Sunday, April 7, 2024

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার ( ৯ ম পর্ব)

 ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (৯ম পর্ব)

 দেবেশ কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। রান্নাঘরে বোকার মত এদিক ওদিক ঘুরে ফ্রিজের উপরের কৌটোগুলো একটু নাড়াচাড়া করে ,সুবর্ণার পিছনে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পুণরায় ডাইনিং রুমে এসে আবার রান্নাঘরে ঢুকতে যায় ঠিক ওই সময়েই সুবর্ণার কাজ শেষ হয়ে যাওয়াতে সেও সেই মুহূর্তে বেরোনোর জন্য রান্নাঘর ও ডাইনিং রুমের দরজার কাছে এসে দেবেশের সাথে ধাক্কা খেয়ে দেওয়ালে গিয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে কপাল ফুলে যায়। দেবেশ দেখতে পেয়ে ফ্রিজ থেকে বরফ এনে সুবর্ণার কপালে দিতে গেলে সুবর্ণা দু'পা পিছনে সরে গিয়ে হাত পেতে বলে,
-- আমি নিজেই দিয়ে নিতে পারবো। আমি এত নিষেধ করছি আমার সাথে কথা বলতে আসবে না তাতে তোমার সম্মান ক্ষুণ্ণ হবে তুমি কিছুতেই কথা শুনছো না কেন?
-- চেষ্টা করছি বিশ্বাস করো কিন্তু কিছুতেই পারছি না। অনেককিছু জানতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু এখন এসব কথা থাক। কপালটা খুব ফুলে গেছে। বরফটা চেপে ধরে থাকো। 
-- আমার কোন ব্যাপারে মাথা ঘামাতে আসবে না। কেন বুঝতে পারছো না বাড়ির লোক একবার যদি জেনে ফেলে তোমার সাথে আমার আগে পরিচয় ছিল তাহলে আমার এই কাজটাই যাবে।
-- এ কাজ তোমায় আমি করতে দেবো না। বাড়ি গিয়ে সিভিটা নিয়ে আসবে। দেখি অন্য কোন কাজের ব্যবস্থা করতে পারি কিনা। এটাও ঠিক এখান থেকে চলে গেলে আমি তোমায় রোজ দেখতে পাবো না। কিন্তু তোমাকে এই কাজ করতে দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তবে তোমাকে পেয়ে আমার মা খুব খুশি। আগে মাকে যারা দেখাশুনা করতো তাদের সম্মন্ধে প্রথম দিন থেকেই মায়ের অনেক অভিযোগ ছিলো। কিন্তু তবুও --
-- অবুঝকে বোঝানো যায় না। এবার সরো আমায় যেতে দাও।
-- এত কঠোর হয়োনা সুবর্ণা। সমস্যা মানুষের জীবনে আসে। সময়ে তা কেটেও যায়। তোমার এই সমস্যা আজ আছে কাল থাকবে না। একটু বিশ্বাস করো আমাকে। আমাকে কিছু করতে দাও তোমার আর তোমার পরিবারের জন্য। না, বিনিময়ে আমি তোমার কাজ থেকে কিছুই চাই না। একজন বন্ধু তো মনে করতেই পারো আমায়।
-- অনেক রাত হয়েছে। এবার আমায় যেতে দাও। এসব কথা যখন তখন না বলায় ভালো।
 সুবর্ণা আর দাঁড়ায় না। সে ঘরে ঢুকে দেখে স্বরূপ চলে গেছেন। বিদিশা তাকে দেখতে পেয়ে বললেন,
-- কী করছিলি এতক্ষণ? ওকি কপালে কী হল? কোথায় ধাক্কা খেয়েছিস?
-- ওই আসতে গিয়ে রান্নাঘরের দরজায় একটু লেগে গেছে। বরফ দিয়েছি কিছু হবে না।
-- আসলে নতুন জায়গা তো। সব সময় লাইট জ্বালিয়ে কাজ করবি। বললি না তো কী করছিলি?
-- বাসনগুলো মেজে রেখে আসলাম। 
-- কেন করছিস এসব কাজ মা? তোর তো এগুলো করার কথা নয়।
-- যে বাড়িতে কাজ করতে এসেছি সেখানকার মানুষগুলোকে যদি নিজের ভাবতে না পারলাম তাহলে এই কাজ করবো কী করে মা? তোমার দেখভালের পরে যদি আমার হাতে সময় থাকে তাহলে এগুলো করতে অসুবিধা কোথায়? আমায় তো কেউ এগুলো করতে বলছে না। আমি নিজের ইচ্ছাতেই করছি। 
-- আচ্ছা ঠিক আছে আর বলবো না তবে। তোর বাবা আমায় ওষুধ খাইয়ে দিয়ে গেছেন। বলেছেন আজ নাকি আমায় খুব তরতাজা দেখাচ্ছে। একদিনেই তুই আমায় অনেকটাই সুস্থ করে দিয়েছিস।
 সুবর্ণা হাসতে হাসতে বলে,
-- ওষুধ তো ডাক্তার দিয়েছেন। আমি আর কী করলাম?
-- গাদা গাদা ওষুধ খেলেই কি রোগ ভালো হয় রে? মানসিক শান্তিটাই হচ্ছে আসল। যাকগে অনেক রাত হল। শুয়ে পড় এখন। 
  সারাটা রাত সুবর্ণা ছোটফট করতে থাকে। একটুও ঘুম হয় না তার। কত স্মৃতি মনে পড়তে থাকে। ভাবতে থাকে এখানে থাকতে গেলে দেবেশের সাথে সে আবার জড়িয়ে যাবে। কারণ আজও সে দেবেশকে আগের মতই ভালোবাসে। পরিবার বাঁচাতে সে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিল ঠিকই কিন্তু দেবেশের তো কোন দোষ ছিল না। আর আজও দেবেশ যা করছে সে তো তাকে ভালোবেসেই করছে। এখানেও দেবেশের কোন দোষ সে দেখছে না। কিন্তু এই মুহূর্তে সে কী করবে? আয়ার কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে? কিন্তু দেবেশ এবার ঠিক তাকে খুঁজে বের করবে। কারণ সে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে সুবর্ণা তাকে সেদিন তার বিয়ের ব্যাপারে যা বলেছিলো সবই মিথ্যে। কিন্তু এখানে থেকেও সে কোন চাকরির চেষ্টাও করতে পারবে না। তাহলে এখন সুবর্ণা কী করবে?
 সারাটা রাত না ঘুমানোর ফলে সকালেই সে উঠে পড়ে। ব্যালকনিতেই দাঁড়িয়ে ছিল। বিদিশা উঠে ওকে দেখতে না পেয়ে কাছে ডেকে নেন। মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে যাওয়ার উদ্যোগ করতেই বিলাসী চা নিয়ে ঘরে ঢোকে। ততক্ষণে সুবর্ণা বিদিশাকে দাঁত মাজিয়ে,চুল আঁচড়ে পরিপাটি করে দিয়েছে। বিলাসী চা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে যখন তখন সুবর্ণা তাকে ডেকে বলে,
-- পিসি আমি রান্নাঘরে আসছি। তুমি মাছ,তরকারি রেডি করতে থাকো আমি গিয়ে টিফিন আর দুপুরের রান্না করবো।
 বিলাসী দাঁড়িয়ে পড়ে বলে,
-- না,তুমি কিছু করবে না। আমি খামোখা দেবুর বকা খেতে পারবো না।
-- আচ্ছা তুমি তোমার ভাইপোকে একটু এঘরে পাঠিয়ে দাও।
-- সে তো এখনও ঘুম থেকেই ওঠেনি।
-- আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যাও আমি আসছি।
 সেদিন কী মনে হতে স্বরূপ চায়ের কাপ হাতে বিদিশার ঘরে গিয়ে ঢোকেন। তাকে দেখতে পেয়েই সুবর্ণা খুব খুশি হয়ে বলল,
-- একটা কাজ করে দেবেন? 
 বিদিশা এবং স্বরূপ দু'জনেই অবাক হয়ে সুবর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে। সুবর্ণা দ্রুত হুইল চেয়ারটা এনে খাটের কাছে রেখে বললো,
-- আমায় একটু সাহায্য করবেন ? 
-- এখনি স্নান করাবে?
-- না না এত সকালে স্নান করাবো না। আপনি একটু হেল্প করুন আমি মাকে ডাইনিং রুমে নিয়ে যাবো। মা আজ থেকে টেবিলে গিয়েই তিনবেলা খাবেন।
-- না না সুবর্ণা আমি এতক্ষণ বসে থাকতে পারবো না।
-- আমি তো আছি মা ভয় কিসের? আমার উপর বিশ্বাস রাখো। তুমি বসতে না পারলে আমি তখনই তোমার নিয়ে চলে আসবো।
স্বরূপ এসব শুনে বললেন,
-- পারবো না পারবো না বলে দিনরাত এই ঘরে শুয়ে থাকো। বলছে যখন চলো আজ। তুমি যখনই বলবে আমরা আবার তোমায় নিয়ে এসে শুইয়ে দেবো।
 বিদিশার কোন আপত্তি না শুনে সুবর্ণা স্বরূপের সাহায্যে তাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে নিজেই ঠেলে নিয়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে নিয়ে আসে। সুবর্ণা বিলাসীকে ডেকে বলে,
-- পিসি দেখে যাও কে এসেছে?
 বিলাসী ছুটে এসে বিদিশাকে দেখে বলে,
-- বৌদি, এ মেয়ে তো যাদু জানে। কোন ডাক্তার তোমায় সুস্থ করতে পারেনি। কিন্তু এ মেয়ে তোমায় ঠিক হাঁটিয়ে ছাড়বে।
ইতিমধ্যে দেবেশ সেখানে এসে মাকে দেখে পুরো থ।
-- ওমা, আমরা যা এতদিনে পারিনি সুবর্ণা দেখছি একদিনেই তোমার মনের জোর বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের বিশ্বাস করে ওঘর থেকে হুইল চেয়ার চেপে এঘরে আসতে চাওনি। আর আজ এই অপিরিচিত মেয়েটার প্রতি তোমার এত বিশ্বাস জন্মে গেলো?
-- আরে ও এমনভাবে বললো তোর বাবার কাছে জিজ্ঞেস কর আমার কোন আপত্তি ধোপে টিকলো না।
-- ও বাবা, তুমি ডাক্তার হয়ে যা পারোনি মায়ের নতুন মেয়ে কিন্তু তা করে দেখিয়ে দিল। তারমানে বুঝতে পারছো আমার,তোমার উপর যে বিশ্বাস মায়ের নেই সুবর্ণার উপর একদিনেই মায়ের বিশ্বাস জমে গেছে। এবার মা সুস্থ হবেই। 
 সুবর্ণা রান্নাঘরে ঢোকার আগেই রুটি হয়ে গেছিলো। সে খুব তড়িঘড়ি একটা আলুর তরকারি করে এনে বাপ ছেলের সামনেই বিদিশাকে বললো,
-- মা, তুমি খেয়ে নাও। তোমায় ঘরে নিয়ে যাবো।
 বাধ্য মেয়ের মত বিদিশা খেয়ে বললেন,
-- কতদিন পর আজ এঘরে এসে খেলাম। খুব ভালো লাগলো। তুই এখন আমায় ঘরে দিয়ে আয়। আর বসে থাকতে পারছি না। আমাকে দিয়ে এসে তুইও খেয়ে নিস।
-- হুইল চেয়ারটা নিয়ে সুবর্ণা এগোতে থাকে আর পিছন পিছন দেবেশও এগিয়ে যায়।

ক্রমশ 
--

No comments:

Post a Comment