Thursday, October 7, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (তৃতীয় পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (তৃতীয় পর্ব)
   (আমার এ উপন্যাসটি আত্মজীবনী বলতে পারেন।এটা সম্পূর্ণ আমার পরিবারের ঘটনা।যা আমার জন্মের অনেক আগে থাকতেই ঘটেছে।সমস্ত ঘটনায় সত্যি।অমরেশবাবু আমার জন্মদাতা।একজন মহান মানুষের কথা সন্তান হিসাবে লিখে যাওয়া শ্রেয় বলে মনে করলাম।এই অধ্যায়ে যে মনীষীর কথা আমি লিখলাম এমন অনেক ঘটনায় আমি আপনাদের জানাবো যা আমার বাবুর জীবনে ঘটেছিলো।ভালো লাগলে জানাবেন উৎসাহ পাবো।)

   মানুষের সাংসারিক জীবনটা যতই সুখের হোকনা কেন;অভাব,দুঃখ না থাকলেও ঘাত-প্রতিঘাত কিন্তু থেকেই যায়।
 সে যাত্রায় ভারতী এক অলৌকিক শক্তি বলে নিমাইবাবুর আগমনের ফলে সম্পূর্ণ সুস্থ্য হয়ে উঠে।পরিবারের সকলেই ঈশ্বর বিশ্বাসী,নানান পূজা-পার্বণ রঙ্গিনীবালা দেবীর কারণে লেগেই আছে।অমরেশবাবু কিন্তু কোন ঘটনায় যুক্তিতর্কের বাইরে বিশ্বাস করতেন না।এই ঘটনায় তিনি পুরো স্তব্ধ হয়ে গেছিলেন।তার কাছে ওই বৃদ্ধা বা সাইকেল আরোহীর কোন ব্যাখ্যায় ছিল না।আজীবন তিনি এই ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে গেছেন।
 এরপর নিমাইবাবু রায় চৌধুরী পরিবারের ছেলেমেয়েদের কাছে শুধুমাত্র নিমাইদা বলেই পরিবারের খুব কাছের একজন হয়ে উঠেছিলেন।
 রোজ সকালে সাত্রাগাছি থেকে ট্রেন ধরে অমরেশবাবু ধর্মতলা ব্যাংকসাল কোর্টে আসতেন। এমনই একদিন তার অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যায়।শেষ ট্রেনের আশায় তিনি শিয়ালদা স্টেশনে অপেক্ষা করতে করতে চা খাওয়ার জন্য তিনি একটি চায়ের স্টলে আসেন।চায়ের অর্ডার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।হঠাৎ সেখানে টুপি মাথায় দিয়ে সাহেবী পোশাকে এক ভদ্রলোক এসে দাঁড়ান।স্টল মালিক তার মুখের দিকে তাকিয়ে তার হাতে অমরেশবাবুর জন্য তৈরি করা চা টা তাঁর হাতে ধরিয়ে দেন।অমরেশবাবু স্বভাবতই একটু বিরক্ত হন।স্টল মালিক ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তার দিকে হাত তুলে তাকে কিছু একটা ইঙ্গিত করেন যা তিনি বুঝতে পারেন না।তিনি সাহেবের মুখের দিকে ভালোভাবে তাকান।চমকে ওঠেন! এ কাকে দেখছেন তিনি!এত সেই ব্যক্তি - যার ভয়ে সমগ্র ইংরেজ রাজত্ব কম্পমান!তিনি এদিক ওদিক তাকিয়ে সাহেবের দিকে একটু এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে যাবেন ঠিক এই মুহূর্তে বয়ামের উপর চায়ের পয়সাটা রেখে তড়িৎ গতিতে সাহেব সেখান থেকে বেরিয়ে যান।কিন্তু পরমুহুর্তে সেখানে ইংরেজ সেপাইয়ে সেপাইয়ে ছয় লাফ।
 --- এখানে সাহেবী পোশাক পরা কাউকে দেখেছেন যিনি মাথায় একটি ক্যাপ পরে ছিলেন?
 একজন প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন অমরেশবাবুর দিকে।ততক্ষণে যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে অমরেশবাবুর।তিনি সরাসরি অস্বীকার করলেন যে সেখানে কোন সাহেব আসেননি।তারপর তারা স্টল মালিক এবং আশেপাশে যারা ছিলেন সকলকেই নানান প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে হতাশ হয়ে ফিরে যান।স্টল মালিক ইশারায় অমরেশবাবুকে ওখান থেকে দ্রুত চলে যাওয়ার জন্য বলেন।
 সেদিনের ওই ক্যাপ পরা সাহেব গোছের যে ভদ্রলোকটি ছিলেন তিনি আর কেউ নন স্বয়ং নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস।যিনি শিয়ালদহ স্টেশনে এলে একমাত্র ওই দোকান থেকেই চা খেতেন।এরপর বহুবার অমরেশবাবু তাকে একটু চোখের দেখা দেখার জন্য ইচ্ছাকৃত ওই স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছেন কিন্তু তাঁর দেখা আর কোনদিনও পাননি।তবে বেশ কয়েকমাস পরে ওই স্টলটি তিনি বন্ধই দেখেছেন।আশেপাশে অনেক জানতে চেয়েও তিনি কোন সদুত্তর পাননি।তার জীবনে স্বচক্ষে নেতাজীকে দেখা ছিল এক গর্বের বিষয়।যা তিনি সুযোগ পেলেই অন্যের সাথে গর্বভরে গল্প করেছেন।
   সায়নী তখন কলেজে পড়ছে।অমরেশবাবুর পিসতুতো বোনের মেয়ের বিয়ে ঠিক হল।বোনের বাড়িতে কথা হল অমরেশবাবু গিয়ে আশীর্বাদ করবেন।কারণ সম্পর্কে তিনি মামা আর যেহেতু তাঁর পরিবার ছিলো খুলনা জেলা।এই জেলার মানুষের একটা ধারণা প্রচলিত আছে যেকোন শুভকাজ মামার দ্বারা শুরু হলে তা সেই ছেলে বা মেয়ের পক্ষে সেটা খুব সুখের হয়।মেয়েটির নিজের মামা ছিলেন না তাই তারা অমরেশবাবুকেই এই কাজের দায়িত্ব দেয়।তিনি সানন্দে সেই দায়িত্ব পালন করার জন্য সেখানে নিদিষ্ট দিনে হাজিরা দেন।কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল তিনি যখন ছেলের বাড়িতে আশীর্বাদের জন্য উপস্থিত হলেন তখন দেখলেন এ পরিবারের প্রতিটা সদস্যকেই তিনি চেনেন।তাদের মূল বাড়ি ওই পিলজঙ্গ গ্রামেই।যাকে তিনি আশীর্বাদ করতে গেছেন সে চাকরি পাওয়ার পর তার মা,বাবাকে গ্রামের একান্নবর্তী পরিবার থেকে এনে শহরে সামান্য একটু জমি কিনে সেখানে বাড়ি করে রয়েছে।যদিও ছেলে চাকরি করে দন্ডকারন্য।তারজন্য অবশ্য তাদের গ্রামের বাড়ির নিজেদের অংশটা শরিকের কাছেই কমদামে বিক্রি করে দিয়ে আসতে হয়েছে।অমরেশবাবুর বোন সুবলাদেবীর স্বামীও তার সাথে ছিলেন।তাদের বাড়িও ওই পিলজঙ্গ গ্রামের পরেই আর একটি গ্রাম বেতাগা য় ছিল।আশীর্বাদ শুরু হল।ছেলের মাথায় হাত ছোঁয়াতে গেলে ছেলে অমরেশবাবুর হাত চেপে ধরলেন।
--- কি হল বাবা তুমি হাত ধরলে কেন?
মনোতোষ সরাসরি অমরেশবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল,
--- আমার এখন মনেহচ্ছে এই বিয়েটা করা ঠিক হবে না।
--- এটা কি ইয়ার্কি হচ্ছে নাকি?
--- আসলে কাকু,আমি আপনার মেয়ে সায়নীকে ভালোবাসি।আপনাদের বাড়িতে বাবা,মা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেছিলেন।আপনি সরাসরি জানিয়ে দিয়েছিলেন 'দণ্ডকারন্য সীতার বনবাস হয়েছিলো।তাই আপনি আপনার ঘরের লক্ষিকে ওখানে বিয়ে দেবেন না।এবার ছুটিতে বাড়ি আসার পরে আমার বাবা,মা ও নাছোড়বান্দা আমার বিয়ে দিয়ে তবে ওখানে পাঠাবেন।আমার আপত্তি শর্তেও তারা এই মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করলেন।আমিও নিরুপায় ছিলাম।কিন্তু আজ যখন আপনাকে এখানে দেখলাম তখনই মনেমনে ঠিক করে নিয়েছিলাম আশীর্বাদ পর্ব শুরু হলেই আমি আপনাকে জানাবো।আপনি যদি রাজি থাকেন তবে আমায় আশীর্বাদ করুন।আর তানাহলে এ বিয়ে হবে না।
অমরেশবাবু আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।এবং পরিস্কার সকলকে জানিয়ে দিলেন,"এত ঔদ্ধত্যসম্পন্ন ছেলের সাথে কোন মেয়ের বিয়েই হবে না।এই ছেলের বিরুদ্ধে আমি মানহানির কেস করবো"
শোলগোল হৈ হট্টগোলের মধ্যে কেউ আর কারো কোন কথা শোনে না। অমরেশবাবুর ভগ্নিপতির মাথায় তখন আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে।তার মেয়ের বিয়ের আয়োজন তখন প্রায় শেষের পথে।সব জায়গায় টাকা বায়না দেওয়া হয়ে গেছে।আত্মীয়স্বজন পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে মুখে চুনকালি পড়বে।মনোতোষ তখন তার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাকে আলাদাভাবে বাইরে ডেকে নিয়ে গেলো কিছু কথা বলতে চায় বলে।
--- দেখুন মেসোমশাই আমি জানি আমি যা করছি সেটা ঠিক নয়।বাবা মায়ের জেদের কাছে নতি স্বীকার করে মনেমনে ভেবেই নিয়েছিলাম আপনার মেয়ের সাথে আমার বিয়ে হলে জীবন দুটোই নষ্ট হবে।কারণ আমি সেই স্কুল লাইফ থেকেই সায়নীকে ভালোবাসি।কিন্তু অমরেশবাবু যেহেতু তার মেয়ের বিয়ে আমার সাথে দিতে রাজি হননি তাই বাবাকেও আমি আর বুঝাতে পারিনি।তিনি এই ঘটনায় প্রচণ্ড অপমানিত বোধ করেন।আপনি চিন্তা করবেন না।ওই তারিখেই আপনার মেয়ের বিয়ে হবে একই পোষ্টে চাকরি করা ছেলের সাথে। তারও দণ্ডকারন্য এ পোষ্টিং।আপনি শুধু কাকুকে একটু রাজি করান।



ক্রমশঃ 

No comments:

Post a Comment