সুবর্ণা হুইল চেয়ার নিয়ে কিছুটা এগোনোর সাথে সাথে দেবেশ দ্রুত হেঁটে গিয়ে সুবর্ণার কাছ থেকে চেয়ারটা নিতে যায়। সুবর্ণা সঙ্গে সঙ্গেই হাতল দু'টি ছেড়ে দেয় কারণ বিদিশা পিছন দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে পড়েন।এই ঘটনা বিদিশার মনে একটু খটকা লাগে। কারণ আজ পর্যন্ত যত আয়া তার জন্য এবাড়ি এসেছে যতদূর তার মনে পড়ছে কারো সাথে দেবেশ কোনদিনও কথা বলেনি। কিন্তু আজ দেবেশ সুবর্ণার কাছে এসে যে বললো "আমাকে দাও" - কথাটা বিদিশার মনে কিছুটা হলেও কৌতূহলের সৃষ্টি করে। তবে এটাও তিনি ভাবেন কোনদিনও কোন মেয়ে রান্নাঘরে খাওয়ার সময় ছাড়া যেমন ঢোকেনি ঠিক তেমনই তাকে কেউ কোনদিনও জোর করে খাওয়ার টেবিলে নিয়ে আসেনি। দেবেশের হয়ত এটা ভালো লেগেছে। তাই সে আজ সুবর্ণার কাছ থেকে হুইল চেয়ারটা নিয়ে নিজে তার ঘরে এসেছে। কিন্তু ঘরে ঢুকে মাকে তুলতে গিয়ে একবারে সম্ভব না হলে সুবর্ণা এগিয়ে এসে বলে,
-- আমি পায়ের দিকটা ধরছি তু --
বলেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
-- আপনি মায়ের বগলের তলা দিয়ে ধরুন।
দেবেশ সুবর্ণার কথামত মাকে সেইভাবে তুলে ধরে। সুবর্ণা পা দু'টো ধরে দেবেশের সাথে খাটে বসিয়ে দেয় বিদিশাকে। দেবেশ সুবর্ণার মুখের দিকে তাকালে বিদিশা সেটাও খেয়াল করেন। দেবেশ বেরিয়ে গেলে সুবর্ণা বিদিশাকে বলে,
-- মা, আমি একটু রান্নাঘরে গিয়ে পিসিকে সাহায্য করি?
-- হ্যাঁ যা। বাপ,ছেলে বেরিয়ে গেলে আমায় এসে স্নান করিয়ে দিস। এতদিন ধরে শুয়ে থেকে নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসটাই চলে গেছিলো। ওরা আমাকে বারবার বলতো হুইল চেয়ারে করে ঘরের ভিতরেই ঘুরতে। কিন্তু স্নান করতে গিয়েই কোমরে ব্যথা শুরু হয় তাই সাহসই পায়নি এতদিন।কিন্তু তুই এসে যেন আমার সাহস বারিয়ে দিয়েছিস মা। ঈশ্বর তোর মঙ্গল করুন। আজ মনটাও খুব ফুরফুরে লাগছে। যা তুই বিলাসীর কাছে। আমাকে পেপারটা দিয়ে যাস।
"হ্যাঁ" বলে সুবর্ণা রান্নাঘরে যেতে গিয়ে পথের মাঝখানে দেবেশকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে না দেখার ভান করে এগিয়ে যেতে গেলে দেবেশ তাকে বলে,
-- থ্যাংকস।মা আজ অনেকদিন পর নিজের ঘর থেকে বেরোলেন। বাবা,আমি দু'জনেই খুব খুশি। বাবা তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
সুবর্ণা দেবেশের দিকে তাকিয়ে বলে,
-- এসব কথা আমার না শুনলেও চলবে। আমার কাজ আছে।
সুবর্ণা চলে গেলে দেবেশ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে মনেমনে বললো ,'একসময় আমি এটাই চেয়েছিলাম। তোমায় নিজের করে বাড়িতে নিয়ে আসবো আর এভাবেই তুমি সকলের মন জয় করবে। সবকিছু যেন কেমন ওলটপালট হয়ে গেলো।"
এইভাবে পাঁচ পাঁচটা দিন কেটে গেলো সুবর্ণার এ বাড়িতে। রবিবার তার বাড়িতে যাওয়ার কথা। রাতেই স্বরূপ তাকে এই সাতদিনের জন্য একটা মোটা অংকের টাকা খামে করে হাতে দিয়ে দিয়ে বললেন,
-- প্রত্যেক সপ্তাহে বাড়ি যাওয়ার সময় তুমি এই টাকাটা পাবে। আমি প্রতি সপ্তাহেই তোমায় তোমার টাকা দিয়ে দেবো। আজ পর্যন্ত যত মেয়ে এসেছে তোমার মাকে দেখাশুনার জন্য তাদের সাথে তোমার কোন তুলনায় হয় না। মাত্র কটাদিনেই তুমি তোমার মায়ের মনের বল অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছো। ডাক্তারী শাস্ত্র অনুযায়ী এই রোগের সবচেয়ে ভালো ওষুধ হচ্ছে মনের বল যা তোমার মা হারিয়ে ফেলেছিলেন। কোথাও তেমন কোন সমস্যা ওর শরীরে নেই। আমি নিজে একজন ডাক্তার হয়ে বলছি তুমিই পারবে আমার স্ত্রীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুলতে।
-- আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।
কথা শেষ করে সুবর্ণা আবার বিদিশার ঘরে ফিরে আসে।
-- কিরে খামটা খুলে দেখেছিস?
-- না, বাড়ি গিয়ে মায়ের হাতে দেবো মা তখন দেখবেন
-- দূর বোকা মেয়ে! দেখে আমায় বলতো কত আছে ওর ভিতর? তোর চলবে কিনা ওই টাকাই?
-- তুমি এসব নিয়ে ভেবো না। যা আছে থাক।
-- আসলে কী জানিস মা ? তোর চালচলন, ব্যবহার আমাকে পরিস্কার বুঝিয়ে দিয়েছে তুই ভালোঘরের লেখাপড়া জানা একটি মেয়ে। নিজের সংসারকে বাঁচাতে চাকরি না পেয়ে তুই এই কাজে এসেছিস। এটা সত্যি তুই চলে গেলে আমার খুব কষ্ট হবে কিন্তু তবুও তোকে বলছি কাগজপত্রগুলো নিয়ে আছিস দেখি বাপ,ছেলেকে বলে তোর ভালো কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারি কিনা।
-- আমার তো একাজ করতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না। তোমার যদি আমাকে পছন্দ নাহয় তাহলে অন্য কথা।
-- ও তুই বুঝে গেছিস তোকে আমি কতটা ভালোবেসে ফেলেছি। তাই আমার সাথে ইয়ার্কি হচ্ছে?
সুবর্ণা হাসতে হাসতে বলে,
-- চলো, অনেক রাত হল এবার খেতে যাই
-- আজও আমায় টেবিলে খেতে যেতে হবে?
-- তাতো যেতেই হবে। কারণ তুমি পারো। আজ আমি একাই তোমায় চেয়ারে বসাবো
-- আরে না, তুই ওদের কাউকে ডাক
ওদের কথার মাঝখানে বিলাসী খাবার নিয়ে আসে। দেখতে পেয়ে সুবর্ণা বলে,
-- পিসি, মা টেবিলেই খাবেন সকলের সাথে কথা বলতে বলতে। তুমি খাবারটা টেবিলে রেখে এসে আমায় একটু হেল্প করো মাকে চেয়ারে বসাতে।
বিলাসী খাবার নিয়ে চলে যেতেই সেখানে এসে হাজির হল দেবেশ।
সুবর্ণা আর দেবেশ দু'জনে মিলে বিদিশাকে চেয়ারে বসিয়ে দেবেশ নিজেই চেয়ার নিয়ে ডাইনিং রুমের দিকে এগিয়ে যায়। এরমধ্যে বেশ কয়েকবার দু'জনের চোখাচোখি হয়। কিন্তু কেউই কোন কথা বলে না। দু'জনের বুকেই কাঁপুনি কিন্তু কারো কাছেই কারো প্রকাশ তার নেই।
আজ যেন বিদিশা আরও বেশি সতর্ক এই দু'টি তরুণ,তরুণীর আচারাচরণের দিকে। সুবর্ণা আসার পর থেকেই দেবেশকে যেন মায়ের ঘরে একটু বেশিবার এবং একটু বেশি সময় বিদিশা পাচ্ছেন। তাই তিনি সব সময় নিজের চোখ, কানকে বেশি সতর্ক রেখেছেন। কিন্তু এরা পরস্পরের সম্পর্কে নিজেরা যেন নিজেদের মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে। সুবর্ণাকে বিদিশার বেশ ভালো লেগেছে। আর ছেলের সুবর্ণার সামনে বেশি আনাগোনার ফলে বিদিশার মনেও একটা আশার আলো জ্বলতে শুরু করেছে। এবার হয়ত তার দেবু বিয়ের ব্যাপারে নিজের মত পাল্টাবে।
খাবার টেবিলে সুবর্ণা খাবার সার্ভ করছিল। স্বরূপ এবং বিদিশার পাতে বেগুন ভাজা দিলেও দেবেশের থালায় সেটা ছিল না। কারণ দেবেশের বেগুন ভাজায় এলার্জি আছে। বিদিশা সেটাও খেয়াল করেন। কিন্তু কোন অবস্থাতেই এই কয়দিনে সুবর্ণার সেটা জানার কথা নয় কারণ সে আসার পর আজই প্রথম বেগুন ভাজা হয়েছে। এই টুকরো টুকরো ঘটনাগুলি বিদিশাকে ভাবাচ্ছে এরা দু'জন আগে থাকতেই দু'জনকে চেনে। কিন্তু যতক্ষণ না পর্যন্ত সিওর হচ্ছেন ততক্ষন পর্যন্ত কিছু বলতেও পারছেন না। তবে এই ঘটনাগুলো তিনি খুবই উপভোগ করছেন।
রুটি,তরকারি খেতে গিয়ে দেবেশের ভিসুম লাগে। সুবর্ণা তড়িঘড়ি জলের গ্লাস এগিয়ে দেয় তার দিকে। জল খেয়ে ধাতস্ত হয়ে দেবেশ সুবর্ণার দিকে তাকিয়ে বলে, "থ্যাংকস"। সেটাও বিদিশার নজর এড়ায় না। তিনি সুবর্ণার দিকে তাকিয়ে বলেন,
-- তুইও বসে পড় আমাদের সাথে।
বিদিশার কথা শুনে বাপ,ছেলে অবাক হয়ে তার দিকে তাকান। কারণ আজ পর্যন্ত যারা তার দেখভালের জন্য এ বাড়িতে এসেছে তাদের কেউই কোনদিনও টেবিলে তাদের সাথে বসে খাওয়ার অনুমতি পায়নি। এমনকি বিলাসীর জন্যও রান্নাঘরে টেবিল বরাদ্দ। বিদিশার কথা শুনে সুবর্ণা বলে,
-- তোমরা খেয়ে নাও আমি পিসির সাথে রান্নাঘরে বসে খাবো।
-- কেন আমাদের সাথে খেতে তোর আপত্তি কোথায়?
আপত্তিটা যে কোনখানে তা সুবর্ণা কী করে বলবে বিদিশাকে? এরই মধ্যে কতবার যে দেবেশ তার দিকে তাকিয়েছে আর তার এই তাকানোর ফলে সুবর্ণার বুকের ভিতর যে বিদ্যুত খেলে গেছে তার আচ সে ছাড়া আর কেউই জানে না।
খাওয়া শেষে দেবেশ মাকে নিয়ে গিয়ে খাটের উপর বসিয়ে দিয়ে আসে। কিন্তু কোন এক ফাঁকে সে সুবর্ণার হাতের মধ্যে একটা কাগজের টুকরো গুঁজে দেয়।
ক্রমশ