Monday, March 25, 2024

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (৪র্থ পর্ব)

সুবর্ণা বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকে। এখন সে কী করবে? কিভাবে দেবেশের মুখোমুখি হবে? সবই তো ঠিক চলছিল তবে এতগুলো বছর বাদে আবার কেন ও সামনে আসলো? ঈশ্বর কী চান? জীবনে প্রথম ভালোবাসার ঘটনা মানুষ কোনদিনও ভুলতে পারে না। সময় তার উপর একটা প্রলেপ ফেলে দেয় মাত্র। সুবর্ণার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। দেবেশকে ফিরিয়ে দিতে সেদিন সুবর্ণার বুক ফেটে গেলেও সংসারের প্রতি দায়বদ্ধতা তার মনকে করেছিল পাথর। আপ্রাণ চেষ্টা করে চোখের জল সংবরণ করে মুখে কঠোরতা এনে জানিয়েছিল,
-- বাবা,মায়ের অমতে আমি তোমাকে কোনদিনও মেনে নিতে পারবো না। আর তাছাড়া বিয়ে আমার ঠিক হয়ে গেছে। টুকটুক করে বাবা সবকিছুর আয়োজনও করে ফেলেছেন। তাই তোমাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়।
-- তাহলে এতদিনের মেলামেশা? সবটাই অভিনয়? নাকি শুধুমাত্র সময় কাটানো?
-- তোমার যা ইচ্ছে ধরে নিতে পারো। 
 কথা শেষ করে সুবর্ণা বাড়ির রাস্তা ধরে। দেবেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দৌড়ে সুবর্ণার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
-- তোমার এই আচরণ আমাকে নারী জাতিকে চিনতে খুব সাহায্য করলো। এতকাল শুধু শুনে এসেছি নারী ছলনাময়ী। আজ সত্যিই তার প্রমাণ পেলাম। এজন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। 
 দেবেশ নিজেই সরে দাঁড়ালো সুবর্ণাকে এগিয়ে যাওয়ার পথ করে দিয়ে। এরপর সুবর্ণার সাথে দেবেশের আর দেখা হয়নি। উভয়েই দেখা করার কোনরকম চেষ্টাও করিনি।
 দেবেশ মায়ের কাছে অনেকক্ষণ বসে ছিল মেয়েটির সাথে দেখা করবে বলে। কিন্তু এতক্ষণ বসে থেকেও সে আসছে না দেখে মাকে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। সুবর্ণা দরজার বাইরে একটা থামের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলে। দেবেশ চলে যায়। সুবর্ণা মনেমনে ভাবে ক'ঘন্টা কিংবা ক'টা দিন সে দেবেশের কাছ থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখবে?
 সে ঘরে ঢুকে বিদিশার পাশে গিয়ে বসে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। আর ভাবতে থাকে ভদ্রমহিলার কতই বা আর বয়স হবে। হয়ত মায়ের বয়সী কিংবা মায়ের থেকে দু'চার বছরের বড় হবেন। কিন্তু কোনদিনও মায়ের কাছে বসে মাথায়, গায়ে হাত বুলিয়ে দেওয়ার সময় হয়নি একমাত্র অসুস্থ্য হলে ছাড়া। সব সময় পড়াশুনা আর তার ফাঁকে ফাঁকে মাকে সংসারের কাজে যেটুকু পেরেছে সাহায্য করেছে। হাত বুলাতে বুলাতে হঠাৎ হাতটা থেমে যাওয়ায় বিদিশা নিজের হাত দিয়ে সুবর্ণার হাতটা চেপে ধরে বললেন,
-- কী ভাবছো? মায়ের কথা মনে পড়ছে?
 সুবর্ণা একটু চমকে উঠলো। ভদ্রমহিলা কী করে বুঝলেন? কিন্তু মুখে হাসি এনে বললো,
-- না সেরকম কিছু না। আসলে আগে কখনো বাড়ি ছেড়ে কোথাও থাকিনি তাই ভাবছি --
-- কিচ্ছু ভাবতে হবে না। আমিও তো তোমার মায়ের মত। 
 তারপর হাতের ইশারায় একটি খাট দেখিয়ে বললেন,
-- রাতে তুমি ওই খাটটায় শুয়ে পড়বে। আমি শুয়ে পড়ার পর কেউ আর এঘরে রাতে আসে না। তার আগে এসেই বাবা,ছেলে দেখা করে যায়। 
 সুবর্ণা চুপচাপ বসে আছে কিন্তু মনের মধ্যে তার ঝড় বয়ে চলেছে। এখানে থাকতে গেলে তো দেবেশের সাথে তার দেখা হবেই। তার কাছে মিথ্যে কথা বলা আর শেষ পর্যন্ত এই আয়ার কাজ করতে আসার লজ্জা সে কোথায় লুকাবে? 
 বিদিশা একটু একটু করে সুবর্ণার কাছ থেকে তার পরিবার ও নিজ সম্পর্কে সব জেনে নিলেন।কিন্তু সুবর্ণা বিদিশার কাছে যা লুকিয়ে গেলো তা হল তার এডুকেশনাল কোয়ালিফিকেশন আর দেবেশের সাথে তার পূর্ব সম্পর্ক।
  দেবেশ কলেজে বেরোনোর সময় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মাকে ডেকে বলে যায় যে সে বেরোচ্ছে। ঠিক তার বাবাও স্বরূপবাবু ওই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তার স্ত্রীকে ডেকে বলে যান।
 দুপুরবেলা বিলাসী এসে বিদিশার খাবার দিয়ে যায়। বিলাসী ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় মেয়েটি ঘরের চেহারায় পাল্টে দিয়েছে। বৌদির মুখেও বেশ প্রসন্নতার হাসি। বিলাসী মনেমনে খুব খুশি হয় সুবর্ণার কাজে। সুবর্ণার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,
-- হ্যাগো মেয়ে তোমার নাম কী? কী বলে তোমায় ডাকবো আমি? তুমি আমায় পিসি বোলো। দেবু আমায় পিসি বলেই ডাকে। আমার দেবুর সাথে তোমার দেখা হয়েছে? ও কিন্তু খুব লাজুক ছেলে।
 বিদিশা মৃদু ধমক দিয়ে উঠলো বিলাসীকে। 
-- তুই চুপ কর বিলাসী। এখানে ও আমার দেখভাল করার জন্য এসেছে। তোর দেবুর গল্প শুনতে আসেনি। কথা একবার যদি শুরু করিস তা যে কোথায় থামাতে হয় আজও সেটা বুঝলি না। 
-- হ্যাঁ তুমি তো সারাজীবন আমার কথাই শুনে গেলে। বাপ,ছেলে সকাল হলেই বেরিয়ে পড়েন আর সারাটাদিন আমি মুখ বুজে সংসারের কাজ করে করে আমারও তো পেট ফুলে ওঠে। কথা বলার জন্য মনটা আকুপাকু করে। তুমি তো ঘুমিয়ে আর গল্পের বই পড়েই সময় কাটিয়ে দাও। আমার কথা একবারও ভাবো কেউ?
-- আচ্ছা এখন থেকে ভাববো। তুই এখন যা আমার খিদে পেয়েছে।
 সুবর্ণা বিদিশাকে ধরে খাটের উপর বসিয়ে দিলো। তারপর চামচে করে খাইয়ে দিতে লাগলো। মাছের কাঁটা বাছার সময় বিদিশার মুখের দিকে তাকিয়ে পড়ে বললো,
-- হাত দিয়ে কাঁটা না বাছলে তো কাঁটা থেকে যাবে মা
 বিদিশা সুবর্ণার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে তার মাথায় একটা হাত দিয়ে বললেন,
-- এই যে মা বলে ডাকলি এতেই তো তুই আমার মেয়ে হয়ে গেলি। আজ আমাকে তুই নিজেই মাছ বেছে খাইয়ে দে, কাল থেকে আমি নিজের হাতেই খাবো। ওরে আমি কি হাতে খেতে পারি না? নিশ্চয়ই পারি। কিন্তু কী জানিস? এই যে মেয়েগুলো আসে কেউ একটু ভালোবাসা,দরদ নিয়ে কথা বলতে জানে না। সব যেন প্রফেশনাল। আমার একটুও ভালো লাগে না। তুই কত সহজে মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আমায় আপন করে নিলি। 
 সুবর্ণা বিদিশার এই আবেগঘন কথা শুনে নিজেও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো। চোখের থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে দেখে বিদিশা হাত দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বললেন,
-- কাঁদে না মা। তোকে দেখে প্রথমেই আমার মনে হয়েছে তুই ভালো পরিবারের মেয়ে। অভাবের তাড়নায় আয়ার কাজ করতে এসেছিস। মা বলে যখন দেখেছিস কোন অসুবিধা হবে না এখানে তোর। তোর বাবাকে বলে দেবো অন্যদের যে টাকা মাইনে দিতেন তার থেকে তোকে যেন বেশি টাকা দেন। এবার যা আমার তো খাওয়া হয়ে গেলো নিজে গিয়ে খেয়ে আয়। রান্নাঘরে চলে যা। বিলাসী তোর খাবার দিয়ে দেবে।
 বিশাল বাড়ির বেশ কয়েকটি ঘরের মধ্যে রান্নাঘরটি খুঁজে পেতে সুবর্ণাকে বেশ বেগ পেতে হল। রান্নাঘরে ঢোকার সাথে সাথেই বিলাসী তাকে বলে,
-- এই যে মেয়ে দেখো তোমার খাবার এখানে এই ছোট টেবিলে ঢাকা দেওয়া আছে। খেয়েদেয়ে বাসনগুলো সিনকে রেখে টেবিলটা মুছে ফেলো। এখন আমার একটু গড়াগড়ি দেওয়ার সময়। আমি চললুম। তুমি খেয়ে বৌদির ঘরে চলে যেও।
 বিলাসী বেরিয়ে যাওয়ার পর সুবর্ণা রান্নাঘরের চারিপাশে তাকিয়ে দেখে এত সুন্দর, এত বড় রান্নাঘরে চারিপাশে জিনিসপত্র ছড়ানোছিটানো। খিদেও পেয়েছিল খুব। আগে সে খেয়ে নিয়ে প্রথমে এটো বাসন যত পড়েছিল সেগুলি মেজে ফেলে যত্রতত্র জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখে। বাসন রাখার জায়গায় বাসনগুলিকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে। হলুদ,নুন,তেল লাগানো কৌটোগুলো সার্ফজলে সুন্দর করে ধুয়ে পরিষ্কার করে।
এসব করতে করতে তার অনেকটাই সময় চলে যায়। এরপর যখন সে এসে বিদিশার ঘরে ঢোকে সে দেখতে পায় বিদিশা একটা গল্পের বই পড়তে পড়তে বুকের উপর বইটি রেখে ঘুমিয়ে পড়েছেন। বিদিশা আস্তে করে ঘরে ঢুকে বিদিশার বুকের উপর থেকে বইটি নিয়ে ভাঁজ করে টেবিলে রাখে। চশমাটা চোখ থেকে খুব সন্তর্পনে খুলে ভাঁজ করে বালিশের পাশেই রেখে দেয়। 
  ঘর থেকে আস্তে বেরিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। ফিরে যায় সে তিন বছর আগের অতীতে। চোখের সামনে জ্বলজ্বল করতে থাকে দেবেশের সাথে পরিচয়ের প্রথম দিনের ঘটনা।

ক্রমশ -
    

No comments:

Post a Comment