Thursday, December 23, 2021

ঝরাপাতা (দ্বিতীয় পর্ব)


  অনেকগুলি ছেলেমেয়ের মধ্যে অজিতেশবাবুর ছোট মেয়ে এই সুচন্দা। লোকে বলে সে সুন্দরী।পড়াশুনায় প্রতিবছর সে তার অপূর্ব মেধা শক্তির পরিচয় দিয়ে থাকে। সুশোভনবাবুর অন্য ছেলেমেয়েদের তুলনায় সুচন্দা সম্পূর্ণই অন্যরকম।তার সমস্ত জগৎ ঘিরে রয়েছে পড়াশুনা,বইপত্র আর জীবনে ডাক্তার হওয়ার এক সুন্দর স্বপ্ন।
  কো এডে পড়ে,দেখতে সুন্দরী।ছেলেরা তো পিছনে একটু আধটু লাগবেই!কিন্তু সুচন্দার পার্সোনালিটির কাছে কেউই তার সামনে এসে কোন কথা বলতে সাহসই পায়না।সব কথাই হয় তার আড়ালে-আবডালে।তার মুখের দিকে তাকালে সব ছেলেরাই কেমন চুপসে যায়।সুচন্দা তার চারিদিকে যেন একটা লক্ষ্মণরেখার গন্ডি টেনে রেখেছে।সেই গণ্ডি ডিঙ্গিয়ে তার কাছে পৌঁছানোর কোন সাহসই যেন কারও নেই।
 প্রতি ক্লাসে প্রথম হয়ে ওঠার ফলে সকল শিক্ষক,শিক্ষকরাও তাকে খুবই স্নেহ করতেন।সকলের কাছেই সুচন্দা ছিল এক কথায় 'খুব ভালো মেয়ে।' তার বাবা অজিতেশ রায় একজন সূচাকুরে ও সমাজসেবী।আজিতেশবাবুর এই ছোট মেয়েটিকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল।নিজের জীবনের স্বপ্ন,বাবার ইচ্ছাপূরণের স্বপ্ন সবকিছু মিলেমিশে সুচন্দা নিজের মনেই নিজে প্রতিজ্ঞা করেছিলো আগে সে জীবনে ভালোভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াবে তারপর অন্যকিছু।
 সুচন্দার বাবা ছিলেন তার কাছে বন্ধুর মত।সব রকম গল্পই তার সাথে হত।এখনকার মত তখন টিভির এত দৌরত্ব ছিলনা।বিনোদন বলতে রেডিও।শুক্রবার রাত আটটায় আকাশবাণী থেকে একটা নাটক সম্প্রচার হত।সুচন্দা তার বাবার সাথে বসে প্রতি সপ্তাহে এই নাটকটা শুনতো।আর অদ্ভুত ব্যাপার এই নাটক শুনতে শুনতেই সে অঙ্ক প্রাকটিস করতো।তখন বাড়িতে কেউ আসলে অনেকেই তার কাছে জানতে চাইতো
--- রেডিওতে নাটক শুনতে শুনতে তুমি কিভাবে অঙ্ক কষায় মন দাও?
 সুচন্দার তখন ক্লাস ফোর।সে দু'বিনুনী ঝাঁকিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলো,
--- অঙ্কের জন্য তো মনটা দরকার আমি মনটা অঙ্কেই দিচ্ছি আর শোনার জন্য কানটা।ওটা নাটকে দিচ্ছি।
  সেদিন মেয়ের এই উত্তর শুনে আজিতেশবাবু ভীষণ খুশি হয়েছিলেন।এমনই একদিন কোন একটি নাটক শুনতে শুনতে সুচন্দা সেই নাটক নিয়ে তার বাবার সাথে আলোচনাকালে জানতে চেয়েছিল নাটকের নায়িকার জীবন প্রসঙ্গে।
  নাটকটির নায়িকা পড়াশুনায় ভালো থাকার পরেও স্কুলের গণ্ডি পেরোতে না পেরোতেই সে প্রেম করে বিয়ে করার ফলে জীবনে আর সেভাবে কোনদিন দাঁড়াতে পারেনি।এই প্রসঙ্গেই বাবার সাথে আলোচনাকালে তার বাবা তাকে বলেছিলেন,
--- জীবনে নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে কোন ছেলে বা মেয়ে যদি প্রেমে পরে তাহলে তার পড়াশুনার ব্যাঘাত ঘটে।আর বিয়ে করলে তো জীবনের স্বপ্ন অধিকাংশ ক্ষেত্রে সফল হয় না।
  এই কথাটা সুচন্দার মাথার ভিতর ভীষণভাবে সেদিন ঢুকে গেছিলো।সে ওই বয়সে ধরেই নিয়েছিল প্রেমে পড়া মানেই স্বপ্নের পথে বাঁধ দেওয়া।তাই এই ব্যাপারে সে নিজের চারিধারে নিজেই একটি গণ্ডি তৈরি করে রেখে দিয়েছিল।
এরফলে জীবনে সত্যিকারের ভালোবাসার সন্ধান পেয়ে ,নিজে তার প্রতি দূর্বল হওয়ার পরেও নিজের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে চুপিসারে মানুষটির কাছ থেকে সরে এসেছিল।কিন্তু মনের মধ্যে প্রথম প্রেমের বীজটি সে বপন করেই রেখেছিল।
  সুচন্দার তখন ক্লাস নাইন।সামনেই মাধ্যমিক।সুতরাং পড়াশুনার চাপটাও বেশ বেশি।তাদের বাড়ির ঠিক পাশের বাড়ি মঞ্জু সুচন্দার থেকে বয়সে বড় হলেও দুজনের মধ্যে এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।মঞ্জুর দিদির বিয়ে।কিন্তু বিয়েটা হবে গ্রামের বাড়িতে।সুচন্দাকে মঞ্জু সাথে নিয়ে যেতে চায়।কিন্তু যেহেতু দুই রাত থাকতে হবে তাই তার বাবা ছাড়া বাড়ির অন্য লোকদের বেশ আপত্তি।কিন্তু সুচন্দার যাওয়ার ইচ্ছা দেখে তার বাবা মত দিলেন।কারণ তিনি ভালোভাবেই জানতেন এ মেয়ে যেকোন জায়গায় নিজেকে ঠিক রক্ষা করতে পারবে।
 মঞ্জুর এক দাদা ছিল।ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তখন তার সেকেন্ড ইয়ার।আর পাঁচজনের মত সেও সুচন্দার প্রতি দুর্বল ছিল।মঞ্জু তার দাদার কথা মতই সুচন্দাকে তার দিদির বিয়েতে যেনতেন প্রকারে নিয়ে যেতে চেয়েছিল।কিন্তু সুচন্দা এ বিষয়ে কিছুই ঘুণাক্ষরেও জানতো না।
 সে তার বন্ধু মঞ্জু ও তার দাদার সাথে বিয়ের দু'দিন আগেই মঞ্জুদের গ্রামের বাড়িতে গেলো।কিন্তু এখানে এসে মঞ্জুর দাদা নবীনের হাবভাব কথা বলার ধরণে সে পরিস্কার বুঝে গেলো নবীনের তার প্রতি দুর্বলতা রয়েছে। 
  গ্রাম অঞ্চলের বিয়ে বাড়ীতে এই প্রথম সুচন্দার আসা।বরযাত্রীদের মধ্যে সুচন্দাকে নিয়ে বেশ আলোচনা শুরু হয়।তার কারণও হচ্ছে সে যথেষ্ঠ সুন্দরী।তাদের আলোচনার কিছুটা নবীনের কানে যেতেই হঠাৎ সে মাথা গরম করে একটি ছেলেকে ঘুষি মেরে বসে। ব্যস বিয়েবাড়িতে হুলুস্থুল।চিৎকার,চেঁচামেচি।ঘটনার আকস্মিকতায় বাড়ির সকলেই অবাক!কিসের জন্য কি হয়েছে কেউ কিছুই জানে না।সবাই শুধু একটা কথায় শুনছে নবীন বরযাত্রীদের গায়ে হাত তুলেছে।পরিস্থিতি এতটাই ভয়ানক তারা বর উঠিয়ে নিয়েই চলে যায় আর কি!মঞ্জুর বাবা তখন তার ছেলেকে হাত ধরে টানতে টানতে সকলের অলক্ষ্যে নিয়ে গিয়ে জানতে চান,
--- হঠাৎ করে তুই বরযাত্রীদের গায়ে হাত দিতে গেলি কেন?এখন যদি তারা বর উঠিয়ে নিয়ে যায় তোর দিদির কি হবে ভেবে দেখেছিস?
 নবীন মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে থাকে।সে কোন উত্তর দিচ্ছে না দেখে পুনরায় তার বাবা চাপাস্বরে তাকে বলেন,
--- আমি তোকে চিনি আর আমি এও জানি বিনা কারণে তুই ছেলেটির গায়ে হাত তুলিসনি।আমাকে পুরোটা খুলে না বললে বিয়ের আসর থেকে যদি বর তুলে নিয়ে চলে যায় তাহলে বুঝতে পারছিস আরতির জীবনটা শেষ হয়ে যাবে।বাইরে শোরগোল যা শুরু হয়েছে --- থানা পুলিশ হয়ে যাবে বিয়ে বাড়িতে।তোর মা অসুস্থ্য হয়ে পড়েছে।গ্রামে বাস করি একবার যদি আরতী লগ্নভ্রষ্ঠা হয় ওর জীবনটা তছনচ হয়ে যাবে।ভাই হয়ে পারবি সারাজীবন এর দায় সামলাতে?সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই স্বীকার কর কেন তুই একাজ করলি?
নবীন মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে বাবার কথাগুলি শুনছিল।এবার সে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
--- ওরা মেয়েদের নিয়ে কটূক্তি করছিলো।মঞ্জুর বন্ধু সুচন্দার সম্পর্কে নোংরা ভাষা প্রয়োগ করেছিলো।শুনেই মাথাটা গরম হয়ে গেলো।
--- তাই বলে তুমি বরযাত্রীদের গায়ে হাত তুলবে?এটা তুমি খুব অন্যায় করেছো।তোমার উচিত ছিল তাদের বুঝিয়ে বলা।প্রয়োজনে আমরা বড়রা সবাই তো ছিলাম।আলোচনার মাধ্যমে একটা ক্ষমা চাওয়ানো যেত।এখন কি করে যে ব্যাপারটা ম্যানেজ করবো সেটাই ভাবছি।
 কথাগুলো বলে নবীনের বাবা একমুহুর্ত সময় নষ্ট না করে সরাসরি পাত্রের বাবার কাছে গিয়ে ঘটনার বিবৃতি দেন।সব শুনে তিনি ওই ছেলেগুলোকে ডেকে এনে সামনে নবীনকে দাঁড় করিয়ে দুই পক্ষের মীমাংসা করে নির্বিঘ্নে ছেলের বিয়ে দেন।
 কিন্তু যাকে নিয়ে এত কান্ড সেই সুচন্দা কিন্তু তখনো কিছুই জানে না।সে জানতে পারলো বিয়েরদিন ভোর রাতে মঞ্জুর কাছে শুতে গিয়ে।আর তখনই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে আর কিছু ঘটার আগেই  সে সকালে বেরিয়ে পড়বে।বৌভাতে কিছুতেই সে যাবে না।
  কিন্তু সকালে উঠে বাড়ি চলে যাওয়ার কথা বলতেই মঞ্জু আর নবীন কিছুতেই তাকে ছাড়তে চায় না।

ক্রমশঃ 
  

No comments:

Post a Comment