Monday, December 13, 2021

স্বপ্ন ভাঙ্গার রং

স্বপ্ন ভাঙার রং
     নন্দা মুখার্জী 
"কাকেরা সব ছায়ায় বসে এ'দিক সে'দিক চায়
শুকনা গলায় ডাকছে কা-কা হঠাৎ উড়ে যায়।"
  এমনই এক চৈত্রের দুপুরে গ্রামের ছেলে সজল তার জীবনের স্বপ্ন সফল করতে মায়ের চোখের জল ঝরিয়ে নিজের হাতে তা মুছে দিয়ে ছ'মাসের মধ্যে যেভাবেই হোক সে নিজে এসে মাকে নিয়ে যাবে এই আশ্বাস দিয়ে বেরিয়ে পড়ে অজানা, অচেনা কলকাতা শহরের উদ্দেশ্যে।বাড়ি থেকে স্টেশনের দূরত্ব অনেকটাই।সাধারণত সাইকেল করেই সজলের এদিক ওদিক যাতায়াত।কিন্তু আজ সে সাইকেল নিয়ে স্টেশনে আসলে কে আবার তা বাড়ি নিয়ে যাবে?তাই হেঁটেই সে রওনা দেয় কাঠ-ফাটা রোদে স্টেশনের উদ্দেশ্যে।
  সাধারণভাবে গ্র্যাজুয়েশন করা সজল স্বপ্ন দেখে সে একদিন খুব বড় একজন আর্টিস্ট হবে।খুব ভালো ছবি আঁকে সে।গ্রামের যেখানেই মেলা হয় সে সেখানে বসে তার আঁকা ছবি বিক্রি করে। আঁকার সরঞ্জাম তার সাথেই থাকে তখন।কেউ এসে যদি বলে তার একটা ছবি একে দিতে তৎক্ষণাৎ সে তার ছবি এঁকে দিয়ে আরো কিছু বাড়তি রোজগার করে।
 এইরকমই এক মেলাতে কলকাতা থেকে কিছু লোক এসেছিলেন। সজলের আঁকা দেখে খুব প্রশংসা করে গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্যের উপর আঁকা দুটি ছবিও কিনে নিয়ে গেছিলেন।যাওয়ার সময় একজন সজলকে একটা কার্ড দিয়ে গেছিলেন কলকাতা গিয়ে তার সাথে দেখা করার জন্য।
  সজল কলকাতা পৌঁছে প্রথমেই ভদ্রলোকের সাথে দেখা করলো।ভদ্রলোকও তাকে আশ্বাস দিলেন তার পাশে থাকার জন্য।অযাচিতভাবে কলকাতা শহরে এইরূপ একজন মানুষের সান্নিধ্য পেয়ে সজল তার দেখা স্বপ্নগুলো নিয়ে মনের মাঝে সর্বদা নাড়াচাড়া করতে লাগলো।নতুনভাবে নিজেকে তৈরি করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো।ভদ্রলোক নিজেও ছবি আঁকেন।তিনি তার আর্ট রুমটাকে সজলকে ব্যবহার করতে দিলেন।বাইরের প্রখর গরমের ভিতর থেকে শীততাপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে ঢুকে সজলের সেদিন আনন্দে চোখে জল এসে গেছিলো।অজিত রায়ের বাড়ি বা সংসার অন্যত্র।এখানেও মাঝে মধ্যে এসে থাকেন সে ব্যবস্থাও আছে।তার ছবি আঁকার সবকিছু এখানেই।
 সজল বুঝতে পারে না ভদ্রলোক কেন তাকে এভাবে সাহায্য করছেন।কৃতজ্ঞতায় তার মাথা নুইয়ে আসে সবসময়।সময় মত তিনবেলা খাবার পৌঁছে যায়।সারাটাদিন সজল মন দিয়ে ছবি একে চলে।
  মাঝে একবার গ্রামের বাড়ি গিয়ে মায়ের সাথে দেখা করে এসেছে।একদিনের বেশি মায়ের কাছে থাকেনি।তার সাধনায় ব্যাঘাত হবে মনে ভেবে।এইভাবে বেশ কয়েকটি মাস কেটে যায়। সজলের ছবিগুলি যত্ন সহকারে বাইন্ডিং হয়ে প্রদর্শনীতে চলে যায়।আনন্দে,সুখে কৃতজ্ঞতায় সজলের চোখ থেকে সারারাত জল পড়তে থাকে।পরদিন সজলের আঁকার ছবির একক প্রদর্শনী।সারাটা রাত সজল দু'চোখের পাতা এক করতে পারেনি।
 অজিত রায়ের দেওয়া ঠিকানা সাথে করে একবুক আশা নিয়ে ধীর পায়ে সজল প্রদর্শনী কক্ষে প্রবেশ করতে গিয়ে দেখে পাশেই সেখানকার কোন একটি রুমে তখন লোক গিজগিজ করছে।সাংবাদিক বৈঠক চলছে।মধ্যমনি অজিত রায়।মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বক্তৃতা দিয়ে চলেছেন, "আজ তার স্বপ্ন পূরণের পথে।তিনি তার আঁকা যে ছবি আন্তজার্তিক প্রতিযোগিতায় পাঠিয়েছিলেন সে ছবি প্রথম স্থান অধিকার করেছে।গ্রাম বাংলার একটি চিত্র তিনি অঙ্কন করেছিলেন।এবার তিনি তাদেরই কথামত এই একক প্রদর্শনী করতে সাহস পেয়েছেন।আর এর জন্য তিনি প্রচুর অর্থমূল্য ছাড়াও সোনার মেডেল এবং জাপান ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছেন।
  সজল অজিতদার বক্তৃতা শুনে কিছুই বুঝতে পারছে না।কিন্তু মনের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব নিয়ে ছুটে বেরিয়ে এসে ছবিগুলির সামনে দাঁড়িয়ে দেখে ছবিগুলির যেখানে সে নিজের নামটা লিখেছিলো সেখানে অন্য রং দিয়ে তার নামটা মুছে 'অজিত' লেখা।
  তার মাথাটা ভনভন করে ঘুরতে লাগলো। কাঁচ ভাঙ্গা শব্দের মত সে তার স্বপ্ন ভাঙ্গার শব্দ শুনতে পাচ্ছে তখন।দৌড়ে সেখান থেকে বেরিয়ে কনফারেন্স রুমে ঢুকে চিৎকার চেঁচামেচি করতে শুরু করলে পুলিশ তাকে পাগল বলে গলা ধাক্কা দিয়ে সেখান থেকে বের করে দেয়। মাথা ফেটে তখন রক্ত পড়ছে।রক্ত আর চোখের জল মিলেমিশে গায়ে পরা জামাটি তখন অস্তগামী সূর্যের ন্যায় লাল রঙে রঞ্জিত।

No comments:

Post a Comment