আজ বারবার করে রবীন্দ্রসংগীতের একটা কলি মনেহচ্ছে অনিন্দিতার |"যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙ্গলো ঝড়ে-" কবিগুরু যতগুলি গান লিখেছেন তার প্রতিটাই কোন না কোন সময়ে কোন না কোন মানুষের মনের কথা হয়ে বেজে উঠেছে | কি দুঃখে , কি আনন্দে ,কি অভিমানে - কি অদ্ভুত এক ক্ষমতাই বিষয় বিশেষে মানুষের মনের কথাগুলো নিংড়ে বের করে এনেছেন |
বাড়ির দক্ষিণদিকের ঘরটা ছিল বড় মেয়ে অনিন্দিতার | ঘর সমান লম্বা বড় ব্যালকনি | একটা বেতের দোলনা ঝুলানো | দোলনাটা তাকে মামা একবার জন্মদিনে গিফট করেছিলেন | সুযোগ পেলেই ব্যালকনিতে এসে দোলনায় বসে থাকতো অনিন্দিতা | ভাই প্রায় নবছরের ছোট তার থেকে | বাবা একজন রেলকর্মচারী | নিজে পছন্দ করে অনিন্দিতার বিয়ে দেন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকুরীরত ছেলের সাথে | ইন্দ্রনীল ভীষণ ভালো ছেলে | তারা দুই ভাই | ইন্দ্রনীলই বড় | রুদ্রনীল ছোট | রুদ্রনীল কেদ্রীয় সরকারের অধীনে সার্ভে অফ ইন্ডিয়ায় কর্মরত | নিজেরদের বাড়ি | তাদের বাবা মারা গেছেন বছর তিনেক | বিধবা মা পেনশনভোগী | বাবার মৃত্যুর আগেই ইন্দ্রনীল চাকরি পেয়ে গেছিলো | রুদ্রনীল এই বছর খানেক হল জয়েন করেছে | তবে তাকে মাঝে মাঝে অফিসের কাজে বাইরে যেতে হয় | অবশ্যই তা ভারতবর্ষের মধ্যে |
ইন্দ্রনীলের সাথে বিয়ের পর তারা সিমলা হানিমুন করে ফিরে এসে তার দুদিন পরেই ইন্দ্র অফিসে জয়েন করে | দিন পনের পরে একদিন ফোন করে অনিন্দিতাকে বলে , রেডি হয়ে থাকবে , আমি ফিরে তোমায় নিয়ে বেরোবো | মাকে বলে রাখবে আমরা হোটেল থেকে খাবার নিয়েই ফিরবো | বাড়িতে রান্নার ঝামেলা করতে হবেনা আজ | বিয়ে হয়েছে মাত্র মাসখানেক | বিধবা মাসি এখনো বাড়ি ফিরে যাননি | তার আবার ছেলের সংসার | বৌমাটি দিনরাত তাকে দিয়ে কাজ করায় | তাই মাসি কালেভদ্রে যখনই আসেন মাসতিনেক বোনের কাছে থাকার অলিখিত চুক্তিতেই আসেন | ইন্দ্রের মা ও তাতে বেশ খুশিই হন | দিদির সাথে দিনরাত বকরবকর করে বেশ আনন্দেই থাকেন | ইন্দ্র বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসবে শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বোনকে বললেন ,
--- তোর জামাইবাবু যখন বেঁচে ছিলেন আর প্রীতমটাও ছোট ছিল তখন মাঝে মধ্যেই খাবার কিনে সন্ধ্যার আগেই বাড়িতে ঢুকে বলতো " আজ আর রান্নাঘরে তোমায় ঢুকতে হবেনা | গল্প করেই আমরা আজ সময় কাটিয়ে দেবো | রাতে খাবারটা গরম আমিই করে নেবো | তোমার আজ ছুটি | সেসব দিন আর ফিরে আসবেনা | এখন প্রীতম তার বৌ , বাচ্চা নিয়ে মাঝে মধ্যেই বাইরে থেকে খেয়ে আসে | কিন্তু আমার জন্য আনেনা | সেদিন আর আমি রান্নাঘরে ঢুকি না | ওই চিড়ে ,মুড়ি খেয়ে রাতটা কাটিয়ে দিই |
--- দিদি , খারাপ স্মৃতিগুলি কখনোই মনে করবিনা | তাতে কষ্ট বেশি পাবি | জীবনের সুখস্মৃতিগুলিই সবসময় মনে করার চেষ্টা করবি | দেখবি শরীর মন দুইই ভালো থাকবে |
সেদিন সন্ধ্যা হতেই অনিন্দিতা সেজেগুজে ইন্দ্রের অপেক্ষায় বসে | আস্তে আস্তে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যেতে থাকে | প্রথমে অভিমান পরে রাগ সবশেষে বাড়ির প্রত্যেকটা প্রাণীর উৎকণ্ঠা বেড়ে চললো | সকলেই ঘরবার করছে | ফোনের সুইচ অফ | দিশেহারা অবস্থা প্রতিটা মানুষের | রুদ্র দাদাকে খুঁজতে রাস্তায় | কিন্তু কোথায় খুঁজবে তাকে | রাত তখন দশটা | এক বন্ধুর পরামর্শে তারা লোকাল থানায় ঢুকলো | থানায় ঢুকতে গিয়েই তারা সাদা কাপড়ে ঢাকা একটি লাশ দেখতে পেলো | ইন্দ্রের বুকের ভিতরটা ছ্যাৎ করে উঠলেও সে কল্পনাও করেনি ---- |
বডি মর্গে চলে গেলো | বাড়ি থেকে বহুবার ফোনের জবাবে সে একটি কথাই বারবার বলেছে ," এসে সব বলছি |" খবর শুনে অনিন্দিতা মাথা ঘুরে পরে গেলো | তার বাপেরবাড়ির লোকেরা এসে হাজির হল | মা , মাসি শোকে পাথর | ইন্দ্র রাস্তা ক্রস করতে গিয়ে বাসের তলায় পুরো পিষে যায় | বড় রাস্তায় নেমে রাস্তা পার হয়ে অটো ধরে তবে তাদের বাড়িতে আসতে হয় | কাজ শেষ হওয়ার পরেই অনিন্দিতাকে তার বাবা , মা তাদের কাছে নিয়ে আসেন | পরের মাসেই জানতে পারে সে প্রেগন্যান্ট | নূতনভাবে জীবন শুরু করবার জন্য বাড়ির লোক তাকে এবরশন করিয়ে ফেলতে বলে | কিন্তু সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে বলে ," এ আমার ভালোবাসার সন্তান , ইন্দ্রের শেষ স্মৃতিচিহ্ন , ওকে কিছুতেই আমি নষ্ট করতে পারবোনা |"
ব্যালকনিতে বসে হানিমুনের পনেরদিনের সব মনে পড়ছে অনিন্দিতার | আজ এই খবরে সব থেকে খুশি হত সে | শ্বাশুড়ি জানতে পেরে তাকে তার কাছে নিয়ে যেতে চান | কিন্তু অনিন্দিতার মা রাজি হননা | মাঝে মাঝে তিনি , তার দিদি , আর রুদ্র এসে দেখা করে যায় | দেখতে দেখতে দশমাস দশদিন অতিক্রান্ত | অনিন্দিতা নার্সিংহোম যাচ্ছে | শ্বাশুড়ীকে ফোন করা হল | ইভাদেবী ছুঁটে গিয়ে ঘুমন্ত ছেলেকে ডেকে তুলে বললেন , " আমায় এক্ষুণি নার্সিংহোম নিয়ে চল | বৌমাকে ভর্তি করানোর আগেই আমাকে পৌঁছাতে হবে |
--- হ্যাঁ সে নিয়ে যাচ্ছি | কিন্তু বৌদিকে ভর্তি করার আগেই তোমায় যেতে হবে কেন ?
--- যেতে যেতে সব বলবো |
ইভাদেবী ও রুদ্র যখন পৌছালো তখন অনিন্দিতাকে লেবাররুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে | রুদ্র ছুঁটে গেলো ফর্মফিলাপ করতে | কারণ মাকে সে কথা দিয়েছে ----| রুদ্র ওদিকে আইনি কাজকর্মে ব্যস্ত আর এদিকে ইভাদেবী দুহাত জড়ো করে তার বেয়াই , বেয়ানের কাছে তার ছোটছেলে ও অনিন্দিতার দুহাত এক করার অনুরোধ নিয়ে আকুল হয়ে কেঁদে চলেছেন |
রুদ্র অনিন্দিতার স্বামীর নামের জায়গায় নিজের নামটাই লিখলো কারণ মা উবেরের ভিতর তার হাতটা মাথায় রেখে মায়ের কথা শোনার জন্য কথা আদায় করে নিয়েছিলেন | যথাসময়ে অনিন্দিতা একটি ফুটফুটে মেয়ের জন্ম দেয় | যেদিন সে নার্সিংহোম থেকে ছাড়া পায় দুই পরিবারের সব সদস্যরাই উপস্থিত | অনিন্দিতা তার নিজের মায়ের কাছে আগেই সব শুনেছিলো | হ্যাঁ বা না কোন উত্তরই সে দিয়েছিলো না | শুধু চোখ থেকে অনর্গল জল পরে গেছিলো | কেবিনের ভিতরেই ইভাদেবী সিঁদুরের কৌটোটা রুদ্রের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন , " নে অনিন্দিতাকে আপন করে নে , আমি আজ জোড়া লক্ষীকে নিয়ে বাড়ি যাবো |" তারপর অনিন্দিতার দিকে তাকিয়ে বলেন , " বৌমা আমি আমার এক ছেলেকে চিরজীবনের মত হারিয়েছি | কিন্তু আমার মেয়ে আর নাতনীকে হারাতে পারবো না | আজ থেকে তুই আমার মেয়ে | আমার এই সিদ্ধান্তে নিশ্চয় তোর আপত্তি নেই? তুই সুখী হবি মা | অমত করিস না |
ইভাদেবী জোড়া লক্ষী নিয়ে শাঁখ উলুধ্বনি সহযোগে বাড়ি ফিরলেন | দিদিকে সেই থেকে তিনি তার নিজের কাছেই রেখে দিয়েছেন |রাতে দিদিকে জড়িয়ে ধরে বললেন ," ভাগ্যিস তুই ছিলি দিদি | তুই আমাকে এভাবে বুঝিয়ে না বললে আমার মাথায় তো এ কথা আসতোই না | মাঝখান থেকে অনিন্দিতার জীবনটাই শেষ হয়ে যেত | দিদি , তুই আর কিছুদিন থেকে যা | আঁতুরটা উঠে যাক আমরা ওদের বিয়েটা রেজিস্ট্রি করে কিছু আত্মীয়স্বজনকে ডেকে জানিয়ে দেবো |
No comments:
Post a Comment