ভালোবাসি বলেছি অনেকবার ( ষষ্ঠ পর্ব)
সেদিন কলেজে যাওয়ার সময় নিজের অজান্তেই সুবর্ণা একটু বেশিই যেন নিজেকে গুছিয়ে নিলো। পাঁচফুট চার ইঞ্চির টানা টানা চোখের অধিকারিণী কোমর ছাপিয়ে একমাথা কালো চুলের একটা মোটা বেনুনী করে সুন্দর একটি তাঁতের শাড়িতে নিজেকে সাজিয়ে কলেজে এলো। দেবেশও যেন এই অপেক্ষাতেই ছিলো। সেও নীল রঙের একটা গেঞ্জি পরে শ্যাম্পু করা চুল যা হাওয়ার দাপটে বারবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, সুবর্ণাকে দেখতে পেয়েই একগাল হাসি দিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালো। দু'জনেই দু'জনের এই সাক্ষাতের অপেক্ষাতেই ছিলো কিন্তু সামনাসামনি হয়ে যাওয়ায় দু'জনেই কেমন জড়োসড়ো হয়ে কোন কথাই কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। তাদের জড়তা কাটালো একদল মেয়ে এসে
-- সুবর্ণা তোকে আজ দারুন লাগছে। তুই তো এত সেজে কোনদিন কলেজে আসিস না। কী ব্যাপার বলতো?
সুবর্ণার বন্ধুরা আসাতে দেবেশ একটু সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। কিন্তু মেয়েগুলোর কথা তার কানে সবই আসছিল। বন্ধুদের কথাই সুবর্ণা স্বভাবতই একটু লজ্জা পেয়ে যায়। সে প্রসঙ্গ পাল্টাতে তাদের বলে,
-- চল ক্লাসে যাই। এক্ষুনি ঘণ্টা পড়ে যাবে।
যাওয়ার সময় দেবেশের দিকে তাকিয়ে একটু দুষ্টু হাসি দিয়ে যায়।দেবেশও কিছুক্ষণ সেখানে অপেক্ষা করে ঘণ্টা পড়ার আওয়াজ পেয়ে নিজের ক্লাসে চলে যায়।
একসময় ক্লাস শেষ হয়। পরের ক্লাস দুটোই অফ থাকায় দেবেশ কলেজ ক্যাপাশে বিশাল মাঠে খুব বড় একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে আনমনাভাবে বসে আছে। হয়ত মনেমনে তখন সুবর্ণার কথাই ভাবছে। ঠিক ওই সময়েই সুবর্ণারও একটা ক্লাস অফ থাকায় সেও বেরিয়ে দেবেশকেই খুঁজছিল। এদিকওদিক তাকিয়েও দেবেশের কোন দেখা না পেয়ে মন খারাপ করে ক্যাম্পাসের একদম শেষ দিকে হাঁটতে হাঁটতে এসে দেখে দেবেশ গাছের তলায় একাকী বসে।
-- তুমি এইখানে? আমি তোমাকে সেই থেকে খুঁজছি। আসলে আজ সকলেরই এই সময়ের ক্লাসটা অফ আছে। স্যারদের মিটিং চলছে।
-- আমার পরপর দু'টো ক্লাস অফ। কিন্তু আমায় খুঁজছিলে কেন?
দেবেশের প্রশ্নে সুবর্ণা লজ্জা পেয়ে গেলো। সুবর্ণা ইতস্তত করছে দেখে বললো,
-- তোমাকে আমার একটা কথা বলার ছিল --
সুবর্ণা নিচুতে বসার উদ্যোগ করতে করতে বললো,
-- বলো কী বলতে চাইছো?
-- আচ্ছা তার আগে একটা প্রশ্ন করি উত্তর দেবে তো?
সুবর্ণা ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালো।
-- মাত্র দু'দিন হল তোমার সাথে আমার পরিচয়। আমার মত কি তোমারও মনে হচ্ছে আমরা একে অপরকে অনেক দিন ধরেই চিনি।
সুবর্ণা হেসে দিলো দেখে দেবেশ পুনরায় বলে,
-- হাসলে হবে না,উত্তর দিতে হবে। তবেই না আমার কথাটা তোমায় নির্ভয়ে বলতে পারবো।
-- তাই যদি না হত আজ কলেজে ঢুকেই তোমায় খুঁজব কেন?
-- এসেই আমায় খুঁজছিলে? কিছু বলার জন্য? কী বলার জন্য খুঁজছিলে বলো তো?
-- আগে তোমারটা শুনি তারপর আমারটা বলবো।
দেবেশ কিছুটা সময় চুপ করে থেকে বললো,
--- আমি জানি না কথাটা তুমি কিভাবে নেবে। যদি তোমার মনোমত নাও হয় প্লিজ খারাপ ভেবো না আমায়। আসলে কথাটা না বলা পর্যন্ত আমিও শান্তি পাচ্ছি না।
সুবর্ণা তখন ঘামছে। সমস্ত শরীর তার কাঁপছে। সে বুঝতে পারছে দেবেশ তাকে কী বলতে চায়। সেও তো সেই একই কথা দেবেশকে জানাতে চায়।
দেবেশ সরাসরি সুবর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে বসলো,
-- মানুষ কথায় বলে প্রথম দেখাতেই প্রেম। আজ নিজের জীবনেই সেই কথা চরম সত্যি হয়ে দেখা দিয়েছে। আমি তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি সুবর্ণা। তোমার কোন আপত্তি থাকলে আমাকে এখনই জানিয়ে দাও।
সুবর্ণা হেসে দিয়ে বললো,
-- এই কথাটা তুমি আমায় না জানালে আমিই তোমায় জানাতাম।
-- সারাজীবন আমার হয়ে থাকবে তো?
--- কথা দিলাম।
সুবর্ণার সম্বিত ফিরলো বিদিশার ডাকে। সে দৌড়ে ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে খাটের কাছে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলো,
--- কিছু লাগবে মা?
-- না না কিছু লাগবে না। সন্ধ্যা হয়ে গেছে তোকে দেখতে পারছি না তাই ডাকছিলাম।
- আমি তোমার চুলটা একটু বেঁধে দিই। কাপড়টা কি পাল্টাবে মা?
-- আগে একটু মুখটা ধোয়ার ব্যবস্থা কর তারপর আমাকে উঠিয়ে দে।
-- মা, কয়েকদিন আমি তোমার সব কাজ করে দেবো। কিন্তু আস্তে আস্তে তোমার নিজের কাজগুলো তোমাকেই করতে হবে। কেন জানো? এগুলো হচ্ছে শরীরের ব্যায়াম। তোমাকে তো উঠে দাঁড়াতে হবে। তুমি যদি হাত,পা সব নিজের থেকেই শুয়ে বসে একটু নাড়াচাড়া করো তাহলে দেখবে একটু একটু করে তুমি সুস্থ হয়ে গেছো।
-- এই জন্যই প্রথম দেখাতেই তোকে আমার ভালো লেগেছে। আজ এসেই তুই আমাকে আপন মনে করে সুস্থ হওয়ার জন্য কতকিছু বলছিস।
সুবর্ণা চুল বাঁধতে বাঁধতেই কথা বলে যাচ্ছিল। বিদিশা শুরু করলেন ওর অসুস্থ্য হওয়ার গল্প।
-- এই বছর দু'য়েক হল আমি বিছানায় পড়ে আছি। আগে সংসারের সব কাজ নিজের হাতে করেছি। হ্যাঁ বিলাসী সেই প্রথম থেকেই আছে ঠিকই। সব কাজে ওই আমাকে সাহায্য করেছে। কিন্তু রান্না কখনো আমি বিলাসীর হাতে ছাড়িনি। আমার ছেলে আর তোর বাবা আমার হাতের রান্না ছাড়া আর কারও হাতের রান্না কোনদিনও পছন্দ করতো না।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে পূনরায় শুরু করলেন,
আজ দু'বছর হল আমি রান্নাঘরে ঢুকি না। ওরা এখন বাধ্য হয়েছে বিলাসীর হাতের রান্না খেতে। তবে জানিস বিলাসী কিন্তু খুব ভালো মানুষ। ও বাপ,ছেলের খুব যত্ন করে।প্রথম প্রথম আমার কাছে শুনে নিয়ে রান্না করতো। এখন তো বেশ ভালই রান্না শিখে গেছে। দুপুরে খেলি তো ভালো লাগেনি?
সুবর্ণা মাথা কাত করে সম্মতি জানালো। বিদিশা যেন প্রথম দিনেই সব গল্প সুবর্ণাকে জানাতে চান। দেবু তখন সবে সবে চাকরি পেয়েছে। ও একটা কলেজে পড়ায়। দিন তিনেকের জন্য আমি আর তোর বাবা দীঘা গেছিলাম বেড়াতে। সমুদ্রে স্নান করে হোটেলে ফিরে এসেছি। জামাকাপড় পাল্টে নিচুতে খেতে যাবো বলে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে সিঁড়ির উপর জল থাকার কারণে পা পিছলে পড়ে যাই। কিন্তু তখন ব্যথা পেলেও খুব একটা কষ্ট হচ্ছিল না। তাই তোর বাবাকে ব্যথার কথা কিছু জানাই না। পেইনকিলার খেয়ে খেয়ে দু'দিন চলার পর প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কষ্ট পেতে থাকি। তারপর বেশ কয়েক ঘন্টা গাড়ি করে কলকাতা আসার ধকল নিতে পারি না। এসেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর নানান পরীক্ষা,নিরীক্ষা করার পর কোনকিছু না পেয়ে ওরা ছেড়ে দেয়। কিন্তু বাড়িতে আসার পর একটু হাঁটাহাঁটি করলেই কোমর ব্যথা হতে শুরু করে। হাঁফিয়ে যাই, প্রচণ্ড কষ্ট পেতে থাকি। হাসপাতালে থাকা আমার আবার প্রচণ্ড একটা আতঙ্ক। তাই রোগের কথা বাপ, ছেলেকে কিছুই জানাই না। কিন্তু আস্তে আস্তে পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকায় ওদের চোখে ধরা পড়ে যাই। আর সেই থেকেই হাসপাতাল আর বাড়ি। তোর বাবা ডাক্তার হওয়ার কারণে কলকাতা শহরের অনেক বড় বড় ডাক্তার দেখিয়েছে ওরা। ফিজিও থেরাপিস্ট এসে ছ'মাস চেষ্টা চালিয়ে গেছে। কিন্তু কিছুই হয়নি।এমনিতে আমি খুবই ভালো আছি। অন্যকোন অসুখ আমার নেই। কিন্তু আমি দাঁড়াতে পারি না; হাঁটাচলা তো মোটেই নয়। ওরা বারবার আমাকে বলেছে ভেলোর কিংবা চেন্নাই যাওয়ার কথা। কিন্তু কী করে যাই বলতো? একজনকে তো আমার সাথেই যেতে হবে। আর একজন তো একা হয়ে যাবে। বিলাসী তো সাথেই নিতে হবে।কতদিন থাকতে হবে তার কোন হিসাব নেই।
--- এইসব বললে কি হয় মা? সুস্থ হতে হবে তো? এবার আমি যাবো তোমাদের সাথে। ঠিক সুস্থ করে নিয়ে ফিরবো। এতদিন কেন যে এভাবে জীদ করে বসে আছো কে জানে?
বিদিশা ঠোঁটের কোণে একটু হাসি এনে বললেন,
--- একদিন এখনো হয়নি। এরই মধ্যে কেমন মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছিস আমাকে।
ওদের কথার মাঝখানেই ভেজানো দরজার বাইরে আওয়াজ শুনে আর সঙ্গে সঙ্গে " মা ভিতরে আসছি" বলেই দেবেশের প্রবেশ। দেবেশ ঘরে ঢুকেই সুবর্ণাকে দেখে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে আর সঙ্গে সঙ্গে সুবর্ণা উঠে সেখান থেকে চলে যাওয়ার উদ্যোগ করতেই বিদিশা তাকে ডেকে বসতে বলেন কাছে।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment