনি স্বামীর প্রতি দায়িত্ব পালন করতেন ঠিকই কিন্তু স্বামী সেবা বলতে যা বোঝায় তা তিনি কোনদিনও করেননি।ছিলেন প্রচন্ডভাবে অর্থলোভী।ফুড কর্পোরেশনে উচ্চপদে চাকরি করার সুবাদে মোটা অঙ্কের টাকা হাতে নিয়ে বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথেই স্ত্রী সে টাকা নিয়ে নিজ জিম্মায় রেখে দিতেন।এ নিয়ে বিধানবাবুর কোনদিনও কোন অভিযোগ ছিলোনা।ছেলেরা বড় হোল।বড় ছেলে চাকরি পাওয়ার পর ইশানীদেবী নিজে পছন্দ করে ছেলের বৌ ঘরে আনলেন।বৌমাটি ছিলো তার শ্বাশুড়ীর পুরো বিপরীত।খুব সংসারী ও লক্ষীমন্ত।বড় ছেলের বিয়ের পর কয়েক মাসের মধ্যেই বিধানবাবু রিটায়ার করেন।  
        বিধানবাবুর সংসারে কোনদিনও শান্তি ছিলোনা রিটায়ার করার পর অশান্তি আরও চরমে ওঠে।খেতে, বসতে,শুতে সব সময়ই তার স্ত্রী তাকে কথার খোঁটায় তাকে বুঝিয়ে দেন ওই সংসারে তিনি জঞ্জাল স্বরূপ।কারন তার রোজগারের পরিমাণ অনেকটাই কমে গেছিলো।এই অশান্তি থেকে মুক্তি পেতে তিনি একদিন নিজেই গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেন।বৌমা ছুটে এসে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে।অনেক চেষ্টা করেও সে আগুন নেভাতে পারেনা।বিধানবাবু মারা যান।শ্রাদ্ধের পর তারা বাড়িটি বিক্রি করে অন্যত্র চলে যান।এখন কথা হোল শ্রাদ্ধের পরেও বিধানবাবুর আত্মা মুক্তি পেলোনা কেন?এর কারন হিসাবে তিনি বলেছেন তার মৃত্যুর পর ছেলেরা বাড়িতে অশৌচ পালন করলেও বাইরে বেরিয়ে তারা আমিষ খাবারই খেত।মৃত্যুর পর বাড়ির লোকেরা যে এগারোদিন সেদ্ধ ভাত খায় এটা কোন কুসংস্কার নয়।দেহ ও মনকে প্রবিত্র রাখতে এই কটাদিন কোন প্রাণী হত্যা করা অথ্যাৎ মাছ, মাংস না খাওয়ার যে বিধান শাস্ত্রে রয়েছে তার কারন হিসাবে তিনি বলেছেন ওই এগারোটা দিন আত্মা বাড়ির আশেপাশেই ঘোরাঘুরি করে।শুদ্ধ মনে, শুদ্ধ দেহে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান না করলে আত্মা সর্বভূতে বিলীন হয়না অথাৎ আত্মার মুক্তি সম্ভব হয়না।তাই তারও মুক্তি হয়নি।এই কারনেই  তিনি এই বাড়িটিকে নিয়ে আজও আছেন। এরপর বিধানবাবু যে কথা বলেন তা শুনে আমার পিলে চমকে ওঠে।তিনি বলেন যে তিনি যখন মারা যান তখন তার বৌমাটি ছিলেন সন্তানসম্ভবা।পরবর্তীতে তিনি একটি মৃত পুত্র সন্তান প্রসব করেন।সেই মৃত পুত্র সন্তানটি পরবর্তী জন্মে নাকি আমি!আর বিধানবাবু এত বছর ধরে নাকি আমার জন্যই বসে আছেন।আমি এসে তাকে মুক্তি দেবো।সামনাসামনি ভূতের সাথে কথা বলেও যে ভয় আমি পাইনি এ কথা শুনে বুকটা দুরু দুরু করে কাঁপতে শুরু করলো।আমায় কি করতে হবে জিজ্ঞাসা করাতে তিনি হাতের ইশারায় টেবিলের উপর একটি চাবি দেখিয়ে বললেন যে ওই বন্ধ ঘরের চাবি ওটা;ঘরটি খুলে একটি পূজার ব্যবস্থা করতে আর গীতা পাঠ করতে।পূজার পরে আমি যেন তার আত্মার উদ্দেশ্যে একটি অন্নজল করি তাহলেই নাকি তার আত্মার মুক্তি হবে।চলে যাওয়ার আগে তিনি তার গোত্রটি জানাতে ভুললেননা।
          পরদিন ওই চাবি দিয়ে রমাপদকে সাথে নিয়ে তার সমস্ত বাঁধা-নিষেধকে অগ্রাজ্য করে ঘরে ঢুকে ঘরটি পরিষ্কার করি।রমাপদর অনেক প্রশ্নের উত্তরই আমি দিতে পারিনা বা ইচ্ছা করেই দিইনা।স্থানীয় একজন বয়স্ক ঠাকুর মশাইকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে ঘরটিতে নারায়ন পূজা করি ও বিধানবাবুর কথামত তার নামে একটি অন্নজল দান করি। 
         বলাবাহুল্য ওই পুজোর রাত থেকে কেউ আর কোনদিন কোন চিৎকার ওই ঘর থেকে শুনতে পায়নি। 

 নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী 

No comments:

Post a Comment