শখের গয়না
রাতের নিস্তব্দতা ভেদ করে বুকের ভিতর যে কুঠারাঘাত হয় তার শব্দ বাড়ির আর চারটে প্রাণী টের পায়না | আজ সম্পূর্ণ একা তৃপ্তিদেবী | কি দাপটের সাথে একসময় এই সংসারে রাজ করেছেন তিনি | স্বামী ছিলেন আত্মভোলা শিব ঠাকুর | অশান্তির হাত থেকে রেহাই পেতে কোনদিন স্ত্রীর বিরুদ্ধে যেতে পারেননি | কিন্তু একবার জীবনে তাকে মুখ খুলতেই হয়েছিল সেও বাধ্য হয়েই | ম্যাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সুচাকুরে ছোট ছেলে যখন অবাঙ্গালী সুন্দরী মেয়েকে হঠাৎ করেই বিয়ে করে বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল তখন তৃপ্তিদেবী রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ছেলে আর তার বৌকে সদর দরজা থেকেই দূরদূর করে শুধু তারিয়েই দিয়েছিলেন না নানান কুকথায় ভৎর্সনাও করেছিলেন | সেদিন অধীরবাবু আর চুপ করে থাকতে পারেননি | বারবার তিনি তার জেদী, একগুঁয়ে স্ত্রীকে বুঝানোর চেষ্টা করেছিলেন এই হটকারী সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকতে | তিনি এও বলেছিলেন একদিন তাকে এই সিদ্ধান্তের জন্য পস্তাতে হবে | কি পরিস্থিতিতে মানুষ হঠাৎ করেই বিয়ের মত একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে তা শোনার জন্য বারবার অনুরোধ জানিয়েছিলেন | কিন্তু তৃপ্তিদেবীর গলার জোরের কাছে অধীরবাবুর গলার স্বর চাপা পরে গেছিলো | আজ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি যেন এই বদ্ধ অন্ধকার ঘরে সেদিনের অধীরবাবুর বলা কথাগুলির প্রতিধ্বনি শুনতে পান |
তৃপ্তিদেবীর দুই ছেলে | ছোটছেলে কিশোর দাদার আগেই বিয়ে করেছিল | আর বড়ছেলে কৌশিককে তিনি নিজে পছন্দ করে বড় ঘরের মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন | স্বামী তার ভালো মাইনে পেলেও চাকরিটা ছিল তার প্রাইভেট ফার্মে | পৈতৃক সম্পত্তিতে বেশ ভালো বাড়ি করেছিলেন | তৃপ্তিদেবীর ছিল সোনার গয়না গড়ানোর নেশা | বছরে তিন থেকে চারটে গয়না তার করা চাইই | ছেলেরা যখন নিজেরা রোজগার করতে শুরু করে তখনও গয়না গড়ানোর শখ বিন্দুমাত্র কমেনি | তবে পরবর্তীতে তিনি সমস্ত গয়নায় সমপরিমাণ সোনা দিয়ে দুবউয়ের জন্য দুসেট করে করতেন | মাঝে মধ্যে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে নানান অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় এইসব গয়না ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়তেন | মহিলামহলে পরিহিত গয়নাটিতে হাত দিয়ে " দেখো এটা নুতন করেছি -" কথাটা বলতে বেশ গর্ববোধ করতেন |
বড়বৌকে তিনি তার প্রাপ্য অংশটা বিয়ের পরেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন | নিজে পছন্দ করে বড় বৌকে ঘরে আনলেও সে বৌ তার মনের মত হয়না | তৃপ্তিদেবীর মত মানুষও তার মুখের কাছে হার মেনে যেত | তখনও অধীরবাবু বেঁচে ছিলেন | একদিন তিনি তার বড়ছেলেকে ডেকে ওই বাড়ির মধ্যেই তার হাড়ি আলাদা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন | স্ত্রী তার যে একা হেঁসেল ঠেলতে পারছেননা সেটা তিনি বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন | তার উপর বয়স বাড়াতে তার আথ্রাইটিসের যন্ত্রণায় কষ্ট দিনকে দিন বেড়েই চলেছিল | অধিকাংশ রাতেই তিনি ঘুমাতে পারতেননা | সেই থেকেই একই বাড়িতে বড়ছেলে বৌ আলাদা | এখন তাদের দুটি সন্তান | তারাও ঠাকুমার কাছে খুব একটা ঘেসে না | স্বামী গত হয়েছেন বছর দুয়েক | তৃপ্তিদেবী আজও নিজে রেঁধেই দুটি সেদ্ধ ভাত খান |
অধীরবাবুর সাথে তার ছোটছেলে বৌয়ের যোগাযোগ ছিল যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন | তাদের প্রথম কন্যা সন্তান কনকের জন্মের পরে তিনি কিশোরের বাড়িতেও এসেছিলেন | তখন তারা ভাড়া বাড়িতে থাকতো | পরে অবশ্য কিশোর বেশ ভালো ফ্লাট কিনেছে অধীরবাবু তা জেনে গেলেও দেখে যেতে পারেননি | কিশোরের এক ছেলে এক মেয়ে | আর কৌশিকের দুই মেয়ে | কিশোরের সাথে সেই ঘটনার পর আর কোন যোগাযোগ নেই তার মায়ের সাথে | বাবার মৃত্যুর পর দাদার ফোন পেয়ে সরাসরি কিশোর শ্মশানেই গেছিলো | নিজের মত করেই কালীঘাটে বাবার শেষকৃত্য করেছে | দাদা বাড়িতেই সব কাজ করেছে বাবার |
অনেকদিন পর কিশোরের সাথে তাদের পাড়ার একজনের সাথে দেখা | তার কাছেই কিশোর জানতে পারে মায়ের শরীর মোটেই ভালোনা | এখন তিনি হোমডেলিভারি খান | সবসময়ই শুয়ে থাকেন | দাদা বৌদি কোন খোঁজ রাখেনা | এ কথা শুনে বাড়িতে এসে লিজাকে সব বলে কিশোর | লিজা তাকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগে | কিন্তু কিশোরের সাহসে কুলায়না পুণরায় মায়ের সামনে দাঁড়াতে | তবুও লিজার অনুনয় বিনয়ে সে একা একাই যাবে বলে মনস্থির করলো |
একদিন অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে কিশোর তার মায়ের ঘরে এসে ঢোকে | তৃপ্তিদেবী চোখ বন্ধ করেই শুয়ে ছিলেন | মায়ের দিকে তাকিয়ে তার শরীরের অবস্থা দেখে কিশোর তার মাকে জড়িয়ে বুকের উপর শুয়ে কাঁদতে থাকে | প্রথম অবস্থায় তৃপ্তিদেবী একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও পরে তিনিও কাঁদতে কাঁদতে বলেন ,
--- হ্যাঁরে এতদিন পরে মায়ের কথা মনে পড়লো ? আমি তো নাহয় তোর বাড়ি চিনিনা --- তুই কেন এতদিন দেরি করলি আমার কাছে আসতে ?কবে কি বলেছি তাই মনে রেখে নিজের গর্ভধারিণীকে ভুলে ছিলি বাবা ---|
--- আমাকে তোমার বৌমা বারবার বলতো তোমার কাছে আসতে কিন্তু আমি সাহস পায়নি |
তৃপ্তিদেবী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন ,
--- কেমন আছে সবাই ?
--- ভালো আছে মা | মা, তুমি আমার সাথে আমার বাড়ি চলো | আমাদের কাছেই থাকবে তুমি | তোমার বৌমা আমাকে তোমায় নিয়ে যেতে বলেছে |
তৃপ্তিদেবী কোনোই আপত্তি করেননা | সামান্য কিছু জিনিসপত্র আর একটা কাপড়ের পুঁটুলি নিয়ে তিনি তার ছোটছেলের সাথে তার বাড়িতে যান | কিশোর আগেই ফোন করে লিজাকে সব জানিয়ে দিয়েছিলো | লিফটে করে পাঁচতলার ফ্ল্যাটে উঠে কিশোর ও তৃপ্তিদেবী দেখেন বাচ্চাদুটির হাতে দুটো গোলাপ আর একটা বরণডালা লিজার হাতে | সেখানে পৌঁছানোর সাথে সাথেই কিশোরের ছেলেমেয়ে দৌড়ে এসে গোলাপ দুটি হাতে দিয়েই 'ঠাম্মি' - বলে জড়িয়ে ধরে | আর লিজা বরণডালা থেকে প্রদীপের তাপ নিয়ে শ্বাশুড়ির মাথায় বুকে দিয়ে হাত ধরে ভিতরে নিয়ে যায় | ঘটনার আকসিকতায় প্রথমে তৃপ্তিদেবী একটু ঘাবড়ে গেলেও মুহূর্তের মাঝে সিনেমার ফ্লাসব্যাকের মত বেশ কয়েক বছর আগের দিনটির কথা মনে পরে যেদিন তিনি কিশোর ও তার বৌকে বরণ করার পরিবর্তে বাড়ি থেকে রাস্তায় তাড়িয়ে দিয়েছিলেন | চোখ থেকে সমানে জল পরে যাচ্ছে | লিজা নিচু হয়ে শ্বাশুড়ীকে প্রণাম করে | দেখাদেখি তার ছেলেমেয়েও তাই করে | বাচ্চাদুটিকে বুকে টেনে নেন তিনি | এই প্রথম তার কোন নাতি নাতনী তাকে প্রণাম করলো | লিজাকে ডেকে তার হাতদুটি ধরে বলেন ," তোর এই মা টাকে পারলে ক্ষমা করে দিস মা | সেদিন তোর শ্বশুরমশাই বলেছিলেন পরে আমায় পস্তাতে হবে | সত্যিই তাই | খুব অন্যায় করেছি সেদিন তোদের উপর |
--- এখন থেকে আপনি আপনার এই বাড়িতেই থাকবেন মা | ফ্লাট আপনার ছেলে কিনেছে | তারমানে এটাও আপনার বাড়ি | আমি ছোটবেলাতেই মাকে হারিয়েছি | বাবা একসিডেন্টে মারা যান | লোকের লোলুপ দৃষ্টির হাত থেকে রেহাই পেতে হঠাৎ করেই আপনার ছেলে সিদ্ধান্ত নেয় বিয়ে করার | তানাহলে কোনো অন্ধকারেই হয়তো হারিয়ে যেতাম | এই ফ্লাট কেনার সময়ই আমি দক্ষিণদিকের ঘরটা আপনার জন্য নিজের মত করে সাজিয়েছি | আপনাকে প্রাণ ভরে মা বলে ডাকবো আর সেবাযত্ন করবো শুধু এইটুকুন অধিকার আমায় দেন |
তৃপ্তিদেবী তার ছোটছেলের বৌকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকেন | কাঁদতে কাঁদতেই বলেন ,
--- অপরাধের শাস্তি যে আনন্দাশ্রু হতে পারে তা তোর কাছে না আসলে বুঝতেই পারতামনা | কোথায় গেলি কিশোর ? আমার কাপড়ের পুঁটলিটা দে --
সেই প্রথম থেকে আমার গয়না করার খুব শখ ছিল | তোমার শ্বশুর বেঁচে থাকতে পড়তাম ও খুব | এই গয়নার পাত্রে আমার আর তোমার সব গয়না আছে | এখন থেকে এই সব গয়না তোমার |
লিজা অবাক হয়ে বললো ,
--- আমার গয়না মানে ?
--- দুই ছেলের বৌয়ের জন্য দুসেট করে গয়না করেছিলাম | বড়বৌমাকে বরণের পরেই তার গুলো দিয়ে দিয়েছিলাম | তোর গুলো এতকাল আগলে বসেছিলাম | আজ দিতে পেরে মনটা খুব হালকা লাগছে | আয় দেখি কিছু পরিয়ে দিই | তোর শ্বশুর উপর থেকে দেখে শান্তি পাবেন |
গা ভর্তি করে লিজাকে তার শ্বাশুড়ি গয়না পরিয়ে দিলেন | চার বছরের নাতী দেখে বললো ,
--- মা , ঠাম্মা তোমাকে মা দুগ্গার মত সাজিয়েছেন |
তৃপ্তিদেবী ছেলের বৌয়ের মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে বললেন ,
--- ওতো আমার মা দুগ্গাই | এতদিন বুঝতে না পেরে অবহেলা করেছি | তার প্রাশ্চিত্ত তো করেই চলেছি | মা দুগ্গা আমায় নিশ্চয় ক্ষমা করবে ---|
লিজা তার শ্বাশুড়ির হাতদুটি ধরে বললো , " আমি তোমার মেয়ে আর তুমি আমার মা --- আজ থেকে এটাই আমাদের পরিচয় |"
তৃপ্তিদেবী তার বৌমাকে বুকের সাথে চেপে ধরলেন |
No comments:
Post a Comment