ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (১৯ তম পর্ব)
সেদিন বাড়ি ফিরতে সুলতা আর তার মায়ের অনেকটাই দেরি হয়ে গেলো। পরদিন অফিস যেতেই হবে। অফিস থেকে ফিরে আবার রজতকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে যে রজতের সাথে দেখা করে যাবে সেটাও সম্ভব নয়। হয়ত সে অত সকালে উঠবেই না। অফিস তো তাকে যেতেই হবে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যেন সুলতার চোখদু'টো ঘুমে জড়িয়ে এলো। ঘুম ভাঙলো সকালে মায়ের ডাকে। মা যে ইচ্ছাকৃতই একটু দেরি করে তাকে ঘুম থেকে ডেকেছেন যাতে তার ঘুমটা পুষিয়ে যায় এটা সুলতা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে বেরিয়ে পড়ে। ৮-২০ লোকালটা না পেলে অফিসে দেরি হয়ে যায়। তাই যেভাবেই হোক সময় মত স্টেশনে পৌঁছাতেই হবে।
অনেকদিন পর আজ হঠাৎ করেই তার সুবর্ণার সাথে দেখা হয়ে যায়। সুলতা তার সাময়িক সমস্যার কথা মন খুলে সুবর্ণাকে বললেও সুবর্ণা কিন্তু তার সম্পর্কে কোন কথাই জানায় না। চুপচাপ সুলতার কথা শুনে যায়। পাশের সহযাত্রীর চার,পাঁচ বছরের বাচ্চার দুষ্টুমির দিকেই তার নজর বেশি। সুবর্ণা নিজের সমস্যায় এতই জর্জরিত অন্য কারো সমস্যা শুনলে কিংবা দেখলেও কিছুটা আনমনা হয়েই পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। কারণ তার মাথায় কোনকিছুই ঢুকছে না। একদিকে দেবেশের ভালোবাসার পাগলামি অন্যদিকে তার নিজের পরিবারের দু'মুঠো অন্নের সংস্থান তাকে উদ্ভ্রান্ত করে দিচ্ছে। দেবেশকে কিছুতেই সে পাশ কাটাতে পারছে না। অথচ ওই কাজটা ছেড়েও চলে আসতে পারছে না। ইচ্ছাকৃত যে তাকে মাইনেটা বেশি দেওয়া হচ্ছে তা সে বেশ ভালই বুঝতে পারছে। আজ সে তার সমস্ত সার্টিফিকেটগুলো নিয়েই যাচ্ছে কারণ দেবেশ তাকে মাথার দিব্যি দিয়েছে। বিদিশা অনেকটাই মনের জোর পেয়েছেন সুবর্ণার কারণেই। যদি কোন চাকরির জোগাড় দেবেশ করতেও পারে তখন ওখান থেকে চলে আসলেও তার অসুবিধা হবে। এইসব হিজিবিজি চিন্তায় মনটা সব সময়ই অন্যমনস্ক থাকে। তাই সুলতার সবকথা তার কান অবধি পৌঁছায়ও না।
আসলে নিম্নবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় সন্তান হয়ে জন্মানোটাই অনেক সময় কারো কারো জীবনে অভিশাপ হয়ে যায়। একমাত্র স্বার্থপর হলেই তারা জীবনটাকে গুছিয়ে নিতে পারে। আর যারা সেটা পারে না তাদের সারাজীবন বাপেরবাড়ির জোয়াল টানতেই জীবন শেষ হয়ে যায়। সুলতা আর সুবর্ণার পারিবারিক সমস্যা এক। দু'জনেই নানান জটিলতার মধ্য দিয়ে একইভাবে এগিয়ে চলেছে।
শিয়ালদহ এসে যে যার গন্তব্যে এগিয়ে যায়। দু'জনকেই বাস রাস্তায় এসে বাস ধরতে হয় কিন্তু নম্বর আলাদা।
সুলতা অফিসে পৌঁছে ম্যানেজারের ঘরে ঢোকে সই করতে। সেখানে গিয়ে দেখে পুরনো এক বয়স্ক কর্মচারী বসে আছেন। সুলতা তাকে আগে থাকতেই চিনতো। সুলতাকে দেখে তিনি জানতে চাইলেন,
-- কেমন আছো মা? চিনতে পারছো তো আমাকে?
-- হ্যাঁ হ্যাঁ মেসোমশাই চিনতে পারছি। ওই চলে যাচ্ছে আর কী? তা কী মনে করে এতদিন পরে?
-- মা,আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। ম্যানেজারের সঙ্গে চাকরি জীবনের আগে থেকেই পরিচিতি। তাই আসলাম উনাকে গরীবের বাড়িতে পদধূলি দেওয়ার নিমন্ত্রণ জানাতে। তা তোমার সাথে যখন দেখা হয়ে গেলো মা তুমিও যেও। দাঁড়াও আমি তোমাকে একটা কার্ড দিই।
-- না না মেসোমশাই। কার্ড দিতে হবে না। আমি যদি যেতে পারি ম্যানেজারবাবুর সাথেই যাবো। আসলে কি জানেন? নানান সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
কথাটা কানে যেতেই ম্যানেজারবাবু বললেন,
-- ভুলে যাই বয়সের ভারে সব। তা কোন খবর পেলে তোমার সেই পরিচিতের?
-- হ্যাঁ গতকাল নিজেই বাড়ি ফিরেছেন। তবে কথা বলার মত অবস্থায় নেই। থরথর করে কাঁপছে। মনেহচ্ছে এ দু'টোদিন ঘুম খাওয়া কোনটাই হয়নি। অনেক রাত পর্যন্ত ওখানেই ছিলাম। কিন্তু কোন কথা এখনো জানতে পারিনি। তবে মনেহচ্ছে এমন কিছু ওর সাথে ঘটেছে যার জেরে ও খুব ভয়ে আছে। বাড়িতে পৌঁছে ভাবছি নিয়ে একটু ডাক্তারের কাছে যাবো।
-- সেই ভালো হবে।
দু'জনকে বলে সুলতা ম্যানেজারের রুম থেকে বেরিয়ে যায়। সারাদিন অফিসে হাড়ভাঙা খাটুনি করতে করতে এক মুহূর্তের জন্যও সে রজতের কথা মাথা থেকে নামাতে পারেনি। কারা এবং কেন ওকে কিডন্যাপ করেছিলো এটা কিছুতেই মাথায় আসছে না তার। মুক্তিপণের জন্য কোন ফোন আসেনি। তারমানে তারা এটাও জানতো টাকা চাইলে দেওয়ার মত ক্ষমতা তাদের নেই। যেহেতু পে-ডেট ছিল তাই মাইনের টাকা এবং মোবাইল নিয়ে তো ওকে ছেড়ে দিতেই পারত। তা না করে ওকে তুলে নিয়ে গেলো কেন? কী এমন রহস্য এর ভিতর লুকিয়ে আছে?
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment