অবুঝ মন ( চতুর্থ ও শেষ অংশ ) নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
--- তুমি সুখেন্দুকে ভালোবেসে সুখী হয়েছিলে কিন্তু বিপাশা ।
---ওটাকে ভালোবাসা বলেনা । ওকে বলে জীবনে কাউকে আঁকড়ে বেঁচে থাকার জন্য এ্যাডজাষ্টমেন্ট । আর একসাথে থাকতে থাকতে মানুষটার প্রতি মমত্ববোধ ,সহনুভূতি ,কর্তব্য ; যেটাকে বাইরে থেকে দেখে অনেকে ভালোবাসা বলে ভুল করে । হ্যাঁ ,এইভাবে থাকতে থাকতে পরস্পরের প্রতি একটা ভালোবাসা তৈরী হয় ! কিন্তু সেটা জীবনের প্রথম ভালোবাসার কাছে তুচ্ছ । প্রকৃত ভালো তো একবারই বাসা যায় তুষার ,সমস্ত মন ,প্রাণ উজাড় করে । যদি পরস্পরের কেউ একের জীবন থেকে অন্যে হারিয়ে গেলেও মনের ভিতর তারজন্য একটা জায়গা থেকেই যায় - যা শূন্য অবস্থায় সারাটাজীবন পরে থাকে , সে একাকিত্বকে সঙ্গ দেয় , চোখের জল ঝরায় ,বুকটাকে মাঝে মাঝে মরুদ্যান করে তোলে ,বারবার ফিরিয়ে নিয়ে যায় তার ফেলে আসা অতীত জীবনে । তুমি আমার ভালোবাসাকে যদি সামনাসামনি প্রত্যাখ্যান করতে তাহলে হয়তো এত কষ্ট আমি পেতামনা ; কিন্তু আমার ভালোবাসা নিয়ে তুমি ছিনিমিনি খেলেছো নিজের মনের মত করে । নিজের মনগড়া ভাবনাকে প্রশ্রয় দিয়েছো ,আমার মনের ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনো দাম দেওয়া তো দূরের কথা - জানতেও চাওনি । জানি আজ এই কথাগুলি বলে কোনো লাভ নেই ,কিন্তু তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি - কারণ কি জানো ? তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার, এখানে আসার পূর্বমুহুর্ত পর্যন্ত কোনো চিড় ধরেনি ।"
তুষার অন্যমনস্কভাবেই উত্তর দেয় ,"আমিও তোতোমায় সেই একই রকম ভালোবাসি । তাইতো তোমার সব খবর আমার জানা । আমি বিশ্বাস করতাম ,মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত হলেও তোমার সাথে আমার দেখা হবে । আর সেই অপেক্ষাতেই আমি ছিলাম । পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরেরদিনই আমি গ্রামে ফিরে যাই । তোমাদের বিয়ের সময় পিসীমা ও সুখেন্দুকে জানিয়ে দেই আমার শরীর খুব খারাপ তাই বিয়েতে উপস্থিত হতে পারবোনা । আস্তে আস্তে সুখেন্দুর সাথে যোগাযোগটাও বন্ধ করি । আর তোমাদের খবর রাখার জন্য পিসীমার সাথে যোগাযোগটা বাড়িয়ে দেই । কলকাতার কলেজ এবং স্কুলগুলিতে চাকরীর আশায় তখন সমানে ইন্টারভিউ দিয়ে চলেছি । আর অন্যদিকে সবকিছু ভুলে থাকার জন্য লেখার পিছনেই বাকি সময় ব্যয় করতে লাগলাম । একবার কলকাতায় ইন্টারভিউ দিতে আসার সময় আমার মানিব্যাগটা পকেটমারী হয়ে যায় । ঘটনাচক্রে ওই পকেটমার রেললাইনে কাটা পরে মারা যায় । সমস্ত আত্মীয়স্বজন,পরিচিত মানুষ ,পাড়াপ্রতিবেশী সকলের কাছে আমি মারা গেলাম । আমার কাছে সেটা শাপে বড় হলো । সেদিন যে ইন্টারভিউটা দিতে গেছিলাম সেই চাকরীটাও আমি পেয়ে গেলাম । এখনো মাসতিনেক চাকরী আছে । পিসীমার কাছ থেকেই খবর পেলাম তোমার আর সুখেন্দুর মেয়ে তৃষার জম্মের । মা ,বাবা মারা যাওয়ার পর গ্রামের বিষয়সম্পত্তি বিক্রি করে পাকাপাকি ভাবে আমার এই 'অপেক্ষা' তৈরী করলাম । পিসীমা মারা যাওয়ার পর আমি ফেসবুক ঘেটে ঘেটে সুখেন্দুর একাউন্ট বের করে সেখান থেকেই তোমাদের যাবতীয় খবরাখবর নিতাম । তৃষার বিয়ের খবরও আমি ওখান থেকেই পাই । এরপর তৃষার সাথে আমার বন্ধুত্ব হয় । আমিই তাকে বলি আমাকে কাকু বলে ডাকতে । তার কাছ থেকেই আমি সুখেন্দুর মৃত্যুর খবর পাই আর এও জানতে পারি কলকাতায় তুমি এখন একই ওই বাড়িতে ..." তুষারের কথা শেষ হওয়ার আগেই বিপাশা হাতে তালি দিয়ে বলে উঠলো ,
---- বাহ্ তুষার বাহ্ ....সত্যি তোমার তুলনা নেই !পুরো রামায়ণ শুনিয়ে গেলে আমায় ! সাতাশ বছর ধরে আমার জীবন থেকে হারিয়ে যেয়ে আমার অগোচরে নিত্য আমার খবর রেখে তুমি আমায় কি প্রমান দিতে চাইছো ? তুমি কত মহান ? নাকি তুমি আমায় কত ভালোবাসো ? ভুল করেছিলাম আমি ,তোমায় আমি চিনতে পারিনি ! আসলে তুমি তোমার মনগড়া জীবনে বাস করো ! তুমি এক মানসিক রোগী !" - বলেই বিপাশা উঠে দাঁড়ায় ।
সকরুণ স্বরে তুষার বিপাশার দিকে তাকিয়ে বলে ,"বিপাশা, কি বললে তুমি ? আমি মানসিক রোগী ? সারাটা জীবন ধরে আমি অপেক্ষা করলাম যারজন্য সে আমায় বলছে আমি মানসিক রোগী !
--- আর কি বলার আছে বলোতো ?
---আচ্ছা বিপাশা ,একটা কথা আমায় বলতো ? তোমায় ভালোবেসে ,তোমায় সুখী দেখতে চেয়ে সারাজীবন ধরে কষ্ট আর যন্ত্রনা ছাড়া আমি কি পেলাম ?
এ কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বিপাশা বাইরের দিকে পা বাড়ায় ।
---চলে যাচ্ছ ? রাত হয়ে গেছে আজ নাইবা গেলে ?
--- তা আর হয়না তুষার । একজন পরপুরুষের বাড়িতে রাত কাটালে লোকে আমায় কি বলবে ? জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় পিছনে ফেলে এসেছি । যে প্রশ্নের উত্তরটা আমার অজানা ছিলো ,যা আমাকে তিলেতিলে দগ্ধ করেছে - এতগুলো বছর বাদে তার সব উত্তর আমার পাওয়া হয়ে গেছে । আজ থেকে আমার আর কোনো কষ্ট নেই । তোমার সাথে আমার আর কোনোদিন দেখা হবেনা । তুমি ভালো থেকো ।
বিপাশা বেরিয়ে গেলো । তুষার হতভম্বের মত তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে মনেমনে বলতে লাগলো ,ভুল বুঝলে বিপাশা ,খুব ভুল বুঝলে ! ওই সময় আমি ছিলাম অসহায় । আমার কিছুই করার ছিলোনা । আমার চাকরী পেতে বেশ কিছুদিন লেগেছে । সুখেন্দু না হোক অন্য কোনো ছেলের সাথে তোমার বাড়ির লোক বিয়ে দিতোই । আমার মত এক বেকার ছেলের চাকরী পাওয়ার আশায় তোমায় বসিয়ে রাখতো না । স্বীকার তুমি না করলেও আমি জানি তুমি খুব সুখী হয়েছিলে । ভালো থেকো তুমিও । এখন থেকে আমায় শুধু ঘেন্নায় কোরো ।
নন্দা 24.10.16 রাত দশটা