সদ্য প্রয়াত স্বামীর উদ্দেশ্যে শেষ চিঠি
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
প্রিয় কেষ্ট,
আমাদের উনত্রিশ বছর বিবাহিত জীবনের তোমার কাছে লেখা এটা আমার জীবনের তৃতীয় ও শেষ চিঠি। প্রথম দু'টি চিঠি লিখেছিলাম সেই নব্বই সালের জুন মাসে। যখন আমাদের বহু আখাংকিত প্রথম সন্তান আমার গর্ভে । মনে আছে তোমার? ডাক্তারবাবু যখন আমাকে বললেন সম্পূর্ণ বেড রেস্ট ;আমি বাপের বাড়ি চলে আসি। তখন তো মুঠোফোনের এত রমরমা ছিলোনা, তাই ঠাকুরপুকুর থেকে সামান্য দূরত্ব বালিগঞ্জেও চিঠি লিখে খবর নিতাম তোমার।
তুমি আমায় ছেড়ে চিরতরে চলে যাওয়ার পর তোমার গুছিয়ে রাখা পুরানো কাগজপত্র ঘাটতে ঘাটতে ওই চিঠি দু'টি পেলাম।কত যত্নে গুছিয়ে রেখেছো! একটি পোষ্টকার্ড আর একটি ইনল্যান্ড লেটারে লেখা। নিজের লেখা চিঠি দু'টি পড়তে নিজেরই বারবার চোখ মুছতে হযেছে। মনেহয় যেন এই তো সেদিনের কথা! কত স্বপ্ন, কত আশা, কত পরিকল্পনা! হঠাৎ করেই সবকিছু কালবৈশাখী ঝড়ে যেন তছনছ হয়ে গেলো!
তোমার মনে আছে গো? একদিন আমরা আমাদের বালিগঞ্জের আমাদের সেই ছোট্ট ঘরটাই বসে টিভিতে পুরনো দিনের একটা হিন্দি সিনেমা দেখছিলাম;সেখানে কেষ্ট মুখার্জী বলে একজন অভিনেতা অভিনয় করছিলেন আর সেদিন থেকেই হয়ে গেলে তুমি আমার কেষ্ট! কেষ্ট মুখার্জীর এক বন্ধু ছিলো সেই ছবিতে;তার নাম ছিলো ভগীরথ। আমার নামকরণ করলে তুমি ভগীরথ। রাস্তাঘাট, লোকজন, ছেলেমেয়ে, জামাই -আমরা সকলের মধ্যেই ওই নামেই পরস্পরকে ডাকতাম এবং খুবই স্বচ্ছন্দ ভাবেই। আজও তোমার সেই ভগীরথ ডাক আমার কানে সব সময়ের জন্যই বাজে। মাঝে মাঝেই যেন শুনতে পাই তুমি আমায় ডাকছো। সত্যিই কি তুমি আমায় ডাক? যা আমার অবচেতন মন শুধু শোনে!সব সময় মনেহয় তুমি আমার সাথেই থাকো , তোমায় দেখতে পাইনা ছুঁতেও পারিনা!কিণ্তু বিশ্বাস করো তোমার উপস্থিতি আমি যেন টের পাই!
এখন প্রচন্ড ঠান্ডা পড়েছে। এখন আর তোমাকে নিয়ে কোন চিন্তা হয়না তোমার ঠান্ডা লাগবে ভেবে। খুব কষ্ট পেতে তো শ্বাসকষ্টে! যখন তখন ইনহেলার, নেবুলাইজার কিনতে আর আমাকে দোকানে ছুটতে হয়না। তোমার শ্বাসকষ্টের কথা মনে পড়লেই শুধু আমার একার নয় গো তোমার ছেলেমেয়ে, জামাই সকলেরই চোখ ছলছল করে ওঠে! এ যে কি কষ্ট তা তোমাকে আমি লিখে বোঝাতে পারবোনা। আজও স্নানের সময় হলেই মনে পরে তুমি রোজ আমার কাছে জানতে চাইতে,"ভগীরথ, আজ স্নান করবো?" আর আমিও সব জান্তার মত গম্ভীরভাবে উত্তর দিতাম, না আজ বড্ড ঠান্ডা পড়েছে আজ আর স্নান করে কাজ নেই বা বলতাম হ্যাঁ আজ স্নান কর।ছোট শিশুর মতো তুমি আমার এই ব্যপারে কথাটা মেনে নিতে। সবকিছুই মনেহয় এই তো কালকের কথা!
আমার জীবনে আমার প্রতি তোমার সব থেকে বড় বিশ্বাসটা রাখতে পারিনি গো!আমায় ক্ষমা কোরো তুমি। তুমি সব সময় তোমার ছেলেমেয়েকে বলতে,"আমার কিছু হলে তোদের মা আমায় ঠিক সুস্থ্য করে বাড়ি নিয়ে আসবে।"কিণ্তু আমি পারিনি গো!কিণ্তু বিশ্বাস করো চেষ্টার কোন ত্রুটি যেমন করিনি, টাকার কথাও ভাবিনি!ষোলো সালের মে মাসে যখন তুমি প্রথমবার অসুস্থ্য হয়েছিলে তখন লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে তিনমাসের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর তোমায় সুস্থ্য করে নিয়ে আসতে পেরেছিলাম! কিণ্তু এবার আমি হেরে গেলাম! এবার যখন সতের সালের ষোলোই আগস্ট তোমায় চেক আপে নিয়ে যেয়ে ভর্তি করে দিতে হোলো তখন ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি তুমি আর ফিরবেনা। নেতা, মন্ত্রী, আমলা ধরে নার্সিংহোম থেকে নিয়ে সরাসরি তোমাকে যখন পিজির সি.সি.ইউ. তে ভর্তি করলাম তখনও তুমি ভেন্টিলেশনে। কিণ্তু পুরো জ্ঞান তোমার ছিলো।ইশারায় তুমি জল খেতে চাইলে তোমাকে তুলো ভিজিয়ে তিনফোটা জল খাওয়ালাম। ভাবিনি গো ওটাই ছিলো আমাদের শেষ দেখা!আমাদের সব চেষ্টা, দৌড়াদৌড়ি ব্যর্থ করে দিয়ে সারাজীবনের জন্য শোক সাগরে ভাসিয়ে সাতাশে আগষ্ট চিরতরে চলে গেলে! এত অল্প আয়ু নিয়ে এসেছিলে কেন? কিসের এত তাড়া ছিলো তোমার?আমাদের ছেলেটা যে খুবই ছোট! আমি একা পারবো তো তোমায় ছাড়া জীবনের এই বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে?তোমার আশীর্বাদের হাত আমাদের মাথায় আছে জানি কিণ্তু তবুও খুব ভয় হয়!মনটা যে একদম ভেঙ্গে গেছে কেষ্ট!তুমি কেন ভাবলেনা তুমি ছাড়া তোমার ভগীরথ কতটা অসহায়!
তুমি কেমন আছ জানতে চাইবোনা;তোমার ওই কষ্ট আজ আর নেই এটাই আজ একমাত্র শান্তনা
আমার।আমার মন বলে তুমি আমার সাথেই থাকো সবসময়!
তোমার খুব শখ ছিলো এবারের বইমেলায় আমার একটি গল্প সংকলন বের হোক। তোমার ইচ্ছাকে মর্যাদা দিতেই আমি আমার লেখা একটি গল্প সংকলন 'মানবী' নামে বের করছি।তুমি খুশি তো?বইটি তোমায় উৎসর্গ করেছি! তোমার ছবির দিকে তাঁকিয়ে মনেমনে আমি কত কথা বলি, তুমি কি শুনতে পাও?কি করে জানবো এর উত্তর আমি?
ছেলেমেয়েকে নিয়ে তুমি একদম ভাববেনা। তোমার মেয়ের বাড়ি তৈরী শেষ হয়ে গেছে। আগামী মাসে গৃহপ্রবেশ। তোমার আদরের ভুতোকে (ছেলে)আমি মানুষের মতো মানুষ করবো।তুমি মোটেই ভাববেনা।তোমার ভগীরথ তোমায় কথা দিচ্ছে। অনেককিছুই লিখতে ইচ্ছা করছে কিণ্তু চোখ দু'টি বারবার ঝাপসা হয়ে যাচেছ।আজ এখানেই রাখি। একটু ধর্য্য ধরে অপেক্ষা কর;দেখা আবার আমাদের হবেই। তখন দু'জনে সামনাসামনি বসে বাকি কথা বলবো সেই আগের মতোই।আমি কিণ্তু সেই আশা নিয়েই তোমার অসমাপ্ত কাজগুলি সম্পর্ণ করে আবার তোমার কাছেই যাবো!কিছুদিন অপেক্ষা করো।
যেখানেই থাকো শান্তিতে থেকো।
ইতি তোমার
ভগীরথ ।