ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (১৪তম পর্ব)
এখানে ভাস্কর সেন সম্পর্কে একটু না জানালেই নয়।
সুলতা বেরিয়ে যাওয়ার পর একের পর এক ভিজিটরস আর তাদের সমস্যা শুনতে শুনতে তিনি মাঝে মাঝেই একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলেন। রাতে কখন বাড়ি ফেরেন তার কোন ঠিক নেই। কিন্তু সেদিন তিনি একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরলেন। তাকে আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে দেখে বাড়ির সকলেই খুব খুশি। কিন্তু ভাস্কর একটু অন্যমনস্ক। একটু বেশি বয়সে বিয়ে করার ফলে মেয়ের বয়স সবে চার বছর। স্ত্রী,মা আর ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে তার সংসার। হ্যাঁ বলতে গেলে সুখের সংসার। কিন্তু সুখ কি মানুষের মুখের উপর লেখা থাকে? মনের ভিতর এতগুলি বছর বাদে আজও প্রথম ভালোবাসার ক্ষত দগদগে হয়ে চেপে বসে আছে। মানুষ দেখে একটি মানুষের সফলতা। কিন্তু এই সফলতার পিছনে কত,ঝড়ঝাপটা,আঘাত,বেদনা,কষ্ট,হতাশা লুকিয়ে আছে তার খোঁজ কেউ রাখে না। জীবনে সবকিছু পাওয়ার পরেও কোন মানুষই অতীতের সেইসব হতাশা, ভালোলাগা,ভালোবাসা কেউই ভুলতে পারে না। একাকী থাকলেই সেইসব চোখের সামনে ভেসে ওঠে আর বুকচিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসবেই। কারণ মানুষ যা চায় আর যা পায় তার দু'টোতেই মানুষের আক্ষেপ থেকেই যায়। মনুষ্য চরিত্রে কোনকিছুতেই পূর্ণতা খুঁজে পায় না।
কিন্তু জীবন তো থেমে থাকবার জন্য নয়। সেও ঠিক ঘড়ির কাঁটার মত টিকটিক করে এগিয়েই চলে। নষ্ট হয়ে যাওয়া ঘড়ি কখনো দ্রুত আবার কখনো বা ধীর গতিতে চলে। জীবনও ঠিক তাই। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে কখনো খুব মসৃন আবার কখনো বা শোক তাপে জর্জরিত হয়েও জীবন ঠিক বয়ে চলে।
প্রথম ভালোবাসার মানুষটির কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হলে আজীবন সে কষ্টটা থেকেই যায়। অনেকে সেই আঘাত সেই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে হয়ত নিজেকেই শেষ করে দেয়। কিন্তু সেটা পরাজিত জীবনের গল্প। সকলে তো জীবনে পরাজিত হতে আসেনি। ব্যর্থতা আর গ্লানিকে সঙ্গী করেই শত আঘাতের পরেও অনেকে মাথা তুলে জীবনকে সম্পূর্ণভাবে নিজের আয়ত্বের মধ্যে নিয়ে আসে। আর এই কণ্টকাকীর্ণ পথ যে পার হতে পারে সেই জীবনের আসল স্বাদ গ্রহণ করে থাকে। এদেরই দলে ভাস্কর সেন একজন। এতদসত্ত্বেও বুকের আঘাতটা সেরে গেলেও মাঝে মাঝে কাঁটার খোসখোসানিতা থেকেই যায়
সুলতা স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর তাকে পড়াতে আসতো অনসূয়া। লম্বা,ফর্সা,একমাথা চুল। চোখ যেন কথা বলে। ভাস্কর তখন সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। পাশাপাশি বাড়ি হওয়ার ফলে যখন তখন এবাড়ি ওবাড়ি করতো দু'বাড়ির লোকজন। এইভাবেই পরিচয় অনসূয়ার সাথে। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরেই দু'জনের মধ্যে গড়ে ওঠে ভালোবাসার সম্পর্ক। সুলতার পড়া শেষ হলে যদি কোনদিন ভাস্করের বাবা,মা বাড়িতে না থাকতেন অনুসূয়া সেদিন সোজা চলে যেত ভাস্করদের বাড়িতে। দুটি উঠতি বয়সের তরুণ, তরুণী। ফাঁকা বাড়ি - দু'জন দু'জনকে পছন্দ করে। খুব কাছে আসতে বেশিদিন সময় লাগেনি। এই কাছে আসাটা তাদের কাছে নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে উঠেছিল। পরপর কিছুদিন ভাস্করের বাবা,মা না বেরোলেই তারা কোন বন্ধুর বাড়ি কিংবা অন্য কোথাও দু'টি নরনারী এক হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতো। ভাস্কর ধরেই নিয়েছিল অনসূয়া এ জীবনে শুধু তার। অনসূয়ার মনের খবর অবশ্য সে জানতো না। তবে সে ধরেই নিয়েছিল তার মত অনসুয়াও ভাবে। এইভাবে প্রায় বছর খানেক চলার পর অনসূয়া হঠাৎ করেই সুলতাকে পড়াতে আসা বন্ধ করে দেয়। দু'তিন দিন পাগলের মত ভাস্কর অপেক্ষা করতে থাকে অনসূয়ার। সুলতার মায়ের কাছে জানতে পারে ও আর পড়াতে আসবে না। ভাস্কর অনসূয়াদের বাড়িতে যায়। সে তখন বাড়িতে ছিল না। তার কোন আত্মীয়ের বাড়িতে গেছে। মন খারাপ করে ভাস্কর চলে আসে। দ্বিতীয়দিন আবার যায়। বাড়ির বাইরে সকাল থেকে অপেক্ষা করতে থাকে। একসময় অনসূয়াকে সে দেখতে পায় দুটি মহিলার সাথে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। ছুটে গিয়ে তার সামনে দাঁড়ায়।কিন্তু অদ্ভুতভাবে অনসূয়া ভাস্করকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায়। যেন তাকে চেনেই না। কষ্ট, শোকে দুঃখে ভাস্কর স্ট্যাচু হয়ে যায়। সে ভাবতেই পারছে না এটা কী করে সম্ভব হল? তাহলে ও কি অনসূয়ার মত দেখতে অন্য কেউ? তাই ওকে চিনতে পারেনি?
ভাস্কর সারাটা রাত ছটফট করতে থাকে। এই তো দু'দিন আগেই পরপর তিনদিন সে অনসূয়াকে নিজের করে পেয়েছে। তার সর্ব শরীরে এখনো অনসুয়ার ভালোবাসার ছোঁয়া রয়ে গেছে। ঠোঁটের ফোলা কমলেও দাগটা এখনো আছে। বিছানায় শুয়ে নিজের ঠোঁটটা নিজেই একবার হাত বুলায় ভাস্কর। অনসূয়া তাকে বলেছিল,
-- যতদিন তুমি চাকরি না পাচ্ছ ততদিন আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।
ভাস্কর ভাবতে থাকে ,কিভাবে সম্ভব এটা? যে কটাদিন তারা মিলিত হয়েছে প্রথম প্রথম পরনে কিছু থাকলেও পরবর্তীতে তাদের শরীরে বিন্দুমাত্র সুতো থাকতো না। ভাস্কর তো মনেমনে তাকেই স্ত্রী হিসাবে মেনে নিয়েছিল। না কিছুতেই ওই মেয়েটি অনসূয়া হতে পারে না। ওরই মত দেখতে হয়ত অন্য কেউ হবে।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment