প্রথম ভালোবাসা
সব ভালোবাসা বিয়ে পর্যন্ত গড়ায় না | সেই মুহূর্তে বুকটা ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেলেও নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছি --- সেই প্রথম ভালোবাসায় মনের মধ্যে গেঁথে থাকে আজীবন | যাকিছু আমরা পাই না তারপ্রতি আগ্রহ আর অনুশোচনা আমাদের সারাটাজীবন | নিজের করে না পাওয়া ভালোবাসা নিয়ে মরনের পূর্ব পর্যন্ত আমার মত হয়তো অনেকেই স্বর্গ রচনা করে চলে তবে তা সমুদ্র পারে বালি দিয়ে শিল্পকর্ম রচনার মত | সমুদ্র পারে বসে যখন কোন শিল্পী তার শিল্পকর্ম সম্পন্ন করেন কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তা ঢেউয়ের প্রকোপে ভেঙ্গেচুরে ভাসিয়ে নিয়ে যায় | আর নির্জন একাকী বসে চোখ বুঝে না পাওয়া ভালোবাসার যে স্বর্গ রচনা করা হয় তা তছনছ হয়ে যায় কারও পদশব্দে | মন তো সবথেকে দ্রুতগামী যান | মুহূর্তের মাঝেই কোথায় যেন সবকিছু পালিয়ে যায় |
ভালোবাসতাম খুব ভালোবাসতাম রঞ্জিতকে | রঞ্জিতও আমায় খুব ভালোবাসতো | রঞ্জিত গ্রামের ছেলে | পেয়িংগেস্ট হিসাবে আমাদের বাড়িতেই থাকতো | আমরা নিচুরতলায় থাকতাম আর রঞ্জিতকে থাকতে দেওয়া হয়েছিল ছাদের উপরে একখানা ঘরে | বাবা কয়েকমাস আগেই মারা গেছেন | আর্থিক দিক থেকে তখন অনেকটাই আমাদের পরিবারটা পিছিয়ে পড়েছে | তাই বাধ্য হয়েই আমার থাকার ঘরটা কিছু টাকার বিনিময়ে রঞ্জিতকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে | আমি নিচুতে মায়ের কাছে নেমে এসেছি | দাদা নিচুতে তার ঘরটাতেই পূর্বের মত আছে | আমরা মেয়েরা জীবনের অধিকাংশ সময়ই শুধু ত্যাগ স্বীকার করেই জীবন কাটিয়ে দিই | অনেক পরিবারেই আজও ছেলেমেয়েদের মধ্যে পার্থক্যটা থেকেই গেছে | ছেলেরা বড় মাছের পিসটা খাবে , আগে ঘুমাবে, দেরিতে উঠবে , তাদের বড় অন্যায়গুলিকে ছোট করে দেখা হবে আর মেয়েদের বেলায় হবে ঠিক তার উল্টোটা |
দাদা তখন একাউন্টসটেন্সিতে অনার্স করছে | আমার ফাষ্টইয়ার আর রঞ্জিতের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে দ্বিতীয় বর্ষ | ছেলেবেলা থেকেই আমি ফুলফলের গাছ খুব ভালোবাসি | তাই ছাদে ছোট থাকতেই বাবা টবে গাছ লাগিয়ে একটা ছোট বাগান করে দিয়েছিলেন | এখন সে বাগান ফুলেফলে ভর্তি আর আস্তে আস্তে বাগান বড়োও হয়েছে | সকালে কলেজের তাড়া থাকাই ফুলফলগুলিকে দেখতে গেলেও জল দিই সেই কলেজ থেকে ফিরে | কোনো কোন দিন সন্ধ্যাও হয়ে যায় | রঞ্জিত আসার পর থেকেই সে আমার গাছগুলির যত্ন করতে থাকে | কোন গাছে কি সার দিতে হবে , কখন গাছে বিষ দিতে হবে এগুলো রঞ্জিতের নখদর্পনে | আসলে সেতো গ্রামের ছেলে | বাবার প্রচুর জমিজমা | রঞ্জিতের বাবা নিজের হাতে চাষ করেন সেসব জমিতে | তাই রঞ্জিতের এগুলো জানা স্বাভাবিক | ও গাছগুলির এমনভাবে যত্ন করে মনেহয় ও যেন তাদের সাথে কথা বলছে | আস্তে আস্তে রঞ্জিতের সাথে আমার বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো | সেই বন্ধুত্ব কখন যে ভালোবাসায় পরিণত হল তা বোধকরি নিজেরাও বুঝতে পারিনি | স্বভাবতই ছাদে গেলে এখন একটু দেরি করেই নামি | মায়ের চোখে সেটা না লাগলেও দাদা ঠিক এটাকে ভালোভাবে নিতোনা | এই নিয়ে সে বেশ কয়েকবার আমার সাথে ঝামেলাও করেছে | এবং সে ঠিক মাকেও ব্যাপারটা বুঝিয়ে ফেলেছে | রঞ্জিতের খাবার এখন মা ই উপরে দিয়ে আসেন আগে যদিও সে নিচুতে এসে খেত কিন্তু দাদার কথায় মা এ ব্যবস্থাই করেন | কিন্তু তবুও সুযোগ পেলেই দাদা বাড়িতে না থাকলে তখন যদি মা কোন কাজে ব্যস্ত থাকতেন তখন ঠিক সুযোগ করে আমি উপরে চলে যেতাম | বেশ কয়েকবার মায়ের কাছে ধরাও পড়েছি | প্রতিবারই একই উত্তর দিয়েছি ," আমি গাছ দেখতে গেছিলাম বা কখনো বলেছি গাছে জল দিচ্ছি |"
দাদা তারপর থেকে রঞ্জিতজে একদমই পছন্দ করতো না | রঞ্জিত ছিল খুব সরল-সাদা ছেলে | মায়ের এবং দাদার এই অবহেলা সে একদমই মেনে নিতে পারছিলোনা | একদিন আমায় ছাদে দেখতে পেয়ে বললো ,
-- রুপা , এখানে আর থাকাটা আমার সম্মানের হবে না | আমি অন্য কোথাও চলে যাবো ভাবছি | আমি তোমায় খুব ভালোবেসে ফেলেছি | কিন্তু কি জানো? আমার এডুকেশন শেষ হতে এখনো বছর খানেক | কবে চাকরি পাবো আদতেই পাবো কিনা জানি না | আমি এখান থেকে চলে গেলেও আমার মনে তুমি রয়ে যাবে আজীবন | আমি সারাজীবন তোমার অপেক্ষায় থাকবো | চাকরি পেয়ে গেলে যেভাবে পারি তোমায় খবর দেবো -- আমি এই বাড়িতেই এসে মাসিমা আর দাদাকে প্রণাম করতে আসবো | তুমি কি আমার অপেক্ষায় থাকবে ?
চোখ থেকে তখন আমার অঝোরধারায় জল পড়ছে | কি উত্তর দেবো আমার জানা ছিলোনা | রঞ্জিত আস্তে আস্তে আমার কাছে এগিয়ে আসলো | ডানহাত দিয়ে মুখটা তুলে চোখদুটো মুছিয়ে দিয়ে বললো ,
--- আমার সব প্রশ্নের উত্তর তোমার এই চোখের জলই দিয়ে দিয়েছে |
আমার তখন ইচ্ছা করছে রঞ্জিতের বুকে মাথা রেখে একটু কাঁদি , দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরি --- আমার মনের কথাটা হয়তো কিছুটা বুঝতে পেরেছিলো সে | ও হঠাৎই আমায় দুহাতে কাছে টেনে নেয় | আলতো করে আমার ঠোঁটদুটোর ওপর নিজের ঠোঁটদুটো নামিয়ে আনে | অদ্ভুত এক অনুভূতিতে সমস্ত শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে | জীবনের প্রথম ভালোবাসার প্রথম স্পর্শ |
এই ঘটনার দুদিন পরেই রঞ্জিত আমাদের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যায় | তখন মুঠোফোনের কোন চল ছিলোনা | তাই রঞ্জিতের সাথে কোন যোগাযোগও ছিলোনা | চিঠি লেখার ব্যাপারটা ছিল দূরহস্ত | দাদা আর মা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন | চেষ্টা করেছিলাম কলেজে গিয়ে খবর নিতে কিন্তু কিছুতেই সম্ভব হয়ে ওঠেনি | আমার এক বন্ধুর মারফৎ জানতে পারলাম দাদা নাকি চুটিয়ে প্রেম করছে | কি অদ্ভুত নিজের পরিবারের মানুষগুলো হয় ! যে কাজ পরিবারের ছেলে করছে তাতে কোন দোষ নেই | মেয়ে করলেই যত দোষ ! এই ছেলেমেয়ের প্রভেদটা আজও কোন কোন পরিবারে রয়েই গেছে | দাদাকে সরাসরি গিয়ে একদিন প্রশ্ন করলাম ,
--- তুই যে প্রেম করছিস মা জানে ?
দাদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সটান উত্তর দিলো ,
-- না জানার কি আছে ?
--- তাহলে দোষটা আমার বেলায় ? কারণ আমি মেয়ে আর তুই ছেলে --|
দাদার সাথে এই নিয়ে বেশ কথা কাটাকাটি হয় | ফলস্বরূপ আমার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলেই বিয়ের সম্মন্ধ পাকা | চিৎকার, চেঁচামেচি, না খেয়ে থাকা --- সবই করেছিলাম কিন্তু সেই আত্মবলিদান মায়ের ইমোশনের কাছে হার স্বীকার করে বিয়ের পিঁড়িতে বসতেই হল | পরিবারে মেয়ে হয়ে জন্মানোর অপরাধে আর একবার জীবনের চরম পরাজয় মেনে নিলাম !
কলকাতা থেকে চলে এলাম শিলিগুড়ি | বিয়ের পর একবারই সেই জোড় খুলতে গেছিলাম বাড়ি | আর যাইনি তবে সেটা অভিমান বশত | দাদার বিয়েতেও নয় | শরীর খারাপের অজুহাতে মনীশ আর ওর বোনকে দামি গিফ্ট দিয়ে পাঠিয়েছিলাম |
মেয়ের মুখে ভাতের সময় দাদা এসেছিলো | তখন অবশ্য তার বিয়ে হয়ে পারেনি | তারপর আমার সাথে যোগাযোগ পুরো বন্ধ | দাদা মাঝে মধ্যে মনীশের কলেজে ফোন করে আমার খবর নিতো | দাদা এখন বেশ বড় চাকরি করে | এখন মুঠোফোনেরও বেশ চল হয়েছে | মনীশ বহুবার বলেছে আমায় একটা ফোন কিনে দেবে তাহলে মা , দাদার সাথে রোজ কথা বলতে পারবো | আমি রাজি হয়নি কখনোই | এখানেও সেই অভিমান ! মেয়েদের এই অভিমান ছাড়া আর কিইবা আছে ?দাদা মনীশের ফোনে জানায় মা খুবই অসুস্থ্য একবার আমাকে দেখতে চেয়েছেন | বিয়ের এতো বছর পরে এই প্রথমবার মায়ের জন্য খুব কষ্ট হতে লাগলো | মেয়ের বয়স তখন পাঁচ বছর | স্বামী , সন্তানকে নিয়ে ছুঁটে গেলাম মায়ের কাছে | মায়ের মৃত্যুর মাত্র একদিন আগে মা আমার হাতদুটো ধরে বলেছিলেন রঞ্জিত চাকরি পেয়ে আমাদের বাড়ি এসে আমায় বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিলো | কিন্তু তখন একবছর হয়েছে আমার বিয়ে হয়ে গেছে | মা তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে গেছেন | কোন উত্তর দিয়েছিলাম না উত্তর দেওয়ার কিছু ছিলোও না আমার কাছে | শুধু চোখদুটো অবাধ্য বলে ঝরে যাচ্ছিলো |
জীবনের শেষপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি | মেয়ে ডক্টর | ডাক্তারি পড়ার সময় থেকেই ক্লাসমেটের সাথে প্রেম | নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়েছি | মেয়ে যখন ডাক্তারি পড়ছে মনীশ তখন একদিন ঘুমের মধ্যেই আমাকে আর ওর মেয়েকে ছেড়ে চলে যায় | একা এই বাড়িতে বসে জীবনে এতকিছু পাওয়ার পরও রঞ্জিতকে ভুলতে পারিনি | মনেহয় এই তো সেদিনের কথা | রঞ্জিত কেমন আছে , কোথায় আছে আমি জানিনা - তবে সে আমৃত্যু আমার মনের গহীনে আমার প্রথম ভালোবাসা হয়েই রয়ে যাবে |
No comments:
Post a Comment