Thursday, December 16, 2021

দুঃখ যেন করিতে পারি জয়

দুঃখ যেন করিতে পারি জয়
"তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই"- গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে রতন চললো মাঠে সদ্য কেটে রাখা পাকা ধানের আল বরাবর রাস্তা দিয়ে।মাঠে কাজ করতে থাকা নিতাই খুড়ো তাকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে বললো,
--- সোনার হরিণের খোঁজ পেয়েছিস তুই?
--- কি যে বলো খুড়ো তার কোন ঠিক নেই।এটা তো একটা গান।
--- ওরে খুড়ো তোর মত লেখাপড়া করিনি বলে কি রবিঠাকুরের লেখা গানটার কথাও জানবো না? 
 খুড়োর মুখে কথাটা শুনে রতন খুব লজ্জা পেয়ে যায়।খুড়োর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
--- এই বয়সে এখনো এত পরিশ্রম কেন করো খুড়ো?
--- পরিশ্রম না করলে বুড়ো বুড়ি খাবো কী? এই শোন আগামী বৃহস্পতিবার নবান্ন উৎসব।প্রতিবারের মত তাড়াতাড়ি করে বোনকে নিয়ে চলে আসিস।তোর খুড়ির তো বয়স হয়েছে একা ঠিক সেই আগের মত আর সামলাতে পারে না।তোর বোনটা গেলে হাতে হাতে অনেক কাজ করে দেয়।একটু তাড়াতাড়ি চলে যাস।
--- যাবো খুড়ো।বোনকে বলবো সকালেই চলে যেতে।
--- সেটাই ভালো হবে রে! তোর খুড়ির কাছে চারটি ডালভাত খেয়ে নেবে।
 নিতাই প্রামাণিক।গ্রামের সহজ,সরল একজন কৃষক।পরপর দুটি সন্তান হয়ে মারা যাবার পর আর কোন সন্তান হয়নি।কিন্তু পুরো গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো প্রত্যেকেই তার সন্তান।যখনই তার কানে পৌঁছেছে কেউ অসুস্থ্য তখনই সে ছুটে তাকে দেখতে চলে আসে।গ্রামে অধিকাংশই দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ বাস করে।নিতাই খুড়োর সামান্য কয়েক বিঘা জমিতে এই তেষট্টি বছর বয়সেও নিজেই সেই আদিকাল হতে লাঙ্গল দিয়েই জমি চাষ করেন।অসুস্থ্য বাচ্চাগুলোকে যখন তাদের বাবা,মা পয়সার অভাবে ডাক্তার দেখাতে পারে না,পেট ভরে খেতে দিতে পারে না তখন এই নিতাই খুড়োই তাদের একমাত্র ভরসা।
 হেমন্তে নূতন ধান উঠার সাথে সাথেই খুড়োর বাড়ির পিঠে,নূতন গুড়ের পায়েস আর নবান্ন উৎসবে পুরো গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের খাইয়েই খুড়ো আর খুড়িমা আত্মতৃপ্তি লাভ করেন।পরপর দুটি সন্তানের মৃত্যুর পর পুরো গ্রামের দরিদ্র এই ছেলেমেয়েগুলোই তাদের সন্তান হয়ে উঠেছে।তাদের মুখে হাসি দেখলেই খুড়ো আর খুড়িমা সন্তান না থাকার কষ্ট ভুলে থাকার চেষ্টাটা কিছুটা হলেও সার্থক হয়।খুড়ো মাঠে ধান চাষ করেন আর খুড়িমা বাড়িতে হাস, মুরগী,গরু পালন করেন।লাউ,কুমড়ো,সীম,ডাটা চাষ করেন।অভাব থাকা সর্তেও কোনদিনও এসব তারা বিক্রি করে দুপয়সা রোজগার করার চেষ্টা কখনোই করেন না।সবই যেন গ্রামের ওইসব দরিদ্র বাচ্চাগুলোর জন্য। খুড়িমা পায়ে ব্যাথা নিয়ে কোমর কাত করে এইসব সবজি,ডিম নিয়ে বাচ্চাগুলোর খাবারের ব্যবস্থা করেন মাঝে মধ্যে। এতেই তারা দুজনেই নিজেদের সন্তান হারানো আর সন্তান না থাকার কষ্ট ভুলে থাকতে পারেন।
 বিচিত্র এই পৃথিবী!তার থেকেও বেশি বিচিত্র মানুষের মন!মানুষ যে কখন, কিসে আর কি করলে তার জীবনে শান্তি পাবে তা বোধকরি সে নিজেও ঠিকভাবে বুঝতে পরে না।জীবন থমকে থাকে না।তাই সে জীবনে সবকিছু হারিয়ে ফেললেও কিছু না কিছুর মধ্যে একটু শান্তি খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করে নিজের বুকের উপর পাথর বেঁধে।
    

No comments:

Post a Comment