কবিতা
অনেকদিন পর স্টেশনে নীলেশের সাথে দেখা কবিতার | ছোট্ট দুটি হাত ধরে কাঁধে একটি ব্যাগ ঝুলিয়ে নীলেশ প্লাটফর্ম দিয়ে এগিয়ে চলেছে | পাশাপাশিই হাঁটছিলো কবিতা | নীলেশের দিকে দৃষ্টি যেতেই কবিতা বলে ওঠে ,
--- এই নীলেশ , চিনতে পারছিস ?
নীলেশ দাঁড়িয়ে পরে কবিতার মুখের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে পরে --
--- আরে কবিতা - কেমন আছিস বল
--- চলে যাচ্ছে | এটা তোর মেয়ে বুঝি ? কি মিষ্টি দেখতে হয়েছে |
--- হ্যাঁ সবাই বলে ওকে ওর মায়ের মত দেখতে |
কবিতা কষ্ট হলেও মুখে হাসি এনে বলে ,
--- ওর মাকে দেখতে পারছি না , তুই মেয়েকে নিয়ে একা একা কোথায় চললি ?
কথা বলতে বলতে ওরা স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে এসছে তখন | নীলেশ কবিতার দিকে ফিরে বললো ,
--- বাড়ি যাবি তো একটা উবের বুক করে দিই ?
--- আমি এখন ফ্ল্যাটে থাকি | আমি বুক করে নেবো | যদি কিছু মনে না করিস তোর নম্বরটা দিতে পারিস আমায় |
নীলেশ কবিতার দিকে তাকিয়ে মানিব্যাগ থেকে কার্ডটা বের করতে করতে বলে ,
--- এভাবে বলছিস কেন পুরনো সব কথাগুলি আজও ধরে বসে আছিস ?
কবিতা নিচু হয়ে নীলেশের মেয়েটাকে আদর করে জানতে চাইলো ,
--- তোমার নাম কি সোনা ?
--- বাবাই তো আমাকে তিতলি বলে |
--- আর মা ?
তিতলি তার বাবার মুখের দিকে তাকালো | আর ঠিক সেই মুহূর্তেই নীলেশের মোবাইলে উবের ড্রাইভারের ফোন |
--- পারলে একদিন আমার বাড়িতে আসিস | তবে রবিবার করে আসবি | ঐদিন বাড়িতে পাবি আমায় |
কবিতা তার উবের বুক করতে করতে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো |
প্রায় একযুগ আগে কলেজ চত্বরে দুটো ছেলের মধ্যে প্রচন্ড হাতাহাতি , মারামারি | বাকি ছাত্রছাত্রীরা নীরব দর্শক মাত্র | কোথা থেকে হঠাৎ ছুঁটে এসে কবিতা দু'জনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পরে | দু'জনের মধ্যে মারামারির ভিতরে হঠাৎ একটি মেয়েকে দেখতে পেয়ে দু'জনেই কিছুটা দমে যায় | মেয়েটির মুখটি দু'জনেরই চেনা থাকলেও কথা কারও সাথেই ছিল না | একজন চিৎকার করে ওঠে ,
--- সরে যাও বলছিইই--
এরই মধ্যে দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু ছাত্রছাত্রী দু'দিক থেকে দু'জনকে সরিয়ে নিয়ে যায় | এই দুটি ছেলের মধ্যে একটি ছিল নীলেশ চৌধুরী | আর মেয়েটি ছিল কবিতা প্রামাণিক | কবিতা আর নীলেশ দু'জনে ভালো বন্ধু হয়ে যায় | বন্ধুত্বের গন্ডি পেরিয়ে যখন তারা কাছাকাছি আসতে শুরু করেছে ঠিক সেই মুহূর্তেই তৃতীয় বর্ষ চলাকালীন সময়েই নীলেশ চাকরি পেয়ে যায় রেলে | পড়ার ইতি টেনে চলে যায় তার কর্মস্থল ভুবনেশ্বর | যোগাযোগটা থেকে যায় ফোনে | কবিতার গ্রাজুয়েশন শেষ হলেই তারা নিজেদের বাড়িতে বিয়ের কথা জানাবে কথা হয় | সময় মত নীলেশ যখন তার বাবা , মাকে কবিতাকে বিয়ের কথা জানায় তারা বেঁকে বসেন শুধুমাত্র কবিতা নিচু ঘরের মেয়ে বলে | অনেক বুঝানোর চেষ্টা করে নীলেশ | কিন্তু তারা বুঝতে চাননি | রাগ করে বাড়িতে আসা বন্ধ করে | কবিতা সবকিছু শুনে বলে বাবা , মায়ের কথা শুনতে | যদিও কথাটা তার মনের কথা ছিলো না | ওটা ছিল তার মুখের কথা | কবিতা ও নীলেশ উভয়ই তাদের বাবা , মায়ের একই সন্তান | এ নিয়ে কবিতার সাথেও মান- অভিমান চলতে থাকে | মাসখানেক পরেই নীলেশের মায়ের হার্টএটাক হয় | ছুঁটে চলে আসে সে বাড়িতে | মৃত্যুর আগে মা তাকে জানিয়ে যান সে যেন তার পছন্দ করা মেয়েটিকেই বিয়ে করে তাতে তার আত্মা শান্তি পাবে | ছেলের হাতে পায়ে বেড়ি পরিয়ে তিনি চলে যান চিরতরে |
তারপর নীলেশ একবার ফোন করে কবিতাকে সব জানিয়েছিল | কবিতাও বুকে পাথর বেঁধে মায়ের শেষ অনুরোধ রাখতে অনুরোধ জানিয়েছিল | কেউ আর কখনোই যোগাযোগ করেনি | সেদিনই দু'জনের চলার পথ আলাদা হয়ে গেছিলো | সাত বছর পর আজ আবার দেখা দু'জনের | এক মুহুর্ত্ব সময় লাগেনি পরস্পরকে চিনতে | চলন্ত উবেরের ভিতর বসে কবিতা ফিরে গেলো সেই আগের দিনগুলিতে | ছেলেবেলাতেই মাকে হারিয়েছে সে | বাবা'ই তার কাছে মা বাবা দুইই | অভাব থাকলেও মেয়েকে সেটা লুকিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন সর্বদা | গ্রাজুয়েশন শেষ করে বিএড ট্রেনিং নিয়ে বছর দুয়েক অনেক চেষ্টা তদবির করে শেষে একটা প্রাইমারি স্কুলে জয়েন করতে পারে | বাবা কয়েকবার বিয়ের কথা বললেও সে এড়িয়েই যায় | বছর ছ'য়েক আগে তিনিও চলে যান নিউমোনিয়ায় | নিজেদের ছোট্ট ভাঙ্গাচোরা বাড়িটা বিক্রি করে সে এক কামরার একটা ফ্লাট কিনে শহরের দিকে চলে আসে স্কুলের যাতায়াতের সুবিধার্থে |
আর এদিকে নীলেশ তার মায়ের কথা রাখতে তার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করে মায়ের আত্মাকে শান্তি দিতে চেয়েছিলো | কিন্তু বিধাতা লিখেছিলেন কপালে অন্যকিছু | কন্যা সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের ফলে মারা যায় জয়া | ব্লাড নেওয়ার ক্ষমতাটুকুও তার ছিলো না | সেই থেকে আয়ার কাছে মানুষ নীলেশের আদরের তিতলি | ভালো নাম কঙ্কনা |
পরের শনিবার কবিতা ফোন করে নীলেশকে | জানতে পারে দু'দিন ধরে মেয়ের জ্বর তাই সে বাড়িতেই আছে | পরদিন কবিতা নীলেশের মেয়েকে দেখতে এসে জানতে চায় ,
--- তিতলির মাকে দেখতে পারছি না | ওকে এক্ষুণি জলপট্টি দিতে হবে তো | উনাকে ডাক |
নীলেশ চুপ করে আছে দেখে বয়ষ্ক আয়া সব ঘটনা কবিতাকে জানায় | আয়া মাসির কথা শুরু হতেই নীলেশ ঘর থেকে বেরিয়ে যায় | মাসি নিজেই জলপট্টি দেওয়ার তোড়জোড় করছিলেন | কবিতা তার হাত থেকে নিয়ে নিজেই কাজটি করে যায় | নীলেশ ডাক্তারকে ফোন করায় তিনি জানান বিকালের মধ্যে জ্বর রেমিশন না হলে তাকে যেন হাসপাতাল ভর্তি করা হয় | নীলেশ খুব ভেঙে পড়ে| কবিতার তদারকিতে বিকালের অনেক আগে থাকতেই তিতলির ঘাম দিয়ে জ্বর কমে যায় | যতবার নীলেশ তাকে খাবারের জন্য ডাকতে এসেছে ততবারই সে এককথা বলেছে ,
--- আগে ওর জ্বরটা কমুক পরে খাবো | অগত্যা নীলেশেরও খাওয়া হয় না | ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে থাকতে থাকতে একসময় সে সেখানেই শুয়ে ঘুমিয়ে পরে | বিকালের দিকে ঘুম ভাঙলে নিজের ঘরে ঢুকে দেখে তিতলি আর কবিতা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে | এ দৃশ্য দেখে তার মনটা ভালো হয়ে যায় | মাসি আর সে ছাড়া আর কেউ কখনোই তিতলিকে এতো স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেয়নি |
সন্ধ্যার দিকে তিতলি বেশ চনমনে হয়ে যায় | কবিতা তার ফ্ল্যাটে ফিরতে চায় | কিন্তু তিতলি তার আঁচল জড়িয়ে বলে ,
--- না , তুমি যাবে না | রাতে তোমার কাছে আমি খাবো , ঘুমাবো | তুমি কাছে থাকলে আমার খুব ভালো লাগছে | আচ্ছা তোমায় আমি কি বলে ডাকবো ?
--- যা তোমার খুশি
কবিতা তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
এরপর তিতলি বাবার দিকে তাকিয়ে বলে ,
--- আচ্ছা বাবা , তুমি তো আমায় বলো আমি বড় হলে হঠাৎ একদিন আমার মা এসে যাবে | তবে কি আমি বড় হয়ে গেছি তাই মা আমার কাছে এসে গেছে ?
মাসি , নীলেশ , কবিতা সকলেই চুপ করে যায় | মাসি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে ," আমি একটু চা , জলখাবার করি | তোমরা দু'জনেই তো না খেয়ে আছো " মাসি বেরিয়ে যায় | নীলেশ কবিতার দিকে তাকিয়ে বলে ,
--- তুই মেসোমশাইকে একটা ফোন করে দে ; আজ এখানেই থেকে যাবি |
কবিতা নীলেশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে ,
--- বাবা আজ বছর ছ'য়েক হল আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন | বাড়িটা বিক্রি করে সন্তোষপুর স্টেশন লাগোয়া একটা ফ্লাট কিনেছি | একাই থাকি | একটা প্রাইমারী স্কুলে পড়াই |
--- তাহলে তো তোর থাকার কোন অসুবিধা নেই | আজ রাতটা থেকেই যা | তিতলি যখন এতো করে বলছে |
--- সত্যি করে বলতো নীলেশ শুধু কি তিতলি বলছে বলেই থাকতে বলছিস ? তোর নিজের কোন ইচ্ছা নেই ?
--- অনেক কথাই তো জীবনে বলা হয়ে ওঠে না | আমার জীবনের সব কথা জানার যার সব থেকে আগে অধিকার ছিল তার সাথেই তো কোন সম্পর্ক ছিলো না | আজ মনেহচ্ছে সবই বুঝি ঈশ্বরের লীলা | তানাহলে আমার এই পরিস্থিতিতে তোর সাথে হঠাৎ দেখা হবে কেন ?
তিতলি এতক্ষণ কবিতার হাঁটুর উপর শুয়ে ছিল | এবার উঠে সে কবিতাকে দু'হাতে জড়িয়ে ধরে বললো ,
--- বাবা তো বললো না তোমায় কি বলে ডাকবো ? কিন্তু আমি মনেমনে ঠিক করেছি তোমায় মা বলেই ডাকবো |
নীলেশ ও কবিতা দু'জন দু'জনের মুখের দিকে তাকিয়ে পড়লো | আর নীলেশ বলে উঠলো ,
--- আমার মনের কথাটা তিতলি বলে দিয়ে আমাকে রিলিফ দিয়েছে | কবিতা , তোমার আপত্তি নেই তো ?
আজ তিতলির ভায়ের অন্নপ্রাশন | তিতলি খুব খুশি তার পুতুলের মত এই ভাইটাকে পেয়ে | কবিতা তার চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে | দুই দু'টো বাচ্চাকে নিয়ে সে এখন এক মুহুর্ত্ব সময় পায় না | তবে তার সারাদিনের পরিশ্রম জল হয়ে যায় রাতে নীলেশের বুকে মাথা রাখলে।
#মানবী
No comments:
Post a Comment