Tuesday, December 14, 2021

ঘোরাঘুরি

"এইসব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে" - একাকীত্বের বড় জ্বালা!নিস্তব্ধ,নিঃসঙ্গ জীবনে প্রতিটা মুহূর্তই যেন মৃত্যুর বিভীষিকাময় দূত হয়ে আসে।তখন মানুষ আর নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারেনা,ভুলে যায় স্বপ্ন দেখতে।শুধু মাঝেমধ্যেই বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।একার সাথে একাই যুদ্ধ করে চলে।আর মাঝে মাঝে ভুলের মাসুল হিসাবে বুক ছিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
  শুধুমাত্র একটা ঘটনা অনিন্দ্যর সমস্ত জীবনটা পাল্টে দিলো।স্কুল,কলেজে পড়াকালীন সময়ে শীতকাল এলেই দল বেঁধে পিকনিক যাওয়া ছিলো সকলের কাছেই যেন একটা বাধ্যতামূলক।প্রকৃতির নিয়মে সময়ের সাথে সাথে মানুষের জীবনেও অনেক পরিবর্তন আসে।তখন জীবনে শীতকাল এলেই পিকনিক,যাত্রা আর মায়ের হাতের নানান রকম পিঠাপুলি। এটাতেই ছিল মজা সেই ছেলেবেলার গ্রামীণ জীবনে।স্কুলের পাঠ গ্রামে মিটলেও উচ্চমাধ্যমিকের পরে কলকাতা পিসির বাড়িতে থেকে অনিন্দ্যর পড়াশুনা।তারপর বিরাট মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি।বিয়ে করে বাবা,মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে।বিয়ের আগেই বেহালা ডায়মন্ডবারবার রোডের উপর দু'হাজার স্কয়ার ফিটের সর্ব সুবিধা যুক্ত এক ফ্ল্যাট কিনে নেয়।
  অতি অল্প দিনেইঅর্থ,বৈভব,জীবনযাত্রার আমুল পরিবর্তন অনিন্দ্যর জীবনে।শত ব্যস্ততার মাঝেও প্রতি বছর ঘুরতে যাওয়া তার চাইই চাই।কখনো দিন পনের আবার কখনো বা নিদেনপক্ষে দিন সাতেক।এর মধ্যে আছে বড় বড় অফিস ট্যুর।কলিগদের সাথে পুরো শীতকালটা ধরেই নানান জায়গায় পিকনিক করে বেড়ানো। পুরী,দীঘা,বকখালি,বাঁকুড়া এইরূপ অনেক জায়গায় শনিবার করে যে যার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে আবার সোমবার এসে অফিস করা। হৈহৈ রইরই করে অনিন্দ্য তার জীবনটাকে কাটিয়ে দিতে চায়।
 বিয়ে হয়েছে আজ তিনবছর।এখনো কোন সন্তান নেয়নি তারও কারণ এই শীতের সিজনে ঘুরতে যাওয়া।বাচ্চাকাচ্চা হলেই কয়েক বছরের বিরতি ঘুরতে যাওয়ার।তাই স্ত্রীকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করিয়ে রেখেছে।অন্তত পক্ষে পাঁচটা বছর অপেক্ষাতে রাজি হয়েছে তার স্ত্রী।
 গত দুবছর আগে কালিম্পং থেকে ঘুরে আসার পর আবার এ বছর শীত পড়তে না পড়তেই কালিম্পং যাওয়ার তোড়জোড়।এই নিয়ে কালিম্পং ঘোরা পাঁচবার।একই জায়গায় বারবার ঘুরতে গিয়ে কি যে শান্তি পায় অনিন্দ্য,এটা নিয়ে শুধু স্ত্রী জয়িতাই নয় তার পরিবারের বাকি সদস্যরাও তার কাছে জানতে চেয়ে হাসাহাসি করে।আর অফিস কলিগরা তো শীতের আগমনের শুরু থেকেই তার পিছনে লেগে থাকে।
 কালিম্পং যাওয়ার সবকিছু তৈরি।মাঝে একটা রবিবার।শনিবার রাতে জয়িতাকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন,
--- এই কাল তো রবিবার।বাড়িতে আমি থাকলেই তোমার সারাটাদিন কাজ করতে হয়।তার চেয়ে বরং চলো দুটিতে মিলে খুব ভোরে ডায়মন্ডহারবার কোন গ্রামে ঘুরে আসি।শীতকালে গ্রামের সৌন্দর্য্যই আলাদা। খেজুর গাছ থেকে টপটপ করে রস পড়ছে ঠিলের মধ্যে।ওহ্ তুমি তো আবার ঠিলে বোঝো না।মাটির একটা পাত্র।অনেকটা কলসির মত দেখতে।রাস্তায়,মাঠে-ঘাটে লোকজন আগুন জ্বেলে গরম তাপ নিচ্ছে।কোথাও ধান কাটা হচ্ছে আবার কোথাও বা ধান কেটে মাঠের ভিতর সারি দিয়ে শুইয়ে রেখেছে।সবজির সবুজ মাঠ।দেখলে মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়।
 জয়িতা আর কি বলবে।সে জানে একবার যখন অনিন্দ্য যাবে ঠিক করেছে সে যাবেই।
 খুব ভোরে উঠে দুজনে রেডি হয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখে প্রচণ্ড কুয়াশা।জয়িতা তাকে নিষেধ করে এই কুয়াশার মধ্যে বেরোনোর জন্য।বলে একটু বেলা হলেই বেরোব আমরা।কিন্তু কে শোনে কার কথা!বেরিয়ে পড়ে।
 বেশিদূর আর এগোতে পারে না।জোকার কাছাকাছি এসে একটা বাসের সাথে প্রচণ্ড ধাক্কা খায়।জয়িতার মাথা পুরো থেতলে যায়।জ্ঞান হারায় অনিন্দ্য।বা হাত ভেঙ্গে পুরো চৌচির।ঘটনার অনেক পরে তাদের উদ্ধার করে গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গেলে জয়িতাকে মৃত ঘোষণা করে।পকেট থেকে অক্ষত মোবাইল ফোন বের করে বেশি ডায়াল করা নম্বরে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের লোকেরা ফোন করে এই খবর জানায়।অনিন্দ্যর জ্ঞান আসলেও কথা বলার মত অবস্থায় ছিলনা। হাড় ভাঙ্গা যন্ত্রণায় ছটফট করছে দেখে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে।
 আত্মীয় বন্ধুরা এসে তাকে নিয়ে কলকাতার নামী নার্সিংহোমে মাস খানেক চিকিৎসা করিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যায়।বা হাতটা কনুইয়ের উপর থেকে কাটা পরে।
  সম্পূর্ণভাবে অনিন্দ্য আজ দুটি কাজের লোকের উপর নির্ভরশীল। নির্জন দ্বীপের মত একাকী ঘরে আজ তার ঘোরাঘুরি।

No comments:

Post a Comment