Friday, May 31, 2024

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (১০ম পর্ব)

সুবর্ণা হুইল চেয়ার নিয়ে কিছুটা এগোনোর সাথে সাথে দেবেশ দ্রুত হেঁটে গিয়ে সুবর্ণার কাছ থেকে চেয়ারটা নিতে যায়। সুবর্ণা সঙ্গে সঙ্গেই হাতল দু'টি ছেড়ে দেয় কারণ বিদিশা পিছন দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে পড়েন।এই ঘটনা বিদিশার মনে একটু খটকা লাগে। কারণ আজ পর্যন্ত যত আয়া তার জন্য এবাড়ি এসেছে যতদূর তার মনে পড়ছে কারো সাথে দেবেশ কোনদিনও কথা বলেনি। কিন্তু আজ দেবেশ সুবর্ণার কাছে এসে যে বললো "আমাকে দাও" - কথাটা বিদিশার মনে কিছুটা হলেও কৌতূহলের সৃষ্টি করে। তবে এটাও তিনি ভাবেন কোনদিনও কোন মেয়ে রান্নাঘরে খাওয়ার সময় ছাড়া যেমন ঢোকেনি ঠিক তেমনই তাকে কেউ কোনদিনও জোর করে খাওয়ার টেবিলে নিয়ে আসেনি। দেবেশের হয়ত এটা ভালো লেগেছে। তাই সে আজ সুবর্ণার কাছ থেকে হুইল চেয়ারটা নিয়ে নিজে তার ঘরে এসেছে। কিন্তু ঘরে ঢুকে মাকে তুলতে গিয়ে একবারে সম্ভব না হলে সুবর্ণা এগিয়ে এসে বলে,
-- আমি পায়ের দিকটা ধরছি তু --
বলেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
-- আপনি মায়ের বগলের তলা দিয়ে ধরুন।
 দেবেশ সুবর্ণার কথামত মাকে সেইভাবে তুলে ধরে। সুবর্ণা পা দু'টো ধরে দেবেশের সাথে খাটে বসিয়ে দেয় বিদিশাকে। দেবেশ সুবর্ণার মুখের দিকে তাকালে বিদিশা সেটাও খেয়াল করেন। দেবেশ বেরিয়ে গেলে সুবর্ণা বিদিশাকে বলে,
-- মা, আমি একটু রান্নাঘরে গিয়ে পিসিকে সাহায্য করি?
-- হ্যাঁ যা। বাপ,ছেলে বেরিয়ে গেলে আমায় এসে স্নান করিয়ে দিস। এতদিন ধরে শুয়ে থেকে নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসটাই চলে গেছিলো। ওরা আমাকে বারবার বলতো হুইল চেয়ারে করে ঘরের ভিতরেই ঘুরতে। কিন্তু স্নান করতে গিয়েই কোমরে ব্যথা শুরু হয় তাই সাহসই পায়নি এতদিন।কিন্তু তুই এসে যেন আমার সাহস বারিয়ে দিয়েছিস মা। ঈশ্বর তোর মঙ্গল করুন। আজ মনটাও খুব ফুরফুরে লাগছে। যা তুই বিলাসীর কাছে। আমাকে পেপারটা দিয়ে যাস।
 "হ্যাঁ" বলে সুবর্ণা রান্নাঘরে যেতে গিয়ে পথের মাঝখানে দেবেশকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে না দেখার ভান করে এগিয়ে যেতে গেলে দেবেশ তাকে বলে,
-- থ্যাংকস।মা আজ অনেকদিন পর নিজের ঘর থেকে বেরোলেন। বাবা,আমি দু'জনেই খুব খুশি। বাবা তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
 সুবর্ণা দেবেশের দিকে তাকিয়ে বলে,
-- এসব কথা আমার না শুনলেও চলবে। আমার কাজ আছে। 
 সুবর্ণা চলে গেলে দেবেশ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে মনেমনে বললো ,'একসময় আমি এটাই চেয়েছিলাম। তোমায় নিজের করে বাড়িতে নিয়ে আসবো আর এভাবেই তুমি সকলের মন জয় করবে। সবকিছু যেন কেমন ওলটপালট হয়ে গেলো।"
   এইভাবে পাঁচ পাঁচটা দিন কেটে গেলো সুবর্ণার এ বাড়িতে। রবিবার তার বাড়িতে যাওয়ার কথা। রাতেই স্বরূপ তাকে এই সাতদিনের জন্য একটা মোটা অংকের টাকা খামে করে হাতে দিয়ে দিয়ে বললেন,
-- প্রত্যেক সপ্তাহে বাড়ি যাওয়ার সময় তুমি এই টাকাটা পাবে। আমি প্রতি সপ্তাহেই তোমায় তোমার টাকা দিয়ে দেবো। আজ পর্যন্ত যত মেয়ে এসেছে তোমার মাকে দেখাশুনার জন্য তাদের সাথে তোমার কোন তুলনায় হয় না। মাত্র কটাদিনেই তুমি তোমার মায়ের মনের বল অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছো। ডাক্তারী শাস্ত্র অনুযায়ী এই রোগের সবচেয়ে ভালো ওষুধ হচ্ছে মনের বল যা তোমার মা হারিয়ে ফেলেছিলেন। কোথাও তেমন কোন সমস্যা ওর শরীরে নেই। আমি নিজে একজন ডাক্তার হয়ে বলছি তুমিই পারবে আমার স্ত্রীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুলতে। 
-- আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।
 কথা শেষ করে সুবর্ণা আবার বিদিশার ঘরে ফিরে আসে। 
-- কিরে খামটা খুলে দেখেছিস?
-- না, বাড়ি গিয়ে মায়ের হাতে দেবো মা তখন দেখবেন
-- দূর বোকা মেয়ে! দেখে আমায় বলতো কত আছে ওর ভিতর? তোর চলবে কিনা ওই টাকাই?
-- তুমি এসব নিয়ে ভেবো না। যা আছে থাক।
-- আসলে কী জানিস মা ? তোর চালচলন, ব্যবহার আমাকে পরিস্কার বুঝিয়ে দিয়েছে তুই ভালোঘরের লেখাপড়া জানা একটি মেয়ে। নিজের সংসারকে বাঁচাতে চাকরি না পেয়ে তুই এই কাজে এসেছিস। এটা সত্যি তুই চলে গেলে আমার খুব কষ্ট হবে কিন্তু তবুও তোকে বলছি কাগজপত্রগুলো নিয়ে আছিস দেখি বাপ,ছেলেকে বলে তোর ভালো কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারি কিনা। 
-- আমার তো একাজ করতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না। তোমার যদি আমাকে পছন্দ নাহয় তাহলে অন্য কথা।
-- ও তুই বুঝে গেছিস তোকে আমি কতটা ভালোবেসে ফেলেছি। তাই আমার সাথে ইয়ার্কি হচ্ছে?
সুবর্ণা হাসতে হাসতে বলে,
-- চলো, অনেক রাত হল এবার খেতে যাই
-- আজও আমায় টেবিলে খেতে যেতে হবে?
-- তাতো যেতেই হবে। কারণ তুমি পারো। আজ আমি একাই তোমায় চেয়ারে বসাবো
-- আরে না, তুই ওদের কাউকে ডাক
 ওদের কথার মাঝখানে বিলাসী খাবার নিয়ে আসে। দেখতে পেয়ে সুবর্ণা বলে,
-- পিসি, মা টেবিলেই খাবেন সকলের সাথে কথা বলতে বলতে। তুমি খাবারটা টেবিলে রেখে এসে আমায় একটু হেল্প করো মাকে চেয়ারে বসাতে।
 বিলাসী খাবার নিয়ে চলে যেতেই সেখানে এসে হাজির হল দেবেশ।
 সুবর্ণা আর দেবেশ দু'জনে মিলে বিদিশাকে চেয়ারে বসিয়ে দেবেশ নিজেই চেয়ার নিয়ে ডাইনিং রুমের দিকে এগিয়ে যায়। এরমধ্যে বেশ কয়েকবার দু'জনের চোখাচোখি হয়। কিন্তু কেউই কোন কথা বলে না। দু'জনের বুকেই কাঁপুনি কিন্তু কারো কাছেই কারো প্রকাশ তার নেই। 
আজ যেন বিদিশা আরও বেশি সতর্ক এই দু'টি তরুণ,তরুণীর আচারাচরণের দিকে। সুবর্ণা আসার পর থেকেই দেবেশকে যেন মায়ের ঘরে একটু বেশিবার এবং একটু বেশি সময় বিদিশা পাচ্ছেন। তাই তিনি সব সময় নিজের চোখ, কানকে বেশি সতর্ক রেখেছেন। কিন্তু এরা পরস্পরের সম্পর্কে নিজেরা যেন নিজেদের মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে। সুবর্ণাকে বিদিশার বেশ ভালো লেগেছে। আর ছেলের সুবর্ণার সামনে বেশি আনাগোনার ফলে বিদিশার মনেও একটা আশার আলো জ্বলতে শুরু করেছে। এবার হয়ত তার দেবু বিয়ের ব্যাপারে নিজের মত পাল্টাবে। 
খাবার টেবিলে সুবর্ণা খাবার সার্ভ করছিল। স্বরূপ এবং বিদিশার পাতে বেগুন ভাজা দিলেও দেবেশের থালায় সেটা ছিল না। কারণ দেবেশের বেগুন ভাজায় এলার্জি আছে। বিদিশা সেটাও খেয়াল করেন। কিন্তু কোন অবস্থাতেই এই কয়দিনে সুবর্ণার সেটা জানার কথা নয়  কারণ সে আসার পর আজই প্রথম বেগুন ভাজা হয়েছে। এই টুকরো টুকরো ঘটনাগুলি বিদিশাকে ভাবাচ্ছে এরা দু'জন আগে থাকতেই দু'জনকে চেনে। কিন্তু যতক্ষণ না পর্যন্ত সিওর হচ্ছেন ততক্ষন পর্যন্ত কিছু বলতেও পারছেন না। তবে এই ঘটনাগুলো তিনি খুবই উপভোগ করছেন।
 রুটি,তরকারি খেতে গিয়ে দেবেশের ভিসুম লাগে। সুবর্ণা তড়িঘড়ি জলের গ্লাস এগিয়ে দেয় তার দিকে। জল খেয়ে ধাতস্ত হয়ে দেবেশ সুবর্ণার দিকে তাকিয়ে বলে, "থ্যাংকস"। সেটাও বিদিশার নজর এড়ায় না। তিনি সুবর্ণার দিকে তাকিয়ে বলেন,
-- তুইও বসে পড় আমাদের সাথে।
 বিদিশার কথা শুনে বাপ,ছেলে অবাক হয়ে তার দিকে তাকান। কারণ আজ পর্যন্ত যারা তার দেখভালের জন্য এ বাড়িতে এসেছে তাদের কেউই কোনদিনও টেবিলে তাদের সাথে বসে খাওয়ার অনুমতি পায়নি। এমনকি বিলাসীর জন্যও রান্নাঘরে টেবিল বরাদ্দ। বিদিশার কথা শুনে সুবর্ণা বলে,
-- তোমরা খেয়ে নাও আমি পিসির সাথে রান্নাঘরে বসে খাবো।
-- কেন আমাদের সাথে খেতে তোর আপত্তি কোথায়?
 আপত্তিটা যে কোনখানে তা সুবর্ণা কী করে বলবে বিদিশাকে? এরই মধ্যে কতবার যে দেবেশ তার দিকে তাকিয়েছে আর তার এই তাকানোর ফলে সুবর্ণার বুকের ভিতর যে বিদ্যুত খেলে গেছে তার আচ সে ছাড়া আর কেউই জানে না।
 খাওয়া শেষে দেবেশ মাকে নিয়ে গিয়ে খাটের উপর বসিয়ে দিয়ে আসে। কিন্তু কোন এক ফাঁকে সে সুবর্ণার হাতের মধ্যে একটা কাগজের টুকরো গুঁজে দেয়।

ক্রমশ

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (২০তম পর্ব)

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার ( ২০ তম পর্ব)

  সকাল দশটা নাগাদ রজতের ঘুম ভাঙে। সে ঘুমাতে লাগলে এর আগে তার মা,বাবা বহুবার এঘরে এসেছেন। ছেলে অঘোরে ঘুমাচ্ছে দেখে কোন সাড়াশব্দ নেই তাতেও মা,বাবার আতঙ্ক কমে না। চশমার ডাটি ধরে বুকের কাছে ঝুঁকে পড়ে দেখেন ঠিকমত নিশ্বাস-প্রশ্বাস চলছে কিনা। মা, বাবার সব সময়ই তার সন্তানকে নিয়ে এক দুশ্চিন্তা থেকেই যায়।
সেই জন্মের থেকে মৃত্যু পর্যন্ত।
  রজত ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে। সে ভাবতে চেষ্টা করে গত দু'দিন তার সাথে কী কী ঘটেছে আর সে যদি একটু সাহসী না হত তাহলে কী ঘটতে পারতো। ট্রেনে করে নিত্য যাতায়াতের সূত্র ধরে অনেক মুখের সাথেই একটা পরিচিতি গড়ে উঠেছে। মুখোমুখি হয়ে গেলে জাস্ট একটু হেসে পড়া। কিন্তু সেদিন কী যে হল। ওই মেয়েটাকে তো সে বহুবার দেখেছে, মামুলি কথাও কখনো সখনো হয়েছে। কিন্তু তার ভিতর কী এমন হল যে গত পরশু মেয়েটির কথামত তার পিছন পিছন গাড়ি থেকে এক অচেনা স্টেশনে নেমে পুণরায় অন্য একটা ট্রেনে উঠে পড়লো। মেয়েটি এক সময় তাকে বলেছিল,
-- আমার ফোনটাই চার্জ নেই যদি আপনি ফোনটা দিতেন আমি একটা কল করতাম।
 পকেট থেকে ফোন বের করে রজত মেয়েটির হাতে দেয়। খুব ঘুম পাচ্ছিল রজতের। যখন ওর ঘুম ভাঙে তখন সে নিজেকে আবিষ্কার করে একটা অন্ধকার ঘরের মধ্যে শুয়ে আছে। মশা ছেঁকে ধরেছে। উঠার ক্ষমতা নেই। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল। একসময় ঘরের ভিতরে কিছু লোকজন ঢোকে তাদের সকলের মুখেই কাপড় বাঁধা। শুধু চোখদু'টি তাদের দেখা যাচ্ছে। সামনে তিনটে রুটি আর আলুর তরকারি দিয়ে কেউ একজন তাকে বলেছিল,
-- খাবারটা খেয়ে নিন। আর একদম পালানোর চেষ্টা করবেন না। আমাদের লোকজন বাইরে সবসময় পাহারায় আছে।
 কাউকেই সে চিনতে পারছিল না কিন্তু প্রচণ্ড খিদে পাওয়াতে সে রুটি আর তরকারি পুরোটা খেয়ে নেয়। তারপর আবার কোন সময় যেন ঘুমিয়ে পড়ে।
 তার চিন্তায় ছেদ পড়ে মা যখন এসে তার ঘরে ঢোকেন।
-- ঘুম ভাঙলো তোর রাজু? 
-- হ্যাঁ মা কিন্তু খুব খিদে পেয়েছে। তাতো পাবেই রে। তুই দাঁত ব্রাশ করে নে আমি তোর জন্য চা করে নিয়ে আসি।
 রজতের গলার আওয়াজ পেয়ে রজতের বাবা এই ঘরের দিকেই আসছিলেন। রজতের মা বেরিয়ে যেতে গেলে রজত মাকে ডেকে বলে,
-- মা সুলতা আসেনি কাল?
 রজতের মা কথাটা শুনতে পান না। তিনি বেরিয়ে যান ঘর থেকে। কিন্তু উত্তরটা দেন রজতের বাবা,
-- আসেনি মানে? মেয়েটা নাওয়া-খাওয়া ভুলে এ দু'টোদিন পাগলের মত ছুটাছুটি করেছে। একদিকে অফিস আর অন্যদিকে তোর জন্য দৌড়াদৌড়ি। গতকাল অফিস করে থানা হয়ে যখন বাড়িতে ফিরেছে তখন রাস্তায় তোর ফেরার খবর শুনেই মাকে নিয়ে অত রাতে ছুটে এসেছে। অনেক রাতে এখান থেকে ফিরেছে। তোর মা তো বললেন তোকে নাকি ঘুমের মধ্যে দুধ,রুটি মাখা খাইয়েও দিয়েছে। সকালে তো সময় পায় না ও ঠিক আফিস থেকে ফিরেই চলে আসবে। কিন্তু তুই আমাকে এখন বল তো কী করে কী হল?
-- বলবো বাবা সব বলবো। আগে আমি নিজে একটু ধাতস্ত হয়ে নিই। প্রচণ্ড খিদে পেটে। স্নানটা করে আসি। খেয়েদেয়ে তারপর সব বলছি তোমাদের। 
রজতের বাবা আর জোর করলেন না। তিনি ছেলের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে তার কথার সমর্থন জানালেন।
 রজত পেষ্ট ব্রাশ নিয়ে ড্রয়িং কাম ডাইনিংয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত মাজতে মাজতে পুনরায় ভাবতে থাকে ওই মেয়েটার নামও সে জানে না। মুখ চেনা একই বগিতে সেদিন পাশাপাশি সিটে বসা। সে পকেট থেকে ফোনটা বের করে মেয়েটাকে দেয়। মেয়েটা কথা বলে তাকে ফোনটা ফেরত দেয়। পকেটেও রাখে সে। কিন্তু তারপর কী যে হল প্রচণ্ড ঘুম পেতে লাগলো। পকেটে সেদিন মাইনের সব টাকা। একবার হাত দিয়ে প্যান্টের ভিতরের পকেটে একটু চাপ দিয়ে দেখে নিলো। তারপর যা কিছু ঘটেছে তার আবছা আবছা মনে আছে। মেয়েটা তাকে হাত ধরে ট্রেন থেকে নামালো। তারপর ওভার ব্রিজ করে অন্য একটা ট্রেনে উঠলো। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। ট্রেনে বসে পড়েই পূনরায় ঘুমিয়ে পড়ে সে। কিন্তু যখন ঘুম ভাঙে তখন দেখে একটা অন্ধকার ঘরে শুয়ে আছে সে। এর আগে ওই মেয়েটা তাকে বোতলে জলও খেতে দেয়। জলটাই কোন টেস্ট ছিল না। কেমন যেন লাগছিল খেতে। কিন্তু ওই মেয়েটি তাকে জোর করে বোতলের পুরো জলটা খাওয়ায়।

ক্রমশ 
 

Thursday, May 2, 2024

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (১৯তম)

 ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (১৯ তম পর্ব)

  সেদিন বাড়ি ফিরতে সুলতা আর তার মায়ের অনেকটাই দেরি হয়ে গেলো। পরদিন অফিস যেতেই হবে। অফিস থেকে ফিরে আবার রজতকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে যে রজতের সাথে দেখা করে যাবে সেটাও সম্ভব নয়। হয়ত সে অত সকালে উঠবেই না। অফিস তো তাকে যেতেই হবে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যেন সুলতার চোখদু'টো ঘুমে জড়িয়ে এলো। ঘুম ভাঙলো সকালে মায়ের ডাকে। মা যে ইচ্ছাকৃতই একটু দেরি করে তাকে ঘুম থেকে ডেকেছেন যাতে তার ঘুমটা পুষিয়ে যায় এটা সুলতা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে বেরিয়ে পড়ে। ৮-২০ লোকালটা না পেলে অফিসে দেরি হয়ে যায়। তাই যেভাবেই হোক সময় মত স্টেশনে পৌঁছাতেই হবে।
  অনেকদিন পর আজ হঠাৎ করেই তার সুবর্ণার সাথে দেখা হয়ে যায়। সুলতা তার সাময়িক সমস্যার কথা মন খুলে সুবর্ণাকে বললেও সুবর্ণা কিন্তু তার সম্পর্কে কোন কথাই জানায় না। চুপচাপ সুলতার কথা শুনে যায়। পাশের সহযাত্রীর চার,পাঁচ বছরের বাচ্চার দুষ্টুমির দিকেই তার নজর বেশি। সুবর্ণা নিজের সমস্যায় এতই জর্জরিত অন্য কারো সমস্যা শুনলে কিংবা দেখলেও কিছুটা আনমনা হয়েই পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। কারণ তার মাথায় কোনকিছুই ঢুকছে না। একদিকে দেবেশের ভালোবাসার পাগলামি অন্যদিকে তার নিজের পরিবারের দু'মুঠো অন্নের সংস্থান তাকে উদ্ভ্রান্ত করে দিচ্ছে। দেবেশকে কিছুতেই সে পাশ কাটাতে পারছে না। অথচ ওই কাজটা ছেড়েও চলে আসতে পারছে না। ইচ্ছাকৃত যে তাকে মাইনেটা বেশি দেওয়া হচ্ছে তা সে বেশ ভালই বুঝতে পারছে। আজ সে তার সমস্ত সার্টিফিকেটগুলো নিয়েই যাচ্ছে কারণ দেবেশ তাকে মাথার দিব্যি দিয়েছে। বিদিশা অনেকটাই মনের জোর পেয়েছেন সুবর্ণার কারণেই। যদি কোন চাকরির জোগাড় দেবেশ করতেও পারে তখন ওখান থেকে চলে আসলেও তার অসুবিধা হবে। এইসব হিজিবিজি চিন্তায় মনটা সব সময়ই অন্যমনস্ক থাকে। তাই সুলতার সবকথা তার কান অবধি পৌঁছায়ও না।
 আসলে নিম্নবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় সন্তান হয়ে জন্মানোটাই অনেক সময় কারো কারো জীবনে অভিশাপ হয়ে যায়। একমাত্র স্বার্থপর হলেই তারা জীবনটাকে গুছিয়ে নিতে পারে। আর যারা সেটা পারে না তাদের সারাজীবন বাপেরবাড়ির জোয়াল টানতেই জীবন শেষ হয়ে যায়। সুলতা আর সুবর্ণার পারিবারিক সমস্যা এক। দু'জনেই নানান জটিলতার মধ্য দিয়ে একইভাবে এগিয়ে চলেছে। 
 শিয়ালদহ এসে যে যার গন্তব্যে এগিয়ে যায়। দু'জনকেই বাস রাস্তায় এসে বাস ধরতে হয় কিন্তু নম্বর আলাদা।
 সুলতা অফিসে পৌঁছে ম্যানেজারের ঘরে ঢোকে সই করতে। সেখানে গিয়ে দেখে পুরনো এক বয়স্ক কর্মচারী বসে আছেন। সুলতা তাকে আগে থাকতেই চিনতো। সুলতাকে দেখে তিনি জানতে চাইলেন,
-- কেমন আছো মা? চিনতে পারছো তো আমাকে?
-- হ্যাঁ হ্যাঁ মেসোমশাই চিনতে পারছি। ওই চলে যাচ্ছে আর কী? তা কী মনে করে এতদিন পরে?
-- মা,আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। ম্যানেজারের সঙ্গে চাকরি জীবনের আগে থেকেই পরিচিতি। তাই আসলাম উনাকে গরীবের বাড়িতে পদধূলি দেওয়ার নিমন্ত্রণ জানাতে। তা তোমার সাথে যখন দেখা হয়ে গেলো মা তুমিও যেও। দাঁড়াও আমি তোমাকে একটা কার্ড দিই।
-- না না মেসোমশাই। কার্ড দিতে হবে না। আমি যদি যেতে পারি ম্যানেজারবাবুর সাথেই যাবো। আসলে কি জানেন? নানান সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
 কথাটা কানে যেতেই ম্যানেজারবাবু বললেন,
-- ভুলে যাই বয়সের ভারে সব। তা কোন খবর পেলে তোমার সেই পরিচিতের?
-- হ্যাঁ গতকাল নিজেই বাড়ি ফিরেছেন। তবে কথা বলার মত অবস্থায় নেই। থরথর করে কাঁপছে। মনেহচ্ছে এ দু'টোদিন ঘুম খাওয়া কোনটাই হয়নি। অনেক রাত পর্যন্ত ওখানেই ছিলাম। কিন্তু কোন কথা এখনো জানতে পারিনি। তবে মনেহচ্ছে এমন কিছু ওর সাথে ঘটেছে যার জেরে ও খুব ভয়ে আছে। বাড়িতে পৌঁছে ভাবছি নিয়ে একটু ডাক্তারের কাছে যাবো।
-- সেই ভালো হবে। 
 দু'জনকে বলে সুলতা ম্যানেজারের রুম থেকে বেরিয়ে যায়। সারাদিন অফিসে হাড়ভাঙা খাটুনি করতে করতে এক মুহূর্তের জন্যও সে রজতের কথা মাথা থেকে নামাতে পারেনি। কারা এবং কেন ওকে কিডন্যাপ করেছিলো এটা কিছুতেই মাথায় আসছে না তার। মুক্তিপণের জন্য কোন ফোন আসেনি। তারমানে তারা এটাও জানতো টাকা চাইলে দেওয়ার মত ক্ষমতা তাদের নেই। যেহেতু পে-ডেট ছিল তাই মাইনের টাকা এবং মোবাইল নিয়ে তো ওকে ছেড়ে দিতেই পারত। তা না করে ওকে তুলে নিয়ে গেলো কেন? কী এমন রহস্য এর ভিতর লুকিয়ে আছে?

ক্রমশ
    

Sunday, April 28, 2024

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (১৮তম পর্ব)

সুলতা পাড়ার জেঠিমার কথা শুনে প্রচণ্ড অবাক হয়ে যায়। বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে জানতে চায়,
-- কোথায় ছিল এই দু'টোদিন?
-- সে সব তো কিছু বলতেই পারছে না। খুব দূর্বল। রাস্তা দিয়ে টলতে টলতে বাড়িতে গেছে। আমরা অনেকেই ওর পিছন পিছন যেতে যেতে জানতে চেয়েছি। কিন্তু ও কারো কথার উত্তর করেনি। 
-- জেঠি, তাহলে আমি এখুনি যাই। পরে তোমার সাথে কথা বলবো। 
 রজতের বাড়ির দিকে রওনা হয়েও সে আগে বাড়ি গিয়ে ঢোকে। কারণ রাত অনেক। বাবা,মা দু'জনেই চিন্তা করছেন তার ফিরতে দেরি দেখে। বাড়িতে ঢুকে সব জানিয়ে মাকে সাথে নিয়ে সে রজতের বাড়ির দিকে এগোতে থাকে  দু'দিন পরে তার মনেহচ্ছে যেন তার নিশ্বাস-প্রশ্বাস সেই আগের মত চলছে। এই দু'দিন যেন সে দম বন্ধ করেই ছিল। খুব দ্রুত হেঁটে তারা রজতদের বাড়ি পৌঁছালো। দরজা খোলা ছিল কারণ কিছু পাড়াপ্রতিবেশী রজতদের বাড়িতে তখনো ছিলেন। সকলেই সামনে ঘরে বসে। সুলতা হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকেই রজতের বাবার কাছে জানতে চাইলো,
-- কখন ফিরেছে ও?
-- তোমার সাথে ফোনে আমি কথা বলার কিছুক্ষণ পর।
-- কোথায় ছিল এ দু'দিন?
-- সেতো কথা বলার মত অবস্থায় নেই। প্রচণ্ড দুর্বল। তার মা তাকে একগ্লাস গরম দুধ খাইয়ে সাথে নিয়ে গিয়ে তার ঘরে শুইয়ে দিয়েছে। প্রচণ্ড ভাবে কাঁপছে। মনেহয় খুব ভয় পেয়েছে। তুমি যাও ওর ঘরে। ওর মা ওর কাছেই আছে।
 সুলতা মায়ের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো,
-- তুমি যাবে মা?
-- না,তুই যা আমি এখানেই বসি।
 সুলতা প্রায় দৌড়ে গিয়ে রজতের ঘরে ঢোকে। গিয়ে দেখে সে পাশ ফিরে শুয়ে আর তার মা রজতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। ইশারা করে জানতে চায় রজত ঘুমাচ্ছে কিনা? রজতের মা মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলেন। সুলতা চুপচাপ এসে খাটের উপর কিছুক্ষণ বসে থাকে। রজতের মা উঠে দাঁড়িয়ে ইশারাতেই সুলতাকে ওর পাশে বসতে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। রজতের মা বেরিয়ে গেলে সুলতা এসে রজতের মাথার কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। কিন্তু রজত গভীর ঘুমে তখন আচ্ছন্ন। বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর ওর মনেহয় ভাস্কর সেনকে একবার ফোন করে বিষয়টা জানানো দরকার। সুলতা রজতের ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনে এসে ভাস্কর সেনকে ফোন করে ,
-- স্যার আমি সুলতা সেন বলছি। রজত বাড়িতে ফিরে এসেছে 
 ভাস্কর সেন কথাটা শুনেই একনাগাড়ে বলে যেতে লাগলেন,
-- কখন ফিরলেন? তিনি কী নিজেই কোথাও গেছিলেন নাকি কেউ তাকে তুলে নিয়ে গেছিলো? তিনি কি কাউকে চিনতে পেরেছেন? কী কারণে তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল জানতে পারলেন? তিনি কি --
 ভাস্কর সেনের কথার মাঝখানেই তাকে থামিয়ে দিয়ে সুলতা বললো,
-- সে খুব দূর্বল। কথা বলার মত অবস্থায় নেই। এখন ঘুমাচ্ছে। আমরা কেউ কিছুই এখনো জানতে পারিনি। আমি জানতে পারলে কাল আপনাকে ফোন করে সব জানাবো।
-- তাহলে কাল সন্ধ্যায় দিকে আমি একবার আসি? বিষয়টা খুব একটা স্বচ্ছ বলে মনে হচ্ছে না -
-- হ্যাঁ সে আপনি আসতেই পারেন। কিন্তু আসবার আগে একটা ফোন করে আসবেন। ওকে নিয়ে কাল অফিস থেকে ফিরে একবার ডাক্তার দেখাতে যাবো।
-- ওকে, আমি তোমায় ফোন করেই যাবো।
 সুলতা ফোন কেটে দিয়ে রজতের মায়ের কাছে যায়। তিনি তখন দুধ গরম করছেন। সুলতা রান্নাঘরে ঢুকে জানতে চাইলো,
-- তোমাদের খাওয়া হয়নি এখনো?
-- আমাদের খাওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু রজত তো একগ্লাস দুধ খেয়েছে। ও যা অঘোরে ঘুমাচ্ছে তাতে ওকে ডেকে তুলে বসিয়ে খাওয়ানো যাবে না। তাই ভাবছি গরম দুধে রুটি দিয়ে চটকে খাইয়ে দেবো। তুই আর একটু বোস। খাবারটা তৈরি করে দিচ্ছি তুই একটু খাইয়ে দে ওকে। আমিও আসছি কিন্তু তুই থাকলে আমার একটু সুবিধা হবে।
 রজতের মা খাবার রেডি করে সুলতার হাতে দিয়ে বলেন,
-- তুই নিয়ে যা। আমি আসছি।
 সুলতা খাবার নিয়ে রজতের ঘরে ঢুকে দেখে সে তখনো অসারে ঘুমিয়ে যাচ্ছে। সে মাথার চুলে হাত বুলাতে লাগে। কিন্তু রজতের ঘুম ভাঙে না। বেশ কয়েকবার তাকে গায়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ডাকে কোন সারা পায় না। বুকটার ভিতর ধরাস করে ওঠে তার। সে নাকের কাছে হাত রেখে নিশ্বাসপ্রশ্বাস চালু আছে কিনা দেখে একটু স্বস্তি পায়। ইতিমধ্যে রজতের মা এসে ঘরে ঢোকেন। 
-- ডেকে সারা পাসনি?
-- না, অকাতরে ঘুমাচ্ছে।
-- দাঁড়া এভাবে হবে না। আমার হাতে বাটিটা দে। তুই ওকে গলার পিছনের দিকে হাত দিয়ে মাথাটা একটু তোল।
-- এভাবে কী করে খাওয়াবে?
-- ও ঘুমের মধ্যে মুখের কাছে ধরলে ঠিক খেয়ে নেবে। ওকে অনেক বড়বেলা পর্যন্ত না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে এভাবেই খাওয়াতাম।

ক্রমশ
 
    

Friday, April 26, 2024

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (১৭ তম পর্ব)

বাস থেকে নেমেই হাঁফাতে হাঁফাতে এসে থানায় ঢোকে সুলতা। একজন পুলিশ অফিসার তাকে দেখে জানতে চায়,
-- আপনি সুলতা সেন তো?
-- হ্যাঁ 
-- স্যার একটা বিশেষ দরকারে বেড়িয়েছেন, আপনাকে বসতে বলে গেছেন।
 অফিসার বসার জন্য একটা চেয়ার দেখিয়ে দেন। সুলতা সেখানে গিয়ে বসে। মাথার মধ্যে নানান চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। এখানে পৌঁছানোর আগে একটি পরিচিত ছেলেকে দিয়ে বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দিয়েছে যে সে থানায় যাচ্ছে বাড়িতে জানিয়ে দিতে। কিছুতেই সুলতা বুঝতে পারছে না কেন এবং কিসের জন্য তাকে থানায় ডাকা হল? যদি রজতের কোন খবর থাকতো তাহলে তো তিনি ফোনেই জানাতে পারতেন। তবে কী জানাতে তিনি থানায় ডেকে আনলেন? 
  হঠাৎ ব্যাগের মধ্যে ফোনটা বেজে ওঠায় তার সম্বিৎ ফিরে। ফোনটা বের করে দেখে রজতের বাবা ফোন করেছেন। কী খবরই বা সুলতা তাকে দেবে? তবুও ফোনটা ধরে হ্যালো বলতেই অপর প্রান্ত থেকে বৃদ্ধ কাঁপা কন্ঠ স্বরে জানতে চাইলেন,
-- কোন খবর আছে? তোমায় থানায় ডেকে পাঠালো কেন?
 সুলতার বুঝতে অসুবিধা হল না পাড়ার ওই ছেলেটির মাধ্যমেই বোধহয় রজতের বাড়ি পর্যন্ত খবর গেছে সুলতাকে থানায় ডেকেছে। রাত প্রায় ন'টা তখন। ওসি তখনও আসেননি। বাস থেকে নেমে সারাদিনের পরিশ্রমের পর থানায় এসে বসে থেকে থেকে সুলতার ঝিমুনি এসে গেছে। যেহেতু ওসির পরিচিত তাই একসময় একটু কাগজের ছোট্ট কাপে এককাপ লাল চা পেলো সাথে দুটো বিস্কুট। খিদে পেয়েছে খুব। ইতস্তত করতে করতে বিস্কুট দু'টো নিয়েই নিলো। ওখানে বসে বসে কত মানুষের কত রকম সমস্যা শুনতে লাগলো। রাত প্রায় দশটা। ভাস্কর সেন আসলেন থানায়। ভিতরে ঢুকে সুলতাকে বসে থাকতে দেখে মৃদু হাসি নিয়ে বললেন,
-- সরি, অনেকটা দেরি হয়ে গেলো।একটা ঝামেলায় ভীষণভাবে ফেঁসে গেছিলাম। তুমি আর একটু বসো। চিন্তা করো না আমি নিজেই তোমায় বাড়ি পৌঁছে দেবো। আমি এখুনি আসছি।
 তিনি ভিতরে ঢুকে ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চলে এলেন। এসেই বললেন, 
-- চলো 
-- কোথায়?
-- যেখানে নিয়ে যাবো বলে তোমায় আসতে বলেছিলাম সেখানে এত রাতে তোমায় নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।
-- না,না আমার কোন অসুবিধা নেই। আপনি চলুন। 
 কথাটা বলে ভাস্কর সেনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
-- কিন্তু কোথায় নিয়ে যেতে চাইছেন আমায়?
 ভাস্কর একটু ইতস্তত করতে করতে বললেন,
-- রাত হয়ে গেছে কালই যাবো
-- কিন্তু জায়গাটা কোথায় বললেন না তো?
-- মর্গে 
-- মানে? সেখানে কেন? 
-- এখান থেকে কিছুটা দূরের এক স্টেশনে ক্ষতবিক্ষত একটা লাশ পাওয়া গেছে। পরিচয় জানা যায়নি। তাই আর কী --
-- এটা অসম্ভব! এটা হতেই পারে না। 
 সুলতা ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে। ভাস্কর সেন তার মাথায় হাত রেখে বলেন,
-- আমিও চাই এটা যাতে সত্যি না হয়। কিন্তু যেহেতু তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এটা একটা নিয়মই মনে করো।
-- না, এ নিয়ম আমি মানতে পারবো না। প্রয়োজনে আপনি আরও সোর্স লাগান। কিন্তু আমি মর্গে কিছুতেই যাবো না। রজতের এরূপ কোন ঘটনা ঘটতেই পারে না। তাহলে আমি টের পেতাম।
ভাস্কর সেন কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। এদিকে ড্রাইভার গাড়িতে উঠে গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললো,
-- স্যার উঠুন।
 ভাস্কর সেন গাড়িতে উঠে সুলতার দিকে তাকিয়ে বলেন,
-- গাড়িতে উঠে এসো। অনেক রাত হয়েছে। তোমায় বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসি। যা ভাবার বা করার সকালে করবো।
 সুলতা গাড়িতে উঠে বসে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে ভাস্কর বললেন,
-- এত ভেবো না। রজতবাবুর কোন খারাপ খবর আছে সেইজন্য কিন্তু তোমায় বডি সনাক্ত করতে মর্গে যেতে বলা হয়নি। যেহেতু এই মুহুর্তেই তিনি নিখোঁজ আর এখনই ওই অজ্ঞাত পরিচয় বডিটা পাওয়া গেছে সেই হিসাবেই নিয়মমাফিক তোমায় মর্গে যেতে হবে। খোঁজ তো আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। 
 সুলতা কোন উত্তর দেয় না ভাস্কর সেনের কথার। গাড়ি এসে সুলতাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে বড় রাস্তার মোড়ে থামে। দরজা খুলে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ভাস্কর সেনের দিকে তাকিয়ে শুধু "আসছি" - বলে এগিয়ে যায়।
 পুলিশের গাড়ি থেকে সুলতাকে নামতে দেখে অনেকেই কৌতূহল দৃষ্টিতে অত রাতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সুলতা কোন দিকে না তাকিয়ে আনমনাভাবে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে। সুলতাকে দেখতে পেয়ে একজন বয়স্ক মহিলা বেশ কয়েকবার তার নাম ধরে ডাকেন। কিন্তু অন্যমনস্ক থাকার ফলে সে ডাক সুলতার কানে পৌঁছায় না। কিন্তু তিনি ডাকতে ডাকতে তার পিছন পিছন আসতে থাকেন। সুলতা এবার শুনতে পায়। সে দাঁড়িয়ে পড়ে। ভদ্রমহিলা হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বলতে শুরু করেন
-- এত রাত পর্যন্ত তুমি হন্যে হয়ে রজতের খবরের জন্য ছুটাছুটি করছো অথচ তোমার ফোন বন্ধ। তুমি কি জানো রজত ফিরে এসেছে কিছুক্ষণ আগে।
-- এ্যা 

ক্রমশ 

Wednesday, April 24, 2024

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (১৬ তম পর্ব)

বাস্তবিক ভাস্কর তার বিবাহিত জীবনে সুখী বলা চলে। কিন্তু ভাস্কর যে ধরণের মানুষ তার জীবনে ঘটে যাওয়া এ ঘটনা সে কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারে না। একাকী থাকলেই সেইসব দিনের কথা ভাস্করকে কুরেকুরে খায়। যে মেয়েটিকে সে ভালবেসেছিল তাকেই সে বিয়ে করতে চেয়েছিল বলেই বারংবার সে অনসূয়াকে কাছে টেনেছে একান্তে দু'টো শরীর এক হয়েছে। অথচ কোন কারণ না দেখিয়েই মেয়েটি এভাবে তাকে অন্ধকারে রেখে কেন অন্যত্র বিয়ে করে নিলো ? কেন বারংবার তারই সাথে শারীরিকভাবে মিলিত হল? সে তো এটা চায়নি। সেতো মন থেকেই অনসূয়াকে ভালবেসেছিল। তাই তার সাথে মিলিত হতে কখনো তার মনে একটুও দ্বিধাবোধ জন্মায়নি। এটা অনসূয়া কেন করলো? 
  কিন্তু এ প্রশ্ন ভাস্করকে তাড়া করে বেড়ালেও মাঝে মধ্যে অনসূয়ার সাথে দেখা হলেও উত্তর কোনদিন জানা হয়ে ওঠেনি। তাই বাবার মৃত্যুর পর চাকরি পাওয়ার পর অফিসে যাতায়াতের অসুবিধা হয় জানিয়ে স্বল্প দামে বাড়ি বিক্রি করে এখান থেকে অন্যত্র চলে যায় যাতে অনসূয়ার সাথে তার দেখা না হয়। 
 এখান থেকে ভাস্কর চলে গেলেও অনসূয়ার খবরাখবর সে রাখে পাড়ার নানান লোকের মাধ্যমে। ভাস্কর এটাও জানে অনসূয়ার শ্বাশুড়ির মৃত্যুর পর অনসূয়া তার স্বামী,সন্তানকে নিয়ে এখন বাবা,মায়ের সাথেই থাকে। 
যেহেতু সুলতার সূত্র ধরে অনসূয়ার সাথে তার পরিচয় তাই সুলতার কথা ভাস্করের আজও মনে আছে। আর এই কারণেই বহুবছর বাদে সুলতাকে দেখে একটুও চিনতে কষ্ট হয়নি ভাস্করের।
 ভাস্কর যথাসাধ্য চেষ্টা করতে থাকে রজতকে খুঁজে বের করার। নানান জায়গায় সোর্স লাগিয়ে সে অনবরত খবর নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। 
 রজত যেদিন নিখোঁজ হয় সেদিন ছিল তার পে ডেট। সুতরাং চুরি, ছিনতাইয়ের বিষয়টাও উড়িয়ে দিতে পারছে না। কিন্তু সেতো নয় টাকাপয়সার ব্যাপার। আস্ত মানুষটা সে কারণে উড়ে যেতে তো পারে না।
 ভাস্কর কোনোই কূলকিনারা করতে পারছে না। রোজই অফিস থেকে ফিরে সুলতা তাকে ফোন করে। কিন্তু কোন সদুত্তরই ভাস্কর দিতে পারেন না। এদিকে রজতের বাবা,মায়ের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা ছেলের চিন্তায় দিনদিন খারাপ হতে থাকে। রজতের মা নাওয়া খাওয়া ভুলে ছেলের জন্য সব সময় ঠাকুরের সামনে চোখ বুঝে বসে। সুলতা একা দুটি পরিবারের মধ্যিখানে পড়ে নাজেহাল অবস্থা। রজতকে না পেয়ে মানসিক দিক থেকে সে ভেঙে পড়লেও দায়িত্ব কর্তব্য থেকে বিন্দুমাত্র সরার কোন উপায় তার নেই। কারণ দুটি পরিবারের মধ্যে সেই একমাত্র কর্মক্ষম। 
 এদিকে ভাস্কর সেন দু'দিন পর বিকেলের দিকে ফোন করে সুলতাকে তার সাথে দেখা করতে বলেন। সুলতা তখনও তার অফিস থেকে বের হয়নি। সে ভাস্করের কাছে জানতে চায়
-- কোন খোঁজ পেলেন?
-- তুমি এসো আসলে সব কথা হবে।
-- আমি এখনো অফিস থেকে বের হইনি। অফিসে একটা ঝামেলা চলছে। আজ কোন অবস্থাতেই আগে বেরোতে পারবো না। আপনি যদি আমাকে ফোনেই বলেন সব আমি চিন্তামুক্ত হতে পারি।
-- তুমি তোমার অফিসের কাজ মিটিয়েই এসো। কোন অসুবিধা নেই।
-- তারমানে এখনো সেরূপ কোন খবর নেই।
 ভাস্কর সে কথার কোন উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দেন।
 সেদিন সুলতার অফিসে হিসাবের গণ্ডগোল হওয়ায় ক্যাশিয়ারের সাথে ম্যানেজারের এক চরম ঝামেলা হওয়ার পরে মালিক ও তার ছেলে এসে উপস্থিত হন। তারা এসেই ঘটনার বর্ণনা শুনেই পুলিশে ফোন করেন। অনেক কাকুতিমিনতি করেও ক্যাশিয়ার রেহাই পায় না। তাকে পুলিশ আরেস্ট করে থানায় নিয়ে যায়। ক্যাশিয়ারের দোষগুণ বিচার করবে কোর্ট। কিন্তু সেই মুহূর্তে অফিসের সামনে যে চিৎকার,চেঁচামেচি আর  আরাজগতার সৃষ্টি হয়েছে তার রেশ অফিস ছুটির পরেও ঘণ্টা দেড়েক রয়ে যায়। স্বভাবতই সুলতার বেরোতে অনেকটাই দেরি হয়ে যায়। বারবার ম্যানেজারকে সে বেরোনোর কথা জানালেও মালিক থাকায় নিজের চাকরি বাঁচানোর দায়ে তিনি নাকচ করেছেন সুলতার অনুরোধ। কারণ এই বয়সে চাকরি হারালে আর চাকরি পাওয়ার কোন সম্ভাবনা তার নেই। সংসার অচল হয়ে পড়বে। সুলতাকে তিনি সন্তান স্নেহে দেখলেও আজকে তিনি তার জন্য কিছুই করতে পারেননি।
 সুলতা অফিস থেকে বেরিয়ে স্টেশনে পৌঁছানোর জন্য যে রাস্তাটা সেটা সে হেঁটেই পার হয়। কিন্তু আজ সে অটো ধরে স্টেশনে আসে। কিন্তু এলেই তো আর হল না। ট্রেনের তো একটা নিদ্দিষ্ট সময় আছে। আধাঘন্টা বসে,দাঁড়িয়ে,পায়চারি করে ভিড়ে ঠাসা একটি বগিতে উঠে পড়ে। মাথার মধ্যে সর্বদা একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে আর সেটা হল যদি ওসি রজতের কোন খবর পান তাহলে তো সরাসরি তাকে ফোনেই জানাতেন। তাহলে কী এমন হল যে তিনি থানাতেই দেখা করতে বললেন? কোন খারাপ খবর কি? তবে কি রজত --।

ক্রমশ

Tuesday, April 23, 2024

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (১৫ তম পর্ব)

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (১৫তম পর্ব)

  ছোট থেকেই ছেলেরা "পুরুষ মানুষকে কাঁদতে নেই" একথা শুনেই বড় হয়। তাই কারো সামনে তারা কাঁদতে পারে না কারণ তাতে যদি তার আত্মসম্মানে আঘাত লাগে লোকে তাকে "মেয়েদের মত স্বভাব" - বলে। কিন্তু কষ্ট তো তাদের হয় তারাও কাঁদে তবে সেটা লোকচক্ষুর অন্তরালে। অন্ধকার আর বালিশকে সাক্ষী রেখে সারারাত চোখের জলে তারা তাদের কষ্ট নিবারণের বৃথা চেষ্টা করে। কেউ জানতেও পারে না। নারীর নরম মনের মত পুরুষের মনটাও যে নরম এ ধারনাটাই অধিকাংশ মানুষ বুঝতে চেষ্টাও করে না। প্রতিটা পুরুষই একটা কঠিন আবরণে নিজেকে মুড়িয়ে রাখে। মানুষ বাইরের ওই আবরণটাই দেখে। ভিতরের মনটা নয়।
 সেদিন রাস্তায় দেখা হওয়ার পর থেকে বহুবার ভাস্কর সেই রাস্তায় যাতায়াত করলেও অনসূয়ার দেখা সে আর পায়নি। বুক ভেঙে চৌচির হয়ে গেলেও কারো সাথেই ভাস্কর তা শেয়ার করতে পারেনি। বুকের কষ্ট লাঘব করতে অনেক সময় নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথাও ভেবেছে। কিন্তু পরক্ষণেই মায়ের আর বাবার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। 
 একএক করে দিন গড়িয়ে যেতে থাকে কিন্তু অনসূয়ার দেখা ভাস্কর পায় না। কোন এক প্রত্যুষে ভাস্কর দেখে অনসূয়াদের বাড়ির গেট সাজানো হচ্ছে , ক্লাবের মাঠে বড় প্যান্ডেল বাঁধা হচ্ছে। বড় বড় করে গেটের উপর "শুভ বিবাহ" লেখা। সকলেই জানে আজ অনসূয়ার বিয়ে। ভাস্করেরও কানেও সে কথা আসে। সে স্তব্ধ হয়ে যায়। কী এমন হল যে সে ভাস্করের সাথে এরূপ করলো? কী অপরাধ তার? কিসের জন্য, কিসের ভয়ে সে এতবড় বেইমানী তার সাথে করলো? একবার জানানোরও প্রয়োজন বোধ করলো না? এ কেমন ভালোবাসা? এ কেমন কাছে আসা?
 কোন উত্তর ভাস্কর আজ পর্যন্ত পায়নি। কারণ রাস্তাঘাটে দেখা হলেও অনসূয়া কোনদিন ভাস্করের সাথে কথা বলেনি। কোন একদিন ভাস্কর রাস্তায় তাকে দেখে সামনে এগিয়ে গিয়ে জানতে চেয়েছিল তখন অবশ্য অনসূয়ার বিয়ে হয়ে গেছে,
-- কেন করলে আমার সাথে এরকম? কেন আমায় ঠকালে? তোমার উদ্দেশ্য কি ছিল শুধুই মজা নেওয়া?
 অনসূয়া এতবড় কথা শোনার পরেও কোন উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করেই পাশ কাটিয়ে চলে যায়। অনসূয়ার ব্যবহার ভাস্করকে স্তম্ভিত করে দেয়। সে খোঁজ নিয়ে জানে তার সাথে যার বিয়ে হয়েছে তার থেকে অনসূয়া আঠারো বছরের ছোট। বিয়ের আগে প্রায় রোজই তাকে অনসূয়াদের বাড়িতে দেখা যেত। অনসূয়া তাকে দাদা বলেই ডাকতো। ছেলেটি বলা ভালো ভদ্রলোক স্কুল শিক্ষক। খুব দূরে শ্বশুরবাড়ি তার নয়। সুতরাং দেখা মাঝে মাঝেই তাদের হয়। কিন্তু অনসূয়া কখনোই ভাস্করের দিকে তাকিয়েও দেখে না।
 কষ্টের পাহাড় বুকে নিয়েই ভাস্কর পাশ করেই চাকরির চেষ্টা করতে থাকে। পেয়েও যায় একসময়। আস্তে আস্তে প্রমোশন হতে হতে মধ্য বয়স্ক ভাস্কর আজ ওসি। কিন্তু এই জায়গায় আসতে তাকে অনেক কাঠখড় পুড়াতে হয়েছে। বয়স যখন তার চল্লিশ তখনও সে বিয়ে করবে না বলেই জিদ ধরে বসে। মায়ের পীড়াপীড়িতে আর তিনি একসময় জিদ ধরে বসলেন ছেলে যতক্ষণ না বিয়ের ব্যাপারে তার মত পাল্টাবে তিনিও খাবার ওষুধ কিছুই খাবেন না। মায়ের  দরজার ছিটকিনি খোলার একমাত্র উপায় ছিল ভাস্করের মত পাল্টানো। একমাসের মধ্যেই বিয়ে। 
 বিয়ের রাতেই ভাস্কর তাকে জানিয়েছিল তার পূর্ব প্রেমের কথা। কারণ ভাস্করের মনে হয়েছিল খুব বেশি দূরত্ব যেহেতু অনসূয়া ও ভাস্করদের বাড়ির মধ্যে নেই তাই কখনো না কখনো একথা তার স্ত্রীর কানে যাবেই। আর মিথ্যে দিয়ে নিজের জীবন সে শুরু করতেও চায়নি। নতুন বউ সব শুনে বলেছিল,
-- তোমার অতীত নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই। কিন্তু বর্তমানে তুমি আমায় ভালবাসতে পারবে তো?
-- নিশ্চয় পারবো।
 ভাস্কর সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে সোমাকে ভালবাসলেও আজও যখন সে একাকী থাকে তখন তার অনসূয়ার কথা মনেপড়ে। শত চেষ্টা করেও কিছুতেই সে আজও তাকে ভুলতে পারেনি। কেন অনসূয়া তার সাথে এরূপ করলো আজও সে উত্তর জানার এক তীব্র বাসনা তার মনের মধ্যে কাঁটা হয়ে বসে আছে। সময়ে অসময়ে সেই কাঁটার খোঁচা সে আজও তিলেতিলে অনুভব করে।
 অনসূয়ার বিয়ের পর মানুষের মুখে মুখে অনেক কথাই ছড়িয়েছে। কেউ বলেন অনসূয়ার যার সাথে বিয়ে হয়েছে তার কাছ থেকে অনসূয়ার বাবা কিছু অর্থ ধার নিয়েছিলেন। যা তিনি শোধ দিতে পারেননি। তাই মেয়েকে সম্প্রদান করেছেন। আবার অনেকে বলেন মেয়েকে সামনে দাঁড় করিয়েই লোকটির কাছ থেকে সংসার চালোনোর জন্য নানান সুযোগ সুবিধা নিয়েছেন। তাই বাধ্য হয়েছেন মেয়েকে লোকটির দাবিমত তার হাতে তুলে দিতে। এইরূপ নানান কথা ভাস্করের কানে আসে। কিন্তু ভাস্করের শুধু একটাই প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘুরপাক খায় "যায় হোক না কেন অনসূয়া তাকে সত্যিটা কেন জানালো না? তার সাথে কেন এরূপ করলো?" 

ক্রমশ

Sunday, April 21, 2024

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (১৪তম পর্ব)

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (১৪তম পর্ব)

  এখানে ভাস্কর সেন সম্পর্কে একটু না জানালেই নয়।

  সুলতা বেরিয়ে যাওয়ার পর একের পর এক ভিজিটরস আর তাদের সমস্যা শুনতে শুনতে তিনি মাঝে মাঝেই একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলেন। রাতে কখন বাড়ি ফেরেন তার কোন ঠিক নেই। কিন্তু সেদিন তিনি একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরলেন। তাকে আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে দেখে বাড়ির সকলেই খুব খুশি। কিন্তু ভাস্কর একটু অন্যমনস্ক। একটু বেশি বয়সে বিয়ে করার ফলে মেয়ের বয়স সবে চার বছর। স্ত্রী,মা আর ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে তার সংসার। হ্যাঁ বলতে গেলে সুখের সংসার। কিন্তু সুখ কি মানুষের মুখের উপর লেখা থাকে? মনের ভিতর এতগুলি বছর বাদে আজও প্রথম ভালোবাসার ক্ষত দগদগে হয়ে চেপে বসে আছে। মানুষ দেখে একটি মানুষের সফলতা। কিন্তু এই সফলতার পিছনে কত,ঝড়ঝাপটা,আঘাত,বেদনা,কষ্ট,হতাশা লুকিয়ে আছে তার খোঁজ কেউ রাখে না। জীবনে সবকিছু পাওয়ার পরেও কোন মানুষই অতীতের সেইসব হতাশা, ভালোলাগা,ভালোবাসা কেউই ভুলতে পারে না। একাকী থাকলেই সেইসব চোখের সামনে  ভেসে ওঠে আর বুকচিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসবেই। কারণ মানুষ যা চায় আর যা পায় তার দু'টোতেই মানুষের আক্ষেপ থেকেই যায়। মনুষ্য চরিত্রে কোনকিছুতেই পূর্ণতা খুঁজে পায় না। 
   কিন্তু জীবন তো থেমে থাকবার জন্য নয়। সেও ঠিক ঘড়ির কাঁটার মত টিকটিক করে এগিয়েই চলে। নষ্ট হয়ে যাওয়া ঘড়ি কখনো দ্রুত আবার কখনো বা ধীর গতিতে চলে। জীবনও ঠিক তাই। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে কখনো খুব মসৃন আবার কখনো বা শোক তাপে জর্জরিত হয়েও জীবন ঠিক বয়ে চলে। 
  প্রথম ভালোবাসার মানুষটির কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হলে আজীবন সে কষ্টটা থেকেই যায়। অনেকে সেই আঘাত সেই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে হয়ত নিজেকেই শেষ করে দেয়। কিন্তু সেটা পরাজিত জীবনের গল্প। সকলে তো জীবনে পরাজিত হতে আসেনি। ব্যর্থতা আর গ্লানিকে সঙ্গী করেই শত আঘাতের পরেও অনেকে মাথা তুলে জীবনকে সম্পূর্ণভাবে নিজের আয়ত্বের মধ্যে নিয়ে আসে। আর এই কণ্টকাকীর্ণ পথ যে পার হতে পারে সেই জীবনের আসল স্বাদ গ্রহণ করে থাকে। এদেরই দলে ভাস্কর সেন একজন। এতদসত্ত্বেও বুকের আঘাতটা সেরে গেলেও মাঝে মাঝে কাঁটার খোসখোসানিতা থেকেই যায় 
  
সুলতা স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর তাকে পড়াতে আসতো অনসূয়া। লম্বা,ফর্সা,একমাথা চুল। চোখ যেন কথা বলে। ভাস্কর তখন সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। পাশাপাশি বাড়ি হওয়ার ফলে যখন তখন এবাড়ি ওবাড়ি করতো দু'বাড়ির লোকজন। এইভাবেই পরিচয় অনসূয়ার সাথে। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরেই দু'জনের মধ্যে গড়ে ওঠে ভালোবাসার সম্পর্ক। সুলতার পড়া শেষ হলে যদি কোনদিন ভাস্করের বাবা,মা বাড়িতে না থাকতেন অনুসূয়া সেদিন সোজা চলে যেত ভাস্করদের বাড়িতে। দুটি উঠতি বয়সের তরুণ, তরুণী। ফাঁকা বাড়ি - দু'জন দু'জনকে পছন্দ করে। খুব কাছে আসতে বেশিদিন সময় লাগেনি। এই কাছে আসাটা তাদের কাছে নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে উঠেছিল। পরপর কিছুদিন ভাস্করের বাবা,মা না বেরোলেই তারা কোন বন্ধুর বাড়ি কিংবা অন্য কোথাও দু'টি নরনারী এক হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতো। ভাস্কর ধরেই নিয়েছিল অনসূয়া এ জীবনে শুধু তার। অনসূয়ার মনের খবর অবশ্য সে জানতো না। তবে সে ধরেই নিয়েছিল তার মত অনসুয়াও ভাবে। এইভাবে প্রায় বছর খানেক চলার পর অনসূয়া হঠাৎ করেই সুলতাকে পড়াতে আসা বন্ধ করে দেয়। দু'তিন দিন পাগলের মত ভাস্কর অপেক্ষা করতে থাকে অনসূয়ার। সুলতার মায়ের কাছে জানতে পারে ও আর পড়াতে আসবে না। ভাস্কর অনসূয়াদের বাড়িতে যায়। সে তখন বাড়িতে ছিল না। তার কোন আত্মীয়ের বাড়িতে গেছে। মন খারাপ করে ভাস্কর চলে আসে। দ্বিতীয়দিন আবার যায়। বাড়ির বাইরে সকাল থেকে অপেক্ষা করতে থাকে। একসময় অনসূয়াকে সে দেখতে পায় দুটি মহিলার সাথে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। ছুটে গিয়ে তার সামনে দাঁড়ায়।কিন্তু অদ্ভুতভাবে অনসূয়া  ভাস্করকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায়। যেন তাকে চেনেই না। কষ্ট, শোকে দুঃখে ভাস্কর স্ট্যাচু হয়ে যায়। সে ভাবতেই পারছে না এটা কী করে সম্ভব হল? তাহলে ও কি অনসূয়ার মত দেখতে অন্য কেউ? তাই ওকে চিনতে পারেনি? 
 ভাস্কর সারাটা রাত ছটফট করতে থাকে। এই তো দু'দিন আগেই পরপর তিনদিন সে অনসূয়াকে নিজের করে পেয়েছে। তার সর্ব শরীরে এখনো অনসুয়ার ভালোবাসার ছোঁয়া রয়ে গেছে। ঠোঁটের ফোলা কমলেও দাগটা এখনো আছে। বিছানায় শুয়ে নিজের ঠোঁটটা নিজেই একবার হাত বুলায় ভাস্কর। অনসূয়া তাকে বলেছিল,
-- যতদিন তুমি চাকরি না পাচ্ছ ততদিন আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।
ভাস্কর ভাবতে থাকে ,কিভাবে সম্ভব এটা? যে কটাদিন তারা মিলিত হয়েছে প্রথম প্রথম পরনে কিছু থাকলেও পরবর্তীতে তাদের শরীরে বিন্দুমাত্র সুতো থাকতো না। ভাস্কর তো মনেমনে তাকেই স্ত্রী হিসাবে মেনে নিয়েছিল। না কিছুতেই ওই মেয়েটি অনসূয়া হতে পারে না। ওরই মত দেখতে হয়ত অন্য কেউ হবে।

ক্রমশ

Saturday, April 20, 2024

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (১৩তম)

 ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (১৩তম পর্ব)

  রজতের বন্ধুদের যে ক'টা ফোন নম্বর জানা ছিল প্রতিটাতেই সুলতা ফোন করে রজতের খবর জানতে চায়। এদিকে তার বাবা,মা-ও সমস্ত আত্মীয়স্বজনদের কাছে ফোন করে চলেছেন। কিন্তু কেউই রজতের কোন খবর দিতে পারে না। উৎকণ্ঠা,দুশ্চিন্তায় দু'বাড়ির রাত শেষ হয়। কোথায় গেলো জ্বলজ্যান্ত মানুষটা? তবে কি কোন ? না আর ভাবতে পারছে না সুলতা? চাকরি বাঁচিয়ে কিভাবে সে রজতের খবর পাবে? একদিন অফিসে না যাওয়া মানেই মাইনের টাকা থেকে টাকা কাটবে।পরিবারের অসহায় মুখগুলো চোখের উপর ভেসে ওঠে। কিন্তু এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকাও তো সম্ভব নয়। রজতের বাবা,মায়ের বয়স হয়েছে। তাদের পক্ষেও সম্ভব নয় দৌড়াদৌড়ি, ছুটাছুটি করা। তারাও সুলতার উপরই নির্ভর করে আছেন। মাঝে মাঝেই তাকে ফোন করছেন। খুব অসহায় লাগছে সুলতার! কিভাবে এগোবে? কোথায় যাবে? কাকে ধরবে এ ব্যাপারে?
  খুব ভোরে সে বেরিয়ে পড়ে। প্রথমেই থানায় গিয়ে একটা নিখোঁজ ডাইরি করে। সেখান থেকে সোজা অফিস। অনেক কষ্টে পরদিন ছুটি ম্যানেজ করে। অফিসের ম্যানেজার যেহেতু তাকে খুব স্নেহ করেন সুলতার মনের অবস্থা বুঝে তাকে সেদিন একটু আগেই ছাড়েন। কিন্তু আগে বাড়িতে পৌঁছেই বা সে কী করবে? কোথায় খুঁজবে রজতকে।
 স্টেশনে নেমে সেখান থেকে সোজা সে থানায় যায়। কিন্তু তাদের কাছে কোন খবর নেই। মরিয়া হয়ে ওসির সাথে দেখা করে। প্রথম থেকেই ওসি সুলতার মুখের দিকে কারণে অকারণে তাকানোর ফলে সুলতা কথা বলতে ভীষণ অস্বস্তি বোধ করছিল। কিন্তু  নানান কথার ফাঁকে ওসি হঠাৎ করেই জানতে চান,
-- তোমার নাম কি সুলতা?
-- হ্যাঁ আপনি আমার নামটা জানলেন কী করে? ওই ডাইরির সিগনেচার দেখে?
-- না, আমি তোমায় ছোটবেলা থেকেই চিনি। তোমার মনে নেই একসময় আমি তোমাদের বাড়ির কাছে ভাড়া থাকতাম। তুমি খুব শান্ত মেয়ে ছিলে। সব সময় আমাদের বাড়িতে থাকতে। আমার মায়ের একটা মেয়ের শখ ছিলো। তাই তোমাকে মা মেয়ের মত ভালোবাসতেন। নিজেই স্নান করানো, খাওয়ানো,নিজের কাছে ঘুম পারানো সব করতেন। তোমার বাবা কিংবা মা যখন তোমায় নিতে আসতেন তখন তুমি খুব কাঁদতে। মা আমায় ছোটন বলে ডাকতেন। তুমি এত বড় একটা শব্দ উচ্চারণ করতে পারতে না বলে আমায় ছোটু বলে ডাকতে।
  হাসতে থাকেন ওসি ভাস্কর সেন। মৃদু হাসির রেখা সুলতার মুখেও ফুটে ওঠে। সে বলে,
-- আমার কিচ্ছু মনে পড়ছে না
-- আরে কী করে মনে পড়বে? তখন তুমি কত ছোট। যতদূর মনে পড়ছে তখন তোমার তিনবছর মত বয়স হবে। একদিন মা আমায় সন্ধ্যার সময় আলু ভাজা আর রুটি খেতে দিয়েছেন। তুমি তো রাতে শোয়ার পূর্ব পর্যন্ত আমাদের বাড়িতেই থাকতে। তো তুমি কী করলে জানো? আমার খাটের উপর উঠে বললে," ছোটু আমি খাবো।" মা বললেন," দাঁড়া তোকে আমি আলাদা প্লেটে দিচ্ছি।" না কিছুতেই হবে না। তুমি আমার প্লেট থেকেই খাবে। আমি একটা ছোট রুটির টুকরো তোমার হাতে দিলাম। তারপর তুমি সেটিকে আমার প্লেটে রেখে তার উপর তিন চারটে আলুর টুকরো রেখে রোল করে মুখের ভিতর ঢুকিয়ে খেতে লাগলে। আমি আর মা তো হেসেই খুন।
-- আপনার এত কিছু মনে আছে? 
-- ওমা! থাকবে না কেন? আমি তো তখন কলেজে পড়ি। খুব ন্যাওটা ছিলে আমাদের।
 সুলতা একদৃষ্টিতে ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে। যখন সে ওসির সাথে দেখা করতে চেয়েছিল বাইরে থেকে তাকে বলা হয়েছিল ওসি খুব রাগী মানুষ তিনি সাধারণত খুব প্রয়োজন না হলে কারো সাথে দেখা করেন না আর দেখা করলেও সেই ব্যক্তিকে বেশি সময় দেন না। কিন্তু প্রায় আধাঘন্টা হতে চললো সুলতা ওসির ঘরে আছে। আসলে পরিস্থিতি মানুষকে অহরহ পাল্টে দেয়। তিনি যে পদে আছেন সেখানে তাকে গাম্ভীর্য ধরে রাখার জন্য একটা মুখোশ তাকে পরতেই হয়। জীবনে প্রতিষ্ঠিত প্রতিটা মানুষের চাকরি বাঁচিয়ে রাখা এবং তিনি যে চেয়ারটাতে বসে আছেন সেই চেয়ারের মর্যাদা ও সম্মান অক্ষুণ্ন রাখতেই তার এই প্রচেষ্টা। সাধারণত মানুষটা বদলায় না। পরিস্থিতি তাকে বদলে যেতে বাধ্য করে। কিন্তু মনের ঘরে সেই আসল মানুষটিই ঘুমিয়ে থাকে যাকে আবার জাগিয়ে দেয় সেই পরিস্থিতিই।
-- আপনার বাবা, মা কোথায় আছেন এখন?
-- বাবা নেই। মা আমাদের সাথেই থাকেন। অনেকটা সময় চলে গেলো। তোমার কেসটা আমি দেখছি সবই তো জানলাম তোমার কাছ থেকে। রজতবাবুর বাড়ির লোক কেউ নেই?
-- বাবা,মা আছেন। অনেক বয়স। এক পাড়াতেই থাকি। তাই আমি -
-- ঠিক আছে। বাকিটা না বললেও হয়ত বুঝতে পারছি। ফোন নম্বরটা দাও। যদিও ডাইরিতে লেখা আছে। তবুও তুমি পার্সোনালি আমায় দিয়ে যাও। ছুটে ছুটে আসতে হবে না। আমি খবর পেলেই তোমায় ফোন করবো। আর হ্যাঁ এইসব মিটে গেলে আমি একদিন তোমার বাবা,মায়ের সাথে দেখা করতে যাবো।

ক্রমশ 

Tuesday, April 16, 2024

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (১২তম পর্ব)

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (১২তম পর্ব)

  রজতের বাবা প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক। একজন প্রাইমারী স্কুল শিক্ষকের মাইনে তখনকার দিনে খুব একটা বেশি ছিল না। এই কয়েকমাস হল হুট করে কিছু টাকা বেড়েছে। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে সংসার চালাতে রজতের বাবা,মায়ের খুব একটা বেশি কষ্ট হয়নি। বাড়িটাও ছিল নিজেদের। রজতের বাবাও ছিলেন তার বাবার একমাত্র সন্তান। রজতের সাথে সুলতার ছেলেবেলা থেকেই বন্ধুত্ব। আর এখন এই বন্ধুত্বটা যে ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে এটাও তারা ভালোভাবেই জানেন। তাই সুলতাকে পুত্রবধূ হিসাবে মেনে নিতে তাদের কোন আপত্তি নেই। কিন্তু রজতের বাবা,মা নিজেদের মধ্যে এটাও আলোচনা করেন সুলতা না থাকলে তার বাপের বাড়ির সংসার অচল হয়ে পড়বে। এক্ষেত্রে তারা তাদের পুত্রের ভবিষ্যত নিয়ে বড়ই চিন্তিত। 
  সুলতার সাথে রজতের বাবা,মায়েরও খুবই ভালো সম্পর্ক। সুলতা ছুটির দিনে সময় পেলেই রজতের বাড়িতে যায়। একদম ঘরের মেয়ের মত রান্নাঘর থেকে ঠাকুরঘর তার অবাধ বিচরণ। পুজোতে সুলতা আর তার ভাইবোনের জন্য নতুন পোশাকও আসে। ছুটির দিনে ভালো খাবার রান্না হলে সুলতাদের বাড়িতে বড় এক বাটি খাবারও আসে। কিন্তু আজ কিছুদিন ধরেই রজতের বাবা,মা লক্ষ্য করেন সুলতা আগের মত আর এবড়িতে আসে না। যদি তাকে খবর পাঠানো হয় তবে কিছুক্ষণের জন্য একবার এসে ঘুরে যায়। কিন্তু সেই আগের মত প্রাণোচ্ছল সুলতা নয়। একদিন রজতকে ডেকে তার বাবা বললেন,
-- আমরা ভাবছি তোর বিয়েটা এবার দিয়ে দেবো। বয়স হয়েছে।কখন কী হয়ে যায় ; তাই আমরা থাকতে থাকতেই তোকে সংসারী দেখে যেতে চাই।
 রজত প্রথমে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
-- এই মুহূর্তে আমি ঠিক বিয়ের জন্য প্রস্তুত নই বাবা। আর একটু গুছিয়ে নিই। আমার মনেহয় সুলতা এখনই বিয়ে করতে রাজি হবে না। কারণটাতো তোমরা জানো। এখন ওকে বিয়ের কথা বলা মানে ওকে একটা সমস্যার মধ্যে ফেলে দেওয়া। ও ছাড়া ওদের সংসার যে অচল! 
-- তোরও তো বয়সটা বেড়ে যাচ্ছে।
রজত হেসে পড়ে বলে,
-- তুমি এমনভাবে বলছো যেন আমি বুড়ো হয়ে গেছি। ওমা, তোমার ছেলেকে বাবা বুড়ো বলছেন তুমি কিছু বলছো না কেন?
- আমি বাবা তোমাদের কথার মধ্যে নেই। তবে আমারও ইচ্ছা তোমার বিয়েটা এখনই আমরা দিয়ে দিই।
-- না,মা এখন কোন অবস্থাতেই এটা সম্ভব নয়। সুলতাকে একটু সময় দিতে হবে। এই মুহূর্তে বিয়ের কথা ওকে আমি কিছুতেই বলতে পারবো না।
 রজতের কথা শুনে ওর মা বললেন,
-- তাহলে আমরা যাচ্ছি ওর বাবা,মায়ের কাছে।
-- সেই তো একই ব্যাপার হল মা। আমার বিয়ের চিন্তা এখন বাদ দাও। সময় হলে আমি নিজেই তোমাদের বলবো।
  কথা সেদিন এখানেই শেষ হল ঠিকই কিন্তু রজতের মাথার মধ্যে বিষয়টা নিয়ে একটা চিন্তা ঢুকেই থাকলো। পরিবারের দায়িত্ব সুলতা কোনদিন এড়াতে পারবে না। ওর ভাই এখন খুবই ছোট। বোনটা সবে এইটে উঠেছে। এই পুরো দায়িত্ব সামলে উঠতে বেশ কয়েক বছরের ব্যাপার। সেই বয়সে এসে বিয়ে করা না করার সামিল। একমাত্র যদি পরিবারটির দায়িত্ব সে নিজেও নেয় এবং সম্পূর্ণভাবে সুলতা তার রোজগারের টাকা তার নিজের বাবা,মায়ের হাতে তুলে দেয় তবেই সে বিয়েতে রাজি হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে তার বাবা,মা কতটা সহযোগিতা করবেন সুলতার সাথে? সকালে বেরিয়ে রাতে ফেরা, তারউপর পুরো মাইনের টাকা নিজের মায়ের কাছে ( সুলতার মা)দিলে তার (রজতের) বাবা, মা কি মেনে নেবেন? রজত মনেমনে ভাবে এই পুরো বিষয়টা নিয়ে একদিন বাবা,মায়ের সাথে কথা বলতে হবে। তাঁরা এই ব্যাপারে রাজি হলেই সে সুলতাকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে।
       সেদিন রাতে শুতে গিয়ে সুলতার সাথে রজতের ফোনে কিছুক্ষণ কথা হয়। বলা বাহুল্য এই ফোনটা রজতই সুলতার জন্মদিনে কিনে দিয়েছিল। এরকম মাঝে মধ্যে রজত তাকে তার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি গিফট করে। সুলতা নিষেধ করলেও রজত শোনে না। হাসতে হাসতে বলে
-- সময় হলে সুদেআসলে শোধ দিয়ে দিও।
 সকালে যে যার মতন অফিসে চলে যায়। কিন্তু সুলতা অফিস থেকে ফেরার পথে স্টেশনে রজতকে না দেখতে পেয়ে ভীষণ অবাক হয়। ওখানে দাঁড়িয়েই ফোন করে। কিন্তু সুইচ অফ পায়। ভীষণ চিন্তায় পড়ে যায়। তারপর দ্রুত পায়ে এগিয়ে বাড়িতে না ঢুকেই চলে যায় রজতদের বাড়ি। সেখানে গিয়ে দেখে রজত তখনও আসেনি।অথচ রজতের ফোনের সুইচ অফ। সবাই ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলো। এতক্ষণ রজতের বাবা,মায়ের কোন চিন্তা ছিল না কারণ তারা জানতেন সুলতা ও তাদের ছেলে একসাথেই ফেরে। কিন্তু সুলতা ফিরে এসেছে রজত আসেনি সাধারণত এটা দু'জনে চাকরি পাওয়ার পর আর ঘটেনি। ফিরলেই যাতে সুলতাকে ফোন করা হয় এ'কথা বলে সুলতা ফিরে আসে নিজের বাড়ি। কিন্তু সারা রাত ধরেও রজতের কোন খবর পাওয়া যায় না। কিন্তু কোথায় গেলো রজত? কিভাবে তাকে খুঁজবে সুলতা?

ক্রমশ 

Monday, April 15, 2024

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (১১তম পর্ব)

একদিকে সংসারের চিন্তা অপরদিকে প্রথম ভালোলাগার কিংবা ভালোবাসার আবেশ সুলতাকে মাঝে মাঝেই উদাস করে দেয়। নিজের ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিতে গেলে সংসার পড়বে মুখ থুবড়ে। ভাই বোন দু'টো মানুষ হবে না। তাই সে নিজের মনের কথা কোনদিনও মুখ ফুটে রজতকে জানায়নি। সেই ছেলেবেলা থেকেই রজতের সাথে সুলতার বন্ধুত্ব। দিনে দিনে তারা বড় হয়েছে তাদের ধ্যান,ধারণা পাল্টেছে - দু'জনেই উপলব্ধি করেছে তারা একে অপরকে ভালোবাসে। সুলতা আগে বলুক এটা রজত চাইলেও সুলতা একথা কোনদিনও রজতকে বলতে পারবে না এটাও সে ভালোভাবেই জানতো। সুলতার নিজের সংসার মানে চার চারটে প্রাণীর না খেয়ে ধুকে ধুকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া। 
 ছোট এই কোম্পানিতে কাজটা পাওয়ার পর থেকেই ট্রেনে করে বাড়িতে ফিরতে তার বেশ রাতই হয়ে যায়। স্টেশন থেকে দশ থেকে পনের মিনিট হাঁটা রাস্তা। রিক্সা কিংবা অটো দুইই আছে কিন্তু নিত্য সে ভাড়া দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। তাই রোজই ট্রেন থেকে নেমে সে হেঁটেই বাড়ি পৌঁছায়। তবে একা নয়। রাস্তার মোড়েই রোজ সে পেয়ে যায় রজতকে। রজতের বাইক আছে ঠিকই কিন্তু সুলতা বাইকে করে যেতে অস্বীকার করায় দু'জনে গল্প করতে করতে এই পথটুকু পারি দেয়।
-- রোজ রোজ কেন এই পরিশ্রম করো আমার জন্য?
-- পরিশ্রম কোথায়? আমিও অফিস থেকে ফিরি কিছুক্ষণের মধ্যে তুমিও ফেরো ।তাই অপেক্ষা করি একসাথে ফিরবো বলে।
-- লোকে তো ভালো চোখে এটা নিচ্ছে না। পাড়ায় এটা নিয়ে আলোচনা হয় না ?
-- যাদের আলোচনা করার সময় আছে তারা আলোচনা করুক। পাড়ার লোক তো সেই ছেলেবেলা থেকে আমাদের দেখছে। ওরা যদি এর ভিতর অন্যকিছু দেখতে পায় তাহলে মন্দ কী? কিন্তু আমার কষ্ট অন্যখানে --
-- তোমার আবার কিসের কষ্ট?
 রজত একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলে,
-- পাড়ার লোক যেটা বুঝতে পারছে তুমি সেটা আজও বুঝলে না -
 রজত কী বলতে চাইলো সুলতা সঙ্গে সঙ্গেই সেটা ধরে ফেলে। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
-- বুঝলাম কী বুঝলাম না সেটা পরের কথা কিন্তু সব মানুষের জীবনে সবকিছু পাওয়া বিধাতা লেখেননি। তাই বুঝেও যেমন না বোঝার ভান করে থাকতে হয় ঠিক তেমনই হাতের মুঠোয় আসা জিনিস অনেক সময় পরিস্থিতির চাপে হাত ফসকে বেরিয়েও যায়। তাই মুঠো শক্ত করতে ভয় হয়।
-- কিন্তু বিশ্বাস করো আমি তোমায় --
 কথা শেষ হওয়ার আগেই সুলতা বলে,
-- বলো না রজত। তুমি তো সংসারের একটিমাত্র ছেলে। মেসোমশাই এখনো চাকরি করছেন। তুমিও মোটামুটি ভালো টাকাই রোজগার করো। গরীবের ঘরে সংসারে বড় হয়ে জন্মানো মানে নিজের সুখ,শান্তি বিসর্জন দেওয়া। আমি শুধু নিজের কথা চিন্তা করলে পরিবারের বাকি মানুষগুলির করুন চাহুনি আমার সুখের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। ভাইবোনগুলো না দাঁড়ানো পর্যন্ত আমি নিজের কথা ভাবতে পারবো না। 
-- বিয়ের পরেও তো তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করতে পারো।
-- হয় না রজত হয় না তা - । ভালোবাসা ভাগ হয়ে যায় অনেক দায়িত্বকর্তব্য এসে পড়ে সামনে। তাকেও অবহেলা করা যায় না। কিছু কিছু মানুষ পৃথিবীতে অভিশপ্ত হয়েই জন্মগ্রহণ করে। তারা নিজের দিকে তাকানোর সুযোগ পায় না। সংসার তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। তখন নিজের দিকে তাকানো যায় না। সামনের দিকে পরিবারের অন্য মুখগুলিই দেখতে হয়। হ্যাঁ এরও ব্যতিক্রম হয়। কিন্তু সেখানে স্বার্থপর, মনুষ্যত্বহীন হতে হয়। আমি তা পারবো না।
 কথা বলতে বলতে ওরা বাড়ির কাছেই চলে আসে। সুলতা গেট দিয়ে ঢুকল রজত তার নিজ বাড়ির দিকে রওনা দেয়।
 বাড়িতে ঢুকে দেখে ছোট ভাইবোন দু'টো তখনও বসে আছে না খেয়ে দিদির জন্য। এটা ওদের নিত্য অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। বললেও ওরা শোনে না। বাবা আগেই খেয়ে নেন। যথারীতি মা-ও না খেয়েই থাকেন। আজ কোম্পানির ম্যানেজারের ছেলের জন্মদিনে সকল কর্মীদের একটা করে প্যাকেট দিয়েছে। যেহেতু ম্যানেজার জানেন সুবর্ণা না খেয়ে প্যাকেট বাড়িতে নিয়ে যাবে তার ছোট দু'টি  ভাইবোনের জন্য তাই তিনি তাকে দুটো প্যাকেট দিয়েছেন। সে ঘরে ঢুকেই প্যাকেট দু'টো ব্যাগ থেকে বের করে তাদের দিকে এগিয়ে দিলো। তারা দু'জনেই প্যাকেট নিয়েই খেতে বসে গেলো। মা দেখতে পেয়েই বললেন,
-- আগে রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে এসব খাবার খাবি সব। দিদি না খেয়ে তোদের জন্য নিয়ে এসেছে দিদিকে একটু দু'জনে  মিলে দিস।
-- না না আমার লাগবে না। ওরা খেলেই আমার ভালো লাগবে।
-- হ্যাঁ সেতো আমি জানি। নিজের দিকে আর তাকালি কবে? ভাইবোন, বাবা,মা করেই তো জীবন শেষ করে দিলি।
-- মা, আমি ওদের দিদি। আমার একটা দায়িত্ব রয়েছে ওদের প্রতি।
-- দায়িত্ব তো আমাদেরও রয়েছে তোর প্রতি। কিন্তু পালন করতে পারছি কোথায়? এখন তোর বিয়ে দেওয়ার বয়স হয়েছে। আর আমরা কী করছি? তোর পরিশ্রমের টাকা নিয়ে খেয়েদেয়ে তোর ভবিষ্যতটা নষ্ট করছি।
-- মা, এসব কথা আর শুনতে ভালো লাগে না। তোমাদের যদি অন্য কোন উপায় থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই তোমরা এটা করতে না। বাবার বয়স হয়েছে। বাবা কোনদিনও স্থায়ী কোন কাজ যেহেতু করতে পারেননি কিংবা পাননি তাই জমানো অর্থও তো কিছু নেই। এসব ভেবে কী লাভ বলো তো?
-- রজত ছেলেটা সেই ছেলেবেলা থেকে তোকে খুব ভালবাসে তা আমরা কেন আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীরাও সবাই জানে। কত ভালো একটা চাকরি পেয়েছে। কিন্তু আমরা সবকিছু জেনেবুঝে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছি। অনেক সময় পরিস্থিতির চাপে পড়ে বাবা,মা-ও স্বার্থপর হয়ে যায় রে! এই আমরা যেমন হয়েছি।
 কথা বলছেন আর আঁচলে নিজের চোখ মুছছেন। 
-- চুপ করো মা। এটা স্বার্থপরতা নয়। সংসারের প্রয়োজনে সংসারের লোকেরা এরকম করেই থাকে। আমি তোমাদের বড় সন্তান। সেই হিসাবে আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি। এইভাবে কখনো ভাববে না আর কোনদিনও এসব কথা বলবে না। বিয়েটাই জীবনের শেষ কথা নয়। সন্তান হয়ে যদি বাবা,মায়ের প্রতি দায়িত্ব,কর্তব্য পালন না করলাম তাহলে কিসের সন্তান আমি তোমাদের? আমি অত স্বার্থপর হয়ে নিজের জীবন গুছিয়ে নিতে পারবো না। আমি রজতকে বলে দেবো সে যাতে অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করে সুখী হয়। খামোখা আমার জন্য যেন বসে না থাকে। কারণ আমি কোনদিনও তোমাদের অবহেলা করে,কষ্ট দিয়ে নিজে সুখী হতে পারবো না।
 সুলতা কথাকটি বলে নিজেকে সামলাতে দ্রুত সেখান থেকে চলে যায় তার ছোট্ট ঘরটিতে। বোন আর সে ওই ছোট্ট খাটটাতে শোয়। বোন খেয়ে এসে আগেই শুয়ে পড়েছে। ভাই আরও ছোট সে এখনো বাবা,মায়ের কাছেই শোয়। বাড়িতে মাত্র এই দু'টি ঘর। আর বারান্দা ঘিরে নিয়ে রান্নাবান্না। এই কয়েক মাস হল টাকা জমিয়ে মাকে একটা গ্যাস এনে দিয়েছে। মায়ের খুব কষ্ট হয় স্টোভ আর কয়লায় রান্না করতে। সময়টাও লাগে অনেক বেশি। টিনের চাল ছিদ্র হয়ে বর্ষাকালে জল পড়ে। ম্যানেজারকে বলেছে মালিকের সাথে কথা বলে একটু লোনের ব্যবস্থা করে দিতে। তাহলে বাড়িটাই  মিস্ত্রি লাগাতো। কিন্তু মাইনে খুব একটা বেশি নয়। লোন নিলে প্রতিমাসে টাকা কাটবে। সেই হিসাবে সংসারে টাকার টান পড়বে। কিন্তু কোন উপায়ও নেই। নানান চিন্তায় নিজেই জর্জরিত। কিন্তু মুখ ফুটে বাবা,মাকে কিছু জানাতেও পারে না। সব থেকে কষ্ট হয় রজতের কথা ভেবে। কিভাবে রজতকে ও ফিরিয়ে দেবে? অথচ ফিরিয়ে তাকে দিতেই হবে। নিজের জন্য রজতের জীবনটা সে নষ্ট করতে পারে না। রজতের মুখটা মনে পারলেই চোখদু'টি জল ভরে যায়। রজতকে তো সেও খুব ভালবাসে। কিন্তু ---

ক্রমশ 

Sunday, April 7, 2024

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার ( ৯ ম পর্ব)

 ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (৯ম পর্ব)

 দেবেশ কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। রান্নাঘরে বোকার মত এদিক ওদিক ঘুরে ফ্রিজের উপরের কৌটোগুলো একটু নাড়াচাড়া করে ,সুবর্ণার পিছনে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পুণরায় ডাইনিং রুমে এসে আবার রান্নাঘরে ঢুকতে যায় ঠিক ওই সময়েই সুবর্ণার কাজ শেষ হয়ে যাওয়াতে সেও সেই মুহূর্তে বেরোনোর জন্য রান্নাঘর ও ডাইনিং রুমের দরজার কাছে এসে দেবেশের সাথে ধাক্কা খেয়ে দেওয়ালে গিয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে কপাল ফুলে যায়। দেবেশ দেখতে পেয়ে ফ্রিজ থেকে বরফ এনে সুবর্ণার কপালে দিতে গেলে সুবর্ণা দু'পা পিছনে সরে গিয়ে হাত পেতে বলে,
-- আমি নিজেই দিয়ে নিতে পারবো। আমি এত নিষেধ করছি আমার সাথে কথা বলতে আসবে না তাতে তোমার সম্মান ক্ষুণ্ণ হবে তুমি কিছুতেই কথা শুনছো না কেন?
-- চেষ্টা করছি বিশ্বাস করো কিন্তু কিছুতেই পারছি না। অনেককিছু জানতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু এখন এসব কথা থাক। কপালটা খুব ফুলে গেছে। বরফটা চেপে ধরে থাকো। 
-- আমার কোন ব্যাপারে মাথা ঘামাতে আসবে না। কেন বুঝতে পারছো না বাড়ির লোক একবার যদি জেনে ফেলে তোমার সাথে আমার আগে পরিচয় ছিল তাহলে আমার এই কাজটাই যাবে।
-- এ কাজ তোমায় আমি করতে দেবো না। বাড়ি গিয়ে সিভিটা নিয়ে আসবে। দেখি অন্য কোন কাজের ব্যবস্থা করতে পারি কিনা। এটাও ঠিক এখান থেকে চলে গেলে আমি তোমায় রোজ দেখতে পাবো না। কিন্তু তোমাকে এই কাজ করতে দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তবে তোমাকে পেয়ে আমার মা খুব খুশি। আগে মাকে যারা দেখাশুনা করতো তাদের সম্মন্ধে প্রথম দিন থেকেই মায়ের অনেক অভিযোগ ছিলো। কিন্তু তবুও --
-- অবুঝকে বোঝানো যায় না। এবার সরো আমায় যেতে দাও।
-- এত কঠোর হয়োনা সুবর্ণা। সমস্যা মানুষের জীবনে আসে। সময়ে তা কেটেও যায়। তোমার এই সমস্যা আজ আছে কাল থাকবে না। একটু বিশ্বাস করো আমাকে। আমাকে কিছু করতে দাও তোমার আর তোমার পরিবারের জন্য। না, বিনিময়ে আমি তোমার কাজ থেকে কিছুই চাই না। একজন বন্ধু তো মনে করতেই পারো আমায়।
-- অনেক রাত হয়েছে। এবার আমায় যেতে দাও। এসব কথা যখন তখন না বলায় ভালো।
 সুবর্ণা আর দাঁড়ায় না। সে ঘরে ঢুকে দেখে স্বরূপ চলে গেছেন। বিদিশা তাকে দেখতে পেয়ে বললেন,
-- কী করছিলি এতক্ষণ? ওকি কপালে কী হল? কোথায় ধাক্কা খেয়েছিস?
-- ওই আসতে গিয়ে রান্নাঘরের দরজায় একটু লেগে গেছে। বরফ দিয়েছি কিছু হবে না।
-- আসলে নতুন জায়গা তো। সব সময় লাইট জ্বালিয়ে কাজ করবি। বললি না তো কী করছিলি?
-- বাসনগুলো মেজে রেখে আসলাম। 
-- কেন করছিস এসব কাজ মা? তোর তো এগুলো করার কথা নয়।
-- যে বাড়িতে কাজ করতে এসেছি সেখানকার মানুষগুলোকে যদি নিজের ভাবতে না পারলাম তাহলে এই কাজ করবো কী করে মা? তোমার দেখভালের পরে যদি আমার হাতে সময় থাকে তাহলে এগুলো করতে অসুবিধা কোথায়? আমায় তো কেউ এগুলো করতে বলছে না। আমি নিজের ইচ্ছাতেই করছি। 
-- আচ্ছা ঠিক আছে আর বলবো না তবে। তোর বাবা আমায় ওষুধ খাইয়ে দিয়ে গেছেন। বলেছেন আজ নাকি আমায় খুব তরতাজা দেখাচ্ছে। একদিনেই তুই আমায় অনেকটাই সুস্থ করে দিয়েছিস।
 সুবর্ণা হাসতে হাসতে বলে,
-- ওষুধ তো ডাক্তার দিয়েছেন। আমি আর কী করলাম?
-- গাদা গাদা ওষুধ খেলেই কি রোগ ভালো হয় রে? মানসিক শান্তিটাই হচ্ছে আসল। যাকগে অনেক রাত হল। শুয়ে পড় এখন। 
  সারাটা রাত সুবর্ণা ছোটফট করতে থাকে। একটুও ঘুম হয় না তার। কত স্মৃতি মনে পড়তে থাকে। ভাবতে থাকে এখানে থাকতে গেলে দেবেশের সাথে সে আবার জড়িয়ে যাবে। কারণ আজও সে দেবেশকে আগের মতই ভালোবাসে। পরিবার বাঁচাতে সে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিল ঠিকই কিন্তু দেবেশের তো কোন দোষ ছিল না। আর আজও দেবেশ যা করছে সে তো তাকে ভালোবেসেই করছে। এখানেও দেবেশের কোন দোষ সে দেখছে না। কিন্তু এই মুহূর্তে সে কী করবে? আয়ার কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে? কিন্তু দেবেশ এবার ঠিক তাকে খুঁজে বের করবে। কারণ সে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে সুবর্ণা তাকে সেদিন তার বিয়ের ব্যাপারে যা বলেছিলো সবই মিথ্যে। কিন্তু এখানে থেকেও সে কোন চাকরির চেষ্টাও করতে পারবে না। তাহলে এখন সুবর্ণা কী করবে?
 সারাটা রাত না ঘুমানোর ফলে সকালেই সে উঠে পড়ে। ব্যালকনিতেই দাঁড়িয়ে ছিল। বিদিশা উঠে ওকে দেখতে না পেয়ে কাছে ডেকে নেন। মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে যাওয়ার উদ্যোগ করতেই বিলাসী চা নিয়ে ঘরে ঢোকে। ততক্ষণে সুবর্ণা বিদিশাকে দাঁত মাজিয়ে,চুল আঁচড়ে পরিপাটি করে দিয়েছে। বিলাসী চা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে যখন তখন সুবর্ণা তাকে ডেকে বলে,
-- পিসি আমি রান্নাঘরে আসছি। তুমি মাছ,তরকারি রেডি করতে থাকো আমি গিয়ে টিফিন আর দুপুরের রান্না করবো।
 বিলাসী দাঁড়িয়ে পড়ে বলে,
-- না,তুমি কিছু করবে না। আমি খামোখা দেবুর বকা খেতে পারবো না।
-- আচ্ছা তুমি তোমার ভাইপোকে একটু এঘরে পাঠিয়ে দাও।
-- সে তো এখনও ঘুম থেকেই ওঠেনি।
-- আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যাও আমি আসছি।
 সেদিন কী মনে হতে স্বরূপ চায়ের কাপ হাতে বিদিশার ঘরে গিয়ে ঢোকেন। তাকে দেখতে পেয়েই সুবর্ণা খুব খুশি হয়ে বলল,
-- একটা কাজ করে দেবেন? 
 বিদিশা এবং স্বরূপ দু'জনেই অবাক হয়ে সুবর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে। সুবর্ণা দ্রুত হুইল চেয়ারটা এনে খাটের কাছে রেখে বললো,
-- আমায় একটু সাহায্য করবেন ? 
-- এখনি স্নান করাবে?
-- না না এত সকালে স্নান করাবো না। আপনি একটু হেল্প করুন আমি মাকে ডাইনিং রুমে নিয়ে যাবো। মা আজ থেকে টেবিলে গিয়েই তিনবেলা খাবেন।
-- না না সুবর্ণা আমি এতক্ষণ বসে থাকতে পারবো না।
-- আমি তো আছি মা ভয় কিসের? আমার উপর বিশ্বাস রাখো। তুমি বসতে না পারলে আমি তখনই তোমার নিয়ে চলে আসবো।
স্বরূপ এসব শুনে বললেন,
-- পারবো না পারবো না বলে দিনরাত এই ঘরে শুয়ে থাকো। বলছে যখন চলো আজ। তুমি যখনই বলবে আমরা আবার তোমায় নিয়ে এসে শুইয়ে দেবো।
 বিদিশার কোন আপত্তি না শুনে সুবর্ণা স্বরূপের সাহায্যে তাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে নিজেই ঠেলে নিয়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে নিয়ে আসে। সুবর্ণা বিলাসীকে ডেকে বলে,
-- পিসি দেখে যাও কে এসেছে?
 বিলাসী ছুটে এসে বিদিশাকে দেখে বলে,
-- বৌদি, এ মেয়ে তো যাদু জানে। কোন ডাক্তার তোমায় সুস্থ করতে পারেনি। কিন্তু এ মেয়ে তোমায় ঠিক হাঁটিয়ে ছাড়বে।
ইতিমধ্যে দেবেশ সেখানে এসে মাকে দেখে পুরো থ।
-- ওমা, আমরা যা এতদিনে পারিনি সুবর্ণা দেখছি একদিনেই তোমার মনের জোর বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের বিশ্বাস করে ওঘর থেকে হুইল চেয়ার চেপে এঘরে আসতে চাওনি। আর আজ এই অপিরিচিত মেয়েটার প্রতি তোমার এত বিশ্বাস জন্মে গেলো?
-- আরে ও এমনভাবে বললো তোর বাবার কাছে জিজ্ঞেস কর আমার কোন আপত্তি ধোপে টিকলো না।
-- ও বাবা, তুমি ডাক্তার হয়ে যা পারোনি মায়ের নতুন মেয়ে কিন্তু তা করে দেখিয়ে দিল। তারমানে বুঝতে পারছো আমার,তোমার উপর যে বিশ্বাস মায়ের নেই সুবর্ণার উপর একদিনেই মায়ের বিশ্বাস জমে গেছে। এবার মা সুস্থ হবেই। 
 সুবর্ণা রান্নাঘরে ঢোকার আগেই রুটি হয়ে গেছিলো। সে খুব তড়িঘড়ি একটা আলুর তরকারি করে এনে বাপ ছেলের সামনেই বিদিশাকে বললো,
-- মা, তুমি খেয়ে নাও। তোমায় ঘরে নিয়ে যাবো।
 বাধ্য মেয়ের মত বিদিশা খেয়ে বললেন,
-- কতদিন পর আজ এঘরে এসে খেলাম। খুব ভালো লাগলো। তুই এখন আমায় ঘরে দিয়ে আয়। আর বসে থাকতে পারছি না। আমাকে দিয়ে এসে তুইও খেয়ে নিস।
-- হুইল চেয়ারটা নিয়ে সুবর্ণা এগোতে থাকে আর পিছন পিছন দেবেশও এগিয়ে যায়।

ক্রমশ 
--

Friday, April 5, 2024

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (৮ম পর্ব)

প্রথমে সুবর্ণা ভেবেছিল দেবেশের কোন কথার উত্তর সে দেবে না। তাই সে বিদিশার ঘরের দিকে পা বাড়িয়েও হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বেশ দৃঢ় কন্ঠে বললো,
-- পৃথিবীটা গোল।তাই হয়ত তোমার সাথে আমার আবার দেখা হয়ে গেলো। কিন্তু আর দেখা হোক সেটা আমি কোনদিনও চাইনি। তবে তুমি যেটা ভাবছো সেটা আমার মধ্যে কিছুই হচ্ছে না। সচ্ছল পরিবারে সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছো। অভাব কাকে বলে কোনদিন জানতেও পারোনি। পরিবারের কারও প্রতি কোন দায় কাঁধের উপর নেই। থাকলে বুঝতে পারতে গরীবের ঘরে স্বপ্ন দেখতে নেই। অসুস্থ বাবা,ভায়ের পড়াশুনা পুরো পরিবারের দায় সংসারে বড় হওয়ার কারণে চাকরি না পেয়ে কতটা কষ্টে এই কাজ করতে বাধ্য হচ্ছি তা বোঝার ক্ষমতা তোমার কোনদিনও হবে না।যদি এতে তোমার আপত্তি থাকে অর্থাৎ তোমার বাড়িতে যদি আমাকে কাজ করতে না দাও সরাসরি বলে দাও আমি কালই চলে যাবো। অন্য কোন কাজ খুঁজে নেবো। আর যদি তা না হয় আর কখনো আমাকে কোন কথা বলবে না। বাড়ির আয়ার সাথে মানুষ যেমন প্রয়োজনে কথা বলে সেটুকুই বলবে। এর বাইরে কোনকিছু নয়। বাড়িতে যারা আছেন তাদের কেউ যেন টের না পায় আমায় তুমি আগে চিনতে তাতে আমার সম্মানহানির থেকে তোমার সম্মানহানি বেশি হবে। পূর্ব পরিচিত হিসাবে তাই আমি আশা করবো আর কখনোই তুমি কোন কথা আমাকে বলবে না। আমার পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখতে আমি যেকোন কাজ করতে রাজি আছি।
 কথাগুলো বলে আর এক মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে সুবর্ণা চলে গেলো। ঘরে ঢোকার আগে অবাধ্য চোখদু'টো  শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে নিল।
  দেবেশ স্বপ্নেও ভাবেনি সুবর্ণা তাকে এই ধরণের কথা বলতে পারে। অপমানে,কষ্টে দেবেশ যেন পাথর হয়ে গেলো। হঠাৎ মনে পড়লো বাবা টেবিলে খেতে এসেছেন। ধীরে ধীরে সে এসে বাবার সামনে একটা চেয়ারে বসলো।
-- কি রে মুখটা এত থমথমে কেন? 
-- বাবা, এই মেয়েটিকে তুমি কোথায় পেলে? 
-- কেন বলতো? এবারও কি তোর মায়ের পছন্দ হয়নি একে?
-- না, সে রকম কিছু তো মা বললেন না। আজ তো প্রথম দিন। মনেহচ্ছে মা এর সেবাযত্নে খুশিই হয়েছেন। তাছাড়া শুনলাম ও নাকি আজ রাতের রান্নাও করেছে।
-- হ্যাঁ আমাকে তো বিলাসী তাইই বললো। মেয়েটি ভদ্রঘরের মেয়ে। ও বাবার টিবি হওয়াতে আমাদের হাসপাতালে ট্রিটমেন্টের জন্য আসতো। বাবা একটা দোকানে কাজ করতেন। কাজটা চলে যাওয়াতে ভীষণ সমস্যায় পড়ে ওরা। যেকোন একটা কাজের কথা আমাকে বলেছিল। 
 খেতে খেতে বাপছেলের কথা হচ্ছিল। রুটি ছিঁড়ে মুখে দিতে দিতে স্বরূপ বললেন,
-- রান্নার হাতটাও বেশ ভালো। চানাটা বেশ ভালো লাগছে খেতে। 
-- কিন্তু বাবা ও তো মায়ের দেখাশুনা করতে এসেছে। ও কেন রান্না করবে? আর আমরাও বা এটা মেনে নেবো কেন?
-- কেউ তো বলেনি ওকে রান্না করতে। ও নিজের থেকেই করেছে। বিলাসী আমাকে সব বলেছে।
-- ও করতে চাইলেই আমরাই বা ওকে রান্না করতে দেবো কেন? পিসি তো রান্না করেই। না ওকে এইসব কাজ করতে হবে না।
 স্বরূপ অবাক হয়ে তার ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। এভাবে কোনদিন কারো কোন কাজ নিয়েই তাদের দেবু মাথা গলায়নি। তাহলে আজ এসব কী বলছে সে?
-- ও যদি এরকম রান্না করে তাহলে ওকে মাইনেও বেশি দিতে হবে।
-- ঠিক আছে দেবো। কিন্তু ওকে তো আমরা বলিনি রান্না করতে, রান্নাঘর পরিস্কার করতে।
-- ও তাও করেছে নাকি? 
তারপর আস্তে আস্তে বললো,
-- সব তাতেই বাড়াবাড়ি 
-- কি বললি?
-- না কিছু না 
-- বললি না তো কেমন খেলি?
 দেবেশ গম্ভীর হয়ে উত্তর দিল
-- ভালো।
   খাওয়াদাওয়া শেষে স্বরূপ যখন বিদিশার ঘরে ঢুকলেন তখন রাতটা একটু বেশিই হয়ে গেছে। সুবর্ণাকে দেখেই উনি বললেন,
-- শোনো কাল থেকে তুমি তোমার খাবারটা একসাথে এই ঘরেই নিয়ে আসবে।তানাহলে তোমার খেতে অনেক রাত হয়ে যাবে।
-- তাতে কিছু হবে না। মা আমায় বলেছেন ডিনার করে আপনি রোজ একবার এই ঘরে আসেন। খেয়েদেয়ে আপনি যখন এই ঘরে আসবেন আমি তখনই খেতে যাবো। আমার কোন অসুবিধা হবে না।
বিদিশা তখন বললেন,
-- দেখেছো প্রথম দিন থেকেই কেমন আপন করে নিয়েছে আমায়। কী মিষ্টি করে মা বলে ডাকছে।
-- তাই তো দেখছি। 
 সুবর্ণা ওদের কথার মাঝখানেই বিদিশার খাবারের থালা নিয়ে রান্নাঘরে যাওয়ার উদ্যোগ করতেই স্বরূপ বললেন,
-- তোমার হাতের রান্না খুব ভালো লাগলো। কিন্তু মা আমার ছেলে চায় না তুমি তোমার মায়ের দেখভাল ছাড়া এই সংসারে অন্য কোন কাজ করো। তাই বলি কী তুমি আর রান্নাবান্নার দিকে যেও না।
-- মায়ের কাজ করার পর যদি সময় পাই আমি টুকটাক একটু রান্না করে সময়টা কাটাতে চাই। শুয়ে বসে থাকতে পারি না। এতে আমার কোন অসুবিধা হবে না। আমি রান্না করতেই ভালোবাসি।
 স্বরূপ আর কিছু বললেন না। সুবর্ণা বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার সময় দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যায়।
 বিদিশা স্বরূপকে বললেন,
-- মেয়েটা বড্ড ভালো গো। আমার তো মনেহয় বেশ শিক্ষিত। ওর কথাবার্তার মধ্যে সর্বদা একটা বুদ্ধিমত্তার ছাপ।
-- যাক তোমার ওকে পছন্দ হয়েছে তো?
-- আরে পছন্দ হওয়ার কী আছে? এর আগে যারা এসেছে তারা সকলেই কেমন প্রফেশনাল। কিন্তু ও যখন আমার কাজগুলো করলো আজ আমার মনে হল যেন মেয়ে তার অসুস্থ মায়ের সেবা করছে।
-- তাহলে তো এবার তোমার বাইরে যাওয়ার কোন অসুবিধা নেই?
-- কয়েকদিন পর বলছি --
   সুবর্ণার খাবার গুছিয়ে বিলাসী বসে ছিল সে গেলে দু'জনে একসাথে খাবে বলে। অন্য দিনগুলোতে সে বাপ ছেলের খাওয়া হলেই খেয়ে নেয়। কিন্তু খেতে খেতে সুবর্ণার সাথে গল্প করবে বলে সে আজ না খেয়ে বসে আছে। সুবর্ণা রান্নাঘরে ঢুকে দেখে ছোট্ট টেবিলটায় দু'জনের খাবার গুছিয়ে বিলাসী ঘুমে ঢুলছে।
-- পিসি, তুমি বসে আছো কেন? তোমার তো ঘুম পেয়েছে।
-- হ্যাঁ আমি তো রোজ এইসময় ঘুমিয়েই পড়ি। তবে আজ খেতে খেতে তোমার সাথে গল্প করবো বলে না খেয়ে বসে আছি। তবে এখন মনেহচ্ছে তা আর সম্ভব হল না। প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। কোনরকমে খেয়ে গিয়ে শুয়ে পড়ি। শোনো, তুমি কিন্তু খেয়েদেয়ে আবার বাসন মাজতে লেগে যেও না। দেবু প্রচণ্ড ক্ষেপে গেছে মায়ের কাজ ছাড়া তুমি অন্যসব কাজ করেছো বলে।
-- এতে ক্ষেপে যাওয়ার কী হল? আমার ইচ্ছা হয়েছে আমি করেছি। কেউ তো আমাকে করতে বলেনি।
-- জানি না বাবা। তুমি খেয়ে উঠে বাসন রেখেই চলে যেও।
-- তোমার ভাইপোকে আমার সাথে কথা বলতে বলো। আমি সময় পেলে এগুলো করবো তাও বলে দিও।
 সুবর্ণা একটু দৃঢ়তার সাথে কথাগুলো বলল কারন সে দেখতে পেয়েছিল দেবেশ ডাইনিং রুমে ঢুকে চেয়ারে বসে আছে। দেবেশকে শুনিয়ে শুনিয়ে তাই ইচ্ছাকৃত এই কথাগুলো সে বলে যাতে দেবেশ আর কখনোই বিলাসীকে তার কাজ করা নিয়ে কোন কথা না শোনায়।। বিলাসীর প্রচণ্ড ঘুম পেয়ে গেছিলো। সুবর্ণার সব কথা তার কান পর্যন্তই পৌঁছায়নি। সে ঘুম চোখে অতি দ্রুততার সাথে ডাইনিং রুম পেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়। দেবেশ যে চেয়ারে বসে আছে তা সে খেয়ালই করে না। সুবর্ণা খেয়ে উঠেই সিঙ্কে বাসন ধুতে শুরু করে। দেবেশ গিয়ে রান্নাঘরে ঢোকে। কী করবে কিছু বুঝতে না পেরে খামোখা ফ্রিজ খুলে একটা জলের বোতল বের করে ঠান্ডা জল ঢকঢক করে খেতে শুরু করে। সুবর্ণা যেন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না এমনভাবে সে তার কাজ করে চলেছে।

ক্রমশ -

Wednesday, April 3, 2024

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (৭ম পর্ব)

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার ( ৭ম পর্ব)

  দেবেশ সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে সুবর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে। সুবর্ণা মুখটা নিচু করেই আছে। মানুষের মনটা সবচেয়ে একটি দ্রুতযান। মুহূর্তেই দেবেশের চোখের সামনে ভেসে উঠলো অতীতের কিছু স্মৃতি। একদিন কলেজ বন্ধ করে দু'জনে গেছিলো সিনেমা দেখতে। অবশ্য উভয়ের বাড়ির লোকজন কেউই সেটা জানতেন না। হলে পৌঁছাতে সেদিন বেশ দেরি হওয়াতে পড়িমরি দু'জনে হলে ঢুকে লাইটম্যানকে না দেখে দু'টো  ছিট ফাঁকা পেয়ে দ্বিতীয়টাই সুবর্ণা বসে পাশের ছিটটাই দেবেশকে হাত টেনে বসিয়ে দেয়। কিন্তু রোগা,পাতলা দেবেশ ওই চেয়ারটাতে বসতে গিয়ে 'আহ্' বলে তার পিছনটা পুরো চেয়ারের ভিতর ঢুকে যায়। আসলে চেয়ারটা ভেঙ্গে ভিতরটা পুরো ফাঁকা হয়ে গেছিলো। সুবর্ণা সহ আশেপাশের দু'একজন যারা দেখেছিল তারা কেউ জোরে আবার কেউবা মুখ টিপে টিপে হাসছিল। স্বভাবতই হলের ভিতর এরূপ পরিস্থিতিতে অন্যেরা চুপ করতে মৃদু ধমক দিতে থাকে। এরই মাঝে লাইটম্যান চলে আসায় তার সাহায্যে তারা তাদের নিদ্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে বসে।
 আর একদিন মেট্রো করে যাওয়ার সময় দু'জনে গল্পে এতটাই মশগুল ছিলো তাদের স্টেশন ছাড়িয়ে কখন চলে গেছে তা তারা খেয়ালই করেনি। মাঝপথে নেমে আবার উল্টো মেট্রো ধরে বাড়িতে ফেরা। এসব ঘটনা নিয়ে নিজেরা তো বটেই বন্ধু মহলেও সুযোগ পেলেই হাসির রোল ছুটাতো দু'জনেই। মাত্র তিনটে বছরে কত হাসির,কত মান-অভিমান, কত ভালোবাসার স্মৃতি মনের মধ্যে জমা হয়ে আছে। 
 দেবেশ কিছু বলছে না দেখে বিদিশা নিজেই বললো,
-- কখন ফিরলি? চা খেয়েছিস? বিলাসী আজ আমাকে এখনো চা দিলো না তো!
-- সবে ফিরেই তোমার ঘরে আসলাম। এখনো ফ্রেস হয়নি। আমি ফ্রেস হয়ে আবার আসছি তোমার কাছে।
কথাটা বলেই দেবেশ যেন ছুটে বেরিয়ে গেলো। কিন্তু কথা যখন সে বলেছিল সুবর্ণার দিকেই তাকিয়ে ছিল। সুবর্ণা একবারের জন্যেও মুখ তুলে দেবেশের দিকে তাকায়নি। না তাকিয়েও তার বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি যে দেবেশ তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
 কোন মুখে সে দেবেশের দিকে তাকাবে? সে যে তার পরিবার বাঁচাতে তার ভালোবাসাকে গলাটিপে মেরে ফেলেছে। 
 দেবেশ বেরিয়ে যেতেই বিলাসী দু'কাপ চা একটি ট্রেতে করে নিয়ে বিদিশার ঘরে ঢোকে। সে টি টেবিলের উপর চা রেখে বেরিয়ে যাচ্ছে যখন তখন সুবর্ণা তাকে বলে,
-- পিসি আমি আজ রাতের খাবারটা করি? তুমি আমায় দেখিয়ে দেবে?
আসলে সুবর্ণা এই ঘর থেকে কিছুক্ষণের জন্য পালাতে চাইছে। কারণ সে জানে দেবেশ এখনই এই ঘরে আসবে।
বিলাসী সুবর্ণার কথা শুনে মুখে একটা আঙ্গুল চাপা দিয়ে বলে,
-- ও বৌদি, এ মেয়ে বলে কী? এত মেয়ে এলো আর গেলো এ কথা তো কারো মুখে শুনিনি। আর তুমি জানো দুপুরে খেতে গিয়ে মেয়ে কী করেছে?
-- কী করেছে?
-- আমার তো দুপুরে খেলেই ঘুম পায়। আমি ওর খাবার গুছিয়ে ওকে দেখিয়ে দিয়ে আমার ঘরে চলে যাই ঘুমাতে। ওমা! পরে এসে দেখি রান্নাঘর একদম ফিটফাট। যেন মা লক্ষ্মীর হাত পড়েছে রান্নাঘরে। কী সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছে। জানো সমস্ত বাসনও মেজে গুছিয়েছে।
বিদিশা সব শুনে বললেন,
-- আমি ওকে ঠিক চিনেছি। 
তারপর দু'জনেরই কথার উত্তর একসাথেই দিলেন,
-- যা বিলাসী ওকে রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে সব দেখিয়ে দে।আর হ্যাঁ কী রান্না করতে হবে সব গুছিয়ে দিস।
-- তারমানে আমার ছুটি?
-- আজ্ঞে না, ওর সাথে তুইও থাকিস। 
-- বেশ বেশ। ও মেয়ে আমি যাই তুমি চা টা খেয়ে এসো।
 বিলাসী বেরিয়ে গেলো। বিদিশার কাছে বসে চা খেতে খেতে সুবর্ণা বললো,
-- আসলে আমি ঠিক এভাবে বসে সময় কাটাতে পারি না। এখন তো তোমার কোন কাজ নেই। আর তোমার ছেলেও আসবে এখন তোমার কাছে। আমি আর থেকে কি করবো? তাই ভাবলাম আমি রান্নাঘরেই যাই।
-- সেই ভালো।হ্যাঁ আজ তোর হাতের রুটি, তরকারি খাবো। কিন্তু এ কাজটা তোর নয়। আজ প্রথম দিন তোর শখ হয়েছে তাই বললাম কিন্তু।
 সুবর্ণা হেসে পড়ে বললো,
-সে দেখা যাবে। আজ আমার সর্ববিষয়ে পরীক্ষা। দাঁড়াও রুটি,তরকারি করে নিয়ে আসছি।
 সুবর্ণা খুব তাড়াতাড়ি কাপ প্লেট সমেত চায়ের ছোট্ট ট্রেটা নিয়ে বিদিশার ঘর থেকে বেরোতে গিয়েই দেবেশের মুখোমুখি।
-- বাংলায় এম এ করা সুবর্ণা, বাবা মায়ের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে শেষ পর্যন্ত চাকরির অভাবে আয়ার কাজ? 
সুবর্ণা কোন উত্তর না দিয়ে এগিয়ে যেতে গেলে দেবেশ তার পথ আটকায়। সুবর্ণা একবার দেবেশের দিকে তাকিয়েই মুখ নিচু করে নেয়।
-- এভাবে পালিয়ে কতদিন থাকবে? আমার তো সব জানতেই হবে। কবে জানতে পারবো সব? 
 একথারও সুবর্ণা কোন উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে দ্রুত চলে যায়। দেবেশ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মায়ের ঘরে ঢোকে।
 সুবর্ণার মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু এই মুহূর্তে কাজ ছেড়ে চলেও যেতে সে পারবে না। সংসার,ভায়ের পড়াশুনা তার উপর বাবার ওষুধ এবং ভালো ভালো খাওয়াদাওয়া। 
 সে রান্নাঘরে ঢুকে দেখে বিলাসী আটা মেখে কাবলি ছোলা সিদ্ধ করে রেখেছে আগেই। পেঁয়াজ,টমেটো,আদা,রসুন নিয়ে কাটতে বসেছে। সুবর্ণা রান্নাঘরে এসে বললো,
-- আগে রুটিটা করে নিই পিসি?
-- সে করো। কিন্তু এই কাজগুলো তো তোমার নয়। দাদা দেখলে খুব বকাবকি করবেন আমায়।
-- তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। এই ব্যাপারে যে তোমায় বকতে যাবে তুমি বুঝতে পারলেই বলবে আমি নিজের ইচ্ছায় করেছি। আসলে আমি শুধু শুধু বসে থাকতে পারি না। এখন তো মায়ের ঘরে কোন কাজ নেই তাই এখানে এলাম।
-- ওমা সে কী কথা? একটা মানুষ সব সময় কাজ করতে পারে নাকি? দুপুরেও তো ঘুমাওনি দেখলাম। সন্ধ্যার সময় ছাদ থেকে কাপড়জামা তুলে বৌদির ঘরে রাখতে গিয়ে দেখি তুমি ব্যালকনিতে।
-- কাল থেকে ছাদের জামাকাপড় আমিই তুলবো। আজ একদম ভুলে গেছিলাম। আমি ওগুলো দেখেই বুঝতে পেরেছি তুমি তুলে এনেছো।
-- হ্যাঁ তাই তো। আমি ছাড়া আর কে করবে বলো? তবে এখন দেখছি আমাকে আর এ বাড়িতে দরকার পড়বে না।
 বিলাসী কথাটা বলেই হাসতে থাকে। তার হাসি দেখে সুবর্ণাও হেসে দেয়।
-- একটা কথা বলবো তোমায়? কিছু মনে করবে নাতো?
-- না না মনে করবো কেন? বলো কী জানতে চাও?
-- আচ্ছা তোমার চেহারা,পোশাকআশাক দেখে মনে হয় তুমি কোন ভদ্র ঘরের মেয়ে। তা কী অসুবিধায় পড়ে এই আয়ার কাজ করতে আসলে? তোমার চালচলন,চেহারা বলছে বলছে তুমি লেখাপড়াও জানো।
-- পিসি প্রথম দিনেই সব শুনলে হবে? পরে বলবো সব।

 স্বরূপের বাড়িতে ফিরতে প্রায়ই রাত হয়। এখন বিদিশা টেবিলে খেতে আসতে পারেন না তাই বাবা যতক্ষণ না ফেরেন দেবেশ বাবার জন্য বসে থাকে। কিন্তু আজ সে সেই যে মায়ের ঘরে ঢুকেছে এখনো বের হয়নি। সে ওখানে বসে সুবর্ণার জন্য অপেক্ষা করছে আর সুবর্ণা রান্নাঘরের কাজ সেরে বিলাসীর সাথে কথা বলেই যাচ্ছে। খেয়াল রাখছে দেবেশ বেরোলেই ওই ঘরে গিয়ে ঢুকবে।
 স্বরূপ ঘরে এসে ফ্রেস হয়েই খাবার টেবিলে চলে আসেন। কোনদিন খেয়েদেয়ে বিদিশার ঘরে যান আবার একটু তাড়াতাড়ি ফিরলে আগে গিয়ে দেখা করে শারীরিক খবর নিয়ে তারপর খেতে আসেন। আজ দেরি হওয়াতে সোজা খাবার টেবিলে। বিলাসী গিয়ে দেবেশকে ডেকে আসে। আর এদিকে সুবর্ণা খাবার গুছিয়ে নিয়ে বিদিশার ঘরের দিকে রওনা দেয়। আবার মাজপথে দু'জন মুখোমুখি।
-- খারাপ লাগছে বর্না তোমায় এভাবে দেখতে। আবার জানো কোথাও একটা ভালোলাগাও কাজ করছে। সেই প্রথম দিনের মত বুকের ভিতর কে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। আমি এটাও জানি তোমারও ঠিক একইরকম অনুভূতি হচ্ছে।


ক্রমশ 
    

Monday, April 1, 2024

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার ( ষষ্ঠ পর্ব)

 ভালোবাসি বলেছি অনেকবার ( ষষ্ঠ পর্ব)

  সেদিন কলেজে যাওয়ার সময় নিজের অজান্তেই সুবর্ণা একটু বেশিই যেন নিজেকে গুছিয়ে নিলো। পাঁচফুট চার ইঞ্চির টানা টানা চোখের অধিকারিণী কোমর ছাপিয়ে একমাথা কালো চুলের একটা মোটা বেনুনী করে সুন্দর একটি তাঁতের শাড়িতে নিজেকে সাজিয়ে কলেজে এলো। দেবেশও যেন এই অপেক্ষাতেই ছিলো। সেও নীল রঙের একটা গেঞ্জি পরে শ্যাম্পু করা চুল যা হাওয়ার দাপটে বারবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, সুবর্ণাকে দেখতে পেয়েই একগাল হাসি দিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালো। দু'জনেই দু'জনের এই সাক্ষাতের অপেক্ষাতেই ছিলো কিন্তু সামনাসামনি হয়ে যাওয়ায় দু'জনেই কেমন জড়োসড়ো হয়ে কোন কথাই কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। তাদের জড়তা কাটালো একদল মেয়ে এসে 
-- সুবর্ণা তোকে আজ দারুন লাগছে। তুই তো এত সেজে কোনদিন কলেজে আসিস না। কী ব্যাপার বলতো?
 সুবর্ণার বন্ধুরা আসাতে দেবেশ একটু সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। কিন্তু মেয়েগুলোর কথা তার কানে সবই আসছিল। বন্ধুদের কথাই সুবর্ণা স্বভাবতই একটু লজ্জা পেয়ে যায়। সে প্রসঙ্গ পাল্টাতে তাদের বলে,
-- চল ক্লাসে যাই। এক্ষুনি ঘণ্টা পড়ে যাবে।
 যাওয়ার সময় দেবেশের দিকে তাকিয়ে একটু দুষ্টু হাসি দিয়ে যায়।দেবেশও কিছুক্ষণ সেখানে অপেক্ষা করে ঘণ্টা পড়ার আওয়াজ পেয়ে নিজের ক্লাসে চলে যায়।
  একসময় ক্লাস শেষ হয়। পরের ক্লাস দুটোই অফ থাকায় দেবেশ কলেজ ক্যাপাশে বিশাল মাঠে খুব বড় একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে আনমনাভাবে বসে আছে। হয়ত মনেমনে তখন সুবর্ণার কথাই ভাবছে। ঠিক ওই সময়েই সুবর্ণারও একটা ক্লাস অফ থাকায় সেও বেরিয়ে দেবেশকেই খুঁজছিল। এদিকওদিক তাকিয়েও দেবেশের কোন দেখা না পেয়ে মন খারাপ করে ক্যাম্পাসের একদম শেষ দিকে হাঁটতে হাঁটতে এসে দেখে দেবেশ গাছের তলায় একাকী বসে।
-- তুমি এইখানে? আমি তোমাকে সেই থেকে খুঁজছি। আসলে আজ সকলেরই এই সময়ের ক্লাসটা অফ আছে। স্যারদের মিটিং চলছে। 
-- আমার পরপর দু'টো ক্লাস অফ। কিন্তু আমায় খুঁজছিলে কেন?
 দেবেশের প্রশ্নে সুবর্ণা লজ্জা পেয়ে গেলো। সুবর্ণা ইতস্তত করছে দেখে বললো,
-- তোমাকে আমার একটা কথা বলার ছিল --
সুবর্ণা নিচুতে বসার উদ্যোগ করতে করতে বললো,
-- বলো কী বলতে চাইছো?
-- আচ্ছা তার আগে একটা প্রশ্ন করি উত্তর দেবে তো?
 সুবর্ণা ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালো।
-- মাত্র দু'দিন হল তোমার সাথে আমার পরিচয়। আমার মত কি তোমারও মনে হচ্ছে আমরা একে অপরকে অনেক দিন ধরেই চিনি।
 সুবর্ণা হেসে দিলো দেখে দেবেশ পুনরায় বলে,
-- হাসলে হবে না,উত্তর দিতে হবে। তবেই না আমার কথাটা তোমায় নির্ভয়ে বলতে পারবো।
-- তাই যদি না হত আজ কলেজে ঢুকেই তোমায় খুঁজব কেন?
-- এসেই আমায় খুঁজছিলে? কিছু বলার জন্য? কী বলার জন্য খুঁজছিলে বলো তো? 
-- আগে তোমারটা শুনি তারপর আমারটা বলবো।
 দেবেশ কিছুটা সময় চুপ করে থেকে বললো,
--- আমি জানি না কথাটা তুমি কিভাবে নেবে। যদি তোমার মনোমত নাও হয় প্লিজ খারাপ ভেবো না আমায়। আসলে কথাটা না বলা পর্যন্ত আমিও শান্তি পাচ্ছি না।
 সুবর্ণা তখন ঘামছে। সমস্ত শরীর তার কাঁপছে। সে বুঝতে পারছে দেবেশ তাকে কী বলতে চায়। সেও তো সেই একই কথা দেবেশকে জানাতে চায়। 
 দেবেশ সরাসরি সুবর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে বসলো,
-- মানুষ কথায় বলে প্রথম দেখাতেই প্রেম। আজ নিজের জীবনেই সেই কথা চরম সত্যি হয়ে দেখা দিয়েছে। আমি তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি সুবর্ণা। তোমার কোন আপত্তি থাকলে আমাকে এখনই জানিয়ে দাও।
 সুবর্ণা হেসে দিয়ে বললো,
-- এই কথাটা তুমি আমায় না জানালে আমিই তোমায় জানাতাম। 
-- সারাজীবন আমার হয়ে থাকবে তো?
--- কথা দিলাম।
  
  সুবর্ণার সম্বিত ফিরলো বিদিশার ডাকে। সে দৌড়ে ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে খাটের কাছে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলো,
--- কিছু লাগবে মা?
-- না না কিছু লাগবে না। সন্ধ্যা হয়ে গেছে তোকে দেখতে পারছি না তাই ডাকছিলাম।
- আমি তোমার চুলটা একটু বেঁধে দিই। কাপড়টা কি পাল্টাবে মা?
--  আগে একটু মুখটা ধোয়ার ব্যবস্থা কর তারপর আমাকে উঠিয়ে দে। 
-- মা, কয়েকদিন আমি তোমার সব কাজ করে দেবো। কিন্তু আস্তে আস্তে তোমার নিজের কাজগুলো তোমাকেই করতে হবে। কেন জানো? এগুলো হচ্ছে শরীরের ব্যায়াম। তোমাকে তো উঠে দাঁড়াতে হবে। তুমি যদি হাত,পা সব নিজের থেকেই শুয়ে বসে একটু নাড়াচাড়া করো তাহলে দেখবে একটু একটু করে তুমি সুস্থ হয়ে গেছো।
-- এই জন্যই প্রথম দেখাতেই তোকে আমার ভালো লেগেছে। আজ এসেই তুই আমাকে আপন মনে করে সুস্থ হওয়ার জন্য কতকিছু বলছিস।
 সুবর্ণা চুল বাঁধতে বাঁধতেই কথা বলে যাচ্ছিল। বিদিশা শুরু করলেন ওর অসুস্থ্য হওয়ার গল্প।
-- এই বছর দু'য়েক হল আমি বিছানায় পড়ে আছি। আগে সংসারের সব কাজ নিজের হাতে করেছি। হ্যাঁ বিলাসী সেই প্রথম থেকেই আছে ঠিকই। সব কাজে ওই আমাকে সাহায্য করেছে। কিন্তু রান্না কখনো আমি বিলাসীর হাতে ছাড়িনি। আমার ছেলে আর তোর বাবা আমার হাতের রান্না ছাড়া আর কারও হাতের রান্না কোনদিনও পছন্দ করতো না। 
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে পূনরায় শুরু করলেন,
আজ দু'বছর হল আমি রান্নাঘরে ঢুকি না। ওরা এখন বাধ্য হয়েছে বিলাসীর হাতের রান্না খেতে। তবে জানিস বিলাসী কিন্তু খুব ভালো মানুষ। ও বাপ,ছেলের খুব যত্ন করে।প্রথম প্রথম আমার কাছে শুনে নিয়ে রান্না করতো। এখন তো বেশ ভালই রান্না শিখে গেছে। দুপুরে খেলি তো ভালো লাগেনি?
 সুবর্ণা মাথা কাত করে সম্মতি জানালো। বিদিশা যেন প্রথম দিনেই সব গল্প সুবর্ণাকে জানাতে চান। দেবু তখন সবে সবে চাকরি পেয়েছে। ও একটা কলেজে পড়ায়। দিন তিনেকের জন্য আমি আর তোর বাবা দীঘা গেছিলাম বেড়াতে। সমুদ্রে স্নান করে হোটেলে ফিরে এসেছি। জামাকাপড় পাল্টে নিচুতে খেতে যাবো বলে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে সিঁড়ির উপর জল থাকার কারণে পা পিছলে পড়ে যাই। কিন্তু তখন ব্যথা পেলেও খুব একটা কষ্ট হচ্ছিল না। তাই তোর বাবাকে ব্যথার কথা কিছু জানাই না। পেইনকিলার খেয়ে খেয়ে দু'দিন চলার পর প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কষ্ট পেতে থাকি। তারপর বেশ কয়েক ঘন্টা গাড়ি করে কলকাতা আসার ধকল নিতে পারি না। এসেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর নানান পরীক্ষা,নিরীক্ষা করার পর কোনকিছু না পেয়ে ওরা ছেড়ে দেয়। কিন্তু বাড়িতে আসার পর একটু হাঁটাহাঁটি করলেই কোমর ব্যথা হতে শুরু করে। হাঁফিয়ে যাই, প্রচণ্ড কষ্ট পেতে থাকি। হাসপাতালে থাকা আমার আবার প্রচণ্ড একটা আতঙ্ক। তাই রোগের কথা বাপ, ছেলেকে কিছুই জানাই না। কিন্তু আস্তে আস্তে পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকায় ওদের চোখে ধরা পড়ে যাই। আর সেই থেকেই হাসপাতাল আর বাড়ি। তোর বাবা ডাক্তার হওয়ার কারণে কলকাতা শহরের অনেক বড় বড় ডাক্তার দেখিয়েছে ওরা। ফিজিও থেরাপিস্ট এসে ছ'মাস চেষ্টা চালিয়ে গেছে। কিন্তু কিছুই হয়নি।এমনিতে আমি খুবই ভালো আছি। অন্যকোন অসুখ আমার নেই। কিন্তু আমি দাঁড়াতে পারি না; হাঁটাচলা তো মোটেই নয়। ওরা বারবার আমাকে বলেছে ভেলোর কিংবা চেন্নাই যাওয়ার কথা। কিন্তু কী করে যাই বলতো? একজনকে তো আমার সাথেই যেতে হবে। আর একজন তো একা হয়ে যাবে। বিলাসী তো সাথেই নিতে হবে।কতদিন থাকতে হবে তার কোন হিসাব নেই।
--- এইসব বললে কি হয় মা? সুস্থ হতে হবে তো? এবার আমি যাবো তোমাদের সাথে। ঠিক সুস্থ করে নিয়ে ফিরবো। এতদিন কেন যে এভাবে জীদ করে বসে আছো কে জানে?
 বিদিশা ঠোঁটের কোণে একটু হাসি এনে বললেন,
--- একদিন এখনো হয়নি। এরই মধ্যে কেমন মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছিস আমাকে।
 ওদের কথার মাঝখানেই ভেজানো দরজার বাইরে আওয়াজ শুনে আর সঙ্গে সঙ্গে " মা ভিতরে আসছি" বলেই দেবেশের প্রবেশ। দেবেশ ঘরে ঢুকেই সুবর্ণাকে দেখে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে আর সঙ্গে সঙ্গে সুবর্ণা উঠে সেখান থেকে চলে যাওয়ার উদ্যোগ করতেই বিদিশা তাকে ডেকে বসতে বলেন কাছে।

ক্রমশ 


    

Thursday, March 28, 2024

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার ( পঞ্চম পর্ব)

   কলেজ ফেষ্ট। স্বভাবতই সকলে খুব সেজেগুজে এসেছে। শ্যামলা গায়ের রং হলেও সুবর্ণার চোখ,মুখ খুব সার্ফ। হলুদ তাঁতের শাড়ি আর সাথে লাল ব্লাউজে তাকে খুব সুন্দর লাগছিল সেদিন।নামকরা শিল্পীর আগমনের ফলে ছাত্রছাত্রী ছাড়াও কিছু বাইরের লোক, কিছু গার্জিয়ানের উপস্থিতিতে কলেজ ক্যাম্পাস ভিড়ে থিকথিকে হয়ে আছে। কেউই জায়গা ছেড়ে উঠতে পারছে না। আর ধাক্কাধাক্কি তো চলছেই। অনুষ্ঠান শেষ হতে রাত সাড়ে ন'টা। অনুষ্ঠান শেষে সুবর্ণা উঠতে গিয়ে ভিড়ের চাপে ঘেমেনেয়ে একসার। জায়গা থেকে নড়তেই পারছে না। হঠাৎ একটি ছেলে এসে তাকে বললো,
-- এই রোয়ের ভিতরে গিয়ে কোন একটা চেয়ারে বসে থাকো। দেখছো না অনেকেই বসে রয়েছে। এই ভিড়ের মধ্যে বেরোতে গেলে চাপেই দম বন্ধ হয়ে যাবে।
  মুখ তুলে ছেলেটির কথা শুনে বাধ্য মেয়ের মতোই সুবর্ণা একটা চেয়ার দখল করে বসে থাকে। কিন্তু তার মাথায় চিন্তা ঢুকে আছে এত রাত হয়েছে শিয়ালদহ গিয়ে যদি ট্রেন না পায় তাহলে বাড়ি পৌঁছাবে কিভাবে?
প্রায় মিনিট দশেক এভাবে বসে থেকে ভির কমলে সে উঠে দাঁড়ায়। এদিক - ওদিক তাকিয়ে ছেলেটিকে খোঁজে কিন্তু কোথাও দেখতে পায় না। বেশ জোড়ে পা চালিয়ে কলেজ গেটের কাছে এসে দেখে সেই ছেলেটি বাস স্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছে। সুবর্ণার এই মুহূর্তে কেন যেন মনে হল ছেলেটি তাকে এই ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে। দ্রুত হেঁটে সে ছেলেটির কাছে আসলো। ইতস্তত করতে করতে বলেই বসলো,
-- আমার মনেহচ্ছে এখন গিয়ে আমি ট্রেন পাবো না। অনেক রাত হয়ে গেছে। তুমি কি আমায় কোন সাহায্য করতে পারবে?
 আচমকা একটি মেয়ের কাছ থেকে এ কথা শুনে ওই ছেলেটি অর্থাৎ দেবেশ কিছুটা হকচকিয়ে গেলো। তারপর গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে বললো,
-- কী সাহায্য চাও বলো।
-- আসলে এখন যদি আমি বাসে উঠি তাহলে শিয়ালদহ পৌঁছাতে আমার দেরি হয়ে যাবে। তাই ভাবছি ট্যাক্সি করে যাবো। কিন্তু এত রাতে একা ট্যাক্সিতে যেতে ভীষণ ভয় করছে। আমার সাথে শিয়ালদহ পর্যন্ত যদি তুমি ট্যাক্সিতে যেতে আমি ট্রেনটা পেয়ে যেতাম। যদিও জানি তোমার বাড়ি পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। যদি আপত্তি না থাকে --
  নাম না জানা একটি অপরিচিত মেয়ে একই কলেজে পড়ে তাই কোনোকিছু না ভেবেই সঙ্গে সঙ্গে দেবেশ একটা ট্যাক্সি ডেকে সুবর্ণাকে নিয়ে উঠে পড়লো। কারণ আজ পর্যন্ত সাহায্য চেয়ে ফিরে গেছে দেবেশের কাছ থেকে কেউ এটা ঘটেনি। দু'জনেই  পিছনের সিটে দু'টি জানালার পাশে, দু'জনেরই  চোখ বাইরের দিকে কিন্তু কারো মুখেই কোন কথা নেই।
  ট্যাক্সি শিয়ালদহ আসলে দেবেশ ভাড়া মিটাতে গেলে সুবর্ণা বাধা দেয়।সে ব্যাগ খুলে টাকাটা বের করতে গেলে দেবেশ তাকে বলে,
-- একই কলেজে পড়ি তো। অন্যভাবে টাকাটা কোন এক সময় শোধ দিয়ে দিও। তুমি এগোতে লাগো আমি টিকিট কেটেই আসছি। কোথাকার টিকিট কাটবো?
-- আরে না। তোমাকে আর আসতে হবে না। এতেই আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো তোমার কাছে।
-- সেতো পরের কথা। আপাতত তোমার নামটা বলো। আমি দেবেশ।
--- সুবর্ণা। বাংলা নিয়ে পড়ছি
--- আমার ইংলিশ।
 কথা বলতে বলতে ওরা কাউন্টারের কাছে চলে আসলো। সুবর্ণার কথামত নির্দিষ্ট জায়গার টিকিট কেটে দেবেশ তার হাতে দিলো।
-- এই টাকাটাও কিন্তু ঋণ হয়ে গেলো।
-- হিসাব রেখে দাও। পরে একসময় সুদ আসলে নিয়ে নেবো।
 ইতিমধ্যে ট্রেন এসে গেলে সুবর্ণা দৌড়ে গিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ে। দেবেশও তার পিছুপিছু ছুটে গিয়ে ট্রেনের জানালার কাছে দাঁড়ায়। দু'জন দু'জনকে হাত নাড়িয়ে টাটা করে। দু'জনের মনেই অদ্ভুত এক অনুভূতির অনুরণন খেলে যায়। দু'জনেরই মনেহয় এই প্রথম তাদের পরিচয় নয় যেন কত যুগ যুগ ধরে একে অপরকে চেনে।
 সেদিন বাড়ি ফিরতে সুবর্ণার অনেক রাত হয়ে যায়। মা একটু চেঁচামেচি করলেও তার বাবা জানতেন কোন রকম বিপদআপদ না ঘটলে  সুবর্ণা ঠিক সময় মত ফিরে আসবে। যদিও সে বাড়িতে বলেই গেছিলো ফিরতে রাত হবে। মেয়ে না ফেরা পর্যন্ত তিনি বড় রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একদম স্টেশন লাগোয়া বাড়ি তাদের। তাই শেষ ট্রেনে আসলেও ঘরে পৌঁছাতে কোন রকম বেগ পেতে হয় না।
  মা না খেয়েই বসে ছিলেন এবং মা যে এটা করবেন হাজার বারণ সত্বেও তিনি শুনবেন না এটা সুবর্ণা বেশ ভালোভাবেই জানতো। তাই ঘরে ঢুকেই তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে রান্নাঘরে খেতে চলে আসে। মেঝেতে আসন পেতে খাবার গুছিয়ে মুখ গোমড়া করে মা বসে ছিলেন। মা রেগে থাকলে তার মুখ দেখেই সুবর্ণা বুঝে ফেলতো। তাই খেতে খেতে খাবারের খুব প্রশংসা করতে লাগলো যাতে মায়ের রাগটা একটু কমাতে পারে।
--- ছোলা আর নারকেল দিয়ে কচুশাকটা ভীষণ ভালো হয়েছে মা। বাজার থেকে আনলে কচুশাক?
 মা গম্ভীরভাবে উত্তর দিলেন,
-- না, স্কুল মাঠের পিছন দিকটা অনেক কচুগাছ হয়েছে সেদিন বাজার থেকে আসতে গিয়ে দেখলাম। আজ রান্নার কিছু ছিলো না তাই তুই বেরোনোর পর গিয়ে কেটে এনেছি।
-- দারুন হয়েছে খেতে মা
 এইভাবে গল্প করতে করতে মায়ের রাগটা কোথায় যেন উবে যায়।

 পরদিন ছিলো কলেজ বন্ধ। রাতে ঘুমানোর আগে পর্যন্ত সে দেবেশের কথা ভেবে গেছে। আজ যদি ছেলেটি না থাকতো সত্যিই সে আজ খুব বিপদে পড়তো। ওই ভিড়ের মধ্যে বেরোতে গেলে সত্যিই সেদিন খুব কষ্ট হত। অযাচিতভাবে দেবেশ এসে কথাগুলো না বললে সে ওই ভিরেই ধাক্কাধাক্কি করেই বেরোত। অনেক রাতে শিয়ালদহ এসে ট্রেনে উঠতে গেলেও কিছু বিপদ হতেই পারতো। হয়ত ঈশ্বর স্বয়ংই চাননি সে কোন বিপদে পড়ুক। তিনি তো নিজে এসে মানুষের উপকার করতে পারেন না তাই হয়ত দেবেশের মধ্য দিয়েই তার উপকার করেছেন। 
 কিন্তু প্রথম দেখাতেই দেবেশকে এত কাছের কেন মনে হচ্ছে ওর। মনেহয় যেন কত যুগ ধরে ওকে চেনে। রাস্তাঘাটে কত মানুষের সাথেই তো দেখা হয় কথা হয় কই কারো ক্ষেত্রে তো কখনোই এরূপ মনে হয়নি। তবে কি ---?
  এদিকে সেদিন দেবেশের বাড়ি পৌঁছাতে অনেক রাত হয়। সে শিয়ালদহ থেকেই একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি যায়। ডিনারটা সকলে একসাথেই করে। খাবার টেবিলেই তিনজনের যত আলোচনা। এতো রাত করে দেবেশ মাঝে মাঝেই বাড়িতে আসে। তার কারণও অবশ্য আছে। পথেঘাটে কেউ কোন বিপদে পড়লে দেবেশ পাশ কাটিয়ে কোনদিনও আসতে পারে না। আর এটা বাবা, মা ভালোভাবে জানেন বলেই হাত খরচের টাকাটা তার হাতে দু'জনেই একটু বেশি দেন সব সময়। কারণ মানুষের উপকার করতে গেলে খালি পকেটে সে কাজ করা যায় না। তাই দেবেশের রাত করে ফেরার কোন কৈফিয়ত তারা কোনদিনই চাননি। বরং খাবার খেতে খেতে বিদিশা এবং স্বরূপ দু'জনেই বেশ আগ্রহ সহকারে সেই গল্প শোনেন। দেবেশ খাবার টেবিলে আসার সাথে সাথে বিদিশা একটু মজা করে বললেন,
-- পুত্র, আজ কোন রাজকার্য করে আসলে?
 দেবেশও কম যায় না। সেও মায়ের কথার উত্তর তার মায়ের মতোই করে দিল,
-- মাতা, আজ একজন নারীর বিপদে তার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম।
 তারপর তিনজনেই হেসে উঠলো। খেতে খেতে সমস্ত ঘটনা দেবেশ তার মা, বাবাকে বললো। শুধু লুকিয়ে গেলো প্রথম দিনেই মেয়েটিকে তার খুব ভালো লেগে গেছে এই কথাটা। দু'জনেই দেবেশের সাথে খুব ফ্রী। তাই স্বরূপ বললেন,
-- সে তুমি যেভাবে পারো বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াও। কিন্তু মেয়েটিকে দেখতে কেমন? বয়স কত? মানাবে তো তোমার সাথে?
 চোখ বড় বড় করে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
-- এরূপ কিছু ঘটলে তো তোমাদের বলতেই হবে। আজ শুধু তো পাশেই দাঁড়ালাম।
 মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে মা মিটিমিটি হাসছেন। প্রায় প্রতিদিন খাবার টেবিলে এইরূপ হাসি,ঠাট্টার মধ্যেই খাওয়া শেষ হয়। মাঝে মধ্যে বিলাসী এসে ফোড়ন কাটে। কিন্তু আজ সে টেবিলে খাবার গুছিয়ে শুয়ে পড়েছে কারণ তার শরীরটা ভালো নেই।

ক্রমশ -

Monday, March 25, 2024

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (৪র্থ পর্ব)

সুবর্ণা বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকে। এখন সে কী করবে? কিভাবে দেবেশের মুখোমুখি হবে? সবই তো ঠিক চলছিল তবে এতগুলো বছর বাদে আবার কেন ও সামনে আসলো? ঈশ্বর কী চান? জীবনে প্রথম ভালোবাসার ঘটনা মানুষ কোনদিনও ভুলতে পারে না। সময় তার উপর একটা প্রলেপ ফেলে দেয় মাত্র। সুবর্ণার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। দেবেশকে ফিরিয়ে দিতে সেদিন সুবর্ণার বুক ফেটে গেলেও সংসারের প্রতি দায়বদ্ধতা তার মনকে করেছিল পাথর। আপ্রাণ চেষ্টা করে চোখের জল সংবরণ করে মুখে কঠোরতা এনে জানিয়েছিল,
-- বাবা,মায়ের অমতে আমি তোমাকে কোনদিনও মেনে নিতে পারবো না। আর তাছাড়া বিয়ে আমার ঠিক হয়ে গেছে। টুকটুক করে বাবা সবকিছুর আয়োজনও করে ফেলেছেন। তাই তোমাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়।
-- তাহলে এতদিনের মেলামেশা? সবটাই অভিনয়? নাকি শুধুমাত্র সময় কাটানো?
-- তোমার যা ইচ্ছে ধরে নিতে পারো। 
 কথা শেষ করে সুবর্ণা বাড়ির রাস্তা ধরে। দেবেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দৌড়ে সুবর্ণার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
-- তোমার এই আচরণ আমাকে নারী জাতিকে চিনতে খুব সাহায্য করলো। এতকাল শুধু শুনে এসেছি নারী ছলনাময়ী। আজ সত্যিই তার প্রমাণ পেলাম। এজন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। 
 দেবেশ নিজেই সরে দাঁড়ালো সুবর্ণাকে এগিয়ে যাওয়ার পথ করে দিয়ে। এরপর সুবর্ণার সাথে দেবেশের আর দেখা হয়নি। উভয়েই দেখা করার কোনরকম চেষ্টাও করিনি।
 দেবেশ মায়ের কাছে অনেকক্ষণ বসে ছিল মেয়েটির সাথে দেখা করবে বলে। কিন্তু এতক্ষণ বসে থেকেও সে আসছে না দেখে মাকে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। সুবর্ণা দরজার বাইরে একটা থামের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলে। দেবেশ চলে যায়। সুবর্ণা মনেমনে ভাবে ক'ঘন্টা কিংবা ক'টা দিন সে দেবেশের কাছ থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখবে?
 সে ঘরে ঢুকে বিদিশার পাশে গিয়ে বসে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। আর ভাবতে থাকে ভদ্রমহিলার কতই বা আর বয়স হবে। হয়ত মায়ের বয়সী কিংবা মায়ের থেকে দু'চার বছরের বড় হবেন। কিন্তু কোনদিনও মায়ের কাছে বসে মাথায়, গায়ে হাত বুলিয়ে দেওয়ার সময় হয়নি একমাত্র অসুস্থ্য হলে ছাড়া। সব সময় পড়াশুনা আর তার ফাঁকে ফাঁকে মাকে সংসারের কাজে যেটুকু পেরেছে সাহায্য করেছে। হাত বুলাতে বুলাতে হঠাৎ হাতটা থেমে যাওয়ায় বিদিশা নিজের হাত দিয়ে সুবর্ণার হাতটা চেপে ধরে বললেন,
-- কী ভাবছো? মায়ের কথা মনে পড়ছে?
 সুবর্ণা একটু চমকে উঠলো। ভদ্রমহিলা কী করে বুঝলেন? কিন্তু মুখে হাসি এনে বললো,
-- না সেরকম কিছু না। আসলে আগে কখনো বাড়ি ছেড়ে কোথাও থাকিনি তাই ভাবছি --
-- কিচ্ছু ভাবতে হবে না। আমিও তো তোমার মায়ের মত। 
 তারপর হাতের ইশারায় একটি খাট দেখিয়ে বললেন,
-- রাতে তুমি ওই খাটটায় শুয়ে পড়বে। আমি শুয়ে পড়ার পর কেউ আর এঘরে রাতে আসে না। তার আগে এসেই বাবা,ছেলে দেখা করে যায়। 
 সুবর্ণা চুপচাপ বসে আছে কিন্তু মনের মধ্যে তার ঝড় বয়ে চলেছে। এখানে থাকতে গেলে তো দেবেশের সাথে তার দেখা হবেই। তার কাছে মিথ্যে কথা বলা আর শেষ পর্যন্ত এই আয়ার কাজ করতে আসার লজ্জা সে কোথায় লুকাবে? 
 বিদিশা একটু একটু করে সুবর্ণার কাছ থেকে তার পরিবার ও নিজ সম্পর্কে সব জেনে নিলেন।কিন্তু সুবর্ণা বিদিশার কাছে যা লুকিয়ে গেলো তা হল তার এডুকেশনাল কোয়ালিফিকেশন আর দেবেশের সাথে তার পূর্ব সম্পর্ক।
  দেবেশ কলেজে বেরোনোর সময় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মাকে ডেকে বলে যায় যে সে বেরোচ্ছে। ঠিক তার বাবাও স্বরূপবাবু ওই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তার স্ত্রীকে ডেকে বলে যান।
 দুপুরবেলা বিলাসী এসে বিদিশার খাবার দিয়ে যায়। বিলাসী ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় মেয়েটি ঘরের চেহারায় পাল্টে দিয়েছে। বৌদির মুখেও বেশ প্রসন্নতার হাসি। বিলাসী মনেমনে খুব খুশি হয় সুবর্ণার কাজে। সুবর্ণার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,
-- হ্যাগো মেয়ে তোমার নাম কী? কী বলে তোমায় ডাকবো আমি? তুমি আমায় পিসি বোলো। দেবু আমায় পিসি বলেই ডাকে। আমার দেবুর সাথে তোমার দেখা হয়েছে? ও কিন্তু খুব লাজুক ছেলে।
 বিদিশা মৃদু ধমক দিয়ে উঠলো বিলাসীকে। 
-- তুই চুপ কর বিলাসী। এখানে ও আমার দেখভাল করার জন্য এসেছে। তোর দেবুর গল্প শুনতে আসেনি। কথা একবার যদি শুরু করিস তা যে কোথায় থামাতে হয় আজও সেটা বুঝলি না। 
-- হ্যাঁ তুমি তো সারাজীবন আমার কথাই শুনে গেলে। বাপ,ছেলে সকাল হলেই বেরিয়ে পড়েন আর সারাটাদিন আমি মুখ বুজে সংসারের কাজ করে করে আমারও তো পেট ফুলে ওঠে। কথা বলার জন্য মনটা আকুপাকু করে। তুমি তো ঘুমিয়ে আর গল্পের বই পড়েই সময় কাটিয়ে দাও। আমার কথা একবারও ভাবো কেউ?
-- আচ্ছা এখন থেকে ভাববো। তুই এখন যা আমার খিদে পেয়েছে।
 সুবর্ণা বিদিশাকে ধরে খাটের উপর বসিয়ে দিলো। তারপর চামচে করে খাইয়ে দিতে লাগলো। মাছের কাঁটা বাছার সময় বিদিশার মুখের দিকে তাকিয়ে পড়ে বললো,
-- হাত দিয়ে কাঁটা না বাছলে তো কাঁটা থেকে যাবে মা
 বিদিশা সুবর্ণার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে তার মাথায় একটা হাত দিয়ে বললেন,
-- এই যে মা বলে ডাকলি এতেই তো তুই আমার মেয়ে হয়ে গেলি। আজ আমাকে তুই নিজেই মাছ বেছে খাইয়ে দে, কাল থেকে আমি নিজের হাতেই খাবো। ওরে আমি কি হাতে খেতে পারি না? নিশ্চয়ই পারি। কিন্তু কী জানিস? এই যে মেয়েগুলো আসে কেউ একটু ভালোবাসা,দরদ নিয়ে কথা বলতে জানে না। সব যেন প্রফেশনাল। আমার একটুও ভালো লাগে না। তুই কত সহজে মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আমায় আপন করে নিলি। 
 সুবর্ণা বিদিশার এই আবেগঘন কথা শুনে নিজেও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো। চোখের থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে দেখে বিদিশা হাত দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বললেন,
-- কাঁদে না মা। তোকে দেখে প্রথমেই আমার মনে হয়েছে তুই ভালো পরিবারের মেয়ে। অভাবের তাড়নায় আয়ার কাজ করতে এসেছিস। মা বলে যখন দেখেছিস কোন অসুবিধা হবে না এখানে তোর। তোর বাবাকে বলে দেবো অন্যদের যে টাকা মাইনে দিতেন তার থেকে তোকে যেন বেশি টাকা দেন। এবার যা আমার তো খাওয়া হয়ে গেলো নিজে গিয়ে খেয়ে আয়। রান্নাঘরে চলে যা। বিলাসী তোর খাবার দিয়ে দেবে।
 বিশাল বাড়ির বেশ কয়েকটি ঘরের মধ্যে রান্নাঘরটি খুঁজে পেতে সুবর্ণাকে বেশ বেগ পেতে হল। রান্নাঘরে ঢোকার সাথে সাথেই বিলাসী তাকে বলে,
-- এই যে মেয়ে দেখো তোমার খাবার এখানে এই ছোট টেবিলে ঢাকা দেওয়া আছে। খেয়েদেয়ে বাসনগুলো সিনকে রেখে টেবিলটা মুছে ফেলো। এখন আমার একটু গড়াগড়ি দেওয়ার সময়। আমি চললুম। তুমি খেয়ে বৌদির ঘরে চলে যেও।
 বিলাসী বেরিয়ে যাওয়ার পর সুবর্ণা রান্নাঘরের চারিপাশে তাকিয়ে দেখে এত সুন্দর, এত বড় রান্নাঘরে চারিপাশে জিনিসপত্র ছড়ানোছিটানো। খিদেও পেয়েছিল খুব। আগে সে খেয়ে নিয়ে প্রথমে এটো বাসন যত পড়েছিল সেগুলি মেজে ফেলে যত্রতত্র জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখে। বাসন রাখার জায়গায় বাসনগুলিকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে। হলুদ,নুন,তেল লাগানো কৌটোগুলো সার্ফজলে সুন্দর করে ধুয়ে পরিষ্কার করে।
এসব করতে করতে তার অনেকটাই সময় চলে যায়। এরপর যখন সে এসে বিদিশার ঘরে ঢোকে সে দেখতে পায় বিদিশা একটা গল্পের বই পড়তে পড়তে বুকের উপর বইটি রেখে ঘুমিয়ে পড়েছেন। বিদিশা আস্তে করে ঘরে ঢুকে বিদিশার বুকের উপর থেকে বইটি নিয়ে ভাঁজ করে টেবিলে রাখে। চশমাটা চোখ থেকে খুব সন্তর্পনে খুলে ভাঁজ করে বালিশের পাশেই রেখে দেয়। 
  ঘর থেকে আস্তে বেরিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। ফিরে যায় সে তিন বছর আগের অতীতে। চোখের সামনে জ্বলজ্বল করতে থাকে দেবেশের সাথে পরিচয়ের প্রথম দিনের ঘটনা।

ক্রমশ -
    

Thursday, March 21, 2024

অজানা আশঙ্কা ( সহজ পাঠ)

অজানা আশঙ্কা

   বিয়ের ঠিক বছর দশেক আগে দার্জিলিং ট্যুরে আর্যের জীবনে এক সকালে একটি অঘটন ঘটে যায়। যে হোটেলে আর্য তার বন্ধুদের সাথে উঠেছিল সেই হোটেলে রোজ সকালে একটি পাহাড়িয়া মেয়ে এসে সমস্ত রুমে ঢুকে টেবিলে ফুল সাজিয়ে দিয়ে যেত। তিন বন্ধু এক হোটেলে উঠলেও যে যার মত সিঙ্গেল রুম নিয়েই থাকতো। মেয়েটি পাহাড়িয়া হলেও খুব সুন্দর দেখতে ছিলো। বনফুল খোঁপায় গুঁজে যখন সে অন্যান্য রুমের কাজ শেষ করে আর্যের রুমে ঢুকতো আর্য মুগ্ধ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতো। 
   মেয়েটি জানতো না আর্যরা কবে ফিরে যাবে। সপ্তম দিনের মাথায় সকালে ফুল নিয়ে এসে পরপর তিনটে ঘরে তালা দেওয়া দেখে ছুটে রিসেপশনে গিয়ে জানতে পারে গতকাল সন্ধ্যায় তারা কলকাতায় ফিরে গেছে। খুব অবাক হয় তবাসু বাঙ্গালীবাবুর এহেন আচরণে।
  কোনকিছুতেই জীবন থেমে থাকার নয়। জীবন সময়ের সাথে তাল মেলাতে না পারলেও ঠিক তার নিয়ম মেনেই এগিয়ে চলে। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আর্যর জীবন থেকে যেমন তবাসুর নামটা মুছে গেছে ঠিক তেমনই তবাসুর জীবন থেকেও বাঙ্গালীবাবুর কথা হারিয়ে গেছে। শুধু ন'বছরের সন্তান বিক্রমের মুখের দিকে তাকালেই সেদিনের ঘটনাগুলো তার ভীষণভাবে মনে পড়ে যায়। একটু উদাস হয়ে যায়, অজান্তেই চোখের থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সে ক্ষণিকের জন্য। জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে বিক্রমকে মানুষ করার তাগিদে কোমরে ওড়না জড়িয়ে আবার নেমে পড়ে কঠোর পরিশ্রমে।
 আর্য বিয়ে করেছে বছর সাতেক হল। এরমধ্যে সে তিন তিনবার দার্জিলিং ঘুরে গেছে। কিন্তু হোটেল মানবীতে সে ওঠেনি। দার্জিলিং আসলেই এক অজানা আশঙ্কায় তার বুকের ভিতর তোলপাড় করে ওঠে। এই সাত বছরে বহু চিকিৎসা করার পরেও তাদের কোন সন্তান হয় না। তার স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা সন্তান ধারণের পক্ষে সহায়ক নয়।
 চতুর্থবার দার্জিলিং এসে মনের সাথে যুদ্ধ করে সে হোটেল মানবীতেই ওঠে। সারাটা রাত উৎকণ্ঠায় কাটে ভোরের আশায়। খুব ভোরে দরজার বেলের আওয়াজে দরজা খুলে সে তবাসুকে দেখতে পায়। ভূত দেখার মত চমকে ওঠে তবাসূ। কিন্তু কোন কথা না বলে তার কাজ সেরে সে বেরিয়ে যায়। আর্য আস্তে করে দরজা ভেজিয়ে লুকিয়ে ওর পিছন নিয়ে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেখে পুরো তারই ছেলেবেলার মত দেখতে ন'বছরের একটি ছেলে স্কুল ড্রেস পরে উঠোনে বসে। লুকিয়ে দেখতে পায় মায়ের হাত ধরে সে পাহাড়িয়া রাস্তা ধরে হেঁটে স্কুলের পথে।
  ফিরে আসে আর্য হোটেলে। সন্ধ্যায় স্ত্রীকে সাথে না নিয়েই তবাসুর বাড়ি পৌঁছে যায়। অন্ধকারাচ্ছন্ন বাড়িতে মোবাইলের আলোতে আবিস্কার করে দরজায় তালা লাগানো। কিছুটা এগিয়ে একটি বাড়িতে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে বিক্রম স্কুল থেকে ফেরার পরেই এই ভাড়াবাড়ি ছেড়ে জিনিসপত্র নিয়ে হঠাৎ করেই তবাসু এই অঞ্চল ত্যাগ করেছে।

 শেষ