সুখের ঘরে আগুন ( নবম পর্ব )
বৌভারের পরে অনেকেই সেদিন বাড়ি চলে গেছেন | আবার কেউবা সকালে টিফিন করে , কেউবা দুপুরে খেয়েদেয়ে যে যার বাড়ির পথ ধরেছেন | একমাত্র নিলয়ের অনুরোধে প্রমিতা আর রিতেশ যায়নি | অবশ্য নিলয় অনুরোধ না করলেও প্রমিতা তার দাদার মনে কিসের এতো কষ্ট এই বিয়ে করে সেটা সে না জেনে কিছুতেই যেত না | কারণ দাদাকে সে খুব ভালোবাসে | সেই ছোট্ট থেকে তাকে ভাইফোঁটা দেয়, রাখি পরায় | দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়ার পর নিলয় সোফার উপর বসে টিভি দেখতে দেখতে ওখানেই ঘুমিয়ে পরে | এটা সে করে নিজের ঘরে যাবে না বলেই প্ল্যানমাফিক | শালিনীও তাকে কিছু বলার সুযোগ খুঁজছে কিন্তু নিলয় তাকে কোন কথা বলার সুযোগই দিচ্ছে না | রাতে খাওয়া শেষ করে নিলয় যখন বেসিনে হাত ধুতে যায় শালিনী তড়িঘড়ি খাওয়া শেষ করে নিলয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে ,
--- আপনাকে কিছু বলার ছিল |
নিলয়ও খুব চাপাস্বরে উত্তর দেয় ,
--- আপনার যা বলার বিয়ের আগেরদিন তো বলেই দিয়েছেন | আমার আর কিছু শোনার ইচ্ছা নেই | এবার যা করার আমিই করবো |
কথাকটি বলে নিলয় আর সেখানে দাঁড়ায় না | সকলেই খেয়ে উঠে ড্রয়িংরুমে বসে গল্প করছে | শালিনীও সেখানে কিছুক্ষণ বসে থাকে | প্রমিতাই তাকে একসময় বলে , " বৌদি তোমার তো ঘুম পেয়েছে | তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো |
--- না না ঠিক আছে , এই তো গল্প শুনছি |
বাবা, মা একসময় উঠে শুতে চলে যান | কিন্তু প্রমিতা, রিতেশ আর নিলয় আর কোন কথা খুঁজে না পেয়ে টিভি চালিয়ে একটা মুভি নিয়ে সব বসে পড়লো | অনেকক্ষণ শালিনী বসে থেকে শেষে সেও উঠে পড়লো | তারপর ওরা সবাই মিলে ছাদে এসে একটা শতরঞ্চি পাতিয়ে বসলো |
--- হ্যাঁ এবার বল দাদা বৌদিকে নিয়ে তোর সমস্যাটা কি ?
--- বলছি সব , বলবো বলেই তো এতো কান্ড করে এখানে আসা | একটু দাঁড়া শুরুটা নিজের মনের মধ্যে সাজিয়ে নিই ---|
কিছুক্ষণ থেমে থেকে নিলয় শুরু করলো ---
বিয়ের আগেরদিন রাতে ----- আস্তে আস্তে নিলয় সমস্ত ঘটনাগুলি প্রমিতা আর রিতেশকে জানালো | এমন কি বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে শালিনী কি বলেছে সেটাও জানালো | সব শুনে দুজনেই কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলো | তারপর প্রমিতা বলে উঠলো ,
--- তাহলে বিয়েটা করতে গেলি কেন ? এখন তো বিষয়টা আরও জটিল হয়ে দাঁড়ালো |
রিতেশ বলে উঠলো ,
--- বোকার মত কথা বোলো না | বাড়িতে তখন আত্মীয়স্বজন ভর্তি | ওই মুহূর্তে বিয়েটা ভেঙ্গে দিলে বাবা , মায়ের অবস্থাটা ভেবে দেখেছো? দুশ লোক নিমন্ত্রিত | সমস্ত কিছুর বায়না দেওয়া | কত লোকে ছি ছি করতো , কত মানুষ বিষয়টা নিয়ে চর্চ্চা করতো ?
--- সেতো এখনো করবে |
--- সেটা সংখ্যায় কম | এটাতে জানবে কম লোকে |
তারপর নিলয়ের দিকে তাকিয়ে বললো ,
--- তুমি এখন কি চাও ? ডিভোর্স ?
--- তাই ছাড়া আর উপায় কি ?
প্রমিতা দাদার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো ,
--- তুই একবার বৌদির সাথে কথা বল না --
--- কি কথা বলবো ?
--- না - বলছি যদি এখন তার মতের পরিবর্তন হয় ?
নিলয় ব্যঙ্গের হাসি দিয়ে বলে উঠলো,
--- তুই কি পাগল নাকি ? যে মেয়ে বিয়ের আগের রাত্রে তার হবু স্বামীকে ফোন করে অন্য পুরুষকে ভালোবাসার কথা জানায় তার সাথে সংসার করা যায় ? আর শুধু সংসার কেন তার প্রতি কোনদিন ভালোবাসা জন্মাতে পারে ?
--- কেন পারে না দাদা ? দুটো মানুষ একসাথে থাকতে থাকতে তাদের মধ্যে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে আর সেই সম্পর্ক থেকেই একের প্রতি অন্যের প্রগাঢ় ভালোবাসা জন্মায় |
----অনেক ক্ষেত্রে তাও হয়না | দেখ একটা ছেলে বা মেয়ের জীবনে বিয়ের আগে ভালোবাসা আসতেই পারে | অনেক সময় এই ভালোবাসা বিয়ে পর্যন্ত গড়ায় না | পরে তাদের অন্যের সাথে বিয়ে হয় তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুখীও হয় | আর এইসব ক্ষেত্রে দেখা যায় উভয়ই উভয়ের ক্ষেত্রে বিষয়টা গোপনই রাখে | কিন্তু যে মেয়ে বিয়ের আগের রাতে তার হবু স্বামীকে ফোন করে তার অন্যের প্রতি ভালোবাসার কথা জানায় সে কতটা ডেসপারেট | একটা কথাও আমি ভেবেছি আর সেটা হচ্ছে শালিনীর বয়স এখন তেইশ বছর | এতটাই যখন সে ডেসপারেট হয়ে আমায় সব জানিয়েছে সে তো পুলিশের সাহায্য নিতে পারতো | আমি মেনে নিলাম তার বাবা, মা তাকে ঘরে আটকে রেখে জোর করে বিয়ে দিয়েছে | কিন্তু ফোনটা আমায় না করে সে তো পুলিশকে করতে পারতো |
রিতেশ এতক্ষণ পরে বলে উঠলো ,
--- আমাদের মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী পরিবারগুলি সহজে পুলিশের ঝামেলায় যেতে চায় না | সেক্ষেত্রে শালিনীও হয়তো ভেবেছিলো পুলিশকে জানিয়ে ঝামেলার থেকে তোমায় জানালে তুমি যদি বিয়েটা করতে না চাও তাহলে অনেক হ্যাপা থেকে সে মুক্তি পাবে | জানি না অবশ্য তার মনের কথা | তবে স্বাভাবিক ভাবে এটাই আমার মনে হচ্ছে | আর ডিভোর্সের কথা বলছো ?ওটা পেতে গেলেও তো কিছুটা সময় লাগবে | ডিভোর্স বললেই তো আর ডিভোর্স পাবে না | কাল আবার তোমার অষ্টমঙ্গল | সেখান থেকে ফিরে এসো তারপর দেখছি কি করতে পারি |
--- আমি কি এবারই ওখানে ওকে রেখে আসবো ?
--- নারে দাদা , একসাথেই ফিরতে হয় |
নিলয় তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো ,
--- অনেক তো নিয়মকানুন মানা হল কি লাভ হল তাতে ? আসলে কি জানিস তো - এইসব নিয়মকানুন মানে মানুষ শুধুমাত্র যে কোন অনুষ্ঠানে একটু আনন্দ - ফুর্তি করতে | এই নিয়মকানুন কারও জীবনে শান্তি , ভালোবাসা এনে দিতে পারে না | মানুষ জন্মানোর সময়ই তার ভাগ্য নিয়ে জন্মায় | কেউ মানুক বা না মানুক - কপালের লিখন কেউ খন্ডন করতে পারে না | অনেক সময় মানুষ তার কঠোর পরিশ্রম দ্বারা ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে | এখানে কাজ করে সর্বদা ঘূর্ণয়মান রাহু , কেতু সহ আরও অন্যান্য গ্রহ | ওই গ্রহের অবস্থান অনুযায়ীই ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয় | জন্মে দশা আর মৃত্যুতে দোষ - এটা অবশ্যম্ভাবী | এখানে কিন্তু কে বিশ্বাস করলো আর কে বিশ্বাস করলো না সেটা বড় কথা নয় | এই গ্রহ নক্ষত্র ব্যাপারগুলো কিন্তু বিজ্ঞানও স্বীকার করে | কিন্তু বিজ্ঞান ঠিকুজি কুষ্ঠী মানে না | জোতিষীরা কিন্তু গ্রহ নক্ষত্র অনুযায়ীই ঠিকুজি , কুষ্ঠি তৈরী করে মানুষের ভাগ্য গণনা করে থাকেন | আমি এসব মানি আর মানি বলেই এই ঘটনা নিয়ে আমার কোন দুঃখ নেই | আমার ভাগ্যে যা ছিল তাই ঘটেছে |
ক্রমশঃ-
No comments:
Post a Comment