Monday, December 13, 2021

জীবনের গতি যে পথে বহে

জীবনের গতি যে পথে বহে
"সোনার খাঁচায় দিনগুলি মোর রইল না 
সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি"-
 শত আক্ষেপেও চলে যাওয়া দিনগুলি আর ফিরে আসে না।মাত্র কটা বছর আগের কথা। শরতের আকাশ,বাতাস, ফুলপাখি সকলেই যখন জানান দিচ্ছে "আমি এসেছি দ্বারে -" ঠিক সেইরূপ একটি দিনে পুজোর ঠিক দিন সাতেক বাকি যখন,ঠিক তখন অনুপ্রিয়াদের বাড়িতে তার দাদার সাথে তার বন্ধু আসে এবারে সে গ্রামের পুজো দেখবে বলে।
 বছর পাঁচেক হল অনুপম আর শঙ্করের বন্ধুত্ব।শঙ্করের বাড়ি উত্তর প্রদেশের কোন একটি গ্রামে।একই সাথে দুজনেই চাকরি করে।থাকে দিল্লির এক কামরার একটি ঘর ভাড়া করে দুই বন্ধু।এবারে শঙ্করের আবদারে অনুপম তাকে সাথে করেই পুজোর সময় দেশের বাড়িতে আসে।
 অনুপ্রিয়া ভীষণ সুন্দরী মেয়ে।পড়াশুনায় ভালো।চপলতা তার চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য।যে কোন ছেলে দেখলেই তার প্রেমে পড়বে।শঙ্করের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয় না।প্রথম দেখাতেই শঙ্কর অনুপ্রিয়ার প্রেমে পড়ে যায়।
 প্রথম কটাদিন অনুপ্রিয়া শঙ্করকে একটু এড়িয়ে যেতে চাইলেও ঠিক এড়িয়ে যেতে পারে না।কি এক অমোঘ আকর্ষণে শঙ্কর যেন চুম্বকের মত তাকে টানতে থাকে।ব্যাপারটা দাদা অনুপমের চোখ এড়ায় না।বোন ও বন্ধুর এই মন দেওয়া-নেওয়া বিষয়টা দূর থেকেই সে বেশ উপভোগ করতে থাকে।আর মনেমনে ভাবে শঙ্করের সাথে অনুর বিয়েটা যদি সত্যিই হয় তাহলে বোনটা তার সুখেই থাকবে।কারণ শঙ্কর খুবই ভালো ছেলে।শান্ত,নম্র,ভদ্র।খুব আস্তে আস্তে কথা বলে।কোনরকম কোন নেশা নেই একমাত্র চা ছাড়া।
 বোনের কাছে কিছু জানতে না খেয়েই শঙ্করকে দেখে বোনের লাজুকতা দেখে সে বুঝতে পেরে যায় তার আদরের বোনটি তার বন্ধুর প্রেমে পড়েছে।আর শঙ্কর তো একাকী কোথাও তার ছোট্ট বোনটিকে দেখতে পেলেই এমনভাবে হা করে তাকিয়ে থাকত যেন সে হা বন্ধ করতেই ভুলে গেছে।
 অনুপম তার বাবা,মাকে আলাদা ডেকে নিয়ে বোনের সাথে শঙ্করের বিয়ের কথা বলেন।শঙ্কর বিহারী ছেলে।আর অনুপমরা কায়স্থ।প্রথম অবস্থায় তারা কিছুতেই রাজি হতে চান না।কিন্তু ছেলের কাছে তারা জানতে পারেন শঙ্কর অনুপ্রিয়াকে ভালবেসে ফেলেছে এ কদিনেই।আর সে যদি খুব ভুল করে না থাকে  অনুপ্রিয়াও তাকে পছন্দ করেছে।ভালো চাকরি করে।বাবা,মায়ের একমাত্র সন্তান।গ্রামের বাড়িতে প্রচুর জমিজমা।বোনটি তার সুখেই থাকবে।সব কথা শুনে তারা নিমরাজি হন।আর এদিকে অনুপম কায়দা করে বাবা,মাকে ষষ্ঠীর দিনে এক আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।নিজেও একফাঁকে বাড়ি থেকে কিছু সময়ের জন্য বেরিয়ে যায়।
 অনুপ্রিয়া আস্তে আস্তে গিয়ে দাদার ঘরে ঢুকে দেখে অনুপম একটা গল্পের বই নিয়ে শুয়ে শুয়ে খুব মনোযোগ সহকারে পড়ছে।
--- কি গল্প পড়ছেন?
 থতমত খেয়ে শঙ্কর উঠে বসতে বসতে বলে,
--- অনুপম বেরোনোর সময় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিণীতা বইটা দিয়ে বলে গেলো এটা পরে দেখ তোর কাজে আসবে।
 --- আগে পড়েননি পরিণীতা?
--- না পড়া হয়ে ওঠেনি আগে।
--- কোন কাজে আসলো ?
--- এখনো পড়া শেষ হয়নি।তবে যেটুকু পড়েছি তাতেই বুঝতে পারছি --- 
 শঙ্কর চুপ করে গেলো দেখে অনুপ্রিয়া জানতে চাইলো
--- কি হল চুপ করে গেলেন যে --
শঙ্কর খুব আস্তে আস্তে বললো,
--- মানুষের জীবনে প্রেম যদি আসে সেক্ষেত্রে খুব দেরি না করে তৎক্ষণাৎ বলে দেওয়া উচিত।
 চকিতে অনুপ্রিয়ার বুকের মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে গেলো।সে চুপ করেই দাঁড়িয়ে রইলো।তখন শঙ্কর সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে বললো,
--- আপনি তো বইটা অনেক আগেই পড়েছেন।বইটা পড়ে আপনার কি উপলব্ধি হয়েছে?আমি তো আমারটা বললাম।এবার আপনার পালা।
 অনুপ্রিয়া মুখটা নীচু করেই থাকে।আর চাতক পাখির মত শঙ্কর তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।এইভাবে কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর অনুপমের গলার আওয়াজে দুজনেই থতমত খেয়ে যায়। অনুপ্রিয়া উঠে পালিয়ে যেতে যায়
--- তুই খুব বোকা শঙ্কর।মেয়েরা সব কথা মুখে বলতে পারে না।ওটা বুঝে নিতে হয়।আমি তো আছি।কোন চিন্তা করিস না।তোকে আমার একমাত্র বোনের বর করেই ছাড়বো।
 অনুপ্রিয়া লজ্জায় লাল হয়ে ঘর থেকে দৌড়ে পালিয়ে যায়।অনুপম হো হো করে হাসতে থাকে।আর শঙ্কর এমনভাবে বসে থাকে যেন ধরা পড়া চোর!
  কথাবার্তা পাকা হয়ে যায়।রোজই ফোনে দুজনের কথা হতে থাকে।শঙ্কর বাবা,মাকে সবকিছু জানানোর জন্য বাড়িতে যায় কটাদিন ছুটি নিয়ে।কিন্তু তারপর ফিরে এসে সে অনুপমকে যে কথা জানায় তাতে অনুপম পুরো স্তব্ধ হয়ে যায়।বোনের স্বপ্ন ভাঙ্গার কথা সে কিভাবে তাকে জানাবে ভাবতে গেলেই তার চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়তে থাকে।
 বাড়িতে পৌঁছে শঙ্কর তার বাবা,মাকে যখন একথা জানায় তারা তাকে বলেন যে গ্রামের একটি মেয়েকে পছন্দ করে তার বাবাকে তারা কথা দিয়েছেন শঙ্করের সাথে বিয়ে দেবেন বলে।শঙ্কর আপত্তি জানায়।বাবা,মায়ের সাথে চলতে থাকে ঝামেলা।তার বাবা তাকে পরিষ্কার জানিয়ে দেন যদি সে এ বিয়ে না করে তাহলে তারা শঙ্করের সাথে কোন সম্পর্ক রাখবেন না।শঙ্কর যেন আর কোনদিন এই বাড়িতে না আসে।আর এখন থেকে সে যেন মনে করে সে পিতৃমাতৃহীন।
 একমাত্র ছেলে হওয়ার কারণে বাবা,মায়ের এই বৃদ্ধ বয়সে এতো বড় আঘাত সে কেমন করে দেবে? প্রশ্নটা সে তার বন্ধু অনুপমের কাছেই রাখলো।
    

No comments:

Post a Comment