বেলাশেষে
তোমায় যে কথা বলতে এসেছিলাম --- কয়েক যুগ আগে যে কথা বলা উচিত ছিল।কিন্তু তখন বলতে পারিনি।কারণ তখন আমার পায়ের তলার মাটি শক্ত ছিলনা।জানি আজ আর সে কথা বলে কোন লাভ নেই।কিন্তু তবুও আমার জীবনের চরম সত্যতা তোমার জানা দরকার।ভীষণভাবে বিশ্বাস করি পরজন্ম।যদি এ জীবনে মনের কথাটা তোমায় না জানিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাই কিজানি হয়ত পরের জনমেও বলা হয়ে উঠবে না।
স্বরসতী পুজোয় প্রথম শাড়ি পরা অর্পিতার।তখন ক্লাস এইট।হাঁটতে গেলেই হোঁচট খাচ্ছে।কিন্তু এই একটা দিনই বছরে বরাদ্দ মায়ের অনুমতিতে শাড়ি পরার।মায়ের হলুদ রঙ্গের দামী জামদানী শাড়িটা বের করে মা নিজেই বেশ উচুঁ করে পরিয়ে দেন।কিন্তু স্কুলে ঢোকার মুখেই দুক্লাস উচুঁতে পরা অনিরুদ্ধ তাকে দেখে বললো,
--- এত সুন্দর শাড়ীটা এতো উচুঁ করে পরেছিস মনেহচ্ছে কোন পাহাড়িয়া মেয়ে।
কথাটা শুনে অর্পিতা খুব অপমানিত বোধ করে।সে অনিরুদ্ধর দিকে তাকিয়ে বলে,
--- নীচু করে পরলে তো আমি পড়ে যাবো।তুমি বুঝি তাই চাও।
--- আরে তা কেন?পড়তে পড়তেই তো একদিন ভালোভাবে হাঁটতে শিখবি।এত উচুঁ করে কেউ শাড়ি পরে?
কোন কথা না বলে অর্পিতা তার এক বন্ধুকে নিয়ে ফাঁকা একটা ক্লাসরুমে ঢুকে লুটিয়ে শাড়ীটা পরে বেরোয়।কিন্তু এইভাবে শাড়ি পরার ফলে সে কিছুতেই ভালোভাবে হাঁটতে পারছে না।তাই এক হাতে কুচিটা ধরে নিয়ে তাকে হাঁটতে হচ্ছে।অনিরুদ্ধ পুনরায় অর্পিতাকে দেখতে পেয়ে মনেমনে বেশ খুশি হয় যে অর্পিতা তার কথা শুনেছে।এই সামান্য একটি কারণ থেকেই সে বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী অনিরুদ্ধ অর্পিতার প্রতি আস্তে আস্তে দুর্বল হতে শুরু করে।অনেক পরে অর্পিতারও অনিরুদ্ধর প্রতি একটা ভালোলাগা কাজ করতে শুরু করে।
সে বছর মাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্ট করে অনিরুদ্ধ ওই স্কুলেই সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হয়ে যায়।মাঝেমধ্যে দুজনের দেখা হয়।কিন্তু কথা সেভাবে হয়না কখনো।দুজনেই পড়াশুনায় খুব ভালো।অর্পিতা খুব ভালো ছবি আঁকতে পারতো।একদিন অনুরুদ্ধ অর্পিতাকে অনুরোধ করে তার প্রাকটিক্যাল খাতাটা তৈরি করে দেওয়ার জন্য।অর্পিতা সানন্দে রাজি হয়ে যায়।এই খাতা দেওয়া-নেওয়া এবং আঁকা প্রসঙ্গে নানান কথা বলতে বলতে কিছুটা হলেও দুজনে কাছে আসে।কিন্তু কখনোই ভালোলাগা বা ভালোবাসার কথা কেউ কাউকে কোনদিন বলেনি।
উচ্চমাধ্যমিকেও অনিরুদ্ধ আশাতীত ফল করে।জয়েন্ট বসে সরকারিভাবেই ডাক্তারী পড়ার সুযোগ পেয়ে যায়।বহুবার চেষ্টা করেও মাত্র দুটি স্টপেজ গিয়ে অর্পিতাকে জানাতে পারেনি তার ভালোবাসার কথা।অর্পিতা তখন কলেজে।
কলেজে পড়তে পড়তেই অর্পিতার বিয়ে হয়ে যায়।এই সময় বিয়ে করতে সে না চাইলেও বাড়ির লোকের সকলের কাছে তার অব্যক্ত ভালোবাসার কথা জানাতেও পারেনি। অনিরুদ্ধর সাথে যোগাযোগটাও আর সেভাবে তখন ছিলনা।কারণ অনিরুদ্ধ কলেজ ক্যাম্পাসেই থাকতো।যোগাযোগের কোন রাস্তাও ছিলনা আজকের দিনের মত।
কেটে গেছে বেশ কয়েক যুগ।অনিরুদ্ধ অনেক পড়ে জেনেছে অর্পিতার বিয়ের কথা।মনের কষ্ট মনেই চেপে রেখেছে।অকৃতদার জীবনে বাবা,মায়ের মৃত্যুর পর হাসপাতাল,চেম্বার,বাড়ি আর দিনরাত এক করে রোগীকে সুস্থ্য করার আপ্রাণ চেষ্টায় অনিয়মের বেড়াজালে নিজেকে আটকে ফেলে অনিরুদ্ধ।তার ফলও পায় হাতে হাতে।রক্তে শর্করার পরিমাণ এতটাই বেড়ে যায় নিজে ডাক্তার হয়েও কিছুতেই তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনা।কিডনি দুটিই হয়ে পড়ে অকেজো।শুরু হয় ডায়ালিসিস।প্রাকটিস বলতে গেলে পুরোই বন্ধ।জুনিয়রদের সাহায্যার্থে মাঝে মধ্যে তারা এসে নিয়ে যায় বা ফোনেই কথা হয় তাদের সাথে।
জীবনে শেষ সময়ে এসে আর একবার অর্পিতার সাথে দেখা করার প্রবল ইচ্ছাতে তার বাপেরবাড়িতে এসে ঠিকানা নিয়ে এই অসুস্থ্য অবস্থাতেই তার বাড়িতে এসে হাজির হয় অনিরুদ্ধ।
অর্পিতা আজ একা।ছেলে সুইডেনে থাকে।সেখানেই বাড়ি করেছে।মাকে নিয়ে যেতে চাইলেও অর্পিতা যেতে চায়নি।হয়ত জীবনের শেষ বেলায় সেও আর একটিবার অনিরুদ্ধকে দেখতে চেয়েছিলো,বলতে চেয়েছিল কোন প্রত্যাশা না রেখেই কোন কথা।
No comments:
Post a Comment