স্বাধীনতার সুখ
অনেক স্বপ্ন নিয়ে বাবার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে আর পাঁচটা মেয়ের মতোই সুখী হতে চেয়েছিল অনুষ্কা | মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা , মায়ের একমাত্র সন্তান অনুষ্কা | বাবা প্রাইভেট ফার্মের একজন সামান্য কর্মচারী | পরিবারে অর্থের অভাব থাকলেও সুখের কোন অভাব ছিলোনা | অনুষ্কাকে তার বাবা , মা কখনোই কোন অভাব বুঝতে দেননি | আহামরি সুন্দরী না হলেও দেখতে সে মন্দ নয় , খুব সুন্দর গানের গলা | এই গানের জন্যই অনেক সুন্দর সুন্দর প্রাইজ আর সার্টিফিকেটে সে ঘর ভরিয়েছে | বাবা , মায়ের অত্যন্ত বাধ্য মেয়ে অনুষ্কা | অনুষ্কার বাবা দ্বীপায়ন রায় ভেবেছিলেন মেয়েকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়েই বিয়ে দেবেন | কিন্তু পরিচিত একজনের সূত্র ধরে এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সন্ধান পান | একমাত্র ছেলে | বাবা ডাক্তার | কলকাতা শহরের উপর বিশাল দোতলা বাড়ি | বাড়িতে ছেলে ও বাপের দুখানা গাড়ি | এমন পাত্র তিনি হাতছাড়া করতে চাননি | অনুষ্কার মা এতে অসম্মতি জানিয়েছিলেন | বলেছিলেন ," কপালে যদি থাকে তাহলে ওর ভালো ঘরেই বিয়ে হবে ; তোমার আগের সিদ্ধান্তই ঠিক ছিল আগে অনু নিজের পায়ে দাঁড়াক তারপর নাহয় বিয়ে নিয়ে ভেবো |" কিন্তু না দ্বিপায়ন রায় এতো ভালো সম্মন্ধ হাতছাড়া করতে চাইনি | তিনি এখানেই বিয়ে ফাইনাল করেন | ও বাড়ির তিন সদস্য এসে অনুষ্কাকে পছন্দ করে গেছিলো | তাদের একমাত্র দাবি ছিল বরযাত্রীদের যেন সুন্দরভাবে আপ্যায়ন করা হয় | দ্বীপায়নবাবু তার আদরের কন্যার বিয়েতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি | তিনি তার সার্ধ্যাতিত এ বিয়েতে আয়োজন করেছিলেন |
অনুষ্কা শ্বশুরবাড়িতে পা দিয়েই বুঝতে পেরেছিলো এদের চালচলন তাদের বাড়ি থেকে সম্পূর্ণ অন্যরকম | টাকাপয়সা যে তাদের প্রচুর তা তারা হাবভাবে প্রতিটা মুহূর্তেই বুঝিয়ে দেন | কিছুটা ব্যতিক্রম ছিলেন তার শ্বাশুড়ি | তিনিও গরীব ঘরের মেয়ে | রূপের জন্য তিনি এ বাড়িতে আসতে পেরেছিলেন | এখনো এই বয়সে তিনি যথেষ্ট সুন্দরী | কিন্তু কোনকিছুতেই তার কোন অহংকার নেই | তারমত সুন্দরী না হলেও অনুষ্কা এ বাড়ির বৌ হয়েছে শুধুমাত্র তার পছন্দের কারণেই | তিনি প্রথমে অনুষ্কার ছবি দেখে পছন্দ করেছিলেন | ছেলেকে সাথে নিয়ে স্বামী , স্ত্রী দুজনে সামনাসামনি মেয়ে দেখে যাওয়ার পর ছেলে তার আপত্তির কথা জানালেও মায়ের ইমোশনের কাছে তা ধোপে টেকেনি | ফুলশয্যার রাতে অনিক তাকে আংটি ছাড়াও একটা হীরের নেকলেস প্রেজেন্ট করেছিল | নিজেকে খুবই ভাগ্যবতী মনেহত অনুষ্কার | বাড়ি থেকে বেরোলেই গাড়ি আর গা ভর্তি গয়নায় নিজেকে তার রানী রানী লাগতো | অনিকের ভালোবাসাই কোথাও কোন খামতি আছে বলে কখনো তার মনেহয়নি | শ্বশুরমশাই তার চেম্বার আর নার্সিংহোমের কাজ নিয়েই সদা ব্যস্ত | সংসার নিয়ে ভাববার তার সময় সত্যিই নেই | অনিকও তার অফিস আর মাঝে মাঝে সাইটের কাজের জন্য একদুরাত বাইরে কাটিয়ে টায়ার্ড হয়ে বাড়িতে ফিরে বেশ কয়েকঘন্টা ঘুমিয়ে ফ্রেস হয়ে আবার ছুট | শ্বাশুড়ীকে কোনদিনই তার মা ছাড়া অন্যকিছু মনেহয়নি |
কিন্তু সুখের ঘরে আগুন লাগতে বেশিদিন লাগেনি | বিয়ের বছর দুয়েক পরে লন্ডন থেকে মাত্র সাতদিনের জন্য অনুষ্কার শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে আসে অনিকের মাসি ও মাসতুত দাদা | তারা বিয়ের সময় আসতে পারেনি বলেই এই ঝটিকা সফর | বেশ আনন্দের মধ্যে দিয়েই দু থেকে তিনদিন কেটে গেলো | অনিকের মাসতুত দাদা একদিন সুযোগ পেয়ে অনুষ্কার কাছে জানতে চায় অনিক তাকে ভালোবাসে কিনা | অনুষ্কা আকাশ থেকে পরে এরূপ একটি প্রশ্নে | সে হা করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে | ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ঋতম অনুষ্কাকে বলে ,
--- আজ আমি অনিকের অফিসে গেছিলাম | অনিক অফিস ছিলোনা | সেখানে গিয়ে সে জানতে পারে অফিসের এক কলিগের সাথে বেশ কয়েকবছর যাবৎ তার একটা সম্পর্ক রয়েছে | কলিগ ডিভোর্সি | তার একটা সন্তানও আছে | হুট করে কেউ আমাকে ঘটনাটা বলেনি | আমি অফিস ক্যান্টিনে কফি খেতে ঢুকেছিলাম দুজন মহিলার চাপাস্বরে কথাবার্তা শুনেই বললাম | একটু খবর রেখো |
অনুষ্কার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে | এসব কথা তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে | চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে -' আপনি মিথ্যা' বলছেন | কিন্তু কিছুই করলোনা |
মাসি ও তার ছেলে যথাসময়ে পুণরায় লন্ডন চলে গেলো | কিন্তু ঋতমদা অনুষ্কার মনের ভিতরে ঢুকিয়ে গেলো এক বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন | অনিকের কোন ব্যবহার তার কাছে কোন প্রশ্নেরই উদ্দেক করেনা | কি করে তার কাছে এ কথাটা জানতে চাইবে? সে ঠিক করে অফিসে একটু খোঁজ করবে | কিন্তু এখান থেকে বেরোতে গেলে তাকে বাড়ির গাড়ি নিয়েই বেরোতে হবে | নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে সবথেকে বড় কথা ড্রাইভারদাদা যদি বাড়ির লোককে বলে দেয় ? | বিয়ের পর বাপের বাড়িতে গিয়ে সেরকম ভাবে থাকা হয়নি | ওখানে গিয়েই সে খবরটা নেবে | শ্বাশুড়িমাকে মায়ের কাছে যাবে বলাতে তিনি কোন আপত্তি করেননা | অনিকও না | আর শ্বশুরমশাই তো যে যা বলে বা করে তাতে তার কখনোই আপত্তি নেই | পরদিন অনিক অফিসে বেরোবার পথে অনুষ্কাকে তাদের বাড়ির গেটের কাছে নামিয়ে দিয়ে গেলো | কথা হল যেদিন তার ফিরতে ইচ্ছা করবে সেদিন ফোন করলেই অনিক এসে নিয়ে যাবে | অনিক বেরিয়ে গেলো | অনুষ্কা বাড়িতে না ঢুকে একটা সামনেই ট্যাক্সি পেয়ে তাতেই চড়ে বসলো গন্তব্য অনিকের অফিস | মনেমনে ভাবতে লাগলো কি করবে সে অফিসে গিয়ে ? গেলেই তো আর সবকিছু জানতে পারবেনা ?তবুও কিছু তো করতেই হবে | অফিসের বড় গেটের সামনে গিয়ে গাড়ি থেকে নেমে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো | অনেকেই তার দিকে তাকিয়ে দেখছে বলে সে ঘোমটাটা টেনে দেয় মাথার উপরে | কোথা থেকে যে বিকেল গড়িয়ে যায় খেয়ালই করেনা | অফিস ছুটি হয় অনুষ্কা দেখতে পায় অনিক একটি মেয়ের সাথে গল্প করতে করতে এসে গাড়িতে উঠে বসলো | আশেপাশে কোন ট্যাক্সিও নেই , উবের বুক করে ওদের ফলো করাও সম্ভব নয় ; গাড়ি তখন নাগালের বাইরে চলে যাবে | বিধস্ত শরীর ও মন নিয়ে সে একটা উবের বুক করে বাবা , মায়ের কাছে চলে আসে |
অনিককে উবেরে উঠেই ফোন করে | সে জানায় অফিসে কাজের চাপ থাকাই বেরোতে পারেনি | প্রথম ধাক্কাটা বেশ জোরেই আঘাত দেয় তার বুকে | সে বুঝতে পারে ঋতমদা যা বলেছে তা মিথ্যা নয় | পরদিন বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি বলে বিকালের ঠিক আগেই একটা ট্যাক্সির ভিতর অনিকের অফিসের সামনেই অনুষ্কা অপেক্ষা করতে থাকে | গতদিনের মত সেই একই সময়ে একই মহিলার সাথে অনিক গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দেয় | সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্কাও ড্রাইভারকে বলে গাড়িটিকে ফলো করতে | অনিকের গাড়িটা এসে একটা বড় ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে দাঁড়ায় | অনুষ্কা একটু দূরে গাড়িটিকে দাঁড় করায় | দুজনে গাড়ি থেকে নেমে লিফটের দিকে এগিয়ে যায় | অনুষ্কা থমকে দাঁড়িয়ে পরে |
রাতে অনিচ্ছা স্বর্তেও অনিকের কাছে জানতে চায় কখন অফিস থেকে বেরোলো --|
--- আরে আর বোলো না অফিস থেকে বেরিয়েই একটা ফোন আসে সাইটে যেতে হয় | সেখানে দুই শিফটে কাজ হচ্ছে | তাই ফিরতে একটু দেরি হয়ে গেলো | তুমি কবে আসবে ?
--- এখনই বলতে পারছিনা |
ফোনটা কেটে দেয় অনুষ্কা |
অনিকের কথার মধ্যে নেই কোন জড়তা | ফোনটা নামিয়ে রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পরে সে |
বাবা , মাকে সবকিছু জানায় | শুনে তারা তো পাথর হয়ে যান | আর মেয়েকে তারা শ্বশুরবাড়ি পাঠাবেন না বলে স্থির করেন | আবার তাকে নুতন করে পড়াশুনা করার উৎসাহ দিতে থাকেন | প্রথম অবস্থায় অনুষ্কা প্রচন্ড ভেঙ্গে পড়লেও পরে নিজেকে আস্তে আস্তে সামলে নেয় | ফোনে জানায় সবকথা শ্বাশুড়ীকে | তিনি শুনে স্তব্ধ হয়ে যান | একথাও বলে সে আর ওই বাড়িতে ফিরবেনা | সে কথারও তিনি কোন উত্তর করেননা | শ্বাশুড়ীকে বলার কয়েক ঘন্টা পরেই অনিক বেশ কয়েকবার ফোন করে অনুষ্কাকে | কিন্তু সে ফোন তোলেনা | ভাড়া বাড়ি ছিল অনুষ্কাদের তারা বাড়ি চেঞ্জ করে অন্যত্র উঠে যায় | কোন যোগাযোগ আর অনিকদের পরিবারের সাথে রাখে না | শ্বাশুড়ি একবার ফোন করে তাকে বলেছিলেন একবার সবাই মুখোমুখি বসে কথা বলতে | সে রাজি হয়নি | ঋতমদাকে ফোন করে ধন্যবাদ জানিয়েছে এ রকম বালির বাঁধের উপর ঘর নির্মাণের খবরটা তাকে দেওয়ার জন্য | মাসকয়েক পরে ডিভোর্সের কাগজপত্র পাঠিয়ে দেয় বাইপোষ্টে | শুরু করে নিজেকে তৈরী করতে |
বছর পাঁচেক বাদে শ্বশুরবাড়ির পরিচিত একজনের সাথে দেখা হয় | তার কাছেই জানতে পারে শ্বাশুড়িমা হার্টএটাকে মারা গেছেন | শ্বশুরমশাইও নার্সিংহোম যাওয়া বন্ধ করেছেন | এখন সামান্য যা রোগী দেখেন তা বাড়িতেই | সময় তার নিয়ম মেনেই এগিয়ে চলেছে | অনুষ্কা এখন এল আই সি তে কর্মরত | জীবনে কঠিনতম সিদ্ধান্ত নিতে সে এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করেনি | অনিককে সে সাক্ষাৎ শয়তানের প্রতিমূর্তিই মনে করে | একটা দুমুখো সাপ | চেহারা এবং ব্যবহার দেখে বোঝার উপায় নেই সে কতটা ভয়ঙ্কর| অফিস কলিগ শেখর তাকে খুব পছন্দ করে | সেও ডিভোর্সি | অনুষ্কারও যে তাকে ভালো লাগে না তা নয় ; কিন্তু সে নিজেকে সংসারের মাঝে আর জড়াতে চায় না | নিজের মত করে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায় | জীবনে সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারলে সংসার না করেও যে ভালো থাকা যায় অনুষ্কা সেটা ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছে | তাই আর কোন বন্ধন সে চায় না | স্বাধীনতার সুখ একবার যে পেয়েছে সে কি আর খাঁচায় বন্দি হতে চায় ?
No comments:
Post a Comment