Saturday, December 25, 2021

ঝরাপাতা (তৃতীয় পর্ব)

ঝরাপাতা (তৃতীয় পর্ব)
  সুচন্দা ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই বাড়ি ফেরার তোড়জোড় করতে লাগলো।সে তার নিজের মনের মধ্যে নিজেই গতকালের ঘটনার ব্যাখ্যা করতে শুরু করেছে ঘটনাটি জানার পর থেকেই।সে ভাবতে থাকে এই ঘটনা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে সে যদি বৌভাতে যায়।কারণ যে ছেলেটি মার খেয়েছে সে সহজে এ অপমান হজম করবে না।এর প্রতিশোধ সে নেবেই।আর সে যদি বৌভাতে ওই বাড়িতে হাজির না থাকে তাহলে ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে যাবে।কিন্তু মঞ্জু এবং তার দাদা নবীন কিছুতেই চায় না সুচন্দা সেদিন ফিরে আসুক।বুদ্ধিমতী সুচন্দা বুঝতে পারে মঞ্জুর বাবা মা ও চান না সে বৌভাতে যাওয়ার জন্য ওখানে থেকে যাক।সুতরাং সুচন্দাকে ফিরতেই হবে।শুনতে পায় চাপাস্বরে মঞ্জু ও তার দাদার সাথে তার বাবার ঝামেলা।তখনো টিফিনের ব্যবস্থা হয়নি।ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে সুচন্দা বারান্দায় এসে 
'মঞ্জু'বলে ডাক দেয়।মঞ্জু বেরিয়ে আসে।
--- তুই তাহলে সত্যিই চলে যাচ্ছিস ?
 যে ঘটনার জন্য সুচন্দার কোন ভূমিকায় নেই।সেই ঘটনার কারণে মঞ্জুর বাবা,মায়ের এ ধরনের কথাবার্তা সুচন্দার মনে আঘাত হানে।অপমান বোধ করে সে।কোন রকমে নিজেকে সামলে বললো,
--- নারে সামনেই পরীক্ষা তাই যেতেই হচ্ছে।পড়াশুনার খুব ক্ষতি হচ্ছে।
--- সকালের খাবারটা অন্তত খেয়ে যা
--- আরে কালকের খাবারই আমার এখনো হজম হয়নি।এখন কিছুই খেতে পারবো না।চা,বিস্কুট খেয়েছি তো।
 কাকু,কাকিমাকে বলে সুচন্দা বেরিয়ে আসলো।তখন নবীনও বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে।সুচন্দা তার দিকে ইচ্ছা করেই আর তাকায়নি।মঞ্জু হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ সুচন্দার সাথে আসে।তারপর সে বাড়ির দিকে ফেরে।বাড়ি ফেরার পথে দেখতে পায় তার দাদা সাইকেল নিয়ে এগোচ্ছে।মঞ্জুকে দেখে বললো,
--- যেটা হল ঠিক হল না।আমার মনেহয় বাবা,মার সমস্ত কথা সুচন্দার কানে গেছে।তুই বাড়ির দিকে যা আমি ওকে বাসে তুলে দিয়ে আসছি।একটা মেয়েকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে এসে বিনা অপরাধেই তাকে দোষী বানিয়ে ছাড়লো আমার বাড়ির লোক।
  মঞ্জু কোন কথার উত্তর না দিয়েই বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলো।একটু জোড়ে সাইকেল চালিয়ে এসে সুচন্দাকে দেখতে পেলো নবীন।সুচন্দার একদম সামনে হঠাৎ ব্রেক কষে সাইকেলটাকে দাঁড় করিয়ে দেওয়ায় সুচন্দা চমকে দুপা পিছিয়ে গেলো।কিন্তু নবীনকে দেখেই অপমানে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রুটা আটকাতে ওড়নার সাহায্য নিতেই নবীনের চোখে ধরা পড়ে গেলো।নবীন এগিয়ে এসে বলল,
--- ব্যাগটা আমার কাছে দাও।
--- না আমার কোন অসুবিধা হচ্ছে না।তুমি আবার আসতে গেলে কেন?আমি একাই পারতাম বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে যেতে।
--- হ্যাঁ সে আমি জানি তুমি একাই যেতে পারবে।আর এতটা পথ যাবেও তো একা।কিন্তু আমি এসেছি অন্য কারণে।
--- অন্য কারণে মানে?
--- প্রথম কারণ যেটা হচ্ছে অকারণে তোমাকে নিয়ে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে যার বিন্দুবিসর্গও তুমি জানো না।এরজন্য আমিই দায়ী।আমায় ক্ষমা করে দিও।
--- কি যা তা বলছো নবীনদা।তুমি কেন দায়ী হতে যাবে?একটা মেয়ের অসম্মানের প্রতিবাদ করতে তুমি রুখে দাঁড়িয়েছ।তুমি যা করেছ একদম সঠিক কাজ করেছো।এরজন্য ক্ষমা কেন চাইছো?
--- ক্ষমা চাইছি কেন সেটা তুমি ঠিকই বুঝেছ কিন্তু ধরা দিতে চাইছো না।আমি জানি আসার আগে তুমি বাবা,মায়ের কথাগুলো শুনতে পেয়েছ।আমি তাদের হয়ে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।আর বৌভাত কাটিয়ে যাবে বলেছিলে কিন্তু পরিস্থিতি এমনই হল তার আগেই তুমি চলে যেতে বাধ্য হলে।আমি এটুকু অন্তত বুঝতে পারছি ছেলের বাড়িতে তুমি গেলে গতকালের ঘটনার রেশ ধরে যদি আবার কোন ঝামেলার সৃষ্টি হয় -- এইসব ভেবেই তুমি আজ চলে যাচ্ছ।
 সুচন্দা চুপ করেই হাঁটতে থাকে।হঠাৎ নবীন দাঁড়িয়ে পড়ে।একটা কথা বলার ছিল তোমায়।সুচন্দা কোন উত্তর না দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে।গ্রামের মাটির রাস্তা।দু একজন রাস্তায় যাতায়াত করছে তখন।নবীন সাইকেলটা একটা গাছে ঠেস দিয়ে সুচন্দার সামনে এসে দাঁড়ায়।সুচন্দা হাঁটা থামিয়ে নবীনের মুখের দিকে তাকায়।নবীন সরাসরি সুচন্দাকে বলে,
--- আমাদের বাড়ি থেকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত খুব একটা বেশি পথ নয়।আমি জানি তুমি একাই এ পথটা পেরিয়ে বাড়ি পৌঁছে যাবে।কিন্তু আমি আজ এসেছি একটা কথা বলতে ,জীবনের অনেকটা পথ আমাদের হাঁটতে হয়।তুমি কি সেই পথটা আমার সাথে হাঁটতে রাজি আছ?
 নবীনের মনের খবর তাদের বাড়িতে এসেই সুচন্দা পেয়ে গেছিলো।কিন্তু এখন সে ব্যাপারটা হালকা ভাবে নিয়ে বললো,
--- এখনো স্কুলের গণ্ডি পেরোইনি।সামনে মাধ্যমিক।আর তা ছাড়া আমাকে নিয়ে আমার বাবার অনেক স্বপ্ন।আমিও স্বপ্ন দেখি জীবনে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর।মানুষের পাশে থেকে তাদের সেবা করবার।আমার বাবা যতদিন বেঁচে আছেন ততদিন আমার হাঁটার পথটা তিনি কণ্টকাকীর্ণ হতে দেবেন না।আর কেউ সেটা করতে চাইলে তিনি মেনেও নেবেন না।তাই এই বয়সে আমি আমার বাবাকে কোন কষ্ট দিতে পারবো না।তুমি আমায় ভুল বুঝো না।সময় যেমন মানুষের কাছ থেকে অনেককিছু কেড়ে নেয় আবার এই সময়ই কিন্তু মানুষকে অনেক কিছু ফিরিয়ে দেয়।তাই এই ভাবনাগুলো আমি এই মুহূর্তে ভাবতে চাই না।
 কথা শেষ করেই সুচন্দা দূরে একটা বাস আসতে দেখে বললো,
--- নবীনদা আমার বাস এসে গেছে।আমি আসি।তোমরা খুব মজা করো।তোমাদের সাথে তো আবার দেখা হচ্ছেই।তুমি আমার বন্ধুর দাদা।সেই সূত্র ধরেই তোমায় দাদা বলি।আর তুমি আমার দাদা হয়েই থেকো।
 পনের বছরের মেয়েটার মুখে এই ধরনের দার্শনিক কথাবার্তা শুনে নবীনও ঠিক কি উত্তর দেবে বুঝতে পারে না।তবে সুচন্দার এই পরিস্কারভাবে কথাগুলো শুনতে নবীনের খুব একটা খারাপ লাগে না।এই বয়সেই মানুষের জীবনদর্শন সম্পর্কে সুচন্দার যেন একটু বেশিই জ্ঞান।
এর ঠিক দিন সাতেক বাদে মঞ্জুরা তাদের শহরের বাড়িতে ফিরে আসে।সুচন্দা এবং মঞ্জু সেই আগের মতই একে অপরের বাড়িতে যাতায়াত করতে থাকে।কিন্তু মঞ্জুদের গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর নবীনকে সে আর আগের মত দেখতে পায় না।ইচ্ছা করেই মঞ্জুর কাছে সে নবীনের কথা জানতেও চায়নি।মাঝে মধ্যে যে সে নবীনকে দেখে না ঠিক তাও নয়।একদিন খুব ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে সুচন্দা নিজেদের উঠোনে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করছিলো।সেদিন ছিল সোমবার।হঠাৎ দেখে নবীন পিঠে একটা বেশ বড়সড় ব্যাগ নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়েছে।পিছনে মঞ্জু।সে এগিয়ে গিয়ে জানতে চায়,
--- এত সকালে তুমি কোথায় যাচ্ছ ?
--- আমি তো এখন এখানে থাকি না।
--- ওই জন্য তোমায় দেখতে পাইনা।তবে তুমি কোথায় থাকো এখন?
--- কলেজের কাছে একটা বাড়িতে পেয়িংগেস্ট হিসাবে থাকি।শনিবার কলেজ ছুটির পর আসি আবার সোমবার সকালে গিয়ে কলেজ করি।তুমি মন দিয়ে পড়াশুনা করো।খুব ভালো রেজাল্ট করতে হবে কিন্তু।তোমার রেজাল্ট শুনে যেন আমরা গর্বিত হতে পারি।
 বাসস্ট্যান্ডে সেদিন দেখা নবীন আর আজকে ভোরে দেখা নবীনের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।সুচন্দা নবীনের আজকের কথাগুলি শুনে অবাক হলেও মনেমনে ভীষন খুশী হয়।

ক্রমশঃ 

Thursday, December 23, 2021

ঝরাপাতা (দ্বিতীয় পর্ব)


  অনেকগুলি ছেলেমেয়ের মধ্যে অজিতেশবাবুর ছোট মেয়ে এই সুচন্দা। লোকে বলে সে সুন্দরী।পড়াশুনায় প্রতিবছর সে তার অপূর্ব মেধা শক্তির পরিচয় দিয়ে থাকে। সুশোভনবাবুর অন্য ছেলেমেয়েদের তুলনায় সুচন্দা সম্পূর্ণই অন্যরকম।তার সমস্ত জগৎ ঘিরে রয়েছে পড়াশুনা,বইপত্র আর জীবনে ডাক্তার হওয়ার এক সুন্দর স্বপ্ন।
  কো এডে পড়ে,দেখতে সুন্দরী।ছেলেরা তো পিছনে একটু আধটু লাগবেই!কিন্তু সুচন্দার পার্সোনালিটির কাছে কেউই তার সামনে এসে কোন কথা বলতে সাহসই পায়না।সব কথাই হয় তার আড়ালে-আবডালে।তার মুখের দিকে তাকালে সব ছেলেরাই কেমন চুপসে যায়।সুচন্দা তার চারিদিকে যেন একটা লক্ষ্মণরেখার গন্ডি টেনে রেখেছে।সেই গণ্ডি ডিঙ্গিয়ে তার কাছে পৌঁছানোর কোন সাহসই যেন কারও নেই।
 প্রতি ক্লাসে প্রথম হয়ে ওঠার ফলে সকল শিক্ষক,শিক্ষকরাও তাকে খুবই স্নেহ করতেন।সকলের কাছেই সুচন্দা ছিল এক কথায় 'খুব ভালো মেয়ে।' তার বাবা অজিতেশ রায় একজন সূচাকুরে ও সমাজসেবী।আজিতেশবাবুর এই ছোট মেয়েটিকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল।নিজের জীবনের স্বপ্ন,বাবার ইচ্ছাপূরণের স্বপ্ন সবকিছু মিলেমিশে সুচন্দা নিজের মনেই নিজে প্রতিজ্ঞা করেছিলো আগে সে জীবনে ভালোভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াবে তারপর অন্যকিছু।
 সুচন্দার বাবা ছিলেন তার কাছে বন্ধুর মত।সব রকম গল্পই তার সাথে হত।এখনকার মত তখন টিভির এত দৌরত্ব ছিলনা।বিনোদন বলতে রেডিও।শুক্রবার রাত আটটায় আকাশবাণী থেকে একটা নাটক সম্প্রচার হত।সুচন্দা তার বাবার সাথে বসে প্রতি সপ্তাহে এই নাটকটা শুনতো।আর অদ্ভুত ব্যাপার এই নাটক শুনতে শুনতেই সে অঙ্ক প্রাকটিস করতো।তখন বাড়িতে কেউ আসলে অনেকেই তার কাছে জানতে চাইতো
--- রেডিওতে নাটক শুনতে শুনতে তুমি কিভাবে অঙ্ক কষায় মন দাও?
 সুচন্দার তখন ক্লাস ফোর।সে দু'বিনুনী ঝাঁকিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলো,
--- অঙ্কের জন্য তো মনটা দরকার আমি মনটা অঙ্কেই দিচ্ছি আর শোনার জন্য কানটা।ওটা নাটকে দিচ্ছি।
  সেদিন মেয়ের এই উত্তর শুনে আজিতেশবাবু ভীষণ খুশি হয়েছিলেন।এমনই একদিন কোন একটি নাটক শুনতে শুনতে সুচন্দা সেই নাটক নিয়ে তার বাবার সাথে আলোচনাকালে জানতে চেয়েছিল নাটকের নায়িকার জীবন প্রসঙ্গে।
  নাটকটির নায়িকা পড়াশুনায় ভালো থাকার পরেও স্কুলের গণ্ডি পেরোতে না পেরোতেই সে প্রেম করে বিয়ে করার ফলে জীবনে আর সেভাবে কোনদিন দাঁড়াতে পারেনি।এই প্রসঙ্গেই বাবার সাথে আলোচনাকালে তার বাবা তাকে বলেছিলেন,
--- জীবনে নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে কোন ছেলে বা মেয়ে যদি প্রেমে পরে তাহলে তার পড়াশুনার ব্যাঘাত ঘটে।আর বিয়ে করলে তো জীবনের স্বপ্ন অধিকাংশ ক্ষেত্রে সফল হয় না।
  এই কথাটা সুচন্দার মাথার ভিতর ভীষণভাবে সেদিন ঢুকে গেছিলো।সে ওই বয়সে ধরেই নিয়েছিল প্রেমে পড়া মানেই স্বপ্নের পথে বাঁধ দেওয়া।তাই এই ব্যাপারে সে নিজের চারিধারে নিজেই একটি গণ্ডি তৈরি করে রেখে দিয়েছিল।
এরফলে জীবনে সত্যিকারের ভালোবাসার সন্ধান পেয়ে ,নিজে তার প্রতি দূর্বল হওয়ার পরেও নিজের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে চুপিসারে মানুষটির কাছ থেকে সরে এসেছিল।কিন্তু মনের মধ্যে প্রথম প্রেমের বীজটি সে বপন করেই রেখেছিল।
  সুচন্দার তখন ক্লাস নাইন।সামনেই মাধ্যমিক।সুতরাং পড়াশুনার চাপটাও বেশ বেশি।তাদের বাড়ির ঠিক পাশের বাড়ি মঞ্জু সুচন্দার থেকে বয়সে বড় হলেও দুজনের মধ্যে এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।মঞ্জুর দিদির বিয়ে।কিন্তু বিয়েটা হবে গ্রামের বাড়িতে।সুচন্দাকে মঞ্জু সাথে নিয়ে যেতে চায়।কিন্তু যেহেতু দুই রাত থাকতে হবে তাই তার বাবা ছাড়া বাড়ির অন্য লোকদের বেশ আপত্তি।কিন্তু সুচন্দার যাওয়ার ইচ্ছা দেখে তার বাবা মত দিলেন।কারণ তিনি ভালোভাবেই জানতেন এ মেয়ে যেকোন জায়গায় নিজেকে ঠিক রক্ষা করতে পারবে।
 মঞ্জুর এক দাদা ছিল।ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তখন তার সেকেন্ড ইয়ার।আর পাঁচজনের মত সেও সুচন্দার প্রতি দুর্বল ছিল।মঞ্জু তার দাদার কথা মতই সুচন্দাকে তার দিদির বিয়েতে যেনতেন প্রকারে নিয়ে যেতে চেয়েছিল।কিন্তু সুচন্দা এ বিষয়ে কিছুই ঘুণাক্ষরেও জানতো না।
 সে তার বন্ধু মঞ্জু ও তার দাদার সাথে বিয়ের দু'দিন আগেই মঞ্জুদের গ্রামের বাড়িতে গেলো।কিন্তু এখানে এসে মঞ্জুর দাদা নবীনের হাবভাব কথা বলার ধরণে সে পরিস্কার বুঝে গেলো নবীনের তার প্রতি দুর্বলতা রয়েছে। 
  গ্রাম অঞ্চলের বিয়ে বাড়ীতে এই প্রথম সুচন্দার আসা।বরযাত্রীদের মধ্যে সুচন্দাকে নিয়ে বেশ আলোচনা শুরু হয়।তার কারণও হচ্ছে সে যথেষ্ঠ সুন্দরী।তাদের আলোচনার কিছুটা নবীনের কানে যেতেই হঠাৎ সে মাথা গরম করে একটি ছেলেকে ঘুষি মেরে বসে। ব্যস বিয়েবাড়িতে হুলুস্থুল।চিৎকার,চেঁচামেচি।ঘটনার আকস্মিকতায় বাড়ির সকলেই অবাক!কিসের জন্য কি হয়েছে কেউ কিছুই জানে না।সবাই শুধু একটা কথায় শুনছে নবীন বরযাত্রীদের গায়ে হাত তুলেছে।পরিস্থিতি এতটাই ভয়ানক তারা বর উঠিয়ে নিয়েই চলে যায় আর কি!মঞ্জুর বাবা তখন তার ছেলেকে হাত ধরে টানতে টানতে সকলের অলক্ষ্যে নিয়ে গিয়ে জানতে চান,
--- হঠাৎ করে তুই বরযাত্রীদের গায়ে হাত দিতে গেলি কেন?এখন যদি তারা বর উঠিয়ে নিয়ে যায় তোর দিদির কি হবে ভেবে দেখেছিস?
 নবীন মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে থাকে।সে কোন উত্তর দিচ্ছে না দেখে পুনরায় তার বাবা চাপাস্বরে তাকে বলেন,
--- আমি তোকে চিনি আর আমি এও জানি বিনা কারণে তুই ছেলেটির গায়ে হাত তুলিসনি।আমাকে পুরোটা খুলে না বললে বিয়ের আসর থেকে যদি বর তুলে নিয়ে চলে যায় তাহলে বুঝতে পারছিস আরতির জীবনটা শেষ হয়ে যাবে।বাইরে শোরগোল যা শুরু হয়েছে --- থানা পুলিশ হয়ে যাবে বিয়ে বাড়িতে।তোর মা অসুস্থ্য হয়ে পড়েছে।গ্রামে বাস করি একবার যদি আরতী লগ্নভ্রষ্ঠা হয় ওর জীবনটা তছনচ হয়ে যাবে।ভাই হয়ে পারবি সারাজীবন এর দায় সামলাতে?সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই স্বীকার কর কেন তুই একাজ করলি?
নবীন মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে বাবার কথাগুলি শুনছিল।এবার সে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
--- ওরা মেয়েদের নিয়ে কটূক্তি করছিলো।মঞ্জুর বন্ধু সুচন্দার সম্পর্কে নোংরা ভাষা প্রয়োগ করেছিলো।শুনেই মাথাটা গরম হয়ে গেলো।
--- তাই বলে তুমি বরযাত্রীদের গায়ে হাত তুলবে?এটা তুমি খুব অন্যায় করেছো।তোমার উচিত ছিল তাদের বুঝিয়ে বলা।প্রয়োজনে আমরা বড়রা সবাই তো ছিলাম।আলোচনার মাধ্যমে একটা ক্ষমা চাওয়ানো যেত।এখন কি করে যে ব্যাপারটা ম্যানেজ করবো সেটাই ভাবছি।
 কথাগুলো বলে নবীনের বাবা একমুহুর্ত সময় নষ্ট না করে সরাসরি পাত্রের বাবার কাছে গিয়ে ঘটনার বিবৃতি দেন।সব শুনে তিনি ওই ছেলেগুলোকে ডেকে এনে সামনে নবীনকে দাঁড় করিয়ে দুই পক্ষের মীমাংসা করে নির্বিঘ্নে ছেলের বিয়ে দেন।
 কিন্তু যাকে নিয়ে এত কান্ড সেই সুচন্দা কিন্তু তখনো কিছুই জানে না।সে জানতে পারলো বিয়েরদিন ভোর রাতে মঞ্জুর কাছে শুতে গিয়ে।আর তখনই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে আর কিছু ঘটার আগেই  সে সকালে বেরিয়ে পড়বে।বৌভাতে কিছুতেই সে যাবে না।
  কিন্তু সকালে উঠে বাড়ি চলে যাওয়ার কথা বলতেই মঞ্জু আর নবীন কিছুতেই তাকে ছাড়তে চায় না।

ক্রমশঃ 
  

Tuesday, December 21, 2021

ঝরাপাতা (প্রথম পর্ব)

ঝরা পাতা (প্রথম পর্ব)
  প্রথম প্রেম, প্রথম ছোঁয়া --- আমৃত্যু মানুষ ভুলতে পারেনা।মনের গভীরে সদাই রয়ে যায়।অতি কাছের জনও কোনদিনও তা জানতে পারে না।
 জীবনে সব প্রেম পূর্ণতা পায়না।কথাশিল্পীর ভাষায় "বড় প্রেম শুধু কাছেই টানেনা, দূরেও ঠেলিয়া দেয়।" হয়ত কাগজের পাতায় কথাটা বড় বেশি মানানসই।কিন্তু বাস্তব জীবনে যে প্রেম দেয় শুধু বেদনা,দূরে ঠেলে দেয় দুটি তরুণ তরুণীকে;সেই প্রেম আমৃত্যু দুটি হৃদয়ে ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে থাকলেও,কেউ তার হদিস না পেলেও সে থাকে দুটি নরনারীর জীবনে খুবই যত্নে এবং  থাকে আমৃত্যু।
  হঠাৎ যদি জীবনে এমন কোন সুযোগ আসে আর দেখা হয়ে যায় পড়ন্ত বিকালের কোন এক মুহূর্তে সেই প্রেমিক,প্রেমিকার তাহলে কিন্তু সেই ভাঙাচোরা হৃদয় দুটি পুনরায় একটু একটু করে নিজেরাই মেরামত হতে থাকে।তখন চলে যায় জীবন থেকে অনেকগুলি বসন্ত,যদি শেষ হয়ে যায় সংসারের প্রতি দায়বদ্ধতা,যদি হয়ে পড়ে কেউ জীবনে সঙ্গী হারা --- আর ঠিক সেই মুহূর্তেই যদি দেখা পাওয়া যায় প্রথম জীবনের সেই প্রেমিকটিকে --- বা প্রেমিকাকে --- ?
  দূরে চলে যাওয়া বা যেতে বাধ্য হওয়া আর পুনরায় দেখা হওয়ার এই যে মাঝের সময়টা সত্যিই যদি কারো সাথে সংসার জীবন কাটাতে হয় ;অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটা হয়ে যায় অভিনয় ক্ষেত্র।কারণ ঘুর্ণয়মান সময় যেহেতু কারও জন্য বসে থাকে না --- তাই জীবনও এগিয়ে চলে যে কোন একটা গতি ধরে।
 বয়স তো একটা সংখ্যা মাত্র।মনটা থাকে ঠিক সেই জন্মের পর থেকে শিশু,কিশোর,যৌবন --- মনের বয়স বার্ধ্যকে কখনোই পৌঁছায় না।সময় বিশেষে মনটা থাকে শিশুর মত সরল,কৈশোরের সেই উচ্ছলতা।আর বয়স যতই বাড়ুক না কেন মানুষের মনের বয়সটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরে থাকে যৌবনের সেই উদ্দমতায়।বোধহীন শিশুকাল,চিন্তাহীন কৈশোর।কিন্তু যৌবন?এই বয়সেই যে মানুষের চিন্তা-ভাবনা,বোধশক্তির শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করতে শুরু করে।
  কৈশোর থেকে মানুষ শুরু করে স্বপ্ন দেখতে যার পূর্ণতা সে পেতে চায় যৌবনে এসে।কিন্তু সব মানুষের কৈশোরে দেখা স্বপ্নগুলি যৌবন বা সারাজীবনেও পূর্ণতা লাভ করতে পারে না।কিন্তু সময় তো বসে থাকে না --- ঘড়ির কাঁটার ঠিকঠিক শব্দের মত মানব জীবনের ইতিহাসও ভিন্নপথে রচিত হতে শুরু করে। শোক-তাপ,দুঃখ-ব্যথা নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকার নাম তো জীবন নয়।দেশ চালনার ক্ষেত্রে যেমন দেশনায়কের প্রয়োজন এবং পরিবর্তন হয় ঠিক তেমনি প্রতিটা মানব জীবন এগিয়ে নেওয়ার তাগিদে হারিয়ে যাওয়া খুব কাছের মানুষটির শূন্যস্থান পূরণের জন্য অন্য কারো প্রয়োজন হয়েই পরে।
 কিন্তু এ কথাও অনস্বীকার্য কৈশোর বা যৌবনে  যদি কারও জীবনে প্রেম আসে আর তা যদি ছাদনাতলা় পর্যন্ত না পৌঁছায় সেই প্রেম বা ভালোবাসা কিংবা ভালোলাগা আমৃত্যু মানুষ তার হৃদয়ের কোন এক কোণে ঘুম পাড়িয়ে রাখে।এই সুপ্ত প্রেম বা ভালোবাসা যাই বলিনা কেন এরা সেই ব্যর্থ হওয়া মানব-মানবীর কাছে এক সময় না একসময় একাকীত্বের সঙ্গী হয়ে ওঠে।চোখ বন্ধ করে কোন কোন নির্জন জায়গায় বা একাকী বাড়িতে তাকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে।
 মানব হৃদয়ে ঘুমিয়ে থাকা সেই প্রথম প্রেম,প্রথম ছোঁয়া কেউ কোনদিনও ভুলতে পারে না।হয়ত কারও কারও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া জীবনে চাওয়ার থেকে পাওয়ার ঝুলিটা অনেক বেশি পরিপূর্ণ থাকে।কিন্তু সেই প্রথম প্রেম,প্রথম ছোঁয়া যা ভাবলে শরীর মন বাহ্যিক বার্ধক্যে পৌঁছেও শরীরকে রোমাঞ্চিত করে।
 মানুষের জীবনের আলাদা আলাদা উপলব্ধি হলেও একথা অতি সহজেই বলা যায় 'আমরা জীবনে যা কিছু হারিয়ে ফেলি তার কদর করি বেশি।'
 কারও কারও জীবনে এমনও হয়
সুখ-শান্তি,অর্থ-বৈভব,স্বামী বা স্ত্রীর ভালোবাসার কোন খামতি না থাকার পরেও ফেলে আসা অতীত কোন এক নির্জনতায় হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে যাবেই সেখানে।
 জীবনে ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উৎরাই বয়সের ভারে মানুষ ভুলে গেলেও প্রথম প্রেম আর প্রথম ছোঁয়া পাথরে খোদায় করে কোন মূর্তি তৈরির মত মানুষের হৃদয়ে খোদিত হয়েই থাকে যতদিন সে স্বজ্ঞানে থাকে।
   সুমিত ও সুচন্দা দুজনেই তাদের ব্যক্তিগত জীবনে যে যার মত করে পরবর্তীতে সুখী হলেও দুজনের মনের কোণে রয়ে গেছে তাদের অব্যক্ত সেই ভালোবাসা।ভার্চুয়াল জগৎ কার জীবনে কতটা ক্ষতি করেছে সুমিত কিংবা সুচন্দার জানা না থাকলেও তারা কিন্তু এই ভার্চুয়াল জগতের প্রতি ভীষণভাবে ঋণী।এই ভার্চুয়াল জগৎ অর্থাৎ এই ফেসবুকই যুগ যুগ ধরে হারিয়ে যাওয়া সেই দুটি হৃদয়কে পড়ন্ত বিকালে আবার কাছে এনেছে।
 প্রভাতে যে মিষ্টি সূর্য্যটা তাদের জীবনে ভালোলাগার পরশ নিয়ে এসেছিল --- হঠাৎ দৈত্যের মত একটি কালো মেঘ এসে তাদের ভালোলাগা,ভালোবাসার সেই অপরূপ সুন্দর মিষ্টি সূর্য্যটাকে ঢেকে দিয়েছিল।সেই অন্ধকার ভেদ করে কিশোর কিশোরী দুটি কেউ কারো নাগাল পায়নি।কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী জীবন কারো থেমে থাকেনি কারণ জীবন ও সময় কালের নিয়মে ঘূর্ণয়মান।
 প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগে মধ্যমগ্রামের ছোট্ট একটি শহরে সুমিত ও সুচন্দা পড়তো ।এই শহরের নামকরা যতগুলি স্কুল ছিল তার মধ্যে সেরা একটি স্কুল ছিল সেটি।স্কুলটি কো এড।প্রতি বছর বহু ছাত্রছাত্রী মাধ্যমিকে বোর্ডে স্ট্যান্ড করে বেরোত এবং আজও বেরোয়।
 এই স্কুলেরই দুটি ছাত্রছাত্রী কৈশোরে নিজেদের চোখের চাহনী আর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে দুজন দুজনকে বুঝিয়ে দিয়েছিল তাদের ভালোলাগার কথা কিন্তু মুখ ফুটে তারা সে কথা একে অপরকে জানাতে পারেনি।
  তখনকার দিনের ছেলেমেয়েরা আজকের দিনের ছেলেমেয়ের মত এতটা অ্যাডভান্স ছিলনা।কোন কোন বাবা মায়ের অঢেল অর্থ থাকার পরেও তারা কখনোই আজকের যুগের মত চাইতে না চাইতেই তাদের সম্মুখে সেই জিনিস হাজির কখনোই করেননি। ছোটবেলা থেকেই তাদের পিতামাতা অভাব আর দারিদ্রের কষ্টটা অনুভব করানোর কারণেই তাদের সচ্ছলতা কখনোই সন্তানদের সম্মুখে আনতেন না কারণ তাহলেই তারা তাদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য বন্ধুর পথও অতিক্রম করতে পিছপা হবে না।
    
    আমার এই নূতন উপন্যাসের শুরুতেই কিছুটা গৌড় চন্দ্রিকা দিলাম।আসলে অভিজ্ঞতা থেকে যেটুকু বুঝেছি প্রথম প্রেম মানব হৃদয়ে ঠিক এইভাবেই সারাজীবন অনেকটা জায়গা জুড়ে থাকে।উপন্যাসটি লিখিত হবে দুটি তরুণ তরুণীর অব্যক্ত হৃদয়ের কথা দিয়ে।হ্যাঁ অব্যক্তই বটে।কারণ আজ থেকে প্রায় চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর আগে দুজন তরুণ তরুণী কেউই মুখ ফুটে কারও ভালোলাগা বা ভালোবাসার কথা পরস্পরকে জানাতে পারেনি।তাই সে প্রেমের পূর্ণতা পাওয়ার কোন কারণও ছিলনা।উপন্যাসটি সম্পূর্ণভাবেই প্রেমের উপাখ্যান।

  ক্রমশঃ

আয়নার ভিতর ভবিষ্যত

আয়নার ভিতর ভবিষ্যৎ
  নূতন বউ হয়ে নলিনী যেদিন এ বাড়িতে ঢুকেছিলো সেদিন বরণের পর ওর শ্বাশুড়ী শোভাদেবী ওকে নিয়ে নিজের বিশাল বড় বেডরুমটাই ঢুকে কারুকার্যে শোভিত একটি বেশ বড় ড্রেসিং টেবিল দেখিয়ে বলেছিলেন,
--- আজ থেকে প্রায় দুশ বছর আগে এই বংশের কোন এক বধূ তার বাবার দেওয়া এই ড্রেসিং টেবিলটা নিয়ে এসেছিলেন।এটার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে।সব তোমায় পরে বলবো।একটা কথা শুধু আজ জানিয়ে রাখি রোজ একবার করে হলেও এই বাড়িতে যখন থাকবে এই আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে কপালে এবং মাথায় সিঁদুর ছোঁয়াবে।কেন কিসের জন্য সব আস্তে আস্তে জানতে পারবে। হ্যাঁ আর একটা কথা এর কাঁচটাকে সব সময় একটা কাপড়ের টুকরো দিয়ে ঢেকে রাখবে।
  বৌভাতের ঠিক পরের দিন লোক দিয়ে ওই ড্রেসিং টেবিলটাকে বাড়ির বিশাল করিডোরের একপ্রান্তে রাখা হয়।যাতে শ্বাশুড়ী বউ তাদের নিজেদের ইচ্ছামত যখন তখন এর সামনে দাঁড়িয়ে সিঁদুর পড়তে পারে।শ্বশুর মশাই ঘরে থাকলে ছেলে বউয়ের যখন তখন ঘরে ঢুকতে অসুবিধা হবে ভেবেই শোভাদেবীর ইচ্ছাতেই এখানে ড্রেসিংটেবিলটা এনে রাখা।
  আজ থেকে প্রায় দুশ বছর আগে এই জমিদার বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলেন অভয়া নামের একজন গরীব তরুণী।তার বাবা তাকে বিয়েতে কিছুই দিতে পেরেছিলেন না।জমিদার পুত্র শিকারে বেরিয়ে তার রূপে মুগ্ধ হয়ে বাড়িতে ফিরে বাবা,মাকে জানায় সে ওই মেয়েটিকে বিয়ে করতে চায়।তখন যুবরাজের বয়স বিয়াল্লিশ বৎসর।এতদিন ধরে সে বিবাহ করবে না বলেই স্থির করে রেখেছিল।কিন্তু হঠাৎ ঠিক সন্ধ্যার  আগে বাড়ি ফেরার পথে অভয়াকে দেখে সে তার প্রেমে পড়ে যায়।
 যে ছেলে বিয়ে করবে না বলে ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা করে বসেছিল সেই ছেলের মুখে বিয়ের কথা শুনে জমিদার ও তার গিন্নী এক মুহুর্ত সময় আর নষ্ট করেননি।মেয়েটির পরিবার থেকে বিয়েতে তাকে কিছুই দিতে পেরেছিল না একমাত্র এই ড্রেসিং টেবিলটা ছাড়া।ড্রেসিংটেবিলটা তৈরি করা হয়েছিল সেগুন কাঠ দিয়ে।
 অভয়া রোজই স্নানের পর এই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সিঁদুর পড়তেন।আর সব সময় আয়নাটাকে ঢেকেই রাখতেন।একদিন সকালে উঠে স্নান করে যখন সিঁদুর পড়ছেন ঠিক সেই সময়ে বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা তার দু'বছরের শিশু পুত্রটি জেগে গিয়ে খাট থেকে পরে যায়।সিঁদুর কৌটো হাতে নিয়েও পরার সুযোগ আর তিনি পান না।কাঁচটাও থাকে খোলা।তিনি দৌড়ে গিয়ে ছেলেকে নীচু থেকে তুলে নিয়ে তাকে শান্ত করে বুকের দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে যখন পুনরায় সিঁদুর পরতে যান;ওই আয়নার ভিতর তিনি দেখতে পান তার স্বামী ঘোড়ায় করে শিকারের উদ্দেশ্যে আস্তে আস্তে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে যাচ্ছেন।কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর ঘোড়াটা যখন তার গতি বেশ কিছুটা কমিয়েছে হঠাৎ কোথা থেকে বিশাল এক চিতা বাঘ এসে লম্বা এক লাফ দিয়ে ঘোড়ার উপর থেকে তাকে মাটিতে ফেলে দিয়েই টেনে হিচড়ে আরও ঘন জঙ্গলের ভিতর নিয়ে যায়।যুবরাজ আর বাড়ি ফিরে আসেননি।
 এরপর বহুবার ওই অভিশপ্ত ড্রেসিংটেবিলটা বিক্রি করতে যাওয়া বা কাউকে দান করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে ততবারই পরিবারের উপর কোন না কোন বিপদ ঘনিয়ে এসেছে।
  বংশ পরম্পরা ধরে তাই চলে আসছে ওই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সিঁদুর পরা আর সিঁদুর পরা হয়ে গেলেই আয়নাটিকে একটি কাপড়ের মাধ্যমে ঢেকে রাখা। 
 

Sunday, December 19, 2021

মায়াপুর ভ্রমণ ২

মায়াপুর ভ্রমণ ২
  ঘন্টা খানেকের মধ্যেই স্নান সেরে বেরিয়ে পড়লাম। টোটো নিয়ে ইস্কন মন্দিরের পুরো সীমানাটা টো-টো করে বেড়ালাম।কয়েকশ একর জমি বোধকরি।
 তারপর চলে এলাম খাবারের কুপন কাটতে।বারোটার মধ্যে খাবারের কুপন কাটতে হয়।একটার থেকে দেড়টার মধ্যে শুরু হয় খাওয়াদাওয়া।বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে কম করে হাজার লোকের খাওয়ার সুনিপুণ ব্যবস্থা।
 আমরা বাড়িতে এত তরিজুত করে রান্না করেও মন্দির প্রাঙ্গণের রান্নার ওই স্বাদ পাইনা।ভাত,ডাল,বেগুনি,দুই রকম কফির তরকারি,পনির, চাটনী, পাপড় ভাজা ও পায়েস।সাথে কিন্তু রুটিটাও থাকে।কিছু ছবি দিলাম দেখে বুঝতে পারবেন কত সুন্দরভাবে তারা খাবার পরিবেশন করেন।
 খাঁটি গরুর দুধের তৈরি মিষ্টি।এখনো মুখে স্বাদ লেগে আছে।গেলাম গোষালায়। গরুগুলির শিং দেখে অবাক হতে হয়।ঘি ভীষণ সস্তা। দু'কিলো ঘিয়ের দাম এগারশ কুড়ি।এই একটা জিনিসের দামই কেবল ওখানে সস্তা।

ক্রমশঃ

মায়াপুর ভ্রমণ ৩

মায়াপুর ভ্রমণ ৩
  খাওয়াদাওয়া শেষে সারাটাদিন কত কত যে মন্দির দেখলাম তার কোন হিসাব নেই।হেঁটে হেঁটে পায়ের তলায় আলু 😜হাঁটুতে ব্যথা,খুঁড়িয়ে হাঁটা ---- কিন্তু হাঁটার বিরাম নেই।জীবনে আমি এত কোনদিন হাঁটিনি।সেই ছেলেবেলা
থেকেই দুর্গা পুজোর সময়ও এই হাঁটার ভয়েই আমি ঠাকুর দেখতে বেরোইনা।তারপর সন্ধ্যার দিকে বেরোলাম ঠাকুরের আরতী দেখতে।এই সময়েও শয়ে শয়ে লোকের লাইন।কিন্তু কোনরকম চিৎকার চেঁচামেচি নেই।সর্বত্রই একটা নীরবতা এবং পবিত্রতা বিরাজমান।মূর্তি দেখলে মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়।
 বাসস্থানে ফিরে আবার মন্দির প্রাঙ্গণে একবারেই খেয়েদেয়ে খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া।
 
ক্রমশঃ

Saturday, December 18, 2021

মায়ের কোল

মায়ের কোল
 খুব ভোরে দাদার কাছ থেকে ফোনটা পেয়ে ডালিয়া কিছুটা সময় কোন কথার উত্তর না দিয়েই চুপ করে বসে ছিল। অপরপ্রান্ত থেকে দাদার 'হ্যালো হ্যালো' আওয়াজে সম্বিত ফিরে পেয়ে কান্না মিশ্রিত গলায় জানতে চাইলো,
--- কখন ঘটলো? তুই আমায় আগে কিছু বলিসনি কেন যে বাবার শরীর খারাপ।
 ডালিয়ার কথা শুনে ওর দাদা একটু চিৎকার করেই বলে উঠলো,
--- আগে আমি জানবো কেমন করে বাবার ঘুমের মধ্যেই স্ট্রোক করবে?
--- ও ঘুমের মধ্যেই চলে গেলেন বাবা? ঠিক আছে আমি এক্ষুনি আসছি।
  পরপর বেশ কয়েকটা ফোন করে কোনরকমে একটা শাড়ি পরেই ডালিয়া রওনা হয়ে গেলো তার বাপেরবাড়ির উদ্দেশ্যে।প্রথমে সে তার স্বামীকে ফোন করলো ।কয়েক মাস হল পরমব্রত হুগলিতে বদলী হয়ে গেছে।স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ায় বেশ বড় পোষ্টে কর্মরত সে।একমাত্র ছেলে এখন ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকে।মেয়ের শ্বশুরবাড়ি গড়িয়াহাট।মাঝে মধ্যে একাই থাকতে হয় কলকাতার বেহালার বিশাল বাড়িতে।এবারের বদলীটা একটু দূরে হওয়াতে আর এই পৌষের শীতে পরমব্রত বাড়ি থেকে আর যাতায়াত করছে না।ওখানেই একটা এক কামরার ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকছে।প্রথম প্রথম কটাদিন ডালিয়া গিয়ে তার কাছে ছিল।কিন্তু নাতির শরীর খারাপ হওয়াতে আবার সেখান থেকে ছুটে চলে এসেছে মেয়ের বাড়িতে।নাতি সুস্থ্য হলে নিজের বাড়িতে ফিরেছে।
 ড্রাইভারকে ফোন করার মিনিট পনের মধ্যেই সে চলে এসেছে।গাড়ির মধ্যে বাবার সাথে কাটানো মুহুর্তগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে বারবার নিজের আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে চলেছে।যখন ক্লাস নাইনে পড়ে ডালিয়া তখন মাকে হারিয়ে বাবা ই ডালিয়া আর ওর থেকে চার বছরের বড় দাদার কাছে বাবা আর মা দুই ই হয়ে উঠেছিলেন।বাবা ছিলেন দুই ভাইবোনের কাছে বন্ধুর মত।
 জ্ঞান হওয়ার পর থেকে জ্ঞানেশবাবুকে কেউ কোনদিনও বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে এক রাতও থাকতে দেখেনি।বাড়ি ভর্তি লোক থাকলেও জ্ঞানেশবাবু কোনদিনও তার নিজের বিছানা ছাড়া অন্য কারো বিছানায় শুতেন না।বাবা,মায়ের ঘরটা ছিল বেশ বড়।সেই ঘরে দুটি খাট পাতা থাকতো।একটি সিঙ্গল আর একটি ডবল বেডের।বাবা রাতে ঘুমানোর জন্য সিঙ্গেল খাটটাই ব্যবহার করতেন।আর বলতেন,
--- এই খাটটাতে না শুলে আমার ঘুমই আসে না।আমার কেন জানি মনেহয় এই খাটে শুয়ে আমি সেই ছেলেবেলার মত মায়ের কাছেই শুয়ে আছি।
  ঠিক বাবা,মায়ের ঘরের মত দাদার ঘরটাও বেশ বড়।বাড়িতে শুধুমাত্র ডালিয়ার ঘরটা অন্য দুটি ঘরের থেকে কিছুটা ছোট।ডালিয়ার বিয়ের পর থেকে ঘরটা ছিল জিনিসপত্রে বোঝায়।এখন অবশ্য দাদার একমাত্র মেয়ের ঘর হয়েছে ওটা।
 বাবার কাজকর্ম মিটে গেলে ডালিয়া সে দিনই বাড়িতে চলে যায়।ঠিক তার পরের দিনই আবার খুব ভোরেই দাদার ফোন।
--- একটা মারত্মক ঘটনা ঘটেছে রে ডলি।
--- কেন কি হয়েছে?সবাই ঠিক আছিস তো?
-- আরে আমরা সবাই ভালো আছি।কিন্তু কাল রাত্রে কি হয়েছে শোন।আমি তো আমার ঘরে আমার খাটে শুয়ে আছি।ঘুমের মধ্যে আমার মনেহল বাবা এসে আমায় ঘুম থেকে ডেকে তুললেন।আমি বিছানায় উঠে বসলাম।বাবা আমার হাত ধরে ধীরে টেনে নিয়ে গেলেন তার ঘরে।তারপর তার খাটে আমায় শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,'এখন থেকে এই খাটটাতেই তুই ঘুমাবি।নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে খাটটা রাখিস।'বলে তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন।বিশ্বাস করবি কিনা জানিনা বাবা যখন তোর বৌদির পাশ থেকে আমায় তুলে হাত ধরে নিয়ে হাঁটছেন আমার তখন কোন জ্ঞানই ছিল না।একটা ঘোরের মধ্যে আমি বাবার সাথে হেঁটে চলেছিলাম।বাবা যে নেই এটাও আমার মাথায় ছিল না।সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখি আমি বাবা মায়ের ঘরে বাবার খাটে ঘুমানো।তোর বৌদি যখন জানতে চাইলো আমি নিজেও মনে করতে পারছিলাম না কাল রাতে কিভাবে আমি এখানে এলাম।ঘরে কিন্তু তালা দেওয়ায় ছিল।
--- কি বলছিস তুই এসব?
--- আর শোন ঐ খাটটায় শুয়ে আমার কেমন যেন মনে হচ্ছিল সেই ছেলেবেলার মত আমি মায়ের কোলের কাছে শুয়ে আছি।বাবাও কিন্তু আমাদের এই কথায় বলতেন।তাই ভাবছি আজই আমি লোক ডেকে বাবার খাটটা আমার ঘরে নিয়ে যাবো।তুই কি বলিস?
--- যেটা তুই ভালো বুঝবি সেটাই করিস।তবে আমার মনেহচ্ছে বহু পুরনো খাট তো। কাঠের মিস্ত্রি ডেকে খাটটাকে একটু মেরামত করে পালিশ করে নিস।ওটা আমাদের বংশের সম্পদ।ওকে যত্নে রাখতে হবে পরবর্তী বংশধরদের জন্য।

Friday, December 17, 2021

মায়াপুর ভ্রমণ ১

 মায়াপুর ভ্রমণ
  দুবছর ঘর বন্দী।ইচ্ছা হলেও সাহসে কুলায় না বাইরে বেরোতে।শুধু আমিই নই গোটা বিশ্বের মানুষ আজ এই অসহায়তার সম্মুখীন।আবার শুরু হয়েছে ওমিক্রণ।সে নাকি আবার পশ্চিম বঙ্গেও ঢুকে পড়েছে!এই করোনা, ওমিক্রণ এদের এতটাই সাহস ইচ্ছা হলেই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নাকের ডগা দিয়ে ঢুকে পড়ছে তারা বুঝতেও পারছে না।একটু ভুল হল কথাটা --- এরা এতটাই উচ্চমানের যে সহজে স্থলপথে যাতায়াত করে না।সাধারণত আকাশ পথেই চুপিচুপি চলে আসছে!করোনা নিয়ে নাজেহাল সারা বিশ্ব আজ দুবছর।এখন দোসর হয়েছেন ওমিক্রণ।"একে রামের দেখা নেই,তারউপর সুগ্রীব দোসর"।অবস্থা ঠিক এরূপ।
  কাহাতক আর "নন্দলাল" হয়ে ঘরে বসে থাকা যায়।দু'মাস ধরে দু'বার ডেট ঠিক করেও যাওয়া হলনা।কিন্তু চোখের সামনে লাগেজটা রেখেই দিলাম যাতে ভাবতে পারি দুবছর পর আমরা বেরোচ্ছি বাড়ি থেকে।
 অতপর সেই সূর্য্য হইলো উদয়! ১৫-১২ তে বেরিয়ে পড়লাম ভোর সাড়ে পাঁচটায়।জামাই,মেয়ে,ছেলে সহ।সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় বেহালা থেকে রবীন্দ্রসদন পৌঁছে গেলাম মাত্র পনের মিনিটে। চার ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম মায়াপুর "গদা ভবন"।চলতি পথে অত ভোরে যত বাজার দেখেছি টাটকা শাকসবজি দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যায়।ভেবেছিলাম ফেরার সময় প্রচুর সবজি কিনে আনবো।কিন্তু দুপুরে বাজার শেষ।তাই গ্রামীণ টাটকা সবজি আমার আর খাওয়া ও ছেলেমেয়ে জামাইকে খাওয়ানো হলনা।
 আমরা চারজন যেখানেই যাই না কেন রুম আমরা একটাই নেবো।প্রথমবার দুটো রুম নিয়ে যেখানে গেছিলাম সেখানে একটা রুম তালা দেওয়া ছিল শুধু বালিশ আর কম্বল সেখান থেকে আনা হয়েছিল।ছিলাম সব একটা রুমেই।তারপর থেকেই রুম একটা নেওয়া হয়।
 প্রত্যেকটা রুমে এত সুন্দর ব্যবস্থা ভাবাই যায় না। চারটে সিঙ্গেল খাট। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ছিমছাম।আমরা ছিলাম তিন তলায়। সিড়ি দিয়ে উঠতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয়নি এতটাই ফ্লাট সিড়ি।করিডোরগুলো ভীষণ চওড়া আর তার দু'পাশে নাম না জানা নানান ফুলের গাছ।বিন্দুমাত্র কোথাও কোন ধুলো জমে নেই।
 এমনিতেই কোন ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতে গেলে মন ভালো হয়ে যায় আর মায়াপুর যেন সব থেকে সতন্ত্র।

ক্রমশঃ

Thursday, December 16, 2021

দুঃখ যেন করিতে পারি জয়

দুঃখ যেন করিতে পারি জয়
"তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই"- গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে রতন চললো মাঠে সদ্য কেটে রাখা পাকা ধানের আল বরাবর রাস্তা দিয়ে।মাঠে কাজ করতে থাকা নিতাই খুড়ো তাকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে বললো,
--- সোনার হরিণের খোঁজ পেয়েছিস তুই?
--- কি যে বলো খুড়ো তার কোন ঠিক নেই।এটা তো একটা গান।
--- ওরে খুড়ো তোর মত লেখাপড়া করিনি বলে কি রবিঠাকুরের লেখা গানটার কথাও জানবো না? 
 খুড়োর মুখে কথাটা শুনে রতন খুব লজ্জা পেয়ে যায়।খুড়োর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
--- এই বয়সে এখনো এত পরিশ্রম কেন করো খুড়ো?
--- পরিশ্রম না করলে বুড়ো বুড়ি খাবো কী? এই শোন আগামী বৃহস্পতিবার নবান্ন উৎসব।প্রতিবারের মত তাড়াতাড়ি করে বোনকে নিয়ে চলে আসিস।তোর খুড়ির তো বয়স হয়েছে একা ঠিক সেই আগের মত আর সামলাতে পারে না।তোর বোনটা গেলে হাতে হাতে অনেক কাজ করে দেয়।একটু তাড়াতাড়ি চলে যাস।
--- যাবো খুড়ো।বোনকে বলবো সকালেই চলে যেতে।
--- সেটাই ভালো হবে রে! তোর খুড়ির কাছে চারটি ডালভাত খেয়ে নেবে।
 নিতাই প্রামাণিক।গ্রামের সহজ,সরল একজন কৃষক।পরপর দুটি সন্তান হয়ে মারা যাবার পর আর কোন সন্তান হয়নি।কিন্তু পুরো গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো প্রত্যেকেই তার সন্তান।যখনই তার কানে পৌঁছেছে কেউ অসুস্থ্য তখনই সে ছুটে তাকে দেখতে চলে আসে।গ্রামে অধিকাংশই দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ বাস করে।নিতাই খুড়োর সামান্য কয়েক বিঘা জমিতে এই তেষট্টি বছর বয়সেও নিজেই সেই আদিকাল হতে লাঙ্গল দিয়েই জমি চাষ করেন।অসুস্থ্য বাচ্চাগুলোকে যখন তাদের বাবা,মা পয়সার অভাবে ডাক্তার দেখাতে পারে না,পেট ভরে খেতে দিতে পারে না তখন এই নিতাই খুড়োই তাদের একমাত্র ভরসা।
 হেমন্তে নূতন ধান উঠার সাথে সাথেই খুড়োর বাড়ির পিঠে,নূতন গুড়ের পায়েস আর নবান্ন উৎসবে পুরো গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের খাইয়েই খুড়ো আর খুড়িমা আত্মতৃপ্তি লাভ করেন।পরপর দুটি সন্তানের মৃত্যুর পর পুরো গ্রামের দরিদ্র এই ছেলেমেয়েগুলোই তাদের সন্তান হয়ে উঠেছে।তাদের মুখে হাসি দেখলেই খুড়ো আর খুড়িমা সন্তান না থাকার কষ্ট ভুলে থাকার চেষ্টাটা কিছুটা হলেও সার্থক হয়।খুড়ো মাঠে ধান চাষ করেন আর খুড়িমা বাড়িতে হাস, মুরগী,গরু পালন করেন।লাউ,কুমড়ো,সীম,ডাটা চাষ করেন।অভাব থাকা সর্তেও কোনদিনও এসব তারা বিক্রি করে দুপয়সা রোজগার করার চেষ্টা কখনোই করেন না।সবই যেন গ্রামের ওইসব দরিদ্র বাচ্চাগুলোর জন্য। খুড়িমা পায়ে ব্যাথা নিয়ে কোমর কাত করে এইসব সবজি,ডিম নিয়ে বাচ্চাগুলোর খাবারের ব্যবস্থা করেন মাঝে মধ্যে। এতেই তারা দুজনেই নিজেদের সন্তান হারানো আর সন্তান না থাকার কষ্ট ভুলে থাকতে পারেন।
 বিচিত্র এই পৃথিবী!তার থেকেও বেশি বিচিত্র মানুষের মন!মানুষ যে কখন, কিসে আর কি করলে তার জীবনে শান্তি পাবে তা বোধকরি সে নিজেও ঠিকভাবে বুঝতে পরে না।জীবন থমকে থাকে না।তাই সে জীবনে সবকিছু হারিয়ে ফেললেও কিছু না কিছুর মধ্যে একটু শান্তি খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করে নিজের বুকের উপর পাথর বেঁধে।
    

Tuesday, December 14, 2021

ঘোরাঘুরি

"এইসব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে" - একাকীত্বের বড় জ্বালা!নিস্তব্ধ,নিঃসঙ্গ জীবনে প্রতিটা মুহূর্তই যেন মৃত্যুর বিভীষিকাময় দূত হয়ে আসে।তখন মানুষ আর নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারেনা,ভুলে যায় স্বপ্ন দেখতে।শুধু মাঝেমধ্যেই বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।একার সাথে একাই যুদ্ধ করে চলে।আর মাঝে মাঝে ভুলের মাসুল হিসাবে বুক ছিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
  শুধুমাত্র একটা ঘটনা অনিন্দ্যর সমস্ত জীবনটা পাল্টে দিলো।স্কুল,কলেজে পড়াকালীন সময়ে শীতকাল এলেই দল বেঁধে পিকনিক যাওয়া ছিলো সকলের কাছেই যেন একটা বাধ্যতামূলক।প্রকৃতির নিয়মে সময়ের সাথে সাথে মানুষের জীবনেও অনেক পরিবর্তন আসে।তখন জীবনে শীতকাল এলেই পিকনিক,যাত্রা আর মায়ের হাতের নানান রকম পিঠাপুলি। এটাতেই ছিল মজা সেই ছেলেবেলার গ্রামীণ জীবনে।স্কুলের পাঠ গ্রামে মিটলেও উচ্চমাধ্যমিকের পরে কলকাতা পিসির বাড়িতে থেকে অনিন্দ্যর পড়াশুনা।তারপর বিরাট মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি।বিয়ে করে বাবা,মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে।বিয়ের আগেই বেহালা ডায়মন্ডবারবার রোডের উপর দু'হাজার স্কয়ার ফিটের সর্ব সুবিধা যুক্ত এক ফ্ল্যাট কিনে নেয়।
  অতি অল্প দিনেইঅর্থ,বৈভব,জীবনযাত্রার আমুল পরিবর্তন অনিন্দ্যর জীবনে।শত ব্যস্ততার মাঝেও প্রতি বছর ঘুরতে যাওয়া তার চাইই চাই।কখনো দিন পনের আবার কখনো বা নিদেনপক্ষে দিন সাতেক।এর মধ্যে আছে বড় বড় অফিস ট্যুর।কলিগদের সাথে পুরো শীতকালটা ধরেই নানান জায়গায় পিকনিক করে বেড়ানো। পুরী,দীঘা,বকখালি,বাঁকুড়া এইরূপ অনেক জায়গায় শনিবার করে যে যার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে আবার সোমবার এসে অফিস করা। হৈহৈ রইরই করে অনিন্দ্য তার জীবনটাকে কাটিয়ে দিতে চায়।
 বিয়ে হয়েছে আজ তিনবছর।এখনো কোন সন্তান নেয়নি তারও কারণ এই শীতের সিজনে ঘুরতে যাওয়া।বাচ্চাকাচ্চা হলেই কয়েক বছরের বিরতি ঘুরতে যাওয়ার।তাই স্ত্রীকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করিয়ে রেখেছে।অন্তত পক্ষে পাঁচটা বছর অপেক্ষাতে রাজি হয়েছে তার স্ত্রী।
 গত দুবছর আগে কালিম্পং থেকে ঘুরে আসার পর আবার এ বছর শীত পড়তে না পড়তেই কালিম্পং যাওয়ার তোড়জোড়।এই নিয়ে কালিম্পং ঘোরা পাঁচবার।একই জায়গায় বারবার ঘুরতে গিয়ে কি যে শান্তি পায় অনিন্দ্য,এটা নিয়ে শুধু স্ত্রী জয়িতাই নয় তার পরিবারের বাকি সদস্যরাও তার কাছে জানতে চেয়ে হাসাহাসি করে।আর অফিস কলিগরা তো শীতের আগমনের শুরু থেকেই তার পিছনে লেগে থাকে।
 কালিম্পং যাওয়ার সবকিছু তৈরি।মাঝে একটা রবিবার।শনিবার রাতে জয়িতাকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন,
--- এই কাল তো রবিবার।বাড়িতে আমি থাকলেই তোমার সারাটাদিন কাজ করতে হয়।তার চেয়ে বরং চলো দুটিতে মিলে খুব ভোরে ডায়মন্ডহারবার কোন গ্রামে ঘুরে আসি।শীতকালে গ্রামের সৌন্দর্য্যই আলাদা। খেজুর গাছ থেকে টপটপ করে রস পড়ছে ঠিলের মধ্যে।ওহ্ তুমি তো আবার ঠিলে বোঝো না।মাটির একটা পাত্র।অনেকটা কলসির মত দেখতে।রাস্তায়,মাঠে-ঘাটে লোকজন আগুন জ্বেলে গরম তাপ নিচ্ছে।কোথাও ধান কাটা হচ্ছে আবার কোথাও বা ধান কেটে মাঠের ভিতর সারি দিয়ে শুইয়ে রেখেছে।সবজির সবুজ মাঠ।দেখলে মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়।
 জয়িতা আর কি বলবে।সে জানে একবার যখন অনিন্দ্য যাবে ঠিক করেছে সে যাবেই।
 খুব ভোরে উঠে দুজনে রেডি হয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখে প্রচণ্ড কুয়াশা।জয়িতা তাকে নিষেধ করে এই কুয়াশার মধ্যে বেরোনোর জন্য।বলে একটু বেলা হলেই বেরোব আমরা।কিন্তু কে শোনে কার কথা!বেরিয়ে পড়ে।
 বেশিদূর আর এগোতে পারে না।জোকার কাছাকাছি এসে একটা বাসের সাথে প্রচণ্ড ধাক্কা খায়।জয়িতার মাথা পুরো থেতলে যায়।জ্ঞান হারায় অনিন্দ্য।বা হাত ভেঙ্গে পুরো চৌচির।ঘটনার অনেক পরে তাদের উদ্ধার করে গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গেলে জয়িতাকে মৃত ঘোষণা করে।পকেট থেকে অক্ষত মোবাইল ফোন বের করে বেশি ডায়াল করা নম্বরে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের লোকেরা ফোন করে এই খবর জানায়।অনিন্দ্যর জ্ঞান আসলেও কথা বলার মত অবস্থায় ছিলনা। হাড় ভাঙ্গা যন্ত্রণায় ছটফট করছে দেখে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে।
 আত্মীয় বন্ধুরা এসে তাকে নিয়ে কলকাতার নামী নার্সিংহোমে মাস খানেক চিকিৎসা করিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যায়।বা হাতটা কনুইয়ের উপর থেকে কাটা পরে।
  সম্পূর্ণভাবে অনিন্দ্য আজ দুটি কাজের লোকের উপর নির্ভরশীল। নির্জন দ্বীপের মত একাকী ঘরে আজ তার ঘোরাঘুরি।

Monday, December 13, 2021

জীবনের গতি যে পথে বহে

জীবনের গতি যে পথে বহে
"সোনার খাঁচায় দিনগুলি মোর রইল না 
সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি"-
 শত আক্ষেপেও চলে যাওয়া দিনগুলি আর ফিরে আসে না।মাত্র কটা বছর আগের কথা। শরতের আকাশ,বাতাস, ফুলপাখি সকলেই যখন জানান দিচ্ছে "আমি এসেছি দ্বারে -" ঠিক সেইরূপ একটি দিনে পুজোর ঠিক দিন সাতেক বাকি যখন,ঠিক তখন অনুপ্রিয়াদের বাড়িতে তার দাদার সাথে তার বন্ধু আসে এবারে সে গ্রামের পুজো দেখবে বলে।
 বছর পাঁচেক হল অনুপম আর শঙ্করের বন্ধুত্ব।শঙ্করের বাড়ি উত্তর প্রদেশের কোন একটি গ্রামে।একই সাথে দুজনেই চাকরি করে।থাকে দিল্লির এক কামরার একটি ঘর ভাড়া করে দুই বন্ধু।এবারে শঙ্করের আবদারে অনুপম তাকে সাথে করেই পুজোর সময় দেশের বাড়িতে আসে।
 অনুপ্রিয়া ভীষণ সুন্দরী মেয়ে।পড়াশুনায় ভালো।চপলতা তার চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য।যে কোন ছেলে দেখলেই তার প্রেমে পড়বে।শঙ্করের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয় না।প্রথম দেখাতেই শঙ্কর অনুপ্রিয়ার প্রেমে পড়ে যায়।
 প্রথম কটাদিন অনুপ্রিয়া শঙ্করকে একটু এড়িয়ে যেতে চাইলেও ঠিক এড়িয়ে যেতে পারে না।কি এক অমোঘ আকর্ষণে শঙ্কর যেন চুম্বকের মত তাকে টানতে থাকে।ব্যাপারটা দাদা অনুপমের চোখ এড়ায় না।বোন ও বন্ধুর এই মন দেওয়া-নেওয়া বিষয়টা দূর থেকেই সে বেশ উপভোগ করতে থাকে।আর মনেমনে ভাবে শঙ্করের সাথে অনুর বিয়েটা যদি সত্যিই হয় তাহলে বোনটা তার সুখেই থাকবে।কারণ শঙ্কর খুবই ভালো ছেলে।শান্ত,নম্র,ভদ্র।খুব আস্তে আস্তে কথা বলে।কোনরকম কোন নেশা নেই একমাত্র চা ছাড়া।
 বোনের কাছে কিছু জানতে না খেয়েই শঙ্করকে দেখে বোনের লাজুকতা দেখে সে বুঝতে পেরে যায় তার আদরের বোনটি তার বন্ধুর প্রেমে পড়েছে।আর শঙ্কর তো একাকী কোথাও তার ছোট্ট বোনটিকে দেখতে পেলেই এমনভাবে হা করে তাকিয়ে থাকত যেন সে হা বন্ধ করতেই ভুলে গেছে।
 অনুপম তার বাবা,মাকে আলাদা ডেকে নিয়ে বোনের সাথে শঙ্করের বিয়ের কথা বলেন।শঙ্কর বিহারী ছেলে।আর অনুপমরা কায়স্থ।প্রথম অবস্থায় তারা কিছুতেই রাজি হতে চান না।কিন্তু ছেলের কাছে তারা জানতে পারেন শঙ্কর অনুপ্রিয়াকে ভালবেসে ফেলেছে এ কদিনেই।আর সে যদি খুব ভুল করে না থাকে  অনুপ্রিয়াও তাকে পছন্দ করেছে।ভালো চাকরি করে।বাবা,মায়ের একমাত্র সন্তান।গ্রামের বাড়িতে প্রচুর জমিজমা।বোনটি তার সুখেই থাকবে।সব কথা শুনে তারা নিমরাজি হন।আর এদিকে অনুপম কায়দা করে বাবা,মাকে ষষ্ঠীর দিনে এক আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।নিজেও একফাঁকে বাড়ি থেকে কিছু সময়ের জন্য বেরিয়ে যায়।
 অনুপ্রিয়া আস্তে আস্তে গিয়ে দাদার ঘরে ঢুকে দেখে অনুপম একটা গল্পের বই নিয়ে শুয়ে শুয়ে খুব মনোযোগ সহকারে পড়ছে।
--- কি গল্প পড়ছেন?
 থতমত খেয়ে শঙ্কর উঠে বসতে বসতে বলে,
--- অনুপম বেরোনোর সময় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিণীতা বইটা দিয়ে বলে গেলো এটা পরে দেখ তোর কাজে আসবে।
 --- আগে পড়েননি পরিণীতা?
--- না পড়া হয়ে ওঠেনি আগে।
--- কোন কাজে আসলো ?
--- এখনো পড়া শেষ হয়নি।তবে যেটুকু পড়েছি তাতেই বুঝতে পারছি --- 
 শঙ্কর চুপ করে গেলো দেখে অনুপ্রিয়া জানতে চাইলো
--- কি হল চুপ করে গেলেন যে --
শঙ্কর খুব আস্তে আস্তে বললো,
--- মানুষের জীবনে প্রেম যদি আসে সেক্ষেত্রে খুব দেরি না করে তৎক্ষণাৎ বলে দেওয়া উচিত।
 চকিতে অনুপ্রিয়ার বুকের মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে গেলো।সে চুপ করেই দাঁড়িয়ে রইলো।তখন শঙ্কর সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে বললো,
--- আপনি তো বইটা অনেক আগেই পড়েছেন।বইটা পড়ে আপনার কি উপলব্ধি হয়েছে?আমি তো আমারটা বললাম।এবার আপনার পালা।
 অনুপ্রিয়া মুখটা নীচু করেই থাকে।আর চাতক পাখির মত শঙ্কর তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।এইভাবে কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর অনুপমের গলার আওয়াজে দুজনেই থতমত খেয়ে যায়। অনুপ্রিয়া উঠে পালিয়ে যেতে যায়
--- তুই খুব বোকা শঙ্কর।মেয়েরা সব কথা মুখে বলতে পারে না।ওটা বুঝে নিতে হয়।আমি তো আছি।কোন চিন্তা করিস না।তোকে আমার একমাত্র বোনের বর করেই ছাড়বো।
 অনুপ্রিয়া লজ্জায় লাল হয়ে ঘর থেকে দৌড়ে পালিয়ে যায়।অনুপম হো হো করে হাসতে থাকে।আর শঙ্কর এমনভাবে বসে থাকে যেন ধরা পড়া চোর!
  কথাবার্তা পাকা হয়ে যায়।রোজই ফোনে দুজনের কথা হতে থাকে।শঙ্কর বাবা,মাকে সবকিছু জানানোর জন্য বাড়িতে যায় কটাদিন ছুটি নিয়ে।কিন্তু তারপর ফিরে এসে সে অনুপমকে যে কথা জানায় তাতে অনুপম পুরো স্তব্ধ হয়ে যায়।বোনের স্বপ্ন ভাঙ্গার কথা সে কিভাবে তাকে জানাবে ভাবতে গেলেই তার চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়তে থাকে।
 বাড়িতে পৌঁছে শঙ্কর তার বাবা,মাকে যখন একথা জানায় তারা তাকে বলেন যে গ্রামের একটি মেয়েকে পছন্দ করে তার বাবাকে তারা কথা দিয়েছেন শঙ্করের সাথে বিয়ে দেবেন বলে।শঙ্কর আপত্তি জানায়।বাবা,মায়ের সাথে চলতে থাকে ঝামেলা।তার বাবা তাকে পরিষ্কার জানিয়ে দেন যদি সে এ বিয়ে না করে তাহলে তারা শঙ্করের সাথে কোন সম্পর্ক রাখবেন না।শঙ্কর যেন আর কোনদিন এই বাড়িতে না আসে।আর এখন থেকে সে যেন মনে করে সে পিতৃমাতৃহীন।
 একমাত্র ছেলে হওয়ার কারণে বাবা,মায়ের এই বৃদ্ধ বয়সে এতো বড় আঘাত সে কেমন করে দেবে? প্রশ্নটা সে তার বন্ধু অনুপমের কাছেই রাখলো।
    

স্বপ্ন ভাঙ্গার রং

স্বপ্ন ভাঙার রং
     নন্দা মুখার্জী 
"কাকেরা সব ছায়ায় বসে এ'দিক সে'দিক চায়
শুকনা গলায় ডাকছে কা-কা হঠাৎ উড়ে যায়।"
  এমনই এক চৈত্রের দুপুরে গ্রামের ছেলে সজল তার জীবনের স্বপ্ন সফল করতে মায়ের চোখের জল ঝরিয়ে নিজের হাতে তা মুছে দিয়ে ছ'মাসের মধ্যে যেভাবেই হোক সে নিজে এসে মাকে নিয়ে যাবে এই আশ্বাস দিয়ে বেরিয়ে পড়ে অজানা, অচেনা কলকাতা শহরের উদ্দেশ্যে।বাড়ি থেকে স্টেশনের দূরত্ব অনেকটাই।সাধারণত সাইকেল করেই সজলের এদিক ওদিক যাতায়াত।কিন্তু আজ সে সাইকেল নিয়ে স্টেশনে আসলে কে আবার তা বাড়ি নিয়ে যাবে?তাই হেঁটেই সে রওনা দেয় কাঠ-ফাটা রোদে স্টেশনের উদ্দেশ্যে।
  সাধারণভাবে গ্র্যাজুয়েশন করা সজল স্বপ্ন দেখে সে একদিন খুব বড় একজন আর্টিস্ট হবে।খুব ভালো ছবি আঁকে সে।গ্রামের যেখানেই মেলা হয় সে সেখানে বসে তার আঁকা ছবি বিক্রি করে। আঁকার সরঞ্জাম তার সাথেই থাকে তখন।কেউ এসে যদি বলে তার একটা ছবি একে দিতে তৎক্ষণাৎ সে তার ছবি এঁকে দিয়ে আরো কিছু বাড়তি রোজগার করে।
 এইরকমই এক মেলাতে কলকাতা থেকে কিছু লোক এসেছিলেন। সজলের আঁকা দেখে খুব প্রশংসা করে গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্যের উপর আঁকা দুটি ছবিও কিনে নিয়ে গেছিলেন।যাওয়ার সময় একজন সজলকে একটা কার্ড দিয়ে গেছিলেন কলকাতা গিয়ে তার সাথে দেখা করার জন্য।
  সজল কলকাতা পৌঁছে প্রথমেই ভদ্রলোকের সাথে দেখা করলো।ভদ্রলোকও তাকে আশ্বাস দিলেন তার পাশে থাকার জন্য।অযাচিতভাবে কলকাতা শহরে এইরূপ একজন মানুষের সান্নিধ্য পেয়ে সজল তার দেখা স্বপ্নগুলো নিয়ে মনের মাঝে সর্বদা নাড়াচাড়া করতে লাগলো।নতুনভাবে নিজেকে তৈরি করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো।ভদ্রলোক নিজেও ছবি আঁকেন।তিনি তার আর্ট রুমটাকে সজলকে ব্যবহার করতে দিলেন।বাইরের প্রখর গরমের ভিতর থেকে শীততাপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে ঢুকে সজলের সেদিন আনন্দে চোখে জল এসে গেছিলো।অজিত রায়ের বাড়ি বা সংসার অন্যত্র।এখানেও মাঝে মধ্যে এসে থাকেন সে ব্যবস্থাও আছে।তার ছবি আঁকার সবকিছু এখানেই।
 সজল বুঝতে পারে না ভদ্রলোক কেন তাকে এভাবে সাহায্য করছেন।কৃতজ্ঞতায় তার মাথা নুইয়ে আসে সবসময়।সময় মত তিনবেলা খাবার পৌঁছে যায়।সারাটাদিন সজল মন দিয়ে ছবি একে চলে।
  মাঝে একবার গ্রামের বাড়ি গিয়ে মায়ের সাথে দেখা করে এসেছে।একদিনের বেশি মায়ের কাছে থাকেনি।তার সাধনায় ব্যাঘাত হবে মনে ভেবে।এইভাবে বেশ কয়েকটি মাস কেটে যায়। সজলের ছবিগুলি যত্ন সহকারে বাইন্ডিং হয়ে প্রদর্শনীতে চলে যায়।আনন্দে,সুখে কৃতজ্ঞতায় সজলের চোখ থেকে সারারাত জল পড়তে থাকে।পরদিন সজলের আঁকার ছবির একক প্রদর্শনী।সারাটা রাত সজল দু'চোখের পাতা এক করতে পারেনি।
 অজিত রায়ের দেওয়া ঠিকানা সাথে করে একবুক আশা নিয়ে ধীর পায়ে সজল প্রদর্শনী কক্ষে প্রবেশ করতে গিয়ে দেখে পাশেই সেখানকার কোন একটি রুমে তখন লোক গিজগিজ করছে।সাংবাদিক বৈঠক চলছে।মধ্যমনি অজিত রায়।মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বক্তৃতা দিয়ে চলেছেন, "আজ তার স্বপ্ন পূরণের পথে।তিনি তার আঁকা যে ছবি আন্তজার্তিক প্রতিযোগিতায় পাঠিয়েছিলেন সে ছবি প্রথম স্থান অধিকার করেছে।গ্রাম বাংলার একটি চিত্র তিনি অঙ্কন করেছিলেন।এবার তিনি তাদেরই কথামত এই একক প্রদর্শনী করতে সাহস পেয়েছেন।আর এর জন্য তিনি প্রচুর অর্থমূল্য ছাড়াও সোনার মেডেল এবং জাপান ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছেন।
  সজল অজিতদার বক্তৃতা শুনে কিছুই বুঝতে পারছে না।কিন্তু মনের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব নিয়ে ছুটে বেরিয়ে এসে ছবিগুলির সামনে দাঁড়িয়ে দেখে ছবিগুলির যেখানে সে নিজের নামটা লিখেছিলো সেখানে অন্য রং দিয়ে তার নামটা মুছে 'অজিত' লেখা।
  তার মাথাটা ভনভন করে ঘুরতে লাগলো। কাঁচ ভাঙ্গা শব্দের মত সে তার স্বপ্ন ভাঙ্গার শব্দ শুনতে পাচ্ছে তখন।দৌড়ে সেখান থেকে বেরিয়ে কনফারেন্স রুমে ঢুকে চিৎকার চেঁচামেচি করতে শুরু করলে পুলিশ তাকে পাগল বলে গলা ধাক্কা দিয়ে সেখান থেকে বের করে দেয়। মাথা ফেটে তখন রক্ত পড়ছে।রক্ত আর চোখের জল মিলেমিশে গায়ে পরা জামাটি তখন অস্তগামী সূর্যের ন্যায় লাল রঙে রঞ্জিত।

Sunday, December 12, 2021

বৃষ্টি থামার শেষে

বৃষ্টি থামার শেষে
 " এ ঘোর দামিনী মেঘের ঘটা কেমনে আইলে বাঁটে
আঙ্গিনার মাঝে বধূয়া ভিজিতে দেখিয়া পরাণ ফাটে।।"
  আমি কবি নই।কিন্তু মহাকবি কালিদাস এক ঘন বর্ষার নবীন মেঘ দেখে তাঁর "মেঘদূত" রচনা করেছিলেন।কবিরা বৃষ্টি,মেঘ দেখে প্রকৃতির প্রেমে পড়ে পাতার পর পাতা লিখে চলেন।সৃষ্টি করেন মহাকাব্য।
 কিন্তু অনসূয়ার জীবনে বর্ষা আসে বেদনার রঙ্গে রঞ্জিত হয়ে।আকাশ ঘন মেঘে আচ্ছন্ন হলেই অনসূয়া সমস্ত দরজা,জানলা বন্ধ করে দিয়ে জোরে টিভিটা চালিয়ে দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায় যাতে বৃষ্টির শব্দ তার কানে এসে না পৌঁছায়।এই বৃষ্টি তার জীবনে এনেছিল প্রেম আবার এই বৃষ্টি তার জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে সমস্ত আশা,আকাঙ্খা,ভালোবাসা।
  সেদিন সকাল থেকেই আকাশের ছিল মুখ ভার। অনসূয়ার বাবা এবং মায়ের নিকট আত্মীয়ের এক নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাওয়ার কথা ছিল।দুপুর হতে না হতেই রাস্তার লাইটগুলো জ্বলে উঠেছিল।চারিদিকে রাতের এক অন্ধকার বিরাজ করছিলো।আশেপাশের সমস্ত বাড়িতেই তখন লাইট জ্বলছে।যেহেতু নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যেতেই হবে তাই আসন্ন দুর্যোগকে উপেক্ষা করেই গাড়ি নিয়ে অনসূয়ার বাবা,মা শতবার মেয়েকে সাবধানে থাকতে বলে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হন।বিকাল থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। এতক্ষণ জানলাগুলো খোলা থাকলেও এবার অনসূয়া উঠে গিয়ে জানলা বন্ধ করতে গিয়ে দেখে কেউ একজন তাদের নিজেদের বাড়ির ভিতরে ঢুকে রাধাকৃষ্ণের মন্দিরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির হাত থেকে মাথা বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।মন্দির লাগোয়া বারান্দায় লাইট জ্বললেও মুখটা ঠিক দেখা যাচ্ছে না।
  একদম রাস্তার উপর বাড়ি অনসূয়াদের।রাস্তার উপরেই রাধামাধবের মন্দির।বাড়িটা এল প্যাটানের।তাই মন্দিরের মুখটা রাস্তার দিকে হলেও বারান্দা থেকে দেখা যায়। মুসলধারে এই বৃষ্টির দিনে রাস্তায় কোন মানুষ তো ছাড় গাড়ির সংখ্যাও নগন্য।কিছুক্ষণ পরে আবার এসে দেখে ভদ্রলোক সেই একইভাবে দাঁড়িয়ে।খুব খারাপ লাগছে এভাবে ভদ্রলোক বৃষ্টিতে ভিজছেন দেখে;এদিকে বাড়িতে সে একা।কি করবে কিছুই বুঝতে পড়ছে না।বৃষ্টি থামারও কোন লক্ষন নেই।সাহসে ভর করে বারান্দার গ্রিল খুলে বাড়ির ভিতর থেকে মন্দিরের দরজা খুলে একটা ছাতা হাতে নিয়ে মন্দিরের সামনের গ্রীলের ভিতর থেকে তাকে দিয়ে বললো,
--- আপনি অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন।এই ছাতাটা নিন।পড়ে এসে নাহয় ফেরত দিয়ে যাবেন।
  পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের ছেলেটি হাত বাড়িয়ে ছাতাটা নিয়ে বললো,
--- আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেবো বুঝতে পারছিনা।আমার অনেক উপকার করলেন।
সুনীল হাত বাড়িয়ে ছাতাটা নিলো।অনসূয়া পুনরায় মন্দিরের ভিতরের দরজা দিয়ে ঘরে চলে গেল।সেদিন ওই বৃষ্টির মধ্যে অনসূয়ার বাবা মা রাতে ফিরতেই পারেননি।পুরো কলকাতা শহর সেদিন ছিল জলের তলায়।
 প্রায় দিন সাতেক বাদে বেল বাজানোর আওয়াজে দরজা খোলেন বাড়ির মালিক অজয় স্যানাল।সুনীল তার হাতে ছাতাটা দিতে দিতে বলে,
--- সেদিন এই ছাতাটা না পেলে ভীষণ মুশকিলে পড়ে যেতাম।
--- কিন্তু এটা কার ছাতা? কোথা থেকে পেলে?আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
--- আমাকে এই বাড়ি থেকেই বৃষ্টির সময় সম্ববত আপনার মেয়ে ছাতাটা দিয়েছিলেন।
--- ও আচ্ছা!দাঁড়াও ওকে ডাকি।
অনসূয়া এসে বাবার কাছে দাঁড়িয়ে বললো,
--- আরে ভিতরে আসুন।একটু চা খেয়ে যান।
 তারপর বাবার দিকে ফিরে সেদিনের ঘটনার পুরো বিবরণ দিলো।গল্প করতে করতেই জেনে নিলো সেদিন ছিল চাকরিতে জয়েন করার প্রথম দিন।প্রথম দিন অফিস থেকে ফেরার পথেই এই ঝড় জলের মধ্যে পড়া।এই পরিচয়ের সূত্র ধরেই তারা একসময় ভীষণ কাছাকাছি এসে গেলো।মায়ের একমাত্র সন্তান সুনীল।বাবা অনেক আগেই চিরতরে চলে গেছেন।
  ধনী পরিবারের সন্তান হওয়ার পরও তাদের বিয়েতে অনসূয়াদের পরিবার থেকে কোন আপত্তি আসেনি।কারণ সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী তো ওই অনসূয়াই।
  অনসূয়া তখন তিনমাসের প্রেগন্যান্ট।মায়ের কাছে এসে আছে।হঠাৎ একদিন প্রবল ঝড় জল।অধিকাংশ দিন সুনীল শ্বশুরবাড়ি থেকেই অফিস করছিলো।সেদিন তাকে সকলে মিলে অফিস যেতে না করে।কিন্তু ব্যাংকের ক্যাশের একটি চাবি তার কাছে থাকার ফলে তাকে অফিসে আসতেই হয়।তখনো বৃষ্টি থামেনি ,অফিস শেষে গাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ির সামনে নেমে যেই বাইরের গ্রীলে হাত দিয়েছে সঙ্গে সঙ্গেই ইলেকট্রিকের শক।ঘরের ভিতরের বাকি মানুষগুলি কিছুই জানতে পারে না।লাইট পোষ্টের একটা তার ছিঁড়ে অনসূয়াদের বাড়ির বাইরের দিকের গ্রীলের উপর পরে।
 বাইরের লোকজনের চিৎকার,চেঁচামেচিতে তারা যখন বেরোয় তখন সেখানে অলরেডি সি এস সি থেকে লোক এসে গেছে।মাথা ঘুরে অনসূয়া পরে যায়।বাচ্চাটাকে রাখা যায় না।
 পাঁচ বছর অতিক্রান্ত।বাড়ির লোক চেষ্টা করেও তার বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারেনি।শুধু ঝড় জলের দিনে সে সারা ঘরময় পাগলের মত করতে থাকে।
 
    

Friday, December 10, 2021

বসন্তে ফুল গাঁথলো মালা

বসন্তে ফুল গাঁথলো মালা
 "মহুয়ার মালা গলে কে তুমি এলে
নয়ন ভুলানো রূপে কে তুমি এলে?"
  আকাশ জোড়া ফাগের রাগ;প্রকৃতিতে আজ লেগেছে শিহরণ!আর সামনের মানুষটাকে দেখে অনুলিকার সমস্ত শরীর রোমাঞ্চিত!
 কিন্তু কে ও?সকলের মাঝে সারা মুখ,শরীর জুড়ে রং মাখানো যেন ইচ্ছা করেই মাথার টুপিটা বড্ড বেশি নীচু করা।
দাদার বন্ধুদের সকলকেই অনুলিকার চেনা।সেই চেনার সূত্র ধরেই যাকে নিয়ে একসময় সংসারে জ্বলে উঠেছিল আগুন;সেতো এখন আর এখানে থাকেই না। অনুলিকার জীবনের ঝড় থামাতে এক সময় চলে গেছিলো সুদূর লন্ডনে। দাদাও বিয়ে করে দেশের বাইরে।মা চলে গেছেন অনেক আগেই।বাপ,বেটির সংসার আজ।বাবার পেনশন আর অনুলিকার প্রাইমারী স্কুলের চাকরিতে বেশ ভালোই চলে যায়।দাদা প্রথম প্রথম টাকা পাঠাতো ঠিকই কিন্তু ধীরে ধীরে সংখ্যায় তা কমতে থাকায় বাবা ই একদিন তাকে জানিয়ে দেন তাদের কোন অভাব নেই।যা রোজগার তাতে ভালোভাবেই দুজনের চলে যায়।দাদাও টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেয়।
 অথচ এই দাদা ই একদিন তার বন্ধুর সাথে বোন অনুলিকার সম্পর্ক মেনে নেবে না বলে গায়ে হাত তুলতেও ছাড়েনি।তার বন্ধু শমিতের অপরাধ সে ব্রাহ্মণ নয়,তাছাড়া ভালো চাকরীও করে না। শমিতের সাথে তার বোনের বিয়ে হলে অন্য বন্ধুদের কাছে তার মাথা হেঁট হবে।মায়েরও আপত্তি ছিল।কিন্তু বাবা বলেছিলেন,
--- জীবনটা ওর।ওকে ওর মত করে ভাবতে দে।আজকের দিনের ছেলে হয়ে কি করে বলিস ব্রাহ্মণ না হলে বোনের বিয়ে দিবি না?পৈতে ধুয়ে কি জল খাবে?আজ ভালো চাকরি করেনা তো কি হয়েছে ? ভবিৎষতে ভালো চাকরী তো পেতেই পারে।আর তাছাড়া অনুও তো রোজগারের চেষ্টা করছে।     কিন্তু অনুলিকার দাদা চিৎকার,চেঁচামেচি করে বাড়ির পরিবেশটাই গুমোট করে ছাড়লো।সবকিছু জানার পর শমিত অনুলিকাকে শুধু বলেছিলো,
--- তুমি আমায় কথা দাও আমি যতদিন না ভালো রোজগার করছি ততদিন পর্যন্ত আমার জন্য অপেক্ষা করবে।আমার জীবনে তুমিই হচ্ছ প্রথম প্রেম।আর এই ভালোবাসাকে পূর্ণতা দিতে যতদূর যেতে হয় আমি যাবো।শুধু তোমার কথাটা জানার উপরেই সবকিছু নির্ভর করছে।
 সেদিন অনুলিকা তাকে কথা দিয়েছিল সে সারাজীবন শমিতের জন্য অপেক্ষা করবে।পড়ে অনুলিকা জেনেছিল শমিত যে কোম্পানিতে চাকরি করতো সেখানে তার কাজের প্রতি নিষ্ঠা দেখে সেই কোম্পানির মালিক তাকে শমিতের কাছ থেকে লিখিত নিয়ে এই মর্মে যে তাকে আজীবন এই কোম্পানিতেই চাকরি করতে হবে এবং তারপর তাকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেয় কোম্পানির স্বার্থে উন্নত শিক্ষার জন্য।
  বাড়িতে অনুলিকার বিয়ের জন্য প্রচুর অশান্তি হয়েছে।কিন্তু বাবা পাশে থাকায় দাদা কিংবা মা কেউই তার উপর জোর খাটাতে পারেননি।বছর তিনেক পর দাদা পারি দেয় আমেরিকা।সেখানে গিয়ে এক বিদেশিনীর প্রেমে পরে।দুবছরের মধ্যে বিয়েও করে নেয়।মায়ের অমত ছিলনা।ছেলের তো শত দোষ মাফ।তিনি তো জীবনে তার ছেলের কোন দোষই দেখতে পাননি।বাবা শুধু হেসে বলেছিলেন,
--- ছেলেটা তোমার পেটে হলেও মেয়েটা বোধহয় পিঠে হয়েছে।
 মা চোখ কটমট করে বাবার দিকে তাকিয়ে নিজ কাজে চলে গেছিলেন।
 দাদা দেশের বাইরে চলে যাওয়ার পর কেউ আর দোলপূর্ণিমায় কখনো অনুলিকাদের বাড়িতে রং খেলতে আসেনি।আজ এতগুলি বছর বাদে দাদার বন্ধুরা আবার অনুলিকাদের ছোট্ট উঠোনটিতে।বাবা এগিয়ে গিয়ে বারান্দার গ্রীলটা খুলে দিয়ে তাঁর সেই চিরাচরিত ভঙ্গিতে তাদের আপ্যায়ন করলেন আর চিৎকার করে বললেন,
--- ওরে অনু এতগুলি বছর বাদে আমার সব ছেলেগুলো আমার পায়ে রং দিতে এসেছে।তুই সেই আগের মত এক গামলা মুড়ি মেখে নিয়ে আয় চানাচুর,পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা আর সরষের তেল দিয়ে।
 জানলা দিয়ে উকি মেরে দেখলাম রাস্তার দিকে মুখ করে সেই মানুষটি দাঁড়িয়ে।বাবা তাকে ডেকে বললেন,
--- আরে তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে কেন এদিকে এসো।
 ধীর পায়ে সে বাবার সামনে এসে দাঁড়ালো।বাবা তাকে চিনতে পেরে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলেন,
--- অনু দেখে যা কে এসেছে।আমি জানতাম একদিন তুমি ঠিক ফিরে আসবে।আমার অনু যে আজও তোমার অপেক্ষায় বসে।
 সকলের মধ্য থেকে এক বন্ধু দাদার কানে কানে বললো," আমাদের দায়িত্ব শেষ।বুড়ো বয়সে তোর জন্য আবার এই রং মাখতে বেরোনো। এবার আমরা আসি।"
 কিন্তু কথাটা বাবার কানে গেলো,
--- আরে সেই আগের মত সবাই বসে মুড়ি মাখাটা তো খেয়ে যাও।
  এক এক করে সবাই চলে গেলো।বাবা শমিতকে বললেন,
--- এবার তুমি অনু মায়ের কাছে যাও।অনু মায়ের জন্য আমার সব চিন্তা আজ শেষ হল।

Thursday, December 9, 2021

ভাবিনি তোমায় নিয়ে

ভাবিনি তোমায় নিয়ে

ভাবিনি কখনো তোমায় নিয়ে

জানিনা তুমি ছিলে কিনা বুকের মাঝারে
নূতন করে পরিচয় হয়ে  
বারবার কেন এক মায়াবী বলে
দূর থেকেই টানছো আমারে।

অতীতের স্মৃতি অতীতেই মুচেছে
ভাবিনি কখনো তোমার কথা
অসীম এক জাদুবলে ভাবছি
অতীতে দেখা তোমার সেই সরলতা।

পৃথিবী যে গোলাকার প্রমাণ পেয়েছি বহুবার
আমার জীবনের কোন গল্পেই
ছিলেনা তুমি কখনোই নায়ক হয়ে
খুশি হয়েছি জীবনে আমি অল্পেই।

 এ জনমে যদিও শুনতে পেলাম না
কেউ কারো নিশ্বাসের শব্দ
পড়ন্ত বিকালে আবার হল পরিচয়
এতেই যে আমি সন্তুষ্ট।

প্রেম, বয়স-সম্পর্ক মানে না
এত সবাই জানে
এগোতে চাইলেই সংসার কিন্তু
পিছন থেকেই টানে!

পাশে থাকা মানে একই খাটে নয়
সমব্যথী হয়ে থাকা,
নাইবা থাকলো হাতে হাত অপরের
ভালোবাসাতেই হৃদয় থাক ঢাকা।

নূতন করে এ জীবনে কিছুই চাওয়ার নেই
তবুও তোমায় বলি চুপিচুপি
বন্ধু হয়েই থেকো পাশে
জীবনের নায়ক নাইবা হলে তুমি।

বেলাশেষে

বেলাশেষে
তোমায় যে কথা বলতে এসেছিলাম --- কয়েক যুগ আগে যে কথা বলা উচিত ছিল।কিন্তু তখন বলতে পারিনি।কারণ তখন আমার পায়ের তলার মাটি শক্ত ছিলনা।জানি আজ আর সে কথা বলে কোন লাভ নেই।কিন্তু তবুও আমার জীবনের চরম সত্যতা তোমার জানা দরকার।ভীষণভাবে বিশ্বাস করি পরজন্ম।যদি এ জীবনে মনের কথাটা তোমায় না জানিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাই কিজানি হয়ত পরের জনমেও বলা হয়ে উঠবে না।
  স্বরসতী পুজোয় প্রথম শাড়ি পরা অর্পিতার।তখন ক্লাস এইট।হাঁটতে গেলেই হোঁচট খাচ্ছে।কিন্তু এই একটা দিনই বছরে বরাদ্দ মায়ের অনুমতিতে শাড়ি পরার।মায়ের হলুদ রঙ্গের দামী জামদানী শাড়িটা বের করে মা নিজেই বেশ উচুঁ করে পরিয়ে দেন।কিন্তু স্কুলে ঢোকার মুখেই দুক্লাস উচুঁতে পরা অনিরুদ্ধ তাকে দেখে বললো,
--- এত সুন্দর শাড়ীটা এতো উচুঁ করে পরেছিস মনেহচ্ছে কোন পাহাড়িয়া মেয়ে।
 কথাটা শুনে অর্পিতা খুব অপমানিত বোধ করে।সে অনিরুদ্ধর দিকে তাকিয়ে বলে,
--- নীচু করে পরলে তো আমি পড়ে যাবো।তুমি বুঝি তাই চাও।
--- আরে তা কেন?পড়তে পড়তেই তো একদিন ভালোভাবে হাঁটতে শিখবি।এত উচুঁ করে কেউ শাড়ি পরে?
 কোন কথা না বলে অর্পিতা তার এক বন্ধুকে নিয়ে ফাঁকা একটা ক্লাসরুমে ঢুকে লুটিয়ে শাড়ীটা পরে বেরোয়।কিন্তু এইভাবে শাড়ি পরার ফলে সে কিছুতেই ভালোভাবে হাঁটতে পারছে না।তাই এক হাতে কুচিটা ধরে নিয়ে তাকে হাঁটতে হচ্ছে।অনিরুদ্ধ পুনরায় অর্পিতাকে দেখতে পেয়ে মনেমনে বেশ খুশি হয় যে অর্পিতা তার কথা শুনেছে।এই সামান্য একটি কারণ থেকেই সে বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী অনিরুদ্ধ অর্পিতার প্রতি আস্তে আস্তে দুর্বল হতে শুরু করে।অনেক পরে অর্পিতারও অনিরুদ্ধর প্রতি একটা ভালোলাগা কাজ করতে শুরু করে।
 সে বছর মাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্ট করে অনিরুদ্ধ ওই স্কুলেই সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হয়ে যায়।মাঝেমধ্যে দুজনের দেখা হয়।কিন্তু কথা সেভাবে হয়না কখনো।দুজনেই পড়াশুনায় খুব ভালো।অর্পিতা খুব ভালো ছবি আঁকতে পারতো।একদিন অনুরুদ্ধ অর্পিতাকে অনুরোধ করে তার প্রাকটিক্যাল খাতাটা তৈরি করে দেওয়ার জন্য।অর্পিতা সানন্দে রাজি হয়ে যায়।এই খাতা দেওয়া-নেওয়া এবং আঁকা প্রসঙ্গে নানান কথা বলতে বলতে কিছুটা হলেও দুজনে কাছে আসে।কিন্তু কখনোই ভালোলাগা বা ভালোবাসার কথা কেউ কাউকে কোনদিন বলেনি।
 উচ্চমাধ্যমিকেও অনিরুদ্ধ আশাতীত ফল করে।জয়েন্ট বসে সরকারিভাবেই ডাক্তারী পড়ার সুযোগ পেয়ে যায়।বহুবার চেষ্টা করেও মাত্র দুটি স্টপেজ গিয়ে অর্পিতাকে জানাতে পারেনি তার ভালোবাসার কথা।অর্পিতা তখন কলেজে।
  কলেজে পড়তে পড়তেই অর্পিতার বিয়ে হয়ে যায়।এই সময় বিয়ে করতে সে না চাইলেও বাড়ির লোকের সকলের কাছে তার অব্যক্ত ভালোবাসার কথা জানাতেও পারেনি। অনিরুদ্ধর সাথে যোগাযোগটাও আর সেভাবে তখন ছিলনা।কারণ অনিরুদ্ধ কলেজ ক্যাম্পাসেই থাকতো।যোগাযোগের কোন রাস্তাও ছিলনা আজকের দিনের মত।
 কেটে গেছে বেশ কয়েক যুগ।অনিরুদ্ধ অনেক পড়ে জেনেছে অর্পিতার বিয়ের কথা।মনের কষ্ট মনেই চেপে রেখেছে।অকৃতদার জীবনে বাবা,মায়ের মৃত্যুর পর হাসপাতাল,চেম্বার,বাড়ি আর দিনরাত এক করে রোগীকে সুস্থ্য করার আপ্রাণ চেষ্টায় অনিয়মের বেড়াজালে নিজেকে আটকে ফেলে অনিরুদ্ধ।তার ফলও পায় হাতে হাতে।রক্তে শর্করার পরিমাণ এতটাই বেড়ে যায় নিজে ডাক্তার হয়েও কিছুতেই তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনা।কিডনি দুটিই হয়ে পড়ে অকেজো।শুরু হয় ডায়ালিসিস।প্রাকটিস বলতে গেলে পুরোই বন্ধ।জুনিয়রদের সাহায্যার্থে মাঝে মধ্যে তারা এসে নিয়ে যায় বা ফোনেই কথা হয় তাদের সাথে।
 জীবনে শেষ সময়ে এসে আর একবার অর্পিতার সাথে দেখা করার প্রবল ইচ্ছাতে তার বাপেরবাড়িতে এসে ঠিকানা নিয়ে এই অসুস্থ্য অবস্থাতেই তার বাড়িতে এসে হাজির হয় অনিরুদ্ধ।
 অর্পিতা আজ একা।ছেলে সুইডেনে থাকে।সেখানেই বাড়ি করেছে।মাকে নিয়ে যেতে চাইলেও অর্পিতা যেতে চায়নি।হয়ত জীবনের শেষ বেলায় সেও আর একটিবার অনিরুদ্ধকে দেখতে চেয়েছিলো,বলতে চেয়েছিল কোন প্রত্যাশা না রেখেই কোন কথা।


 

Monday, December 6, 2021

অব্যক্ত মনের কথা

 মুর্শিদাবাদ।তাই এখানে একটা জমি কিনে বাগান বাড়ি তৈরি করি।আমেরিকা থেকে যখন ফিরি তখন আর কলকাতা যাই না ,সরাসরি মুর্শিদাবাদ আমার বাগান বাড়িতেই উঠি।এই আশায় যদি কোনদিন তোমার সাথে দেখা হয়।আসলে শিখা তো আমার একমাত্র বোন।ও এখন পুরোপুরি সংসারী।দুই সন্তানের মা।মা,বাবা নেই।তাই কলকাতা গিয়ে থাকার ইচ্ছা আর নেই। তবে ইন্ডিয়ায় আসলে যাওয়ার আগে একবার দেখা করে যাই শিখার সাথে।
 বৈশাখী সেদিন নিলয়ের মনের খবর জানতে বা বুঝতে না পারলেও আজ তার এই হেঁয়ালি কথাবার্তায় বুঝতে পারে সে আসলে কি বলতে চেয়েছিল তাকে।
--- এখান থেকে বেশি দূরে নয় আমার বাড়ি।তুমি যাবে আমার বাড়ি?
 নিলয় হেসে দিয়ে বলে,
--- তবুও জোর দিয়ে বলতে পারছো না আমার বাড়ি চলো।আসলে তুমি কোনদিনও আমার মনের কথাটাই বোঝার চেষ্টা করোনি।তোমার হাজব্যান্ড কিছু বলবে না?
--- তুমি আমায় দেখে বুঝতে পারছো না সে নেই!
 নিলয় অবাক হয়ে বৈশাখীর মুখের দিকে তাকায়।
--- তারমানে তুমি একা থাকো?
--- আমার ছেলে ডাক্তারী পড়ছে।সরকারিভাবে সুযোগ পেয়ে গেলো তাই পড়াতে পারছি।এখানে কোথায় তোমার বাগানবাড়ি?
 নিলয় একটা কার্ড বের করে তার হাতে দেয়।
---রিটায়ার করার পর ওখান থেকে চলে আসবো।
--- আর তোমার বউ,বাচ্চা?
অবিবাহিত নিলয় এ কথার কোন উত্তর না দিয়েই বলে,
--- শেষ যেদিন তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছিল সেদিন একটা কথা বলতে চেয়েছিলাম শুনবে আজ সেই কথাটা?
--- সেদিন বুঝতে না পারলেও আজ বুঝতে পারছি তুমি কি বলতে চেয়েছিলে।কি লাভ আর সেই কথা শুনে।কবিগুরুর ভাষায় তবে বলি
"রাতের সব তারাই আছে 
দিনের আলোর গভীরে।