Tuesday, December 21, 2021

ঝরাপাতা (প্রথম পর্ব)

ঝরা পাতা (প্রথম পর্ব)
  প্রথম প্রেম, প্রথম ছোঁয়া --- আমৃত্যু মানুষ ভুলতে পারেনা।মনের গভীরে সদাই রয়ে যায়।অতি কাছের জনও কোনদিনও তা জানতে পারে না।
 জীবনে সব প্রেম পূর্ণতা পায়না।কথাশিল্পীর ভাষায় "বড় প্রেম শুধু কাছেই টানেনা, দূরেও ঠেলিয়া দেয়।" হয়ত কাগজের পাতায় কথাটা বড় বেশি মানানসই।কিন্তু বাস্তব জীবনে যে প্রেম দেয় শুধু বেদনা,দূরে ঠেলে দেয় দুটি তরুণ তরুণীকে;সেই প্রেম আমৃত্যু দুটি হৃদয়ে ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে থাকলেও,কেউ তার হদিস না পেলেও সে থাকে দুটি নরনারীর জীবনে খুবই যত্নে এবং  থাকে আমৃত্যু।
  হঠাৎ যদি জীবনে এমন কোন সুযোগ আসে আর দেখা হয়ে যায় পড়ন্ত বিকালের কোন এক মুহূর্তে সেই প্রেমিক,প্রেমিকার তাহলে কিন্তু সেই ভাঙাচোরা হৃদয় দুটি পুনরায় একটু একটু করে নিজেরাই মেরামত হতে থাকে।তখন চলে যায় জীবন থেকে অনেকগুলি বসন্ত,যদি শেষ হয়ে যায় সংসারের প্রতি দায়বদ্ধতা,যদি হয়ে পড়ে কেউ জীবনে সঙ্গী হারা --- আর ঠিক সেই মুহূর্তেই যদি দেখা পাওয়া যায় প্রথম জীবনের সেই প্রেমিকটিকে --- বা প্রেমিকাকে --- ?
  দূরে চলে যাওয়া বা যেতে বাধ্য হওয়া আর পুনরায় দেখা হওয়ার এই যে মাঝের সময়টা সত্যিই যদি কারো সাথে সংসার জীবন কাটাতে হয় ;অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটা হয়ে যায় অভিনয় ক্ষেত্র।কারণ ঘুর্ণয়মান সময় যেহেতু কারও জন্য বসে থাকে না --- তাই জীবনও এগিয়ে চলে যে কোন একটা গতি ধরে।
 বয়স তো একটা সংখ্যা মাত্র।মনটা থাকে ঠিক সেই জন্মের পর থেকে শিশু,কিশোর,যৌবন --- মনের বয়স বার্ধ্যকে কখনোই পৌঁছায় না।সময় বিশেষে মনটা থাকে শিশুর মত সরল,কৈশোরের সেই উচ্ছলতা।আর বয়স যতই বাড়ুক না কেন মানুষের মনের বয়সটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরে থাকে যৌবনের সেই উদ্দমতায়।বোধহীন শিশুকাল,চিন্তাহীন কৈশোর।কিন্তু যৌবন?এই বয়সেই যে মানুষের চিন্তা-ভাবনা,বোধশক্তির শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করতে শুরু করে।
  কৈশোর থেকে মানুষ শুরু করে স্বপ্ন দেখতে যার পূর্ণতা সে পেতে চায় যৌবনে এসে।কিন্তু সব মানুষের কৈশোরে দেখা স্বপ্নগুলি যৌবন বা সারাজীবনেও পূর্ণতা লাভ করতে পারে না।কিন্তু সময় তো বসে থাকে না --- ঘড়ির কাঁটার ঠিকঠিক শব্দের মত মানব জীবনের ইতিহাসও ভিন্নপথে রচিত হতে শুরু করে। শোক-তাপ,দুঃখ-ব্যথা নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকার নাম তো জীবন নয়।দেশ চালনার ক্ষেত্রে যেমন দেশনায়কের প্রয়োজন এবং পরিবর্তন হয় ঠিক তেমনি প্রতিটা মানব জীবন এগিয়ে নেওয়ার তাগিদে হারিয়ে যাওয়া খুব কাছের মানুষটির শূন্যস্থান পূরণের জন্য অন্য কারো প্রয়োজন হয়েই পরে।
 কিন্তু এ কথাও অনস্বীকার্য কৈশোর বা যৌবনে  যদি কারও জীবনে প্রেম আসে আর তা যদি ছাদনাতলা় পর্যন্ত না পৌঁছায় সেই প্রেম বা ভালোবাসা কিংবা ভালোলাগা আমৃত্যু মানুষ তার হৃদয়ের কোন এক কোণে ঘুম পাড়িয়ে রাখে।এই সুপ্ত প্রেম বা ভালোবাসা যাই বলিনা কেন এরা সেই ব্যর্থ হওয়া মানব-মানবীর কাছে এক সময় না একসময় একাকীত্বের সঙ্গী হয়ে ওঠে।চোখ বন্ধ করে কোন কোন নির্জন জায়গায় বা একাকী বাড়িতে তাকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে।
 মানব হৃদয়ে ঘুমিয়ে থাকা সেই প্রথম প্রেম,প্রথম ছোঁয়া কেউ কোনদিনও ভুলতে পারে না।হয়ত কারও কারও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া জীবনে চাওয়ার থেকে পাওয়ার ঝুলিটা অনেক বেশি পরিপূর্ণ থাকে।কিন্তু সেই প্রথম প্রেম,প্রথম ছোঁয়া যা ভাবলে শরীর মন বাহ্যিক বার্ধক্যে পৌঁছেও শরীরকে রোমাঞ্চিত করে।
 মানুষের জীবনের আলাদা আলাদা উপলব্ধি হলেও একথা অতি সহজেই বলা যায় 'আমরা জীবনে যা কিছু হারিয়ে ফেলি তার কদর করি বেশি।'
 কারও কারও জীবনে এমনও হয়
সুখ-শান্তি,অর্থ-বৈভব,স্বামী বা স্ত্রীর ভালোবাসার কোন খামতি না থাকার পরেও ফেলে আসা অতীত কোন এক নির্জনতায় হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে যাবেই সেখানে।
 জীবনে ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উৎরাই বয়সের ভারে মানুষ ভুলে গেলেও প্রথম প্রেম আর প্রথম ছোঁয়া পাথরে খোদায় করে কোন মূর্তি তৈরির মত মানুষের হৃদয়ে খোদিত হয়েই থাকে যতদিন সে স্বজ্ঞানে থাকে।
   সুমিত ও সুচন্দা দুজনেই তাদের ব্যক্তিগত জীবনে যে যার মত করে পরবর্তীতে সুখী হলেও দুজনের মনের কোণে রয়ে গেছে তাদের অব্যক্ত সেই ভালোবাসা।ভার্চুয়াল জগৎ কার জীবনে কতটা ক্ষতি করেছে সুমিত কিংবা সুচন্দার জানা না থাকলেও তারা কিন্তু এই ভার্চুয়াল জগতের প্রতি ভীষণভাবে ঋণী।এই ভার্চুয়াল জগৎ অর্থাৎ এই ফেসবুকই যুগ যুগ ধরে হারিয়ে যাওয়া সেই দুটি হৃদয়কে পড়ন্ত বিকালে আবার কাছে এনেছে।
 প্রভাতে যে মিষ্টি সূর্য্যটা তাদের জীবনে ভালোলাগার পরশ নিয়ে এসেছিল --- হঠাৎ দৈত্যের মত একটি কালো মেঘ এসে তাদের ভালোলাগা,ভালোবাসার সেই অপরূপ সুন্দর মিষ্টি সূর্য্যটাকে ঢেকে দিয়েছিল।সেই অন্ধকার ভেদ করে কিশোর কিশোরী দুটি কেউ কারো নাগাল পায়নি।কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী জীবন কারো থেমে থাকেনি কারণ জীবন ও সময় কালের নিয়মে ঘূর্ণয়মান।
 প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগে মধ্যমগ্রামের ছোট্ট একটি শহরে সুমিত ও সুচন্দা পড়তো ।এই শহরের নামকরা যতগুলি স্কুল ছিল তার মধ্যে সেরা একটি স্কুল ছিল সেটি।স্কুলটি কো এড।প্রতি বছর বহু ছাত্রছাত্রী মাধ্যমিকে বোর্ডে স্ট্যান্ড করে বেরোত এবং আজও বেরোয়।
 এই স্কুলেরই দুটি ছাত্রছাত্রী কৈশোরে নিজেদের চোখের চাহনী আর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে দুজন দুজনকে বুঝিয়ে দিয়েছিল তাদের ভালোলাগার কথা কিন্তু মুখ ফুটে তারা সে কথা একে অপরকে জানাতে পারেনি।
  তখনকার দিনের ছেলেমেয়েরা আজকের দিনের ছেলেমেয়ের মত এতটা অ্যাডভান্স ছিলনা।কোন কোন বাবা মায়ের অঢেল অর্থ থাকার পরেও তারা কখনোই আজকের যুগের মত চাইতে না চাইতেই তাদের সম্মুখে সেই জিনিস হাজির কখনোই করেননি। ছোটবেলা থেকেই তাদের পিতামাতা অভাব আর দারিদ্রের কষ্টটা অনুভব করানোর কারণেই তাদের সচ্ছলতা কখনোই সন্তানদের সম্মুখে আনতেন না কারণ তাহলেই তারা তাদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য বন্ধুর পথও অতিক্রম করতে পিছপা হবে না।
    
    আমার এই নূতন উপন্যাসের শুরুতেই কিছুটা গৌড় চন্দ্রিকা দিলাম।আসলে অভিজ্ঞতা থেকে যেটুকু বুঝেছি প্রথম প্রেম মানব হৃদয়ে ঠিক এইভাবেই সারাজীবন অনেকটা জায়গা জুড়ে থাকে।উপন্যাসটি লিখিত হবে দুটি তরুণ তরুণীর অব্যক্ত হৃদয়ের কথা দিয়ে।হ্যাঁ অব্যক্তই বটে।কারণ আজ থেকে প্রায় চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর আগে দুজন তরুণ তরুণী কেউই মুখ ফুটে কারও ভালোলাগা বা ভালোবাসার কথা পরস্পরকে জানাতে পারেনি।তাই সে প্রেমের পূর্ণতা পাওয়ার কোন কারণও ছিলনা।উপন্যাসটি সম্পূর্ণভাবেই প্রেমের উপাখ্যান।

  ক্রমশঃ

No comments:

Post a Comment