জীবন যেখানে কথা বলে
যারা প্রেম করে বিয়ে করে তাদের ব্যপারটা আলাদা | কিন্তু যাদের দেখাশুনা করে বিয়ে হয় সেই ছেলে কিংবা মেয়েটির মনে বিয়ের আগে নানান প্রশ্ন উঁকি মারতে থাকে | কিন্তু হঠাৎ মনে আসা এই প্রশ্নগুলো সেই ছেলে বা মেয়েটি কারও সাথেই ভাগ করতে পারেনা | " ছেলেটি ভালো হবে তো ? আমায় ভালোবাসবে তো? আমার বাবা মাকে সম্মানের চোখে দেখবে তো ?-- অপরদিকে ছেলেটির মনেও একই ধরণের প্রশ্ন উঁকি মারতে থাকে |
দুইবাড়ির পছন্দে অনামিকা আর অভিকের বিয়ে হয় | অনামিকা খুবই বড় ঘরের সন্তান | তার বাবা বিশাল ব্যবসায়ী | একমাত্র সন্তান অনামিকা | কোটিপতি ব্যবসায়ী অভিক আমেরিকান ফার্মে কর্মরত জেনে মনেমনে অনেক স্বপ্ন দেখে ফেলেছিলেন তাই সাত তাড়াতাড়ি বিয়েটা দিয়ে ফেললেন | অনামিকা শ্বশুরবাড়িতে এসে অভিকের বাবা , মায়ের ব্যবহার আর ভালোবাসা পেয়ে কখনোই তার মনে হয়নি এঁরা তার নিজের বাবা , মা নন | অভিকও তাকে ভীষণ ভালোবাসে | কিন্তু ছমাসের মধ্যেই অভিকের খোদ আমেরিকাতেই বদলির অর্ডার এসে গেলো | অনামিকা মানসিক দিক থেকে ভীষণ ভেঙ্গে পড়লো | বাড়িতে গিয়ে মায়ের কাছে জানতে পারলো বাবা তার প্রভাব খাটিয়ে এই ব্যবস্থা করেছেন | অনামিকা যাবেনা বলে বেঁকে বসলো | কিন্তু শেষ পর্যন্ত অভিকের ভালোবাসার কাছে তার এই জীদ চাপা পরে গেলো | কিন্তু বাবার এই কারসাজির কথা সে শ্বশুরবাড়িতে কাউকেই জানাতে পারলো না | শুধু অভিকের সাথেই দরজা বন্ধ করে যুদ্ধ চালিয়ে গেলো |চোখের জলে ছেলে আর বৌমাকে বিদায় দিয়ে খুবই ভেঙ্গে পড়লেন আলোকবাবু ও রেখাদেবী |
যাওয়ার সময় অনামিকা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে | অসহায়ের মত স্বামীর সাথে যেতে বাধ্যও হয়েছে | প্রথম প্রথম বাবা , মায়ের সাথে অভিকের যোগাযোগ থাকলেও পরে আস্তে আস্তে সে যোগাযোগ কমতে থাকে | কিন্তু অনামিকার সাথে নিত্য যোগাযোগ রয়েই যায় | অভিক আর দেশে ফিরবেনা জানিয়েও দেয় | শ্বশুর , শ্বাশুড়ি এক বছরের মধ্যেই সেখান থেকে ঘুরেও আসেন | কিন্তু অভিকের অসহায় পিতামাতার ওই ফোনই সম্বল |
দেখতে দেখতে বছর পাঁচেক কেটে গেলো | রেখাদেবী এখন রোজই তার বৌমাকে বলেন একটা নাতি নাতনির মুখ দেখে যেতে চান | রেখা অভিক দুজনেই ভাবে সত্যিই তো তাদের একটা বাচ্চা দরকার এখন | কিন্তু না ছমাসের মধ্যেও কোন খবর দিতে না পারায় তারা ডক্টরের শরণাপন্ন হয় | ডাক্তার অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জানিয়ে দেন অনামিকার পক্ষে মা হওয়া কোনদিনও সম্ভব নয় | অনামিকার সাথে অভিকও মানসিকভাবে ভীষণ ভেঙ্গে পরে | তখন অনামিকা নিজেই বলে অভিককে ," আমরা একটা বাচ্চা দত্তক নেবো |" কিন্তু অভিক যেমন নিজেই রাজি হয়না এবং তার মা রাজি হবেনা বলেও জানায় |
--- আমরা মাকে জানাবোই না
--- মানে বাচ্চা দত্তক নেবো আর মা , বাবা জানবেন না ?
--- বাচ্চাটা দত্তক নেবো ঠিকই কিন্তু সকলে জানবে ও আমাদেরই বাচ্চা |
--- সেটা কি করে সম্ভব ?
--- দত্তক আমরা ইন্ডিয়াতে ফিরে গিয়েই নেবো |
--- সবাইকে মিথ্যে বলবো ?
--- দেখো জীবনে এমন অনেক সময় আসে সেখানে সত্যি বলার চেয়ে মিথ্যে বললে সকলের মঙ্গল হয় সে মিথ্যেতে কোন পাপ নেই | যেকোন যুদ্ধে জয়লাভ করায় হচ্ছে মূল উদ্দেশ্য | যুদ্ধে জয়লাভের জন্য ছলচাতুরির আশ্রয় নেওয়া অন্যায় নয় | কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ছিল ধর্মযুদ্ধ | সেখানে স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণই কিন্তু চাতুরির আশ্রয় নিতে অর্জুনকে প্ররোচিত করেছিলেন | আর ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরও ঘুরিয়ে মিথ্যা বলেছিলেন | আর আমরা তো সাধারণ মানুষ | শুধুমাত্র নিজের স্বার্থ নয় সম্মিলিত স্বার্থের কারণে মিথ্যা বললে কোন অন্যায় বা পাপ হয়না |
সেদিন থেকেই শুরু হয় নানান ওয়েবসাইট ঘাটা | এইসব ওয়েবসাইট ঘেটে তারা জানতে পারে খোদ কলকাতা সল্টলেকেই এইরূপ একটি সেন্টার আছে | সেখানে তারা যোগাযোগ করে | কিন্তু তারা জানায় ফর্মফিলাপ করার পর কম করে চার থেকে পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে একটি বাচ্চা পেতে | সেখান থেকেই নানান রাজ্যের নানান সেন্টারের কথা জানতে পারে | শেষে উড়িষ্যার একটি সেন্টারে তারা ফর্মফিলাম করে প্রাথমিক কাজকর্মগুলি সেরে ফেলে | কথা হয় বছর দেড়েকের মধ্যে তারা বাচ্চা পাবে | ঠিক তার ছ, সাত মাস পরেই দুইবাড়িতে অনামিকার বাচ্চা হবে বলে জানিয়ে দেয় | আর অভিক কিছুতেই কলকাতায় ট্রান্সফার নেওয়ার জন্য কোম্পানিকে রাজি করাতে না পেরে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলে |
এদিকে শ্বশুরমশাইয়ের শরীর মারাত্মক খারাপ হয়ে পরে | রেখাদেবী রোজই তার বৌমাকে সাবধানে থাকা খাওয়ার টিপস দিয়েই চলেছেন | অনামিকার মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে ঠিকই | কিন্তু সেও তো নিরুপায় | মা ডাক শোনার যে তীব্র আকাঙ্খা তারজন্য এই মিথ্যার আশ্রয় টুকু তাকে নিতেই হচ্ছে |
সেন্টার থেকে তিনমাসের একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানের ছবি তাদের পাঠায় | তারা বাচ্চাটি পছন্দ হয়েছে বলে জানালে তাদের সম্ভাব্য একটি তারিখ জানিয়ে দেওয়া হয় বাচ্চাটিকে হাতে পাওয়ার | অভিকও এরইমাঝে একদিন দুইবাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দেয় তাদের একটি মেয়ে হয়েছে | ছবি পাঠাতে বললে অভিক ইন্টারনেট থেকে একটি সদ্যজাত বাচ্চার ছবি খুঁজে বের করে দুবাড়িতে পাঠিয়ে দেয় | অভিক চাকরি ছেড়ে দিয়েই বাচ্চাটি হাতে পাওয়ার তারিখ অনুযায়ী টিকিট কেটে সরাসরি উড়িষ্যায় পৌঁছে যায় আমেরিকার বাস উঠিয়ে | দুই বাড়িতেই তাদের আসার খবর গোপন রাখা হয় | বাচ্চাটি হাতে পাওয়ার পরেও বেশ কিছুদিন তারা ওখানেই হোটেলে থেকে যায় কারণ তাদের আইনি মারফত দত্তক নেওয়ার জন্য বেশ কয়েকবার কোর্টে হাজিরা দিতে হয় | সব কাজ সেরে তারা বাড়িতে ফেরার কথা জানায় | অনামিকার বাবা অসুস্থ্য থাকার জন্য তিনি এয়ারপোর্ট যেতে পারেননা | ড্রাইভারকে নিয়ে অভিকের বাবা এয়ারপোর্টে হাজির হয়ে যান | নাতনির মুখ দেখে তিনি তো বেজাই খুশি | অভিকের মা প্রদীপ জ্বালিয়ে , শাঁখ বাজিয়ে , উলু দিয়ে তিনি তার অভিকের মেয়েকে ঘরে তোলেন |
মাস চারেকের মধ্যে অনামিকার বাবা মারা যান | অভিকই এখন শ্বশুরের ব্যবসার মালিক | চাকরিটা যে সে ছেড়ে এসেছিলো সেটাও কাউকে সে জানিয়েছিল না | তাদের আদরের আরাধ্যা এখন সমস্ত ঘর হামা দিয়ে বেড়ায় | অভিকের বাবা মায়ের এখন সময় কাটে তাদের নাতনিকে নিয়েই | আগে অভিক অনামিকার মনে কষ্ট হলেও এখন আর তাদের কোন কষ্ট নেই | সামান্য মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে এই তিন তিনটি বয়স্ক মানুষের মুখের হাসি দেখে তারা দুজনেই খুব গর্বিত এই মিথ্যা বলা নিয়ে |
No comments:
Post a Comment