Friday, April 5, 2024

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (৮ম পর্ব)

প্রথমে সুবর্ণা ভেবেছিল দেবেশের কোন কথার উত্তর সে দেবে না। তাই সে বিদিশার ঘরের দিকে পা বাড়িয়েও হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বেশ দৃঢ় কন্ঠে বললো,
-- পৃথিবীটা গোল।তাই হয়ত তোমার সাথে আমার আবার দেখা হয়ে গেলো। কিন্তু আর দেখা হোক সেটা আমি কোনদিনও চাইনি। তবে তুমি যেটা ভাবছো সেটা আমার মধ্যে কিছুই হচ্ছে না। সচ্ছল পরিবারে সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছো। অভাব কাকে বলে কোনদিন জানতেও পারোনি। পরিবারের কারও প্রতি কোন দায় কাঁধের উপর নেই। থাকলে বুঝতে পারতে গরীবের ঘরে স্বপ্ন দেখতে নেই। অসুস্থ বাবা,ভায়ের পড়াশুনা পুরো পরিবারের দায় সংসারে বড় হওয়ার কারণে চাকরি না পেয়ে কতটা কষ্টে এই কাজ করতে বাধ্য হচ্ছি তা বোঝার ক্ষমতা তোমার কোনদিনও হবে না।যদি এতে তোমার আপত্তি থাকে অর্থাৎ তোমার বাড়িতে যদি আমাকে কাজ করতে না দাও সরাসরি বলে দাও আমি কালই চলে যাবো। অন্য কোন কাজ খুঁজে নেবো। আর যদি তা না হয় আর কখনো আমাকে কোন কথা বলবে না। বাড়ির আয়ার সাথে মানুষ যেমন প্রয়োজনে কথা বলে সেটুকুই বলবে। এর বাইরে কোনকিছু নয়। বাড়িতে যারা আছেন তাদের কেউ যেন টের না পায় আমায় তুমি আগে চিনতে তাতে আমার সম্মানহানির থেকে তোমার সম্মানহানি বেশি হবে। পূর্ব পরিচিত হিসাবে তাই আমি আশা করবো আর কখনোই তুমি কোন কথা আমাকে বলবে না। আমার পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখতে আমি যেকোন কাজ করতে রাজি আছি।
 কথাগুলো বলে আর এক মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে সুবর্ণা চলে গেলো। ঘরে ঢোকার আগে অবাধ্য চোখদু'টো  শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে নিল।
  দেবেশ স্বপ্নেও ভাবেনি সুবর্ণা তাকে এই ধরণের কথা বলতে পারে। অপমানে,কষ্টে দেবেশ যেন পাথর হয়ে গেলো। হঠাৎ মনে পড়লো বাবা টেবিলে খেতে এসেছেন। ধীরে ধীরে সে এসে বাবার সামনে একটা চেয়ারে বসলো।
-- কি রে মুখটা এত থমথমে কেন? 
-- বাবা, এই মেয়েটিকে তুমি কোথায় পেলে? 
-- কেন বলতো? এবারও কি তোর মায়ের পছন্দ হয়নি একে?
-- না, সে রকম কিছু তো মা বললেন না। আজ তো প্রথম দিন। মনেহচ্ছে মা এর সেবাযত্নে খুশিই হয়েছেন। তাছাড়া শুনলাম ও নাকি আজ রাতের রান্নাও করেছে।
-- হ্যাঁ আমাকে তো বিলাসী তাইই বললো। মেয়েটি ভদ্রঘরের মেয়ে। ও বাবার টিবি হওয়াতে আমাদের হাসপাতালে ট্রিটমেন্টের জন্য আসতো। বাবা একটা দোকানে কাজ করতেন। কাজটা চলে যাওয়াতে ভীষণ সমস্যায় পড়ে ওরা। যেকোন একটা কাজের কথা আমাকে বলেছিল। 
 খেতে খেতে বাপছেলের কথা হচ্ছিল। রুটি ছিঁড়ে মুখে দিতে দিতে স্বরূপ বললেন,
-- রান্নার হাতটাও বেশ ভালো। চানাটা বেশ ভালো লাগছে খেতে। 
-- কিন্তু বাবা ও তো মায়ের দেখাশুনা করতে এসেছে। ও কেন রান্না করবে? আর আমরাও বা এটা মেনে নেবো কেন?
-- কেউ তো বলেনি ওকে রান্না করতে। ও নিজের থেকেই করেছে। বিলাসী আমাকে সব বলেছে।
-- ও করতে চাইলেই আমরাই বা ওকে রান্না করতে দেবো কেন? পিসি তো রান্না করেই। না ওকে এইসব কাজ করতে হবে না।
 স্বরূপ অবাক হয়ে তার ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। এভাবে কোনদিন কারো কোন কাজ নিয়েই তাদের দেবু মাথা গলায়নি। তাহলে আজ এসব কী বলছে সে?
-- ও যদি এরকম রান্না করে তাহলে ওকে মাইনেও বেশি দিতে হবে।
-- ঠিক আছে দেবো। কিন্তু ওকে তো আমরা বলিনি রান্না করতে, রান্নাঘর পরিস্কার করতে।
-- ও তাও করেছে নাকি? 
তারপর আস্তে আস্তে বললো,
-- সব তাতেই বাড়াবাড়ি 
-- কি বললি?
-- না কিছু না 
-- বললি না তো কেমন খেলি?
 দেবেশ গম্ভীর হয়ে উত্তর দিল
-- ভালো।
   খাওয়াদাওয়া শেষে স্বরূপ যখন বিদিশার ঘরে ঢুকলেন তখন রাতটা একটু বেশিই হয়ে গেছে। সুবর্ণাকে দেখেই উনি বললেন,
-- শোনো কাল থেকে তুমি তোমার খাবারটা একসাথে এই ঘরেই নিয়ে আসবে।তানাহলে তোমার খেতে অনেক রাত হয়ে যাবে।
-- তাতে কিছু হবে না। মা আমায় বলেছেন ডিনার করে আপনি রোজ একবার এই ঘরে আসেন। খেয়েদেয়ে আপনি যখন এই ঘরে আসবেন আমি তখনই খেতে যাবো। আমার কোন অসুবিধা হবে না।
বিদিশা তখন বললেন,
-- দেখেছো প্রথম দিন থেকেই কেমন আপন করে নিয়েছে আমায়। কী মিষ্টি করে মা বলে ডাকছে।
-- তাই তো দেখছি। 
 সুবর্ণা ওদের কথার মাঝখানেই বিদিশার খাবারের থালা নিয়ে রান্নাঘরে যাওয়ার উদ্যোগ করতেই স্বরূপ বললেন,
-- তোমার হাতের রান্না খুব ভালো লাগলো। কিন্তু মা আমার ছেলে চায় না তুমি তোমার মায়ের দেখভাল ছাড়া এই সংসারে অন্য কোন কাজ করো। তাই বলি কী তুমি আর রান্নাবান্নার দিকে যেও না।
-- মায়ের কাজ করার পর যদি সময় পাই আমি টুকটাক একটু রান্না করে সময়টা কাটাতে চাই। শুয়ে বসে থাকতে পারি না। এতে আমার কোন অসুবিধা হবে না। আমি রান্না করতেই ভালোবাসি।
 স্বরূপ আর কিছু বললেন না। সুবর্ণা বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার সময় দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যায়।
 বিদিশা স্বরূপকে বললেন,
-- মেয়েটা বড্ড ভালো গো। আমার তো মনেহয় বেশ শিক্ষিত। ওর কথাবার্তার মধ্যে সর্বদা একটা বুদ্ধিমত্তার ছাপ।
-- যাক তোমার ওকে পছন্দ হয়েছে তো?
-- আরে পছন্দ হওয়ার কী আছে? এর আগে যারা এসেছে তারা সকলেই কেমন প্রফেশনাল। কিন্তু ও যখন আমার কাজগুলো করলো আজ আমার মনে হল যেন মেয়ে তার অসুস্থ মায়ের সেবা করছে।
-- তাহলে তো এবার তোমার বাইরে যাওয়ার কোন অসুবিধা নেই?
-- কয়েকদিন পর বলছি --
   সুবর্ণার খাবার গুছিয়ে বিলাসী বসে ছিল সে গেলে দু'জনে একসাথে খাবে বলে। অন্য দিনগুলোতে সে বাপ ছেলের খাওয়া হলেই খেয়ে নেয়। কিন্তু খেতে খেতে সুবর্ণার সাথে গল্প করবে বলে সে আজ না খেয়ে বসে আছে। সুবর্ণা রান্নাঘরে ঢুকে দেখে ছোট্ট টেবিলটায় দু'জনের খাবার গুছিয়ে বিলাসী ঘুমে ঢুলছে।
-- পিসি, তুমি বসে আছো কেন? তোমার তো ঘুম পেয়েছে।
-- হ্যাঁ আমি তো রোজ এইসময় ঘুমিয়েই পড়ি। তবে আজ খেতে খেতে তোমার সাথে গল্প করবো বলে না খেয়ে বসে আছি। তবে এখন মনেহচ্ছে তা আর সম্ভব হল না। প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। কোনরকমে খেয়ে গিয়ে শুয়ে পড়ি। শোনো, তুমি কিন্তু খেয়েদেয়ে আবার বাসন মাজতে লেগে যেও না। দেবু প্রচণ্ড ক্ষেপে গেছে মায়ের কাজ ছাড়া তুমি অন্যসব কাজ করেছো বলে।
-- এতে ক্ষেপে যাওয়ার কী হল? আমার ইচ্ছা হয়েছে আমি করেছি। কেউ তো আমাকে করতে বলেনি।
-- জানি না বাবা। তুমি খেয়ে উঠে বাসন রেখেই চলে যেও।
-- তোমার ভাইপোকে আমার সাথে কথা বলতে বলো। আমি সময় পেলে এগুলো করবো তাও বলে দিও।
 সুবর্ণা একটু দৃঢ়তার সাথে কথাগুলো বলল কারন সে দেখতে পেয়েছিল দেবেশ ডাইনিং রুমে ঢুকে চেয়ারে বসে আছে। দেবেশকে শুনিয়ে শুনিয়ে তাই ইচ্ছাকৃত এই কথাগুলো সে বলে যাতে দেবেশ আর কখনোই বিলাসীকে তার কাজ করা নিয়ে কোন কথা না শোনায়।। বিলাসীর প্রচণ্ড ঘুম পেয়ে গেছিলো। সুবর্ণার সব কথা তার কান পর্যন্তই পৌঁছায়নি। সে ঘুম চোখে অতি দ্রুততার সাথে ডাইনিং রুম পেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়। দেবেশ যে চেয়ারে বসে আছে তা সে খেয়ালই করে না। সুবর্ণা খেয়ে উঠেই সিঙ্কে বাসন ধুতে শুরু করে। দেবেশ গিয়ে রান্নাঘরে ঢোকে। কী করবে কিছু বুঝতে না পেরে খামোখা ফ্রিজ খুলে একটা জলের বোতল বের করে ঠান্ডা জল ঢকঢক করে খেতে শুরু করে। সুবর্ণা যেন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না এমনভাবে সে তার কাজ করে চলেছে।

ক্রমশ -

No comments:

Post a Comment