বেষ্ট ফ্রেন্ড
----নীরবতা মানে সবকাজের সম্মতি নয় , নীরবতা মানে প্রতিবাদ করতে পারিনা তা কিন্তু নয় -- অনেক সময় শান্তি বজায় রাখতেও নীরব হয়ে থাকতে হয় | অনেকগুলো বছর মুখ বুঝে সংসারটাকে ভালোবেসে সকলকে নিয়ে থাকার ব্যর্থ চেষ্টাই শুধু করে গেছি | পরিশেষে আমি হেরে গিয়ে নিজের সন্তানকে নিয়ে ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি |
অনেকদিন পরে দীপেনের সাথে ট্রেনের কামরায় দেখা মোহিনীর | কলেজ জীবনে মোহিনীর রূপে মুগ্ধ হয়ে মনেমনে তাকে ভালোবেসে ফেলেছিলো দীপেন | কিন্তু মোহিনীর দিক থেকে কোন সারা না পেয়ে নিজের মনের কথাটা কোনদিনও ব্যক্ত করতে পারেনি মুখচোরা দীপেন | গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর যোগাযোগ পুরো বন্ধ ছিল | মোহিনীর বিয়ে ঠিক হওয়ার পর বিয়ের শপিং করতে গিয়ে শপিং মলেই দেখা হয়েছিল দীপেনের সাথে | কার্ড ছাড়াই মুখে মোহিনী সেদিন দিপেনকে নিমন্ত্রণ করেছিল | দীপেন বিয়েতে গেছিলো শুধুমাত্র দুটি কারণে | প্রথম কারণটা ছিল মোহিনীকে বধূ সাজে কেমন লাগে তা দেখতে আর দ্বিতীয় কারণটা ছিল ওর বরকে কেমন দেখতে | শেষ অবধি ছিল সেদিন দীপেন | বিয়ে শেষ হয়ে যাওয়ার পর মোহিনী নিজেই তার বরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো " বেষ্ট ফ্রেন্ড" বলে | বুকের ভিতর দলা পাকানো কষ্টটা চেপে রেখে বেশ কিছুক্ষণ মোহিনীর স্বামী অভিষেকের সাথে গল্প করে এসেছিলো দীপেন | তারপর আর কখনোই মোহিনীর সাথে দীপেনের দেখা হয়নি | দীপেনের ভালোবাসাটা কুঁড়িতেই শেষ হয়ে গেলেও আজও বুকের এক পাশে মোহিনীর জন্য একটা চাপা কষ্ট তার রয়েই গেছে |
একবছরের শিশু কন্যাকে নিয়ে বাপের বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সে শিয়ালদা গিয়ে ট্রেনে উঠে বসে | বাড়ি তার মধ্যমগ্রাম | দীপেনের বাড়িও সেখানে | সে এখন একজন জজকোর্টের নামজাদা উকিল | মধ্যমগ্রাম থেকে নিত্য যাতায়াত তার কলকাতা | মোহিনী মেয়ে কোলে জানলার কাছে বসে মেয়ের আধোআধো ভাষায় নানান প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চলেছে | বেশ কিছুক্ষণ লক্ষ্য করে দীপেন তার দিকে এগিয়ে যায় |
--- কিরে আমায় চিনতে পারছিস ?
--- দীপেন --- চিনবো না কেন ? কেমন আছিস বল |
--- ভালো আছি - তুই ?
মোহিনী একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলে ,
--- ওই আছি আর কি সময় চলে যাচ্ছে, জীবন এগিয়ে চলেছে, সাথে পাল্লা দিয়ে বয়স বেড়ে চলেছে ---|
--- বাব্বা বিয়ের পরে তুই তো বেশ কথা বলতে শিখেছিস ---| এসব কি তোর বরের সঙ্গের ফল --?
নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠলো | তারপরেই বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বললো ,
--- তোর মেয়েটা কিন্তু ভীষণ কিউট আর বড় হলে তোর মতই সুন্দরী হবে |
--- সুন্দরী মেয়েদের বড্ড জ্বালা রে --
--- ছাড় এসব কথা | এইটুকুন মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি একাই চললি তোর কর্তা কোথায় ?
মোহিনী প্রসঙ্গটা পাল্টাতে বললো ,
--- দীপেন , অনেক কথা আছে তোর সাথে | আমার এই প্রব্লেমটা একমাত্র তুইই সলভ করতে পারবি |
--- তোর আবার কিসের প্রব্লেম হল ?
--- একদিন আমাদের বাড়িতে আয় | অনেক কথা আছে | এভাবে ট্রেনে বসে বলা যাবেনা | তবে একটা কথা বলে রাখছি আমাকে এখন সবসময় বাবা , মায়ের কাছেই পাবি | তোর সময় মত একদিন আসিস | বিয়ের পর থেকেই চুপ করে ছিলাম রে -- মন দিয়ে সংসারটা করতে চেয়েছিলাম | কিন্তু অভিষেক আমার নিরবতাটাকেই অসহায়তা বলে ধরে নিয়েছে | আর পারিনি | তাই ফুঁসে উঠেছিলাম | পরিণামে আমাকে এককাপড়ে রাস্তায় বের করে দিয়েছে | আমি এর বদলা নেবো | তুই আমার পাশে থাকবি তো |
মোহিনীর বলা এই ভাঙ্গা ভাঙ্গা কথাগুলিকেই নিজের মত করে সাজিয়ে নেয় দীপেন | পাল্টা কোন প্রশ্ন করেনা | মোহিনী ও তার মেয়েকে সেদিন মোহিনীদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে দীপেন বাড়ি যায় |
অভিষেকের সাথে বিয়ের পর কটা মাস খুব ভালোই কেটেছিল | শ্বাশুড়ি ছিলেননা | রিটায়ার্ড শ্বশুরমশাই খুবই ভালোবাসতেন তাকে | বৌভাতের পরেই সংসারের যাবতীয় সে অতি নিপুণভাবে সম্পন্ন করতো | প্রথম প্রথম অভিষেকের ভালোবাসা পেয়ে নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হত | কিন্তু হঠাৎ করেই বিয়ের বছরখানেকের মধ্যেই সে অভিষেকের ভিতর এক আমূল পরিবর্তন দেখতে পায় | যা তার শ্বশুরের চোখেও লাগে | তিনি তার বৌমাকে ডেকে শক্ত হাতে হাল ধরতে বলেন | মোহিনী তখন তিনমাসের অন্তঃসত্বা | কিন্তু অভিষেক তার দিকে সেভাবে নজরই দেয়না | অফিস থেকে মাঝে মধ্যেই খুব রাত করে বাড়িতে ফেরে | জানতে চাইলে " কাজ ছিল বলে" এড়িয়ে যায় | রাতে মোহিনী তার সংসারের যাবতীয় কাজ সেরে যখন ঘুমাতে যায় অভিষেক তখন অঘোরে নাক ডাকছে | রাত করে বাড়ি ফেরার মাত্রা দিনকে দিন বেড়ে যেতে লাগলো | প্রথম প্রথম চুপচাপ থাকলেও পরে এই নিয়ে অভিষেকের সাথে নিত্য ঝামেলা হতে শুরু করে | বৃদ্ধ শ্বশুর সবসময় তিনি তার পুত্রবধূটিকেই সমর্থন করেন |
কিছুই বুঝতে পারেনা মোহিনী | কেন কিসের জন্য অভিষেক এতো পাল্টে যাচ্ছে অনেক ভেবেও কুলকিনারা পায়না | মেয়ের জন্মের মাসদুয়েক আগেই শ্বশুর ইহলোক ত্যাগ করেন রাতে ঘুমের মধ্যেই | তার শরীরের এই অবস্থায় অভিষেকের কোন হেলদোলই নেই দেখে সে বাবাকে ডেকে এনে তার সাথে বাপের বাড়ি চলে যায় | অভিষেক কোন আপত্তিই করেনা | মেয়ের দুমাস বয়স হলে সে ওখান থেকে অভিষেকের কাছে ফিরে আসে | মেয়ে হওয়ার পর তাকে জানানো হলে সে গিয়ে কিছু টাকাকড়ি দিয়ে সেদিনই ফিরে আসে | প্রতিবেশীর কাছ থেকে জানতে পারে সে বাপের বাড়িতে থাকাকালীন একটি মেয়ে প্রায়ই অভিষেকের কাছে আসতো | মোহিনীর বুঝতে বাকি থাকলোনা তার ভালোবাসার ঘর ভাঙ্গতে চলেছে বা বলা ভালো ভেঙ্গেই গেছে | বারবার সে রুখে দাঁড়িয়েছে | শেষে যেদিন অভিষেক গায়ে হাত তুলেছে সেদিনই সে চিৎকার করে বলেছিলো ," তোমাকে জেলের ভাত খাইয়ে তবে ছাড়বো |" তখন মেয়েটি তার কোলে ছিল | অভিষেক ধাক্কা মেরে তাকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজা দিতে দিতে বলেছিলো ," ক্ষমতা থাকলে করে দেখাও |"
মোহিনীর মেয়ের বয়স এখন তিনবছর | বাবার ছোট কাপড়ের দোকানটা এখন সে নিজেই দেখাশুনা করে | বাবার এই ব্যবসাটা মোহিনী আসার পরে একটু একটু করে উন্নত করেছে | দীপেনের সহায়তায় অভিষেককে মোহিনী সত্যিই জেলের ভাত খাইয়ে ছেড়েছে | মাসখানেক সে জেলে ছিল | চাকরিটা খুঁইয়েছে | জেল থেকে বেরিয়ে মেয়ে , বৌকে নিতে এসেছিলো | মোহিনী যায়নি | ততদিনে অভিষেকের প্রেমিকাও উধাও হয়েছে | দীপেন তাকে আপন করে নিতে চেয়েছিলো | মোহিনী রাজি হয়নি | কাপড়ের দোকানটা বড় করেছে | দুজন কর্মচারীও রেখেছে | দোকানে মোহিনী এখন ক্যাশিয়ার | তাকে আর কোনোই কাজ করতে হয়না | স্বপ্ন দেখে মেয়েকে খুব ভালোভাবে মানুষ করা আর বাবার দোকানটাকে যা এখন সম্পূর্ণ তার নিজের বিশাল বড় করার | দীপেন আজও বিয়ে করেনি | " বেষ্ট ফ্রেন্ড " হিসাবেই আজও তার পাশেই আছে |
No comments:
Post a Comment