Thursday, October 14, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (চতুর্থ পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (চতুর্থ পর্ব)

 অমরেন্দ্রনাথ মুখার্জী পড়লেন মহাফাপরে।তিনি তার শ্যালককে বেশ ভালোভাবেই চেনেন।নরম স্বভাবের মানুষ হলেও বেআইনি কিছু দেখলেই তার মাথাটি গরম হয়ে ওঠে।শ্যালক  এই বাঁচাল ছেলেটিকে যে কিছুতেই নিজের জামাই করবেন না,এটা তিনি ভালোভাবেই বুঝে ফেলেছেন।আর মনোতোষ যে ছেলের সাথে তার মেয়ের বিয়ের কথা বলছে তার সম্মন্ধে কিছু না জেনেই বা তিনি রাজি হন কিভাবে?আর ওদিকে তার শ্যালকটি চিৎকার,চেঁচামেচি করেই চলেছেন।মনোতোষের বাবা মা ছেলের এই কান্ড দেখে পুরো চুপসে গেছেন।তাদের মুখে কোন কথা নেই।
 অমরেন্দ্রনাথবাবু অনেক সাহস সঞ্চয় করে তার শ্যালকের কাছে এগিয়ে গিয়ে হাতদুটি ধরে বললেন,
--- শোনো ভাই আমার একটা অনুরোধ রাখো।ছেলেটিকে সেই ছোটবেলা থেকেই তো আমরা জানি।ওর চরিত্রের তো কোন খুদ নেই।কিন্তু ও একটু ডাকাবুকো স্বভাবের ছেলে।সত্যি কথাটা মুখের উপর বলতে বিন্দুমাত্র ভয় পায়না।বলি কি ভাই তুমি সায়নীর জন্যই ওকে আশীর্বাদ করে যাও।দেখো সেন্ট্রাল গভর্মেন্ট এর ভালো  চাকরি করে ,দেখতে শুনতেও ভালো। দোষ তো ওই একটাই শেষ মুহূর্তে এসে শুভ কাজে বাগড়া দিলো।এটা ক্ষমা করে দেওয়া যায়।
--- কি বলছো তুমি অমরদা?এত ঔদ্ধত্য যে ছেলের সে কখনোই ভালো হতে পারে না।আমি কিছুতেই জেনেশুনে মেয়েকে জলে ভাসিয়ে দিতে পারবো না।
  এরপর ওখানে আর যারা উপস্থিত ছিলেন তারা সকলে মিলে অমরেশবাবুকে বুঝাতে শুরু করলেন।অবশেষে তিনি রাজি হলেন।তার বাহুতে এক ভরির একটা সোনার পদক ছিল তিনি তাই দিয়েই মনোতোষকে আশীর্বাদ করে আসলেন এই শর্তে যে তিনি তাকে সোনার বোতাম দেবেন তখন ওই পদক তাকে ফেরৎ দিয়ে দিতে হবে।তবে এ কথাও তিনি তাকে জানিয়ে আসলেন যদি কোনদিন মনতোষের কারণে তার সানুর চোখ থেকে জল পড়ে তাহলে আজকের কথা স্মরণ করে তিনি তাকে পুলিশে দেবেন।
  মনতোষের খোঁজ দেওয়া ছেলের খবর নিয়ে বা অন্য কোন ভালো পাত্রের সন্ধান পেয়ে যাতে ওই তারিখেই তার বোনের মেয়েটিরও বিয়ে হয় সে ব্যবস্থা তিনি করবেন সে কথা তার ভগ্নিপতিকে দিয়ে আসেন।
 বাড়িতে ফিরে আসতে আসতে তিনি অনেক কথায় ভাবছিলেন।কি করে তিনি মেয়ে সায়নী ও পরিবারের সকলের সামনে কথাটা বলবেন।মেয়েকে নিজের পায়ে দাঁড় না করিয়ে তিনি বিয়ে দেবেন না বলেছিলেন।এখন তিনিই কিনা হঠাৎ করেই মেয়ের বিয়ে ঠিক করে আসলেন।বাড়িতে পৌঁছেই তো একটা প্রবল ঝড়ের সম্মুখীন হতে হবে।নানান কথা ভাবতে ভাবতে তিনি যখন নিজ বাড়ি পৌঁছলেন তখন সন্ধ্যা হয় হয়। তাঁর মা তখন তুলসীতলায় সন্ধ্যাবাতি দেখাচ্ছেন। আস্তে আস্তে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।রঙ্গিনীবালা তাঁর ছেলে ক্ষেতোকে (তিনি তাঁকে এই নামেই ডাকতেন)ভালো ভাবেই চিনতেন।ছোট থেকে সে কোন অন্যায় করলেই মায়ের গা ঘেঁষে ঘোরাফেরা করতো।কিন্তু এই বয়সে এসে সে এমন কি কান্ড করেছে যা আগেই মায়ের কাছে স্বীকার করতে এসেছে।তিনি ছেলের মুখের দিকে তাকালেন।
  অনেক চেঁচামেচি,সায়নীর কান্নাকাটি ঝামেলার পর সায়নী যখন জানতে পারে যে মনোতোষের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে তখন সে চুপ করে।আর ওদিকে খোঁজ খবর নিয়ে মনোতোষের বলা ছেলের সাথেই ওই তারিখেই বিয়ে ঠিক হয় তাঁর বোনের মেয়ের।খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায় সে অত্যন্ত ভদ্র ছেলে।মামাবাড়িতে মানুষ।এখন তার দণ্ডকারন্য পোষ্টিং।বিয়ে করে সে বউকে ওখানেই নিয়ে যাবে।
 অমরেশবাবু পুনরায় চলে এলেন শহরে।তার মুহুরী অমৃতলাল পালের সাথে সব সময়ই মেয়ের বিয়ে সংক্রান্ত লিষ্ট আর আলোচনা করেই চলেছেন।ওদিকে বাড়িতে বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কেটে প্যান্ডেলের ব্যবস্থা শুরু হয়েছে।বাড়িতে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচজন লেবার কাজ করেই চলেছেন।আর তখনকার দিনে বাড়িতে লেবার কাজ করা মানেই দুবেলা তাদের পেটপুরে খেতে দিতে হত।শ্বাশুড়ী,বউয়ের দম ফেলার সময় নেই।পাশের দরিদ্র দত্ত বাড়ির বিধবা রতন দত্তের বউ সব সময়ের জন্য রায় চৌধুরী বাড়িতে ফাইফরমায়েস খেটে চলেছে।প্রথম বর্ষে পড়তে পড়তেই সায়নীর পড়া গেলো বন্ধ হয়ে।তার বিয়ে এগিয়ে এলো।
 বিয়ের দিন সকালে ছজন জেলে নিয়ে তিন পুকুর থেকে বড় বড় রুই,কাতলা ধরা হয়।মাছ বাজার থেকে কিনে আনতে হয়না।বড় মেয়েটির সময়ও তাই হয়েছে।বড় মেয়েটি কিন্তু তার মেজো বোনের বিয়েতে আসতে পারেনি।কারণ বড় জামাইয়ের পোষ্টিং ছিল ত্রিপুরা শহরের এক আদিবাসী এলাকায়।তার প্রথম সন্তানটি তখন খুবই ছোট।আর অসুস্থ্যও বটে।তাকে নিয়ে প্লেনে ওঠা মানে নিজের হাতের মুঠোয় তার জীবনটিকে নিয়ে ওঠা।এই একটা কারণে বাড়ির সকলের ছিল মন খারাপ।
দুপুরের দিকে হলুদ নিয়ে জনাদশেক উপস্থিত।তারা এই যে এলো আর ছেলের বাড়ি ফিরে গেলনা।কারণ বিয়েটা হচ্ছিলো গ্রামের বাড়ি থেকেই।আর ছেলে তো এখন থাকে শহরে।তাই পথের ধকল তারা আর নেবে না বলে ওই দশজন লোক দুপুর থেকেই তাদের ভুরিভোজ সারতে লাগলো।তাতে অবশ্য রায় চৌধুরী পরিবারের কিছুই যায় আসে না।কারণ তাদের অর্থের কোনো অভাবই ছিলনা।
 সব জায়গাতেই ভালোমন্দ কিছু মানুষ থাকে।বরযাত্রী আসা মানুষদের মধ্যেও তার ব্যতিক্রম ছিলনা।কিছু দুষ্টু মানুষজন বিয়েবাড়িতে থেকে যাওয়ার কারণে নানান ধরনের কুকীর্তি করতেও বিরত থাকতো না।স্বভাবতই মেয়ের বাড়ির লোকজন তটস্থ থাকতো কখন কি বিপদ বাঁধিয়ে ফেলে তারা।হলুদ নিয়ে আসা কিছু অল্পবয়সী ছেলেগুলি যে ছিল তারা প্রত্যেকেই এক একটা বাদর।বাড়িতে অল্পবয়সী মেয়ে অনেকগুলো।তাছাড়া তাদের বন্ধুরা সব।এই ছেলেগুলো তাদের প্রচন্ডভাবে বিরক্ত করতে লাগলো।অমরেশবাবুর কাছে এক মেয়ে গিয়ে নালিশ করাতে তিনি গেলেন প্রচন্ড ক্ষেপে।তাকে সামাল দিলেন তার স্ত্রী শান্তিলতাদেবী।তিনি শান্তভাবে তাকে বোঝালেন এই ব্যাপারটা ম্যানেজ তিনিই করবেন।নিজের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে তিনি হলুদ নিয়ে আসা অতিথিদের কাছে গিয়ে তাদের মধ্যে সব থেকে বয়স্ক মানুষটিকে সমস্যার কথা জানান।আর তাতেই কাজ হয়।তিনি তার সাথে আসা ছেলেদের সাবধান করে দেন।তারা সে কথা শোনে পরবর্তীতে আর কোন অসুবিধা হয়না।
 যাহোক বিয়েবাড়ির হৈ হট্টগোল চলার মাঝে ঠিক সন্ধ্যার দিকে বাড়িতে বর এসে হাজির।তখনকার দিনে এত গাড়ির রমরমা ছিলনা।তাই রিক্সাতেই বর আসে বিয়ে করতে।সাথে লোকজন স্টেশন থেকে নেমে চার কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে।সে রাতে বিয়ের পর সকল বরযাত্রীরাই কনের বাড়িতে থেকে যেতেন।পরেরদিন সকাল,দুপুরের ভোজ সেরে তবে তারা বর কনের সাথেই বাড়ি ফিরতেন।

 বর আসাতে ঘরের বউ,ঝিরা গেটের কাছে ছুটে যায় তাকে বরণ করতে।মনোতোষ গ্রামের ছেলে হওয়ার কারণে তাকে অনেকেই চিনতো।কিন্তু রিক্সায় যে বসে আছে সেতো মনোতোষ নয়।

ক্রমশঃ 
  

No comments:

Post a Comment