Saturday, November 14, 2020

বেষ্ট ফ্রেন্ড

বেষ্ট ফ্রেন্ড  

   ----নীরবতা  মানে  সবকাজের  সম্মতি  নয় , নীরবতা  মানে  প্রতিবাদ  করতে  পারিনা  তা  কিন্তু  নয়  -- অনেক  সময়  শান্তি  বজায়  রাখতেও  নীরব  হয়ে  থাকতে  হয় | অনেকগুলো  বছর  মুখ  বুঝে  সংসারটাকে  ভালোবেসে  সকলকে  নিয়ে  থাকার  ব্যর্থ  চেষ্টাই  শুধু  করে  গেছি  | পরিশেষে  আমি  হেরে  গিয়ে  নিজের  সন্তানকে  নিয়ে  ও  বাড়ি  থেকে  বেরিয়ে  এসেছি  |
  অনেকদিন  পরে  দীপেনের  সাথে  ট্রেনের  কামরায়  দেখা  মোহিনীর | কলেজ  জীবনে  মোহিনীর  রূপে   মুগ্ধ  হয়ে  মনেমনে  তাকে  ভালোবেসে  ফেলেছিলো  দীপেন  | কিন্তু  মোহিনীর  দিক  থেকে  কোন  সারা  না  পেয়ে  নিজের  মনের  কথাটা  কোনদিনও  ব্যক্ত করতে  পারেনি  মুখচোরা  দীপেন | গ্রাজুয়েশন  শেষ  করার  পর  যোগাযোগ  পুরো  বন্ধ  ছিল  | মোহিনীর  বিয়ে  ঠিক  হওয়ার  পর  বিয়ের  শপিং  করতে  গিয়ে  শপিং  মলেই  দেখা  হয়েছিল  দীপেনের  সাথে  | কার্ড  ছাড়াই  মুখে  মোহিনী  সেদিন  দিপেনকে নিমন্ত্রণ  করেছিল  | দীপেন  বিয়েতে  গেছিলো  শুধুমাত্র  দুটি  কারণে | প্রথম  কারণটা  ছিল  মোহিনীকে  বধূ  সাজে  কেমন  লাগে  তা  দেখতে  আর  দ্বিতীয়  কারণটা  ছিল  ওর  বরকে  কেমন  দেখতে  | শেষ  অবধি  ছিল  সেদিন  দীপেন  | বিয়ে  শেষ  হয়ে  যাওয়ার  পর  মোহিনী  নিজেই  তার  বরের  সাথে  পরিচয়  করিয়ে  দিয়েছিলো  " বেষ্ট ফ্রেন্ড" বলে  | বুকের  ভিতর  দলা পাকানো  কষ্টটা  চেপে  রেখে  বেশ  কিছুক্ষণ মোহিনীর  স্বামী  অভিষেকের  সাথে  গল্প  করে  এসেছিলো  দীপেন  | তারপর  আর  কখনোই  মোহিনীর  সাথে  দীপেনের  দেখা  হয়নি  | দীপেনের  ভালোবাসাটা  কুঁড়িতেই শেষ  হয়ে  গেলেও  আজও বুকের  এক পাশে  মোহিনীর  জন্য  একটা  চাপা  কষ্ট  তার  রয়েই  গেছে | 
  একবছরের  শিশু  কন্যাকে  নিয়ে  বাপের  বাড়িতে  যাওয়ার  উদ্দেশ্যে  সে  শিয়ালদা  গিয়ে  ট্রেনে  উঠে  বসে  | বাড়ি  তার  মধ্যমগ্রাম | দীপেনের  বাড়িও  সেখানে  | সে  এখন  একজন   জজকোর্টের নামজাদা    উকিল  | মধ্যমগ্রাম  থেকে  নিত্য  যাতায়াত  তার  কলকাতা | মোহিনী  মেয়ে  কোলে  জানলার  কাছে  বসে  মেয়ের  আধোআধো  ভাষায় নানান  প্রশ্নের  উত্তর  দিয়ে  চলেছে  | বেশ  কিছুক্ষণ লক্ষ্য  করে  দীপেন  তার  দিকে  এগিয়ে  যায়  | 
--- কিরে  আমায়  চিনতে  পারছিস ?
--- দীপেন  --- চিনবো  না  কেন ? কেমন  আছিস  বল  |
--- ভালো  আছি  - তুই  ?
 মোহিনী  একটা  দীর্ঘনিশ্বাস  ছেড়ে  বলে ,
--- ওই  আছি  আর  কি  সময়  চলে  যাচ্ছে,  জীবন  এগিয়ে  চলেছে,  সাথে  পাল্লা  দিয়ে  বয়স  বেড়ে  চলেছে  ---| 
--- বাব্বা  বিয়ের  পরে  তুই  তো  বেশ  কথা  বলতে  শিখেছিস  ---| এসব  কি  তোর  বরের  সঙ্গের  ফল --?
 নিজের  রসিকতায়  নিজেই  হেসে  উঠলো  | তারপরেই  বাচ্চাটার  দিকে  তাকিয়ে  বললো ,
--- তোর  মেয়েটা  কিন্তু  ভীষণ  কিউট  আর  বড়  হলে  তোর  মতই সুন্দরী  হবে  |
--- সুন্দরী  মেয়েদের  বড্ড  জ্বালা  রে  --
--- ছাড় এসব  কথা | এইটুকুন  মেয়েকে  নিয়ে  বাপের  বাড়ি  একাই চললি তোর  কর্তা কোথায় ?
 মোহিনী  প্রসঙ্গটা পাল্টাতে  বললো ,
--- দীপেন , অনেক  কথা  আছে  তোর  সাথে | আমার  এই  প্রব্লেমটা  একমাত্র  তুইই  সলভ করতে  পারবি |
--- তোর  আবার  কিসের  প্রব্লেম  হল  ?
--- একদিন  আমাদের  বাড়িতে  আয় | অনেক  কথা  আছে | এভাবে  ট্রেনে  বসে  বলা  যাবেনা | তবে  একটা  কথা  বলে  রাখছি  আমাকে  এখন  সবসময়  বাবা , মায়ের  কাছেই  পাবি | তোর  সময়  মত  একদিন  আসিস | বিয়ের  পর  থেকেই  চুপ  করে  ছিলাম  রে  -- মন  দিয়ে  সংসারটা  করতে  চেয়েছিলাম | কিন্তু  অভিষেক   আমার  নিরবতাটাকেই  অসহায়তা বলে  ধরে  নিয়েছে |   আর  পারিনি | তাই  ফুঁসে  উঠেছিলাম | পরিণামে  আমাকে  এককাপড়ে  রাস্তায়  বের  করে  দিয়েছে | আমি  এর  বদলা  নেবো  | তুই  আমার  পাশে  থাকবি  তো  |
 মোহিনীর  বলা  এই  ভাঙ্গা ভাঙ্গা কথাগুলিকেই  নিজের   মত  করে  সাজিয়ে  নেয়  দীপেন | পাল্টা  কোন  প্রশ্ন  করেনা | মোহিনী  ও  তার  মেয়েকে  সেদিন  মোহিনীদের  বাড়িতে  পৌঁছে  দিয়ে  দীপেন  বাড়ি  যায় |
 অভিষেকের  সাথে  বিয়ের  পর  কটা মাস   খুব  ভালোই  কেটেছিল  | শ্বাশুড়ি  ছিলেননা | রিটায়ার্ড  শ্বশুরমশাই  খুবই  ভালোবাসতেন  তাকে | বৌভাতের  পরেই সংসারের  যাবতীয়  সে  অতি নিপুণভাবে  সম্পন্ন  করতো | প্রথম  প্রথম  অভিষেকের  ভালোবাসা  পেয়ে  নিজেকে  খুব  ভাগ্যবতী  মনে  হত | কিন্তু  হঠাৎ  করেই  বিয়ের  বছরখানেকের  মধ্যেই  সে  অভিষেকের  ভিতর  এক  আমূল  পরিবর্তন  দেখতে  পায় | যা  তার  শ্বশুরের  চোখেও  লাগে  | তিনি  তার  বৌমাকে  ডেকে  শক্ত  হাতে  হাল  ধরতে  বলেন | মোহিনী  তখন  তিনমাসের  অন্তঃসত্বা | কিন্তু  অভিষেক  তার  দিকে  সেভাবে  নজরই  দেয়না | অফিস  থেকে  মাঝে  মধ্যেই  খুব  রাত করে  বাড়িতে  ফেরে | জানতে  চাইলে " কাজ  ছিল  বলে" এড়িয়ে  যায় | রাতে  মোহিনী  তার  সংসারের  যাবতীয়  কাজ  সেরে  যখন  ঘুমাতে  যায়  অভিষেক   তখন  অঘোরে  নাক  ডাকছে | রাত করে  বাড়ি  ফেরার  মাত্রা  দিনকে  দিন  বেড়ে  যেতে  লাগলো | প্রথম  প্রথম  চুপচাপ  থাকলেও  পরে  এই  নিয়ে  অভিষেকের  সাথে  নিত্য  ঝামেলা  হতে  শুরু  করে | বৃদ্ধ  শ্বশুর  সবসময়  তিনি  তার  পুত্রবধূটিকেই  সমর্থন  করেন  | 
  কিছুই  বুঝতে  পারেনা  মোহিনী | কেন  কিসের  জন্য  অভিষেক  এতো  পাল্টে  যাচ্ছে  অনেক  ভেবেও  কুলকিনারা  পায়না | মেয়ের  জন্মের  মাসদুয়েক  আগেই  শ্বশুর  ইহলোক  ত্যাগ  করেন  রাতে  ঘুমের  মধ্যেই | তার  শরীরের  এই  অবস্থায়  অভিষেকের  কোন  হেলদোলই নেই  দেখে  সে  বাবাকে  ডেকে  এনে  তার  সাথে  বাপের  বাড়ি  চলে  যায়  | অভিষেক  কোন  আপত্তিই  করেনা | মেয়ের  দুমাস  বয়স  হলে  সে  ওখান  থেকে  অভিষেকের  কাছে  ফিরে  আসে | মেয়ে  হওয়ার  পর  তাকে  জানানো  হলে  সে  গিয়ে  কিছু  টাকাকড়ি  দিয়ে  সেদিনই  ফিরে  আসে  | প্রতিবেশীর  কাছ  থেকে  জানতে  পারে  সে  বাপের  বাড়িতে  থাকাকালীন  একটি  মেয়ে  প্রায়ই  অভিষেকের  কাছে  আসতো | মোহিনীর  বুঝতে  বাকি  থাকলোনা  তার  ভালোবাসার  ঘর  ভাঙ্গতে চলেছে বা  বলা  ভালো  ভেঙ্গেই গেছে  | বারবার  সে  রুখে  দাঁড়িয়েছে | শেষে  যেদিন  অভিষেক  গায়ে  হাত  তুলেছে  সেদিনই  সে  চিৎকার  করে  বলেছিলো ," তোমাকে  জেলের  ভাত খাইয়ে  তবে  ছাড়বো |" তখন  মেয়েটি  তার  কোলে  ছিল | অভিষেক  ধাক্কা  মেরে  তাকে  ঘর  থেকে  বের  করে  দিয়ে  দরজা  দিতে  দিতে  বলেছিলো ," ক্ষমতা  থাকলে  করে  দেখাও |" 
  মোহিনীর  মেয়ের  বয়স  এখন  তিনবছর | বাবার  ছোট  কাপড়ের  দোকানটা  এখন  সে  নিজেই  দেখাশুনা  করে | বাবার  এই  ব্যবসাটা  মোহিনী  আসার  পরে  একটু  একটু  করে  উন্নত  করেছে | দীপেনের  সহায়তায়  অভিষেককে  মোহিনী  সত্যিই  জেলের  ভাত খাইয়ে  ছেড়েছে | মাসখানেক  সে  জেলে  ছিল | চাকরিটা  খুঁইয়েছে | জেল  থেকে  বেরিয়ে  মেয়ে , বৌকে  নিতে  এসেছিলো | মোহিনী  যায়নি | ততদিনে  অভিষেকের  প্রেমিকাও  উধাও  হয়েছে | দীপেন  তাকে  আপন  করে  নিতে  চেয়েছিলো | মোহিনী  রাজি  হয়নি | কাপড়ের  দোকানটা  বড়  করেছে | দুজন  কর্মচারীও  রেখেছে  | দোকানে  মোহিনী  এখন  ক্যাশিয়ার  | তাকে  আর  কোনোই  কাজ  করতে  হয়না | স্বপ্ন  দেখে  মেয়েকে  খুব  ভালোভাবে  মানুষ  করা  আর  বাবার  দোকানটাকে  যা  এখন  সম্পূর্ণ  তার  নিজের  বিশাল  বড়  করার | দীপেন  আজও বিয়ে  করেনি  | " বেষ্ট ফ্রেন্ড " হিসাবেই  আজও তার  পাশেই  আছে  |
    

No comments:

Post a Comment