সুখের ঘরে আগুন ( সপ্তম পর্ব )
নিলয় তার বোনের মুখের দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো ,
--- বলবো মিতা তোকেই সব বলবো | তবে আমাকে একটু সময় দে | বিয়েটা মিটে যাক | দাদার বিয়ের আনন্দটা করে নে | আমার কপালে যা আছে হবে |
--- তুই কি বলছিস দাদা ?
--- আসলে কি জানিস বোন ? সংসারে বাবা মায়ের একটা সন্তান হওয়া ভীষণ জ্বালা | অবশ্য সে সন্তানের যদি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা , ভালোবাসা থাকে | অনেক সন্তান আছে যারা তাদের বাবা , মায়ের কথা না ভেবেই নিজেদের সুখের কথা শুধু ভাবে | হয়ত একের বেশি ভাইবোন কেউ বাড়িতে থাকলে কেউ কেউ ভাবতেই পারে আমাকে দিয়ে বাবা , মায়ের যে শখ পূরণ হয়নি তা অন্যকে দিয়ে হবে | কিন্তু একমাত্র সন্তান হলে তাকে আগেপিছে অনেককিছু ভাবতে হয় | বিয়ের এই শেষ মুহূর্তে এসে মনেহচ্ছে এটা বিয়ে নয় বিয়ে বিয়ে খেলা হচ্ছে ; আর আমি এই বিয়ের বলির পাঠা | চারিপাশ থেকে আমার হাত পা সব বেঁধে রেখেছে পরিবারের মানসম্মান | আমি এই মুহূর্তে বড্ড অসহায় |
--- একটু খুলে বলনা , কিছুই বুঝতে পারছিনা |
--- সব জানতে পারবি মাত্র দুটো দিন অপেক্ষা কর | তোকেই সব বলবো | কারণ রিতেশকে আমার দরকার | তাই উকিলবাবুকে বলার আগে তোকে আগে বলা উচিত বলে আমি মনেকরি | রিতেশের মুখ থেকে সব শোনার আগে আমার মুখ থেকেই তোর শোনা ভালো | তা নাহলে তো আবার দাদার পরে রেগে যাবি |
কথাগুলো বলে নিলয় একটু মৃদু হাসলো | এরইমধ্যে প্রমিতার স্বামী রিতেশ এসে ঘরে ঢুকলো |
--- কি শলাপরামর্শ হচ্ছে ভাইবোনের শালিনীর বাড়ি থেকে ফিরে ?
প্রমিতা স্বামীর দিকে ফিরে একটু অভিমান মিশ্রিত গলায় বলে উঠলো ,
--- দেখ নাগো গো দাদা আজ এই শুভদিনে কিসব আবোলতাবোল বকছে |
--- কেন কি হয়েছে শালাবাবু ?
--- বলবো রিতেশ দুটো দিন সময় দাও | বিয়েটা মিটে যাক |
--- যা বলেছো --- এই বিয়ের আনন্দের মধ্যে খারাপ খবর শুনতে একদম ভালো লাগবেনা |
স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে তারপর বললো ,
--- শোনো মিত শালাবাবু এখন কিছু বলবেনা যখন এই নিয়ে ওকে পীড়াপীড়ি না করায় ভালো | আজ সে একটা নুতন জীবন শুরু করতে চলেছে ; আজকের দিনে আমরা তো বটেই ওর নিজের মনটাও খারাপ হয়ে যাবে কোন খারাপ খবর আমাদের শুনাতে গেলে | তার থেকে আমরা বরং বিয়ের মজাটা লুটেপুটে নিই আর শালাবাবু শালিনীর চিন্তায় মশগুল থাকুক |
কথাগুলো বলে রিতেশ একাই হোহো করে হাসতে থাকে | প্রমিতার মুখটা গম্ভীর থাকলেও রিতেশের অট্টহাসি দেখে নিলয় কষ্ট করে হলেও ঠোঁটের এককোনে এক চিলতে হাসি ধরে রাখে |
দুপুরের খাবার পাট চুকে যায় | প্রমিতা যদিও তার দাদার জন্য সকলকে লুকিয়ে খাবার এনেছিল নিলয় তা খায়নি | কারণ ভোররাতে মা নিজের হাতে দই দিয়ে খৈ মাখা একথালা খাইয়ে দিয়েছেন যা তার হজম হয়নি | সকালেই একটা এন্টাসিডও খেয়েছে | গোধূলি লগ্নে বিয়ে | খেয়ে উঠেই বেরোনোর জন্য সবাই সাজতে শুরু করে দিলো | রিতেশ আর প্রমিতা নিলয়কে তৈরী হতে সাহায্য করলো | বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে শুরু হল আবার একপ্রস্থ আশীর্বাদের পালা | এবার রিতেশ খুবই বিরক্ত হতে শুরু করলো | এইসব নিয়মকানুন মেনে বিয়ে করলে যদি সত্যিই সুখী হওয়া যেত তাহলে নারী পুরুষের জীবনে এতো অশান্তি আর ডিভোর্স থাকতোনা | অনেকে তো পালিয়ে গিয়েও বিয়ে করে তারা তো কোন আচারানুষ্ঠান করেনা | তারা কি সুখী হয়না ? আসলে জীবনে সুখী হতে গেলে এইসব আচারানুষ্ঠান নয় প্রয়োজন শুধুমাত্র দুটি মানুষের মনের মিল | বিয়ের ওই মন্ত্রটা শুধু মুখের বলাই নয় যদি দুটি নরনারী একের হৃদয় দিয়ে অন্যের হৃদিকে জয় করতে পারে তবেই তারা প্রকৃত সুখী হতে পারে | নিলয় মনেমনে ভাবে আজও বিয়ের আসরে বারবার উচ্চারিত হবে " যদিদং হৃদয়ং মম , তদস্তু হৃদয়ং তব"- কিন্তু এই বিয়েতে তো কেউ কারও হৃদয় কেউ কাউকেই দেবোনা --- তবুও কেন এ নিয়ম ?
শাস্ত্র রীতি মেনে মাকে হাতের তিনমুঠ চাল তুলে দিলো নিলয় | মা ও তার কিছুটা ভাঁজ করা হাতের পাতায় দুধ ঢেলে দিলো যা তার কনুই দিয়ে গড়িয়ে পড়লো | ছেলে বিয়ে করতে চলে যাওয়ার পর ওই দুধ আর চাল ফুটিয়ে মাকে খেতে হবে --- আদিকাল থেকে চলে আসছে এ রীতি | নিলয় মায়ের কথামত সব কাজগুলো করে উঠে দাঁড়ালো | পাশ থেকে তার বাবা বললেন ,
--- মাকে প্রণাম করো |
নিলয় মনেমনে হাসলো | মা আবার আশীর্বাদ করবেন ," সুখী হইও"- | কিন্তু তার জীবনের এ বিয়ে কি সুখ এনে দিতে পারবে? মুখে কিছু না বলে সে নিচু হয়ে মাকে প্রণাম করে পরে বাবাকেও | সারাটা রাস্তা নিলয় ভাবতে ভাবতে চললো - স্বইচ্ছায় সং সেজে সন্তান হিসাবে বাবা , মায়ের সম্মান রাখতে আরও কিছু মানুষকে স্বাক্ষী রেখে নিজেই চললো কড়িকাঠে গলা দিতে | ভাগ্যের কি পরিহাস ! বড় জোতিষির ন্যায় আজ সে নিজের ভবিৎষত নিজেই দেখতে পাচ্ছে |
বিয়ে বাড়িতে অনেকেই তাকে ঘিরে ঠাট্টা , ইয়ার্কি করে চলেছে | কিন্তু ভীষণ রকম চুপচাপ নিলয় | ছাদনাতলায় ঠিক শুভদৃষ্টি বলতে যা বোঝায় তা শালিনী আর নিলয়ের হলনা | কেউই কারো দিকে ভালো করে তাকালোনা | বিয়ের আচারানুষ্ঠান চলছে মাঝে মাঝে নিলয় কেউ না শোনে এমনভাবে ঠাকুরমশাইকে বলে চলেছে " একটু কাটছাট করে তাড়াতাড়ি ছাড়ুন ঠাকুরমশাই |" কিন্তু কে শোনে কার কথা ? এ যেন তেত্রিশ কোটি দেবতার পুজো হয়ে চলেছে | মন্ত্র ঠাকুর মশাইয়ের যেন শেষই হয়না | অনেকেই অধর্য্য হয়ে বিয়ের মন্ডব ছেড়ে চলে গেছে | গুটিকয়েক বসে আছে হয়তো তারা খুব নিকট আত্মীয়ই হবেন | একসময় সিঁদুর দানও শেষ হল | সিঁদুর দানের সময়ও নিলয় ভালো করে শালিনীর মুখটা দেখেনি | মনের বিরুদ্ধে গিয়ে সম্পূর্ণ বাধ্য হয়ে সে বিয়েটা করতে বাধ্য হয়েছে | সিঁদুর দানের সময় প্রমিতা তার দাদাকে বারবার বলেছে ,
--- দাদা মুখটার দিকে একবার তাকিয়ে সিঁথিটা দেখে নে ---
না নিলয় খুব বিরক্তভাবেই উত্তর দিয়েছে ,
--- তুই আমার হাতটা ধরে থাক | তাতেই হবে |
কথাটা কানে গেলো শালিনীর | সে একটু বাঁকা দৃষ্টিতে নিলয়ের দিকে তাকালো তার মুখটাও বিরক্তিতে পরিপূর্ণ | এখনো পর্যন্ত নিলয় এবং শালিনীর মধ্যে কোন কথাই হয়নি | শালিনীর মনে এক দ্বন্দ্ব আর নিলয়ের মনে জীবনের স্বপ্ন ভঙ্গের কষ্ট | সে মনেমনে যাই ঠিক করুকনা কেন পরবর্তীতে যে পরিবারের মধ্যে একটা ঝড় উঠবে সেটা তো নিশ্চিত | এখন সে বাবা,মায়ের সম্মানের কথা ভেবে বিয়েটা করলেও পরবর্তীতে তারা তো সবই জানতে পারবেন কষ্টও কম পাবেননা | ছেলে সংসার করতে না পারার কষ্ঠটা তো তাদের হবেই | শালিনী বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে বাবা,মায়ের সম্মান নষ্ট হবে | হয়তো এখনকার চেয়ে একটু কমই হবে --- কিন্তু তবুও তো হবে |
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment