Saturday, April 20, 2024

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (১৩তম)

 ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (১৩তম পর্ব)

  রজতের বন্ধুদের যে ক'টা ফোন নম্বর জানা ছিল প্রতিটাতেই সুলতা ফোন করে রজতের খবর জানতে চায়। এদিকে তার বাবা,মা-ও সমস্ত আত্মীয়স্বজনদের কাছে ফোন করে চলেছেন। কিন্তু কেউই রজতের কোন খবর দিতে পারে না। উৎকণ্ঠা,দুশ্চিন্তায় দু'বাড়ির রাত শেষ হয়। কোথায় গেলো জ্বলজ্যান্ত মানুষটা? তবে কি কোন ? না আর ভাবতে পারছে না সুলতা? চাকরি বাঁচিয়ে কিভাবে সে রজতের খবর পাবে? একদিন অফিসে না যাওয়া মানেই মাইনের টাকা থেকে টাকা কাটবে।পরিবারের অসহায় মুখগুলো চোখের উপর ভেসে ওঠে। কিন্তু এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকাও তো সম্ভব নয়। রজতের বাবা,মায়ের বয়স হয়েছে। তাদের পক্ষেও সম্ভব নয় দৌড়াদৌড়ি, ছুটাছুটি করা। তারাও সুলতার উপরই নির্ভর করে আছেন। মাঝে মাঝেই তাকে ফোন করছেন। খুব অসহায় লাগছে সুলতার! কিভাবে এগোবে? কোথায় যাবে? কাকে ধরবে এ ব্যাপারে?
  খুব ভোরে সে বেরিয়ে পড়ে। প্রথমেই থানায় গিয়ে একটা নিখোঁজ ডাইরি করে। সেখান থেকে সোজা অফিস। অনেক কষ্টে পরদিন ছুটি ম্যানেজ করে। অফিসের ম্যানেজার যেহেতু তাকে খুব স্নেহ করেন সুলতার মনের অবস্থা বুঝে তাকে সেদিন একটু আগেই ছাড়েন। কিন্তু আগে বাড়িতে পৌঁছেই বা সে কী করবে? কোথায় খুঁজবে রজতকে।
 স্টেশনে নেমে সেখান থেকে সোজা সে থানায় যায়। কিন্তু তাদের কাছে কোন খবর নেই। মরিয়া হয়ে ওসির সাথে দেখা করে। প্রথম থেকেই ওসি সুলতার মুখের দিকে কারণে অকারণে তাকানোর ফলে সুলতা কথা বলতে ভীষণ অস্বস্তি বোধ করছিল। কিন্তু  নানান কথার ফাঁকে ওসি হঠাৎ করেই জানতে চান,
-- তোমার নাম কি সুলতা?
-- হ্যাঁ আপনি আমার নামটা জানলেন কী করে? ওই ডাইরির সিগনেচার দেখে?
-- না, আমি তোমায় ছোটবেলা থেকেই চিনি। তোমার মনে নেই একসময় আমি তোমাদের বাড়ির কাছে ভাড়া থাকতাম। তুমি খুব শান্ত মেয়ে ছিলে। সব সময় আমাদের বাড়িতে থাকতে। আমার মায়ের একটা মেয়ের শখ ছিলো। তাই তোমাকে মা মেয়ের মত ভালোবাসতেন। নিজেই স্নান করানো, খাওয়ানো,নিজের কাছে ঘুম পারানো সব করতেন। তোমার বাবা কিংবা মা যখন তোমায় নিতে আসতেন তখন তুমি খুব কাঁদতে। মা আমায় ছোটন বলে ডাকতেন। তুমি এত বড় একটা শব্দ উচ্চারণ করতে পারতে না বলে আমায় ছোটু বলে ডাকতে।
  হাসতে থাকেন ওসি ভাস্কর সেন। মৃদু হাসির রেখা সুলতার মুখেও ফুটে ওঠে। সে বলে,
-- আমার কিচ্ছু মনে পড়ছে না
-- আরে কী করে মনে পড়বে? তখন তুমি কত ছোট। যতদূর মনে পড়ছে তখন তোমার তিনবছর মত বয়স হবে। একদিন মা আমায় সন্ধ্যার সময় আলু ভাজা আর রুটি খেতে দিয়েছেন। তুমি তো রাতে শোয়ার পূর্ব পর্যন্ত আমাদের বাড়িতেই থাকতে। তো তুমি কী করলে জানো? আমার খাটের উপর উঠে বললে," ছোটু আমি খাবো।" মা বললেন," দাঁড়া তোকে আমি আলাদা প্লেটে দিচ্ছি।" না কিছুতেই হবে না। তুমি আমার প্লেট থেকেই খাবে। আমি একটা ছোট রুটির টুকরো তোমার হাতে দিলাম। তারপর তুমি সেটিকে আমার প্লেটে রেখে তার উপর তিন চারটে আলুর টুকরো রেখে রোল করে মুখের ভিতর ঢুকিয়ে খেতে লাগলে। আমি আর মা তো হেসেই খুন।
-- আপনার এত কিছু মনে আছে? 
-- ওমা! থাকবে না কেন? আমি তো তখন কলেজে পড়ি। খুব ন্যাওটা ছিলে আমাদের।
 সুলতা একদৃষ্টিতে ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে। যখন সে ওসির সাথে দেখা করতে চেয়েছিল বাইরে থেকে তাকে বলা হয়েছিল ওসি খুব রাগী মানুষ তিনি সাধারণত খুব প্রয়োজন না হলে কারো সাথে দেখা করেন না আর দেখা করলেও সেই ব্যক্তিকে বেশি সময় দেন না। কিন্তু প্রায় আধাঘন্টা হতে চললো সুলতা ওসির ঘরে আছে। আসলে পরিস্থিতি মানুষকে অহরহ পাল্টে দেয়। তিনি যে পদে আছেন সেখানে তাকে গাম্ভীর্য ধরে রাখার জন্য একটা মুখোশ তাকে পরতেই হয়। জীবনে প্রতিষ্ঠিত প্রতিটা মানুষের চাকরি বাঁচিয়ে রাখা এবং তিনি যে চেয়ারটাতে বসে আছেন সেই চেয়ারের মর্যাদা ও সম্মান অক্ষুণ্ন রাখতেই তার এই প্রচেষ্টা। সাধারণত মানুষটা বদলায় না। পরিস্থিতি তাকে বদলে যেতে বাধ্য করে। কিন্তু মনের ঘরে সেই আসল মানুষটিই ঘুমিয়ে থাকে যাকে আবার জাগিয়ে দেয় সেই পরিস্থিতিই।
-- আপনার বাবা, মা কোথায় আছেন এখন?
-- বাবা নেই। মা আমাদের সাথেই থাকেন। অনেকটা সময় চলে গেলো। তোমার কেসটা আমি দেখছি সবই তো জানলাম তোমার কাছ থেকে। রজতবাবুর বাড়ির লোক কেউ নেই?
-- বাবা,মা আছেন। অনেক বয়স। এক পাড়াতেই থাকি। তাই আমি -
-- ঠিক আছে। বাকিটা না বললেও হয়ত বুঝতে পারছি। ফোন নম্বরটা দাও। যদিও ডাইরিতে লেখা আছে। তবুও তুমি পার্সোনালি আমায় দিয়ে যাও। ছুটে ছুটে আসতে হবে না। আমি খবর পেলেই তোমায় ফোন করবো। আর হ্যাঁ এইসব মিটে গেলে আমি একদিন তোমার বাবা,মায়ের সাথে দেখা করতে যাবো।

ক্রমশ 

No comments:

Post a Comment