Monday, April 15, 2024

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (১১তম পর্ব)

একদিকে সংসারের চিন্তা অপরদিকে প্রথম ভালোলাগার কিংবা ভালোবাসার আবেশ সুলতাকে মাঝে মাঝেই উদাস করে দেয়। নিজের ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিতে গেলে সংসার পড়বে মুখ থুবড়ে। ভাই বোন দু'টো মানুষ হবে না। তাই সে নিজের মনের কথা কোনদিনও মুখ ফুটে রজতকে জানায়নি। সেই ছেলেবেলা থেকেই রজতের সাথে সুলতার বন্ধুত্ব। দিনে দিনে তারা বড় হয়েছে তাদের ধ্যান,ধারণা পাল্টেছে - দু'জনেই উপলব্ধি করেছে তারা একে অপরকে ভালোবাসে। সুলতা আগে বলুক এটা রজত চাইলেও সুলতা একথা কোনদিনও রজতকে বলতে পারবে না এটাও সে ভালোভাবেই জানতো। সুলতার নিজের সংসার মানে চার চারটে প্রাণীর না খেয়ে ধুকে ধুকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া। 
 ছোট এই কোম্পানিতে কাজটা পাওয়ার পর থেকেই ট্রেনে করে বাড়িতে ফিরতে তার বেশ রাতই হয়ে যায়। স্টেশন থেকে দশ থেকে পনের মিনিট হাঁটা রাস্তা। রিক্সা কিংবা অটো দুইই আছে কিন্তু নিত্য সে ভাড়া দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। তাই রোজই ট্রেন থেকে নেমে সে হেঁটেই বাড়ি পৌঁছায়। তবে একা নয়। রাস্তার মোড়েই রোজ সে পেয়ে যায় রজতকে। রজতের বাইক আছে ঠিকই কিন্তু সুলতা বাইকে করে যেতে অস্বীকার করায় দু'জনে গল্প করতে করতে এই পথটুকু পারি দেয়।
-- রোজ রোজ কেন এই পরিশ্রম করো আমার জন্য?
-- পরিশ্রম কোথায়? আমিও অফিস থেকে ফিরি কিছুক্ষণের মধ্যে তুমিও ফেরো ।তাই অপেক্ষা করি একসাথে ফিরবো বলে।
-- লোকে তো ভালো চোখে এটা নিচ্ছে না। পাড়ায় এটা নিয়ে আলোচনা হয় না ?
-- যাদের আলোচনা করার সময় আছে তারা আলোচনা করুক। পাড়ার লোক তো সেই ছেলেবেলা থেকে আমাদের দেখছে। ওরা যদি এর ভিতর অন্যকিছু দেখতে পায় তাহলে মন্দ কী? কিন্তু আমার কষ্ট অন্যখানে --
-- তোমার আবার কিসের কষ্ট?
 রজত একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলে,
-- পাড়ার লোক যেটা বুঝতে পারছে তুমি সেটা আজও বুঝলে না -
 রজত কী বলতে চাইলো সুলতা সঙ্গে সঙ্গেই সেটা ধরে ফেলে। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
-- বুঝলাম কী বুঝলাম না সেটা পরের কথা কিন্তু সব মানুষের জীবনে সবকিছু পাওয়া বিধাতা লেখেননি। তাই বুঝেও যেমন না বোঝার ভান করে থাকতে হয় ঠিক তেমনই হাতের মুঠোয় আসা জিনিস অনেক সময় পরিস্থিতির চাপে হাত ফসকে বেরিয়েও যায়। তাই মুঠো শক্ত করতে ভয় হয়।
-- কিন্তু বিশ্বাস করো আমি তোমায় --
 কথা শেষ হওয়ার আগেই সুলতা বলে,
-- বলো না রজত। তুমি তো সংসারের একটিমাত্র ছেলে। মেসোমশাই এখনো চাকরি করছেন। তুমিও মোটামুটি ভালো টাকাই রোজগার করো। গরীবের ঘরে সংসারে বড় হয়ে জন্মানো মানে নিজের সুখ,শান্তি বিসর্জন দেওয়া। আমি শুধু নিজের কথা চিন্তা করলে পরিবারের বাকি মানুষগুলির করুন চাহুনি আমার সুখের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। ভাইবোনগুলো না দাঁড়ানো পর্যন্ত আমি নিজের কথা ভাবতে পারবো না। 
-- বিয়ের পরেও তো তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করতে পারো।
-- হয় না রজত হয় না তা - । ভালোবাসা ভাগ হয়ে যায় অনেক দায়িত্বকর্তব্য এসে পড়ে সামনে। তাকেও অবহেলা করা যায় না। কিছু কিছু মানুষ পৃথিবীতে অভিশপ্ত হয়েই জন্মগ্রহণ করে। তারা নিজের দিকে তাকানোর সুযোগ পায় না। সংসার তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। তখন নিজের দিকে তাকানো যায় না। সামনের দিকে পরিবারের অন্য মুখগুলিই দেখতে হয়। হ্যাঁ এরও ব্যতিক্রম হয়। কিন্তু সেখানে স্বার্থপর, মনুষ্যত্বহীন হতে হয়। আমি তা পারবো না।
 কথা বলতে বলতে ওরা বাড়ির কাছেই চলে আসে। সুলতা গেট দিয়ে ঢুকল রজত তার নিজ বাড়ির দিকে রওনা দেয়।
 বাড়িতে ঢুকে দেখে ছোট ভাইবোন দু'টো তখনও বসে আছে না খেয়ে দিদির জন্য। এটা ওদের নিত্য অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। বললেও ওরা শোনে না। বাবা আগেই খেয়ে নেন। যথারীতি মা-ও না খেয়েই থাকেন। আজ কোম্পানির ম্যানেজারের ছেলের জন্মদিনে সকল কর্মীদের একটা করে প্যাকেট দিয়েছে। যেহেতু ম্যানেজার জানেন সুবর্ণা না খেয়ে প্যাকেট বাড়িতে নিয়ে যাবে তার ছোট দু'টি  ভাইবোনের জন্য তাই তিনি তাকে দুটো প্যাকেট দিয়েছেন। সে ঘরে ঢুকেই প্যাকেট দু'টো ব্যাগ থেকে বের করে তাদের দিকে এগিয়ে দিলো। তারা দু'জনেই প্যাকেট নিয়েই খেতে বসে গেলো। মা দেখতে পেয়েই বললেন,
-- আগে রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে এসব খাবার খাবি সব। দিদি না খেয়ে তোদের জন্য নিয়ে এসেছে দিদিকে একটু দু'জনে  মিলে দিস।
-- না না আমার লাগবে না। ওরা খেলেই আমার ভালো লাগবে।
-- হ্যাঁ সেতো আমি জানি। নিজের দিকে আর তাকালি কবে? ভাইবোন, বাবা,মা করেই তো জীবন শেষ করে দিলি।
-- মা, আমি ওদের দিদি। আমার একটা দায়িত্ব রয়েছে ওদের প্রতি।
-- দায়িত্ব তো আমাদেরও রয়েছে তোর প্রতি। কিন্তু পালন করতে পারছি কোথায়? এখন তোর বিয়ে দেওয়ার বয়স হয়েছে। আর আমরা কী করছি? তোর পরিশ্রমের টাকা নিয়ে খেয়েদেয়ে তোর ভবিষ্যতটা নষ্ট করছি।
-- মা, এসব কথা আর শুনতে ভালো লাগে না। তোমাদের যদি অন্য কোন উপায় থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই তোমরা এটা করতে না। বাবার বয়স হয়েছে। বাবা কোনদিনও স্থায়ী কোন কাজ যেহেতু করতে পারেননি কিংবা পাননি তাই জমানো অর্থও তো কিছু নেই। এসব ভেবে কী লাভ বলো তো?
-- রজত ছেলেটা সেই ছেলেবেলা থেকে তোকে খুব ভালবাসে তা আমরা কেন আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীরাও সবাই জানে। কত ভালো একটা চাকরি পেয়েছে। কিন্তু আমরা সবকিছু জেনেবুঝে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছি। অনেক সময় পরিস্থিতির চাপে পড়ে বাবা,মা-ও স্বার্থপর হয়ে যায় রে! এই আমরা যেমন হয়েছি।
 কথা বলছেন আর আঁচলে নিজের চোখ মুছছেন। 
-- চুপ করো মা। এটা স্বার্থপরতা নয়। সংসারের প্রয়োজনে সংসারের লোকেরা এরকম করেই থাকে। আমি তোমাদের বড় সন্তান। সেই হিসাবে আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি। এইভাবে কখনো ভাববে না আর কোনদিনও এসব কথা বলবে না। বিয়েটাই জীবনের শেষ কথা নয়। সন্তান হয়ে যদি বাবা,মায়ের প্রতি দায়িত্ব,কর্তব্য পালন না করলাম তাহলে কিসের সন্তান আমি তোমাদের? আমি অত স্বার্থপর হয়ে নিজের জীবন গুছিয়ে নিতে পারবো না। আমি রজতকে বলে দেবো সে যাতে অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করে সুখী হয়। খামোখা আমার জন্য যেন বসে না থাকে। কারণ আমি কোনদিনও তোমাদের অবহেলা করে,কষ্ট দিয়ে নিজে সুখী হতে পারবো না।
 সুলতা কথাকটি বলে নিজেকে সামলাতে দ্রুত সেখান থেকে চলে যায় তার ছোট্ট ঘরটিতে। বোন আর সে ওই ছোট্ট খাটটাতে শোয়। বোন খেয়ে এসে আগেই শুয়ে পড়েছে। ভাই আরও ছোট সে এখনো বাবা,মায়ের কাছেই শোয়। বাড়িতে মাত্র এই দু'টি ঘর। আর বারান্দা ঘিরে নিয়ে রান্নাবান্না। এই কয়েক মাস হল টাকা জমিয়ে মাকে একটা গ্যাস এনে দিয়েছে। মায়ের খুব কষ্ট হয় স্টোভ আর কয়লায় রান্না করতে। সময়টাও লাগে অনেক বেশি। টিনের চাল ছিদ্র হয়ে বর্ষাকালে জল পড়ে। ম্যানেজারকে বলেছে মালিকের সাথে কথা বলে একটু লোনের ব্যবস্থা করে দিতে। তাহলে বাড়িটাই  মিস্ত্রি লাগাতো। কিন্তু মাইনে খুব একটা বেশি নয়। লোন নিলে প্রতিমাসে টাকা কাটবে। সেই হিসাবে সংসারে টাকার টান পড়বে। কিন্তু কোন উপায়ও নেই। নানান চিন্তায় নিজেই জর্জরিত। কিন্তু মুখ ফুটে বাবা,মাকে কিছু জানাতেও পারে না। সব থেকে কষ্ট হয় রজতের কথা ভেবে। কিভাবে রজতকে ও ফিরিয়ে দেবে? অথচ ফিরিয়ে তাকে দিতেই হবে। নিজের জন্য রজতের জীবনটা সে নষ্ট করতে পারে না। রজতের মুখটা মনে পারলেই চোখদু'টি জল ভরে যায়। রজতকে তো সেও খুব ভালবাসে। কিন্তু ---

ক্রমশ 

No comments:

Post a Comment