ভালোবাসি বলেছি অনেকবার ( ৭ম পর্ব)
দেবেশ সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে সুবর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে। সুবর্ণা মুখটা নিচু করেই আছে। মানুষের মনটা সবচেয়ে একটি দ্রুতযান। মুহূর্তেই দেবেশের চোখের সামনে ভেসে উঠলো অতীতের কিছু স্মৃতি। একদিন কলেজ বন্ধ করে দু'জনে গেছিলো সিনেমা দেখতে। অবশ্য উভয়ের বাড়ির লোকজন কেউই সেটা জানতেন না। হলে পৌঁছাতে সেদিন বেশ দেরি হওয়াতে পড়িমরি দু'জনে হলে ঢুকে লাইটম্যানকে না দেখে দু'টো ছিট ফাঁকা পেয়ে দ্বিতীয়টাই সুবর্ণা বসে পাশের ছিটটাই দেবেশকে হাত টেনে বসিয়ে দেয়। কিন্তু রোগা,পাতলা দেবেশ ওই চেয়ারটাতে বসতে গিয়ে 'আহ্' বলে তার পিছনটা পুরো চেয়ারের ভিতর ঢুকে যায়। আসলে চেয়ারটা ভেঙ্গে ভিতরটা পুরো ফাঁকা হয়ে গেছিলো। সুবর্ণা সহ আশেপাশের দু'একজন যারা দেখেছিল তারা কেউ জোরে আবার কেউবা মুখ টিপে টিপে হাসছিল। স্বভাবতই হলের ভিতর এরূপ পরিস্থিতিতে অন্যেরা চুপ করতে মৃদু ধমক দিতে থাকে। এরই মাঝে লাইটম্যান চলে আসায় তার সাহায্যে তারা তাদের নিদ্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে বসে।
আর একদিন মেট্রো করে যাওয়ার সময় দু'জনে গল্পে এতটাই মশগুল ছিলো তাদের স্টেশন ছাড়িয়ে কখন চলে গেছে তা তারা খেয়ালই করেনি। মাঝপথে নেমে আবার উল্টো মেট্রো ধরে বাড়িতে ফেরা। এসব ঘটনা নিয়ে নিজেরা তো বটেই বন্ধু মহলেও সুযোগ পেলেই হাসির রোল ছুটাতো দু'জনেই। মাত্র তিনটে বছরে কত হাসির,কত মান-অভিমান, কত ভালোবাসার স্মৃতি মনের মধ্যে জমা হয়ে আছে।
দেবেশ কিছু বলছে না দেখে বিদিশা নিজেই বললো,
-- কখন ফিরলি? চা খেয়েছিস? বিলাসী আজ আমাকে এখনো চা দিলো না তো!
-- সবে ফিরেই তোমার ঘরে আসলাম। এখনো ফ্রেস হয়নি। আমি ফ্রেস হয়ে আবার আসছি তোমার কাছে।
কথাটা বলেই দেবেশ যেন ছুটে বেরিয়ে গেলো। কিন্তু কথা যখন সে বলেছিল সুবর্ণার দিকেই তাকিয়ে ছিল। সুবর্ণা একবারের জন্যেও মুখ তুলে দেবেশের দিকে তাকায়নি। না তাকিয়েও তার বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি যে দেবেশ তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
কোন মুখে সে দেবেশের দিকে তাকাবে? সে যে তার পরিবার বাঁচাতে তার ভালোবাসাকে গলাটিপে মেরে ফেলেছে।
দেবেশ বেরিয়ে যেতেই বিলাসী দু'কাপ চা একটি ট্রেতে করে নিয়ে বিদিশার ঘরে ঢোকে। সে টি টেবিলের উপর চা রেখে বেরিয়ে যাচ্ছে যখন তখন সুবর্ণা তাকে বলে,
-- পিসি আমি আজ রাতের খাবারটা করি? তুমি আমায় দেখিয়ে দেবে?
আসলে সুবর্ণা এই ঘর থেকে কিছুক্ষণের জন্য পালাতে চাইছে। কারণ সে জানে দেবেশ এখনই এই ঘরে আসবে।
বিলাসী সুবর্ণার কথা শুনে মুখে একটা আঙ্গুল চাপা দিয়ে বলে,
-- ও বৌদি, এ মেয়ে বলে কী? এত মেয়ে এলো আর গেলো এ কথা তো কারো মুখে শুনিনি। আর তুমি জানো দুপুরে খেতে গিয়ে মেয়ে কী করেছে?
-- কী করেছে?
-- আমার তো দুপুরে খেলেই ঘুম পায়। আমি ওর খাবার গুছিয়ে ওকে দেখিয়ে দিয়ে আমার ঘরে চলে যাই ঘুমাতে। ওমা! পরে এসে দেখি রান্নাঘর একদম ফিটফাট। যেন মা লক্ষ্মীর হাত পড়েছে রান্নাঘরে। কী সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছে। জানো সমস্ত বাসনও মেজে গুছিয়েছে।
বিদিশা সব শুনে বললেন,
-- আমি ওকে ঠিক চিনেছি।
তারপর দু'জনেরই কথার উত্তর একসাথেই দিলেন,
-- যা বিলাসী ওকে রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে সব দেখিয়ে দে।আর হ্যাঁ কী রান্না করতে হবে সব গুছিয়ে দিস।
-- তারমানে আমার ছুটি?
-- আজ্ঞে না, ওর সাথে তুইও থাকিস।
-- বেশ বেশ। ও মেয়ে আমি যাই তুমি চা টা খেয়ে এসো।
বিলাসী বেরিয়ে গেলো। বিদিশার কাছে বসে চা খেতে খেতে সুবর্ণা বললো,
-- আসলে আমি ঠিক এভাবে বসে সময় কাটাতে পারি না। এখন তো তোমার কোন কাজ নেই। আর তোমার ছেলেও আসবে এখন তোমার কাছে। আমি আর থেকে কি করবো? তাই ভাবলাম আমি রান্নাঘরেই যাই।
-- সেই ভালো।হ্যাঁ আজ তোর হাতের রুটি, তরকারি খাবো। কিন্তু এ কাজটা তোর নয়। আজ প্রথম দিন তোর শখ হয়েছে তাই বললাম কিন্তু।
সুবর্ণা হেসে পড়ে বললো,
-সে দেখা যাবে। আজ আমার সর্ববিষয়ে পরীক্ষা। দাঁড়াও রুটি,তরকারি করে নিয়ে আসছি।
সুবর্ণা খুব তাড়াতাড়ি কাপ প্লেট সমেত চায়ের ছোট্ট ট্রেটা নিয়ে বিদিশার ঘর থেকে বেরোতে গিয়েই দেবেশের মুখোমুখি।
-- বাংলায় এম এ করা সুবর্ণা, বাবা মায়ের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে শেষ পর্যন্ত চাকরির অভাবে আয়ার কাজ?
সুবর্ণা কোন উত্তর না দিয়ে এগিয়ে যেতে গেলে দেবেশ তার পথ আটকায়। সুবর্ণা একবার দেবেশের দিকে তাকিয়েই মুখ নিচু করে নেয়।
-- এভাবে পালিয়ে কতদিন থাকবে? আমার তো সব জানতেই হবে। কবে জানতে পারবো সব?
একথারও সুবর্ণা কোন উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে দ্রুত চলে যায়। দেবেশ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মায়ের ঘরে ঢোকে।
সুবর্ণার মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু এই মুহূর্তে কাজ ছেড়ে চলেও যেতে সে পারবে না। সংসার,ভায়ের পড়াশুনা তার উপর বাবার ওষুধ এবং ভালো ভালো খাওয়াদাওয়া।
সে রান্নাঘরে ঢুকে দেখে বিলাসী আটা মেখে কাবলি ছোলা সিদ্ধ করে রেখেছে আগেই। পেঁয়াজ,টমেটো,আদা,রসুন নিয়ে কাটতে বসেছে। সুবর্ণা রান্নাঘরে এসে বললো,
-- আগে রুটিটা করে নিই পিসি?
-- সে করো। কিন্তু এই কাজগুলো তো তোমার নয়। দাদা দেখলে খুব বকাবকি করবেন আমায়।
-- তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। এই ব্যাপারে যে তোমায় বকতে যাবে তুমি বুঝতে পারলেই বলবে আমি নিজের ইচ্ছায় করেছি। আসলে আমি শুধু শুধু বসে থাকতে পারি না। এখন তো মায়ের ঘরে কোন কাজ নেই তাই এখানে এলাম।
-- ওমা সে কী কথা? একটা মানুষ সব সময় কাজ করতে পারে নাকি? দুপুরেও তো ঘুমাওনি দেখলাম। সন্ধ্যার সময় ছাদ থেকে কাপড়জামা তুলে বৌদির ঘরে রাখতে গিয়ে দেখি তুমি ব্যালকনিতে।
-- কাল থেকে ছাদের জামাকাপড় আমিই তুলবো। আজ একদম ভুলে গেছিলাম। আমি ওগুলো দেখেই বুঝতে পেরেছি তুমি তুলে এনেছো।
-- হ্যাঁ তাই তো। আমি ছাড়া আর কে করবে বলো? তবে এখন দেখছি আমাকে আর এ বাড়িতে দরকার পড়বে না।
বিলাসী কথাটা বলেই হাসতে থাকে। তার হাসি দেখে সুবর্ণাও হেসে দেয়।
-- একটা কথা বলবো তোমায়? কিছু মনে করবে নাতো?
-- না না মনে করবো কেন? বলো কী জানতে চাও?
-- আচ্ছা তোমার চেহারা,পোশাকআশাক দেখে মনে হয় তুমি কোন ভদ্র ঘরের মেয়ে। তা কী অসুবিধায় পড়ে এই আয়ার কাজ করতে আসলে? তোমার চালচলন,চেহারা বলছে বলছে তুমি লেখাপড়াও জানো।
-- পিসি প্রথম দিনেই সব শুনলে হবে? পরে বলবো সব।
স্বরূপের বাড়িতে ফিরতে প্রায়ই রাত হয়। এখন বিদিশা টেবিলে খেতে আসতে পারেন না তাই বাবা যতক্ষণ না ফেরেন দেবেশ বাবার জন্য বসে থাকে। কিন্তু আজ সে সেই যে মায়ের ঘরে ঢুকেছে এখনো বের হয়নি। সে ওখানে বসে সুবর্ণার জন্য অপেক্ষা করছে আর সুবর্ণা রান্নাঘরের কাজ সেরে বিলাসীর সাথে কথা বলেই যাচ্ছে। খেয়াল রাখছে দেবেশ বেরোলেই ওই ঘরে গিয়ে ঢুকবে।
স্বরূপ ঘরে এসে ফ্রেস হয়েই খাবার টেবিলে চলে আসেন। কোনদিন খেয়েদেয়ে বিদিশার ঘরে যান আবার একটু তাড়াতাড়ি ফিরলে আগে গিয়ে দেখা করে শারীরিক খবর নিয়ে তারপর খেতে আসেন। আজ দেরি হওয়াতে সোজা খাবার টেবিলে। বিলাসী গিয়ে দেবেশকে ডেকে আসে। আর এদিকে সুবর্ণা খাবার গুছিয়ে নিয়ে বিদিশার ঘরের দিকে রওনা দেয়। আবার মাজপথে দু'জন মুখোমুখি।
-- খারাপ লাগছে বর্না তোমায় এভাবে দেখতে। আবার জানো কোথাও একটা ভালোলাগাও কাজ করছে। সেই প্রথম দিনের মত বুকের ভিতর কে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। আমি এটাও জানি তোমারও ঠিক একইরকম অনুভূতি হচ্ছে।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment