ভালোবাসি বলেছি অনেকবার ( ২০ তম পর্ব)
সকাল দশটা নাগাদ রজতের ঘুম ভাঙে। সে ঘুমাতে লাগলে এর আগে তার মা,বাবা বহুবার এঘরে এসেছেন। ছেলে অঘোরে ঘুমাচ্ছে দেখে কোন সাড়াশব্দ নেই তাতেও মা,বাবার আতঙ্ক কমে না। চশমার ডাটি ধরে বুকের কাছে ঝুঁকে পড়ে দেখেন ঠিকমত নিশ্বাস-প্রশ্বাস চলছে কিনা। মা, বাবার সব সময়ই তার সন্তানকে নিয়ে এক দুশ্চিন্তা থেকেই যায়।
সেই জন্মের থেকে মৃত্যু পর্যন্ত।
রজত ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে। সে ভাবতে চেষ্টা করে গত দু'দিন তার সাথে কী কী ঘটেছে আর সে যদি একটু সাহসী না হত তাহলে কী ঘটতে পারতো। ট্রেনে করে নিত্য যাতায়াতের সূত্র ধরে অনেক মুখের সাথেই একটা পরিচিতি গড়ে উঠেছে। মুখোমুখি হয়ে গেলে জাস্ট একটু হেসে পড়া। কিন্তু সেদিন কী যে হল। ওই মেয়েটাকে তো সে বহুবার দেখেছে, মামুলি কথাও কখনো সখনো হয়েছে। কিন্তু তার ভিতর কী এমন হল যে গত পরশু মেয়েটির কথামত তার পিছন পিছন গাড়ি থেকে এক অচেনা স্টেশনে নেমে পুণরায় অন্য একটা ট্রেনে উঠে পড়লো। মেয়েটি এক সময় তাকে বলেছিল,
-- আমার ফোনটাই চার্জ নেই যদি আপনি ফোনটা দিতেন আমি একটা কল করতাম।
পকেট থেকে ফোন বের করে রজত মেয়েটির হাতে দেয়। খুব ঘুম পাচ্ছিল রজতের। যখন ওর ঘুম ভাঙে তখন সে নিজেকে আবিষ্কার করে একটা অন্ধকার ঘরের মধ্যে শুয়ে আছে। মশা ছেঁকে ধরেছে। উঠার ক্ষমতা নেই। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল। একসময় ঘরের ভিতরে কিছু লোকজন ঢোকে তাদের সকলের মুখেই কাপড় বাঁধা। শুধু চোখদু'টি তাদের দেখা যাচ্ছে। সামনে তিনটে রুটি আর আলুর তরকারি দিয়ে কেউ একজন তাকে বলেছিল,
-- খাবারটা খেয়ে নিন। আর একদম পালানোর চেষ্টা করবেন না। আমাদের লোকজন বাইরে সবসময় পাহারায় আছে।
কাউকেই সে চিনতে পারছিল না কিন্তু প্রচণ্ড খিদে পাওয়াতে সে রুটি আর তরকারি পুরোটা খেয়ে নেয়। তারপর আবার কোন সময় যেন ঘুমিয়ে পড়ে।
তার চিন্তায় ছেদ পড়ে মা যখন এসে তার ঘরে ঢোকেন।
-- ঘুম ভাঙলো তোর রাজু?
-- হ্যাঁ মা কিন্তু খুব খিদে পেয়েছে। তাতো পাবেই রে। তুই দাঁত ব্রাশ করে নে আমি তোর জন্য চা করে নিয়ে আসি।
রজতের গলার আওয়াজ পেয়ে রজতের বাবা এই ঘরের দিকেই আসছিলেন। রজতের মা বেরিয়ে যেতে গেলে রজত মাকে ডেকে বলে,
-- মা সুলতা আসেনি কাল?
রজতের মা কথাটা শুনতে পান না। তিনি বেরিয়ে যান ঘর থেকে। কিন্তু উত্তরটা দেন রজতের বাবা,
-- আসেনি মানে? মেয়েটা নাওয়া-খাওয়া ভুলে এ দু'টোদিন পাগলের মত ছুটাছুটি করেছে। একদিকে অফিস আর অন্যদিকে তোর জন্য দৌড়াদৌড়ি। গতকাল অফিস করে থানা হয়ে যখন বাড়িতে ফিরেছে তখন রাস্তায় তোর ফেরার খবর শুনেই মাকে নিয়ে অত রাতে ছুটে এসেছে। অনেক রাতে এখান থেকে ফিরেছে। তোর মা তো বললেন তোকে নাকি ঘুমের মধ্যে দুধ,রুটি মাখা খাইয়েও দিয়েছে। সকালে তো সময় পায় না ও ঠিক আফিস থেকে ফিরেই চলে আসবে। কিন্তু তুই আমাকে এখন বল তো কী করে কী হল?
-- বলবো বাবা সব বলবো। আগে আমি নিজে একটু ধাতস্ত হয়ে নিই। প্রচণ্ড খিদে পেটে। স্নানটা করে আসি। খেয়েদেয়ে তারপর সব বলছি তোমাদের।
রজতের বাবা আর জোর করলেন না। তিনি ছেলের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে তার কথার সমর্থন জানালেন।
রজত পেষ্ট ব্রাশ নিয়ে ড্রয়িং কাম ডাইনিংয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত মাজতে মাজতে পুনরায় ভাবতে থাকে ওই মেয়েটার নামও সে জানে না। মুখ চেনা একই বগিতে সেদিন পাশাপাশি সিটে বসা। সে পকেট থেকে ফোনটা বের করে মেয়েটাকে দেয়। মেয়েটা কথা বলে তাকে ফোনটা ফেরত দেয়। পকেটেও রাখে সে। কিন্তু তারপর কী যে হল প্রচণ্ড ঘুম পেতে লাগলো। পকেটে সেদিন মাইনের সব টাকা। একবার হাত দিয়ে প্যান্টের ভিতরের পকেটে একটু চাপ দিয়ে দেখে নিলো। তারপর যা কিছু ঘটেছে তার আবছা আবছা মনে আছে। মেয়েটা তাকে হাত ধরে ট্রেন থেকে নামালো। তারপর ওভার ব্রিজ করে অন্য একটা ট্রেনে উঠলো। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। ট্রেনে বসে পড়েই পূনরায় ঘুমিয়ে পড়ে সে। কিন্তু যখন ঘুম ভাঙে তখন দেখে একটা অন্ধকার ঘরে শুয়ে আছে সে। এর আগে ওই মেয়েটা তাকে বোতলে জলও খেতে দেয়। জলটাই কোন টেস্ট ছিল না। কেমন যেন লাগছিল খেতে। কিন্তু ওই মেয়েটি তাকে জোর করে বোতলের পুরো জলটা খাওয়ায়।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment