বৃষ্টি থামার শেষে
" এ ঘোর দামিনী মেঘের ঘটা কেমনে আইলে বাঁটে
আঙ্গিনার মাঝে বধূয়া ভিজিতে দেখিয়া পরাণ ফাটে।।"
আমি কবি নই।কিন্তু মহাকবি কালিদাস এক ঘন বর্ষার নবীন মেঘ দেখে তাঁর "মেঘদূত" রচনা করেছিলেন।কবিরা বৃষ্টি,মেঘ দেখে প্রকৃতির প্রেমে পড়ে পাতার পর পাতা লিখে চলেন।সৃষ্টি করেন মহাকাব্য।
কিন্তু অনসূয়ার জীবনে বর্ষা আসে বেদনার রঙ্গে রঞ্জিত হয়ে।আকাশ ঘন মেঘে আচ্ছন্ন হলেই অনসূয়া সমস্ত দরজা,জানলা বন্ধ করে দিয়ে জোরে টিভিটা চালিয়ে দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায় যাতে বৃষ্টির শব্দ তার কানে এসে না পৌঁছায়।এই বৃষ্টি তার জীবনে এনেছিল প্রেম আবার এই বৃষ্টি তার জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে সমস্ত আশা,আকাঙ্খা,ভালোবাসা।
সেদিন সকাল থেকেই আকাশের ছিল মুখ ভার। অনসূয়ার বাবা এবং মায়ের নিকট আত্মীয়ের এক নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাওয়ার কথা ছিল।দুপুর হতে না হতেই রাস্তার লাইটগুলো জ্বলে উঠেছিল।চারিদিকে রাতের এক অন্ধকার বিরাজ করছিলো।আশেপাশের সমস্ত বাড়িতেই তখন লাইট জ্বলছে।যেহেতু নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যেতেই হবে তাই আসন্ন দুর্যোগকে উপেক্ষা করেই গাড়ি নিয়ে অনসূয়ার বাবা,মা শতবার মেয়েকে সাবধানে থাকতে বলে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হন।বিকাল থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। এতক্ষণ জানলাগুলো খোলা থাকলেও এবার অনসূয়া উঠে গিয়ে জানলা বন্ধ করতে গিয়ে দেখে কেউ একজন তাদের নিজেদের বাড়ির ভিতরে ঢুকে রাধাকৃষ্ণের মন্দিরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির হাত থেকে মাথা বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।মন্দির লাগোয়া বারান্দায় লাইট জ্বললেও মুখটা ঠিক দেখা যাচ্ছে না।
একদম রাস্তার উপর বাড়ি অনসূয়াদের।রাস্তার উপরেই রাধামাধবের মন্দির।বাড়িটা এল প্যাটানের।তাই মন্দিরের মুখটা রাস্তার দিকে হলেও বারান্দা থেকে দেখা যায়। মুসলধারে এই বৃষ্টির দিনে রাস্তায় কোন মানুষ তো ছাড় গাড়ির সংখ্যাও নগন্য।কিছুক্ষণ পরে আবার এসে দেখে ভদ্রলোক সেই একইভাবে দাঁড়িয়ে।খুব খারাপ লাগছে এভাবে ভদ্রলোক বৃষ্টিতে ভিজছেন দেখে;এদিকে বাড়িতে সে একা।কি করবে কিছুই বুঝতে পড়ছে না।বৃষ্টি থামারও কোন লক্ষন নেই।সাহসে ভর করে বারান্দার গ্রিল খুলে বাড়ির ভিতর থেকে মন্দিরের দরজা খুলে একটা ছাতা হাতে নিয়ে মন্দিরের সামনের গ্রীলের ভিতর থেকে তাকে দিয়ে বললো,
--- আপনি অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন।এই ছাতাটা নিন।পড়ে এসে নাহয় ফেরত দিয়ে যাবেন।
পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের ছেলেটি হাত বাড়িয়ে ছাতাটা নিয়ে বললো,
--- আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেবো বুঝতে পারছিনা।আমার অনেক উপকার করলেন।
সুনীল হাত বাড়িয়ে ছাতাটা নিলো।অনসূয়া পুনরায় মন্দিরের ভিতরের দরজা দিয়ে ঘরে চলে গেল।সেদিন ওই বৃষ্টির মধ্যে অনসূয়ার বাবা মা রাতে ফিরতেই পারেননি।পুরো কলকাতা শহর সেদিন ছিল জলের তলায়।
প্রায় দিন সাতেক বাদে বেল বাজানোর আওয়াজে দরজা খোলেন বাড়ির মালিক অজয় স্যানাল।সুনীল তার হাতে ছাতাটা দিতে দিতে বলে,
--- সেদিন এই ছাতাটা না পেলে ভীষণ মুশকিলে পড়ে যেতাম।
--- কিন্তু এটা কার ছাতা? কোথা থেকে পেলে?আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
--- আমাকে এই বাড়ি থেকেই বৃষ্টির সময় সম্ববত আপনার মেয়ে ছাতাটা দিয়েছিলেন।
--- ও আচ্ছা!দাঁড়াও ওকে ডাকি।
অনসূয়া এসে বাবার কাছে দাঁড়িয়ে বললো,
--- আরে ভিতরে আসুন।একটু চা খেয়ে যান।
তারপর বাবার দিকে ফিরে সেদিনের ঘটনার পুরো বিবরণ দিলো।গল্প করতে করতেই জেনে নিলো সেদিন ছিল চাকরিতে জয়েন করার প্রথম দিন।প্রথম দিন অফিস থেকে ফেরার পথেই এই ঝড় জলের মধ্যে পড়া।এই পরিচয়ের সূত্র ধরেই তারা একসময় ভীষণ কাছাকাছি এসে গেলো।মায়ের একমাত্র সন্তান সুনীল।বাবা অনেক আগেই চিরতরে চলে গেছেন।
ধনী পরিবারের সন্তান হওয়ার পরও তাদের বিয়েতে অনসূয়াদের পরিবার থেকে কোন আপত্তি আসেনি।কারণ সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী তো ওই অনসূয়াই।
অনসূয়া তখন তিনমাসের প্রেগন্যান্ট।মায়ের কাছে এসে আছে।হঠাৎ একদিন প্রবল ঝড় জল।অধিকাংশ দিন সুনীল শ্বশুরবাড়ি থেকেই অফিস করছিলো।সেদিন তাকে সকলে মিলে অফিস যেতে না করে।কিন্তু ব্যাংকের ক্যাশের একটি চাবি তার কাছে থাকার ফলে তাকে অফিসে আসতেই হয়।তখনো বৃষ্টি থামেনি ,অফিস শেষে গাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ির সামনে নেমে যেই বাইরের গ্রীলে হাত দিয়েছে সঙ্গে সঙ্গেই ইলেকট্রিকের শক।ঘরের ভিতরের বাকি মানুষগুলি কিছুই জানতে পারে না।লাইট পোষ্টের একটা তার ছিঁড়ে অনসূয়াদের বাড়ির বাইরের দিকের গ্রীলের উপর পরে।
বাইরের লোকজনের চিৎকার,চেঁচামেচিতে তারা যখন বেরোয় তখন সেখানে অলরেডি সি এস সি থেকে লোক এসে গেছে।মাথা ঘুরে অনসূয়া পরে যায়।বাচ্চাটাকে রাখা যায় না।
পাঁচ বছর অতিক্রান্ত।বাড়ির লোক চেষ্টা করেও তার বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারেনি।শুধু ঝড় জলের দিনে সে সারা ঘরময় পাগলের মত করতে থাকে।
No comments:
Post a Comment