Saturday, December 18, 2021

মায়ের কোল

মায়ের কোল
 খুব ভোরে দাদার কাছ থেকে ফোনটা পেয়ে ডালিয়া কিছুটা সময় কোন কথার উত্তর না দিয়েই চুপ করে বসে ছিল। অপরপ্রান্ত থেকে দাদার 'হ্যালো হ্যালো' আওয়াজে সম্বিত ফিরে পেয়ে কান্না মিশ্রিত গলায় জানতে চাইলো,
--- কখন ঘটলো? তুই আমায় আগে কিছু বলিসনি কেন যে বাবার শরীর খারাপ।
 ডালিয়ার কথা শুনে ওর দাদা একটু চিৎকার করেই বলে উঠলো,
--- আগে আমি জানবো কেমন করে বাবার ঘুমের মধ্যেই স্ট্রোক করবে?
--- ও ঘুমের মধ্যেই চলে গেলেন বাবা? ঠিক আছে আমি এক্ষুনি আসছি।
  পরপর বেশ কয়েকটা ফোন করে কোনরকমে একটা শাড়ি পরেই ডালিয়া রওনা হয়ে গেলো তার বাপেরবাড়ির উদ্দেশ্যে।প্রথমে সে তার স্বামীকে ফোন করলো ।কয়েক মাস হল পরমব্রত হুগলিতে বদলী হয়ে গেছে।স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ায় বেশ বড় পোষ্টে কর্মরত সে।একমাত্র ছেলে এখন ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকে।মেয়ের শ্বশুরবাড়ি গড়িয়াহাট।মাঝে মধ্যে একাই থাকতে হয় কলকাতার বেহালার বিশাল বাড়িতে।এবারের বদলীটা একটু দূরে হওয়াতে আর এই পৌষের শীতে পরমব্রত বাড়ি থেকে আর যাতায়াত করছে না।ওখানেই একটা এক কামরার ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকছে।প্রথম প্রথম কটাদিন ডালিয়া গিয়ে তার কাছে ছিল।কিন্তু নাতির শরীর খারাপ হওয়াতে আবার সেখান থেকে ছুটে চলে এসেছে মেয়ের বাড়িতে।নাতি সুস্থ্য হলে নিজের বাড়িতে ফিরেছে।
 ড্রাইভারকে ফোন করার মিনিট পনের মধ্যেই সে চলে এসেছে।গাড়ির মধ্যে বাবার সাথে কাটানো মুহুর্তগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে বারবার নিজের আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে চলেছে।যখন ক্লাস নাইনে পড়ে ডালিয়া তখন মাকে হারিয়ে বাবা ই ডালিয়া আর ওর থেকে চার বছরের বড় দাদার কাছে বাবা আর মা দুই ই হয়ে উঠেছিলেন।বাবা ছিলেন দুই ভাইবোনের কাছে বন্ধুর মত।
 জ্ঞান হওয়ার পর থেকে জ্ঞানেশবাবুকে কেউ কোনদিনও বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে এক রাতও থাকতে দেখেনি।বাড়ি ভর্তি লোক থাকলেও জ্ঞানেশবাবু কোনদিনও তার নিজের বিছানা ছাড়া অন্য কারো বিছানায় শুতেন না।বাবা,মায়ের ঘরটা ছিল বেশ বড়।সেই ঘরে দুটি খাট পাতা থাকতো।একটি সিঙ্গল আর একটি ডবল বেডের।বাবা রাতে ঘুমানোর জন্য সিঙ্গেল খাটটাই ব্যবহার করতেন।আর বলতেন,
--- এই খাটটাতে না শুলে আমার ঘুমই আসে না।আমার কেন জানি মনেহয় এই খাটে শুয়ে আমি সেই ছেলেবেলার মত মায়ের কাছেই শুয়ে আছি।
  ঠিক বাবা,মায়ের ঘরের মত দাদার ঘরটাও বেশ বড়।বাড়িতে শুধুমাত্র ডালিয়ার ঘরটা অন্য দুটি ঘরের থেকে কিছুটা ছোট।ডালিয়ার বিয়ের পর থেকে ঘরটা ছিল জিনিসপত্রে বোঝায়।এখন অবশ্য দাদার একমাত্র মেয়ের ঘর হয়েছে ওটা।
 বাবার কাজকর্ম মিটে গেলে ডালিয়া সে দিনই বাড়িতে চলে যায়।ঠিক তার পরের দিনই আবার খুব ভোরেই দাদার ফোন।
--- একটা মারত্মক ঘটনা ঘটেছে রে ডলি।
--- কেন কি হয়েছে?সবাই ঠিক আছিস তো?
-- আরে আমরা সবাই ভালো আছি।কিন্তু কাল রাত্রে কি হয়েছে শোন।আমি তো আমার ঘরে আমার খাটে শুয়ে আছি।ঘুমের মধ্যে আমার মনেহল বাবা এসে আমায় ঘুম থেকে ডেকে তুললেন।আমি বিছানায় উঠে বসলাম।বাবা আমার হাত ধরে ধীরে টেনে নিয়ে গেলেন তার ঘরে।তারপর তার খাটে আমায় শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,'এখন থেকে এই খাটটাতেই তুই ঘুমাবি।নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে খাটটা রাখিস।'বলে তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন।বিশ্বাস করবি কিনা জানিনা বাবা যখন তোর বৌদির পাশ থেকে আমায় তুলে হাত ধরে নিয়ে হাঁটছেন আমার তখন কোন জ্ঞানই ছিল না।একটা ঘোরের মধ্যে আমি বাবার সাথে হেঁটে চলেছিলাম।বাবা যে নেই এটাও আমার মাথায় ছিল না।সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখি আমি বাবা মায়ের ঘরে বাবার খাটে ঘুমানো।তোর বৌদি যখন জানতে চাইলো আমি নিজেও মনে করতে পারছিলাম না কাল রাতে কিভাবে আমি এখানে এলাম।ঘরে কিন্তু তালা দেওয়ায় ছিল।
--- কি বলছিস তুই এসব?
--- আর শোন ঐ খাটটায় শুয়ে আমার কেমন যেন মনে হচ্ছিল সেই ছেলেবেলার মত আমি মায়ের কোলের কাছে শুয়ে আছি।বাবাও কিন্তু আমাদের এই কথায় বলতেন।তাই ভাবছি আজই আমি লোক ডেকে বাবার খাটটা আমার ঘরে নিয়ে যাবো।তুই কি বলিস?
--- যেটা তুই ভালো বুঝবি সেটাই করিস।তবে আমার মনেহচ্ছে বহু পুরনো খাট তো। কাঠের মিস্ত্রি ডেকে খাটটাকে একটু মেরামত করে পালিশ করে নিস।ওটা আমাদের বংশের সম্পদ।ওকে যত্নে রাখতে হবে পরবর্তী বংশধরদের জন্য।

No comments:

Post a Comment