সুচন্দা ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই বাড়ি ফেরার তোড়জোড় করতে লাগলো।সে তার নিজের মনের মধ্যে নিজেই গতকালের ঘটনার ব্যাখ্যা করতে শুরু করেছে ঘটনাটি জানার পর থেকেই।সে ভাবতে থাকে এই ঘটনা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে সে যদি বৌভাতে যায়।কারণ যে ছেলেটি মার খেয়েছে সে সহজে এ অপমান হজম করবে না।এর প্রতিশোধ সে নেবেই।আর সে যদি বৌভাতে ওই বাড়িতে হাজির না থাকে তাহলে ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে যাবে।কিন্তু মঞ্জু এবং তার দাদা নবীন কিছুতেই চায় না সুচন্দা সেদিন ফিরে আসুক।বুদ্ধিমতী সুচন্দা বুঝতে পারে মঞ্জুর বাবা মা ও চান না সে বৌভাতে যাওয়ার জন্য ওখানে থেকে যাক।সুতরাং সুচন্দাকে ফিরতেই হবে।শুনতে পায় চাপাস্বরে মঞ্জু ও তার দাদার সাথে তার বাবার ঝামেলা।তখনো টিফিনের ব্যবস্থা হয়নি।ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে সুচন্দা বারান্দায় এসে
'মঞ্জু'বলে ডাক দেয়।মঞ্জু বেরিয়ে আসে।
--- তুই তাহলে সত্যিই চলে যাচ্ছিস ?
যে ঘটনার জন্য সুচন্দার কোন ভূমিকায় নেই।সেই ঘটনার কারণে মঞ্জুর বাবা,মায়ের এ ধরনের কথাবার্তা সুচন্দার মনে আঘাত হানে।অপমান বোধ করে সে।কোন রকমে নিজেকে সামলে বললো,
--- নারে সামনেই পরীক্ষা তাই যেতেই হচ্ছে।পড়াশুনার খুব ক্ষতি হচ্ছে।
--- সকালের খাবারটা অন্তত খেয়ে যা
--- আরে কালকের খাবারই আমার এখনো হজম হয়নি।এখন কিছুই খেতে পারবো না।চা,বিস্কুট খেয়েছি তো।
কাকু,কাকিমাকে বলে সুচন্দা বেরিয়ে আসলো।তখন নবীনও বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে।সুচন্দা তার দিকে ইচ্ছা করেই আর তাকায়নি।মঞ্জু হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ সুচন্দার সাথে আসে।তারপর সে বাড়ির দিকে ফেরে।বাড়ি ফেরার পথে দেখতে পায় তার দাদা সাইকেল নিয়ে এগোচ্ছে।মঞ্জুকে দেখে বললো,
--- যেটা হল ঠিক হল না।আমার মনেহয় বাবা,মার সমস্ত কথা সুচন্দার কানে গেছে।তুই বাড়ির দিকে যা আমি ওকে বাসে তুলে দিয়ে আসছি।একটা মেয়েকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে এসে বিনা অপরাধেই তাকে দোষী বানিয়ে ছাড়লো আমার বাড়ির লোক।
মঞ্জু কোন কথার উত্তর না দিয়েই বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলো।একটু জোড়ে সাইকেল চালিয়ে এসে সুচন্দাকে দেখতে পেলো নবীন।সুচন্দার একদম সামনে হঠাৎ ব্রেক কষে সাইকেলটাকে দাঁড় করিয়ে দেওয়ায় সুচন্দা চমকে দুপা পিছিয়ে গেলো।কিন্তু নবীনকে দেখেই অপমানে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রুটা আটকাতে ওড়নার সাহায্য নিতেই নবীনের চোখে ধরা পড়ে গেলো।নবীন এগিয়ে এসে বলল,
--- ব্যাগটা আমার কাছে দাও।
--- না আমার কোন অসুবিধা হচ্ছে না।তুমি আবার আসতে গেলে কেন?আমি একাই পারতাম বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে যেতে।
--- হ্যাঁ সে আমি জানি তুমি একাই যেতে পারবে।আর এতটা পথ যাবেও তো একা।কিন্তু আমি এসেছি অন্য কারণে।
--- অন্য কারণে মানে?
--- প্রথম কারণ যেটা হচ্ছে অকারণে তোমাকে নিয়ে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে যার বিন্দুবিসর্গও তুমি জানো না।এরজন্য আমিই দায়ী।আমায় ক্ষমা করে দিও।
--- কি যা তা বলছো নবীনদা।তুমি কেন দায়ী হতে যাবে?একটা মেয়ের অসম্মানের প্রতিবাদ করতে তুমি রুখে দাঁড়িয়েছ।তুমি যা করেছ একদম সঠিক কাজ করেছো।এরজন্য ক্ষমা কেন চাইছো?
--- ক্ষমা চাইছি কেন সেটা তুমি ঠিকই বুঝেছ কিন্তু ধরা দিতে চাইছো না।আমি জানি আসার আগে তুমি বাবা,মায়ের কথাগুলো শুনতে পেয়েছ।আমি তাদের হয়ে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।আর বৌভাত কাটিয়ে যাবে বলেছিলে কিন্তু পরিস্থিতি এমনই হল তার আগেই তুমি চলে যেতে বাধ্য হলে।আমি এটুকু অন্তত বুঝতে পারছি ছেলের বাড়িতে তুমি গেলে গতকালের ঘটনার রেশ ধরে যদি আবার কোন ঝামেলার সৃষ্টি হয় -- এইসব ভেবেই তুমি আজ চলে যাচ্ছ।
সুচন্দা চুপ করেই হাঁটতে থাকে।হঠাৎ নবীন দাঁড়িয়ে পড়ে।একটা কথা বলার ছিল তোমায়।সুচন্দা কোন উত্তর না দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে।গ্রামের মাটির রাস্তা।দু একজন রাস্তায় যাতায়াত করছে তখন।নবীন সাইকেলটা একটা গাছে ঠেস দিয়ে সুচন্দার সামনে এসে দাঁড়ায়।সুচন্দা হাঁটা থামিয়ে নবীনের মুখের দিকে তাকায়।নবীন সরাসরি সুচন্দাকে বলে,
--- আমাদের বাড়ি থেকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত খুব একটা বেশি পথ নয়।আমি জানি তুমি একাই এ পথটা পেরিয়ে বাড়ি পৌঁছে যাবে।কিন্তু আমি আজ এসেছি একটা কথা বলতে ,জীবনের অনেকটা পথ আমাদের হাঁটতে হয়।তুমি কি সেই পথটা আমার সাথে হাঁটতে রাজি আছ?
নবীনের মনের খবর তাদের বাড়িতে এসেই সুচন্দা পেয়ে গেছিলো।কিন্তু এখন সে ব্যাপারটা হালকা ভাবে নিয়ে বললো,
--- এখনো স্কুলের গণ্ডি পেরোইনি।সামনে মাধ্যমিক।আর তা ছাড়া আমাকে নিয়ে আমার বাবার অনেক স্বপ্ন।আমিও স্বপ্ন দেখি জীবনে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর।মানুষের পাশে থেকে তাদের সেবা করবার।আমার বাবা যতদিন বেঁচে আছেন ততদিন আমার হাঁটার পথটা তিনি কণ্টকাকীর্ণ হতে দেবেন না।আর কেউ সেটা করতে চাইলে তিনি মেনেও নেবেন না।তাই এই বয়সে আমি আমার বাবাকে কোন কষ্ট দিতে পারবো না।তুমি আমায় ভুল বুঝো না।সময় যেমন মানুষের কাছ থেকে অনেককিছু কেড়ে নেয় আবার এই সময়ই কিন্তু মানুষকে অনেক কিছু ফিরিয়ে দেয়।তাই এই ভাবনাগুলো আমি এই মুহূর্তে ভাবতে চাই না।
কথা শেষ করেই সুচন্দা দূরে একটা বাস আসতে দেখে বললো,
--- নবীনদা আমার বাস এসে গেছে।আমি আসি।তোমরা খুব মজা করো।তোমাদের সাথে তো আবার দেখা হচ্ছেই।তুমি আমার বন্ধুর দাদা।সেই সূত্র ধরেই তোমায় দাদা বলি।আর তুমি আমার দাদা হয়েই থেকো।
পনের বছরের মেয়েটার মুখে এই ধরনের দার্শনিক কথাবার্তা শুনে নবীনও ঠিক কি উত্তর দেবে বুঝতে পারে না।তবে সুচন্দার এই পরিস্কারভাবে কথাগুলো শুনতে নবীনের খুব একটা খারাপ লাগে না।এই বয়সেই মানুষের জীবনদর্শন সম্পর্কে সুচন্দার যেন একটু বেশিই জ্ঞান।
এর ঠিক দিন সাতেক বাদে মঞ্জুরা তাদের শহরের বাড়িতে ফিরে আসে।সুচন্দা এবং মঞ্জু সেই আগের মতই একে অপরের বাড়িতে যাতায়াত করতে থাকে।কিন্তু মঞ্জুদের গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর নবীনকে সে আর আগের মত দেখতে পায় না।ইচ্ছা করেই মঞ্জুর কাছে সে নবীনের কথা জানতেও চায়নি।মাঝে মধ্যে যে সে নবীনকে দেখে না ঠিক তাও নয়।একদিন খুব ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে সুচন্দা নিজেদের উঠোনে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করছিলো।সেদিন ছিল সোমবার।হঠাৎ দেখে নবীন পিঠে একটা বেশ বড়সড় ব্যাগ নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়েছে।পিছনে মঞ্জু।সে এগিয়ে গিয়ে জানতে চায়,
--- এত সকালে তুমি কোথায় যাচ্ছ ?
--- আমি তো এখন এখানে থাকি না।
--- ওই জন্য তোমায় দেখতে পাইনা।তবে তুমি কোথায় থাকো এখন?
--- কলেজের কাছে একটা বাড়িতে পেয়িংগেস্ট হিসাবে থাকি।শনিবার কলেজ ছুটির পর আসি আবার সোমবার সকালে গিয়ে কলেজ করি।তুমি মন দিয়ে পড়াশুনা করো।খুব ভালো রেজাল্ট করতে হবে কিন্তু।তোমার রেজাল্ট শুনে যেন আমরা গর্বিত হতে পারি।
বাসস্ট্যান্ডে সেদিন দেখা নবীন আর আজকে ভোরে দেখা নবীনের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।সুচন্দা নবীনের আজকের কথাগুলি শুনে অবাক হলেও মনেমনে ভীষন খুশী হয়।
ক্রমশঃ