রুক্ষ্মিণী
রুক্ষ্মিণীর রুদ্র মূর্তি দেখে সকলেই বেশ ভয় পেয়ে যায় | মাতৃত্বের স্বাদ পেয়েছে মাত্র মাসখানেক আগেই | আঁতুর উঠতে না উঠতেই তাকে আবার হেঁসেলে ঢুকতে হয়েছে | মেয়েকে ভোরবেলা পেট ভরে দুধ খাইয়েই তবে সে এসে আবার রান্নাঘরে ঢুকেছে | এই একমাস ধরে ডাল আর আলুসিদ্ধ খেয়েই তার পেট ভর্তি করতে হয়েছে | বৌভাতের পরদিন থেকেই এই পরিবারের অলিখিত কাজের লোক হয়েই সে ঢুকেছে | আর পাঁচটা মেয়ের মত দুচোখ ভরে স্বপ্ন নিয়ে সেও এসেছিলো অচেনা , অদেখা একটি পুরুষের সাথে কোনদিন না আসা একটি অপরিচিত বাড়িতে | শাস্ত্ররীতি মেনে গোধূলিবেলায় তাকেও এ বাড়িতে লক্ষী রূপেই বরণ করে নিয়েছিলেন তার শ্বাশুড়ি | কিন্তু রুক্ষ্মিণী ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি এই মানুষগুলির প্রত্যেকের মনের মধ্যেই আছে বিষ ; এরা নিজেদের কথা ছাড়া অন্য কারও কথাই ভাবে না | বাড়িতে যে চারটি প্রাণী আছে শ্বশুর , শ্বাশুড়ি ,স্বামী , দেওর- এই হল তাদের জগৎ | রুক্ষ্মিণী যে এ বাড়িতে নিজে পায়ে হেঁটে আসেনি তাকে যে তারা বরণ করে ঘরে তুলেছে এই কথাটাই তারা ভুলে বসে আছে | বড়ছেলের বিয়ে দিয়ে তারা খাওয়াপরায় একটা কাজের লোক নিয়ে এসেছে | সূর্য ওঠার পর থেকে রাত বারোটা - তাকে দম দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় আর সে চড়কাকারে সকলের ফাইফরমাশ খাটা থেকে শুরু করে সংসারের যাবতীয় কাজ সেরে রাত বারোটার পরে যখন খাটের উপর ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দেয় স্বামী নরেশের তখন এক ঘুম হয়ে যায় | সে তখন তার শারীরিক ক্ষুদা নিবৃতিতে মেতে ওঠে | অপর প্রান্তের মানুষটা তখন নির্জীব হয়ে পরেই থাকে | তাতে অবশ্য নরেশের কিছুই যায় আসেনা | তার কাজ শেষে সে পুণরায় পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পরে | রোজ রাতে সে একবার করে ধর্ষিতা হয় --| কিন্তু মুখ খুলবে কার কাছে ? কত মেয়ের জীবনেই প্রতি রাতে এই ঘটনা ঘটছে তার খবর কে রাখে ?
বাপ, মা মরা মেয়ে রুক্ষ্মিণী ছোট থেকেই অত্যাচারের স্বীকার | মানুষ হয়েছে জ্যাঠা , জেঠির কাছে | জ্যাঠা তাকে ভালোবাসলেও জেঠি তাকে কোনদিনও একটুও ভালোবাসেনি | সেখানেও সে ছিল কাজের লোকের মতোই | আসলে কিছু মানুষ এভাবেই ভাগ্য নিয়ে জন্মায় | জ্যাঠার বাড়ির সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও একমাত্র জ্যাঠার জন্যই সে উচচমাধ্যমিকটা পাশ করতে পেরেছিলো | জ্যাঠার সামনে জেঠিমা কিছুটা চুপ থাকলেও অত্যাচারটা ছিল তার অনুপস্থিতিতে | প্রতিবাদ করতে সবাই পারেনা | প্রতিবাদ করার মানসিক যে শক্তি সকলের মধ্যে তা থাকেও না | তাই সারাটা জীবন মুখ বুঝেই রুক্ষ্মিণী জেঠিমার আর শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার শুধু সহ্য করেই গেলো |
জ্যাঠার পরিচিত একজনের সূত্র ধরে নরেশের সাথে তার বিয়ে | মায়ের মৃত্যুর পর জ্যাঠাই আগে দৌড়ে গেছিলেন তার কাছে | তখন রুক্ষ্মিণীর বয়স দশ | রুক্ষ্মিণীর কাছ থেকে আলমারির চাবি নিয়ে বৌদির গয়নাগুলি আর ব্যাঙ্কে জমানো কিছু টাকার হদিশ নিজের কাছেই গচ্ছিত রেখেছিলেন | ভাইঝিকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলেছিলেন ঘুণাক্ষরেও যেন তার জেঠি এ কথা জানতে না পারে | রুক্ষ্মিণীকে সাথে নিয়ে অনেক দৌড়াদৌড়ি করে তিনি টাকাগুলি হাতে পেয়ে সেগুলিকে রুক্ষ্মিণীর নামেই ফিক্সড করে রেখে দিয়েছিলেন | আর গয়নাগুলিকে সেই থেকে যক্ষের ধনের মত তার স্ত্রীর কাছ থেকে আগলে রেখে দিয়েছিলেন | জায়ের মৃত্যুর পর টাকা এবং গয়নার খোঁজ অনেকবার করেছেন রুক্ষ্মিণীর জেঠি | এই নিয়ে স্বামীর সাথে ঝামেলাও হয়েছে প্রচুর | কিন্তু তিনি মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন রুক্ষ্মিনীও জ্যাঠার কথা অমান্য করেনি | টাকার জন্য জেঠি যখন বিয়ে ভেঙ্গে দিতে বদ্ধ পরিকর তখনই টাকা আর গয়নার প্রসঙ্গে সব জানান তার জ্যাঠা | বিয়ের সাতদিন আগে থেকে ও বাড়ির ঘরের চালে কাক , চিল ও বসতে পারেনি |
বিয়ের দুবছরের মাথায় রুক্ষ্মিণীর একটি মেয়ে হয় | হাসপাতালে যাওয়ার পূর্ব মুহুর্ত্ব পর্যন্ত রুক্ষ্মিণী সংসারের কাজ করে গেছে | কিন্তু মেয়ে হওয়া নিয়ে এই একমাস ধরে তাকে নানান কটূক্তি শুনতে হয়েছে | বুকের মাঝে তাকে চেপে ধরে চোখের জল ফেলে সে তার কষ্টের লাঘব করতে চেয়েছে | জ্যাঠার বাড়ির সাথে বিয়ের পর থেকে আর কোন সম্পর্ক নেই | পরিচিত একজনের কাছে শুনেছিলো সেই গয়না এবং টাকা নিয়ে তার বিয়ের পরেও তার জেঠি সমানভাবে জ্যাঠার সাথে ঝামেলা করে গেছে | শেষে তিতিবিরক্ত জ্যাঠা একখানা চিঠি লিখে রেখে একদিন ভোরবেলা বাড়ি থেকে কাউকে কিছু না বলে পালিয়ে গিয়ে শান্তি পেয়েছেন |
রান্নাঘরে তরকারি কুটতে কুটতে মেয়ের কান্নার গলার আওয়াজ পেয়ে সে ঘরে পা দিয়ে শোনে - বাড়ির সকলে মিলে ফিসফিস করে কথা বলছে | হঠাৎ কি মনে হতে দাঁড়িয়ে পরে যা সে কোনদিনও করেনি | তাদের ফিসফিসানি যা তার কানে গেলো তাতে সে বুঝতে পারলো সুযোগ পেলেই তারা তার মেয়ের গলাটিপে মেরে ফেলবে | মুহূর্তের মাঝে নন্দিনীর মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো | আজীবন প্রতিবাদহীন মেয়েটি হঠাৎ করেই রণচন্ডিনী মূর্তি ধারণ করলো | ছুঁটে গেলো রান্নাঘরে | একটা কাটারি এনে সকলের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো ,
--- আমার মেয়ের কেউ কোন ক্ষতি করলে এমনকি ক্ষতি করার চিন্তা মাথায় আনলেও আমি এই কাটারি দিয়ে তাকে কুপিয়ে মেরে ফেলবো | এতদিন তোমাদের সকলের সব অত্যাচার আমি মুখ বুজে সহ্য করেছি | কিন্তু আমার মেয়ের কেউ ক্ষতি করতে চাইলে তাকে আমি বাঁচতে দেবোনা | এতদিন তোমরা আমার যে রূপ দেখেছো আজ থেকে তা ভুলে যাও | এখন শুধু আমি এ বাড়ির বৌ নয় ; আমি একজন মা আর মা তার সন্তানকে বাঁচাতে কি করতে পারে আজ থেকে তোমরা সেটা দেখবে |
সকলে অবাক হয়ে রুক্ষ্মিণীর দিকে তাকিয়ে আছে | শ্বাশুড়ি চিৎকার চেঁচামেচি করে গালিগালাজ শুরু করেছেন | হঠাৎ রুক্ষ্মিণী ঘরের জানলা দিয়ে চিৎকার করে পাশের বাড়ির লোকজনকে ডেকে আনলো | আর তাদের সামনেই আজকের ঘটনার পুরো বিবৃতি দিলো | অনেকেই তখন সেখানে হাজির | কেউ কেউ তাকে থানায় যেতে বলে | রুক্ষ্মিণীকে সকলে আস্বস্ত করলো তার এবং তার মেয়ের কিছু হলে এই পরিবারের কাউকেই তারা রেহাই দেবেনা | রুক্ষ্মিণীর পাশে তারা আছে একথা বলে যে যার বাড়ি চলে গেলো |
সেদিন থেকে মেয়েকে নিয়ে রুক্ষ্মিণীর জীবন অন্যখাতে বইতে লাগলো |
No comments:
Post a Comment