একটু সহানুভূতি
অনেক কিছুই মেনে নিতে হয় মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতে গেলে | এই মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নিতে নিতে জীবনের নিজের ভালোলাগা মন্দলাগাগুলিও একসময় ভুলে যেতে হয় | তখন মাথায় থাকে শুধুমাত্র সেই পরিবারের সদস্যদের ভালোলাগাগুলি | সুতপার সকাল শুরু হত বিছানায় বসে এককাপ চা খেয়ে | তখন সে ক্লাস নাইনে পড়ে | ভীষণ ঘুম কাতুরে | ভোরে উঠে পড়তে বসতেই পারেনা | রোজ এই নিয়ে তার বাবা অশান্তি করেন তার মায়ের সাথে | মেয়ের ভিতর গুন কিছু দেখলেই বলে ওঠেন ," কার মেয়ে দেখতে হবে তো! " আর দোষ কিছু দেখলেই চিৎকার করে বলে ওঠেন ," এসব কিছু তোমার থেকে পেয়েছে |" রোজ এই এককথা শুনতে শুনতে শান্তিদেবী মেয়েকে ভোরে ঘুম থেকে তোলার জন্য বেড টি দিতে শুরু করলেন | বিছানায় বসে চা টা খেয়ে সত্যিই সুতপার ঘুম ভেঙ্গে যেত | আস্তে আস্তে এই বেড টি খাওয়াটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছিলো | পড়াশুনা শেষ হওয়ার পরেও মা রোজ তাকে ছটার মধ্যেই এককাপ গরম গরম চা দিয়ে যেতেন | বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে এসে এই চা না পেয়ে তার ঘুম থেকে উঠতে প্রথম প্রথম রোজই দেরি হত | তা নিয়ে অনেক কথা শুনতে হয়েছে তাকে | তার স্বামী , দেওর ,শ্বশুরমশাই এই তিনজনের বেড টি এখন সে দেয় | সকালে কাজের এতো তাড়া থাকে গরম অবস্থাতে কখনোই সে তার চা টা খেতে পারে না | টেবিলের উপর কাপে চা থাকতে থাকতে একসময় তা ঠান্ডা জল হয়ে যায় | তখন ইচ্ছা বা সময় কোনোটাই থাকে না ওটাকে গরম করার | ওই ঠান্ডা চা টাই ঢগঢগ করে জলের মতোই খেয়ে নেয়|
সুতপাদের বাড়িতে তরকারি হলেই তারমধ্যে চিংড়ি মাছ দিয়ে রান্না হত | সুতপা আর ওর বাবা চিংড়িটা খুব ভালোবাসতেন | শ্বশুরবাড়িতে এসে বেশ কয়েকমাস পরে রথীন বাজার যাওয়ার সময় বলেছিলো ," একটু চিংড়ি আর এঁচোড় নিয়ে এসো তো ---| রথীন সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলো , " বাবার চিংড়িতে এলার্জি আছে | তাই আমরা চিংড়ি বাড়িতে আনি না | আজ আমি নিয়ে আসবো কিন্তু তুমি আলাদা রান্না কোরো|" শুনেই সুতপা বলেছিলো ," নাগো তাহলে এনোনা | রান্না করবো অথচ বাবা খাবেন না আমার ভালো লাগবে না |" এই ঘটনার বেশ কয়েকদিন পর সুতপা ও রথীনকে তার মাসতুত ননদের বাড়িতে একদিন নিমন্ত্রণ করলো | সেখানে খেতে গিয়ে দেখে দিদি চিংড়ি দিয়ে এঁচোড় করেছে | সুতপা পুরো ভাতটাই তা দিয়ে খাচ্ছে দেখে রথীনকে বললো ,
--- তোর কথা শুনে এঁচোড় চিংড়ি করলাম সুতপা তো আর কিছু মুখেই দিচ্ছে না |
--- তোমাকে তোমার ভাই বলেছে এঁচোড় চিংড়ি করতে |
--- হ্যাঁ তো -- ওকে যখন আমি ফোনে নিমন্ত্রণ করলাম ও তখনই আমায় বলেছে -' দিদি অনেকদিন এঁচোড় চিংড়ি খাই না | একটু রান্না করিস তো |'
দিদির কথা শুনে সুতপা বুঝতে পেরেছিলো রথীন এটা তার জন্যই বলেছে | সেদিন মনটা খুশিতে ভরে গেছিলো | হয়ত বাড়িতে অশান্তির ভয়ে অনেক কিছুই সে করে উঠতে পারে না | কিন্তু ইচ্ছাটা তার ঠিকই আছে | তাই সুযোগ পেয়েই বৌয়ের ইচ্ছাটা পূরণ করতে চেয়েছে | এই ছোট্ট ছোট্ট না পাওয়াগুলি যদি অন্যভাবেও স্বামী বা অপর কেউ পূরণ করে দেয় তাহলে হয়ত শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে মেয়েরা এতো মানসিক অশান্তিতে ভুগতো না | সারাটা জীবন মেয়েরা শুধু ত্যাগ স্বীকার করেই যায় যার মূল্য কেউ দেয় না | কিন্তু সব থেকে কাছের মানুষটা যদি একটু সহনাভূতিশীল হয় তাহলে
জীবনের অনেক অভ্যাসকেই সহজেই জলাঞ্জলি দেওয়া যায় আর তাতে সেরকম কোন কষ্টও থাকে না |
বাইরে কোথাও বেড়াতে গেলেই হোটেলে গিয়ে রথীন মেনুকার্ডটা সুতপাকে ধরিয়ে দেয় | আর বলে, "তুমি তোমার পছন্দ মত খাবার অর্ডার করো--| বাড়িতে তো সব সময় আমাদের পছন্দ অনুযায়ী খাবার হয় | বাইরে খেলে আমি তোমার পছন্দ অনুযায়ী খাবার খাবো |" মাঝে মাঝে সুতপা ভাবে কপাল করে স্বামী পেয়েছি | একবার শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে শ্বাশুড়ি মায়ের কাছে রথীন শুনেছিলো যে সুতপার বেড টি খাওয়ার অভ্যাস ছিল | বিয়ের ত্রিশ বছর পর বাবা , মা যখন বেঁচে নেই , তাদের একমাত্র মেয়ে শ্বশুরবাড়ি , ভাই অতীন আমেরিকায় সেটেল্ড --- তখন রথীনের ও অনেক বয়স ; বয়সের দিক থেকে না হলেও মনের দিক থেকে এখনো সে তরতাজা যুবক | এমনই একদিন খুব ভোরে রথীন সুতপার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম থেকে ডেকে তোলে | সুতপা ধড়মড় করে উঠে বসে | রথীন হাসি মুখে এককাপ গরম চা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে ," তোমার পুরনো সব অভ্যাসগুলো আমি একটু একটু করে ফিরিয়ে দেবো | একসাথে থাকতে গেলে অনেককিছুই আমরা করে উঠতে পারি না | তোমারদের যেমন মানিয়ে নিতে হয় আমাদেরও ঠিক মেনে নিতে হয় কারণ তাতে শান্তি বজায় থাকে |" সুতপা রথীনের হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে পাশে রেখে রথীনের বুকের উপর মাথা রেখে এতদিনের জমানো অনেক কষ্ট চোখের জল করে বের করে দিলো | সত্যিই রথীন এই বয়সে এসেও সুতপার সেই পুরনো অভ্যাসগুলোকে যা অনভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছিলো একটু একটু করে সব ফিরিয়ে দিলো | এখন তার ফ্রিজে সব সময়ের জন্য চিংড়ি মাছ থাকে আর আজও সুতপা বেড টি না খেয়ে বিছানা ছাড়তে পারে না | এই রকম আরও অনেক কিছুই |কিন্তু সবাই তো আর রথীনের মত স্বামী পায় না | তার ভাগ্য ভালো তাই সে রথীনের মত স্বামী পেয়েছে |
#
No comments:
Post a Comment